Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

হিম (পর্ব-১৪)

Reading Time: 4 minutes

মনোরঞ্জন পাল সময় পেলেই বউয়ের মুখটা দেখে নেয়। যেমন, এখন, রান্না ঘরে ঢুকে, মোড়া টেনে বউয়ের পাশে বসে পড়লো। বউ সবজি কাটছে। সাদা সাদা তাজা ফুলকপি, লাল গাজর, কয়েক রকম শাক, হালকা সবুজ পটল আর গাঢ় সবুজ সীম। আজ নিরামিষের দিন। মার্কেটও বন্ধ। এক বহুজাতিক জুতোর দেশজোড়া আউটলেটের মধ্যে শহরের একটির সে ম্যানেজার। মাইনে এই বাজারে চলনসই তবে সন্তান নিতে ভয় করে তার। তার বাবা-মা থাকেন দেশের বাড়িতে। সারাদিন কাজের মধ্যে থেকে বাবার শরীর এখনো মনোরঞ্জনের চেয়ে শক্ত। পারিবারিক এলবামে বাবা ছেলের ছবি যেন দুই সহোদর। এখনো তাঁকে কলপ দিতে হয় না। আখের ক্ষেত থেকে আখ ভেঙ্গে নিয়ে
নিজের দাঁতে কামড়ে খেতে পারেন। বউয়ের মুখে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। চালচিত্রের দুর্গার মতো লাগে।

জীবনে কোনো নারীর সাথে না মিশে, এমনকি আস্ত এক বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও একা একা থেকে যখন পারিবারিক পছন্দে এই নিভৃত মফস্বলের মেয়েটিকে সে নিজের করে পেলো তখন তার আনন্দ আকাশ না ছুঁয়ে পারে না। জীবনে সেই অর্থে স্বপ্ন সাধ কিছুই ছিলো না, একেকটা প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষার ধাপ অতিক্রম করা ছাড়া। আর তারপর চাকরির পরীক্ষা, একের পর এক। এই নারীটির দিকে তাকিয়ে থেকে মনে হয়, দাম্পত্যের জন্যে এক জীবন থাকার সময় কম বলেই হয়তো সাত জন্ম একসাথে থাকার
ধারণা এসেছে। ‘কিন্তু তোমার সাথে আমি সাতশো জন্ম একসাথে কাটাতে পারি এমনকি পাশাপাশি দুটো পিঁপড়ে হয়ে চরে বেড়াবো চরাচর জুড়ে।’ এসব চিন্তা কোথা থেকে যে আসে তার! অথচ সে কবি নয়, দৈনিকের পাতায় দু একখানা কবিতার দিকে
চোখ পড়ে যায় মাত্র।
-বউ

শ্যামা চোখ তুলে তাকায়, হাসে-
-কি?
– এমনি ডাকতে ইচ্ছে করলো, কিছু না-
শ্যামা জানে, তার স্বামীটি সরল ধরণের, কোনো সাংসারিক জটিলতা তার ভেতরে ঢোকে না। প্রথম দেখার দিনেও তাকেই উদ্যোগী হয়ে কথা বলে জড়তা ভাঙাতে হয়েছিলো মানুষটার। মনে হয়েছিলো, ঘন্টার পর ঘন্টা এই লোক পায়ের আঙুল গুণে কাটিয়ে দিতে পারবে। যখন সবাই তাদের একান্তে কথা বলার সময় দিয়ে বেরিয়ে গেলো, মনোরঞ্জন একবার চকিতে মাথা তুলে চারপাশে তাকিয়ে, আবার মাথা নুইয়ে ফেলেছে আর সে দৃশ্যে শব্দ করে হেসে ফেলেছে শ্যামা।
– মনোরঞ্জন বাবু, আপনি কি কচ্ছপ? গম্ভীর হয়ে ডেকেছিলো শ্যামা আর মনোরঞ্জন তাকালো তখন।
-আপনার এতো লজ্জা কেন মনোরঞ্জন বাবু?
পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে বাবুটি।
-না, না লজ্জা কিসের!
থেমে যেতে হয় কথা খুঁজে না পেয়ে। এবার তাকায় শ্যামার দিকে। তার চোখ দুটি সুন্দর।
– আমার কাছে কিছু জানার নেই আপনার?
– না
শ্যামার কথার উত্তরে চটজলদি বলে, তারপর যোগ করে,
– জানার জন্যে তো সারাজীবন পড়ে রইলো।
নিজের স্মার্ট উত্তরে নিজেকেই পরে বাহবা দিয়েছে সে।
– রান্না কিন্তু খুব একটা পারি না। মেয়েটির কথা শুনে কেন যে হেসে ফেললো মনোরঞ্জন!
– হাসলেন যে?
একটু কি আহত মেয়েটি!
– আমি পারি কিছু কিছু। আমাদের সমস্যা হবে না। এইবার শ্যামার হাসার পালা। নার্সারির ছাত্র প্রথম হলে দিদিমণি যেমন চকিত আনন্দে হাসে সেভাবেই খানিক খুকিদের মতো দুলে দুলে হাসলো শ্যামা। এক
স্কুলপড়ুয়া শ্যালিকা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো। এবার এগিয়ে এসে চা জলখাবারের ট্রে নিয়ে এলো। বিয়ের দিন সকাল থেকে মনোরঞ্জনের জ্বর আর মাথা ব্যথা। উদ্বেগে রীতিমত অসুস্থ হয়ে পড়লো। পরে আকস্মিক এই জ্বর নিয়ে অনেক ভেবেও হদিশ পায়নি। এমনিতে জ্বর সর্দির ধাত নেই বললেই চলে। বিয়ে হয়ে গেলো। শেষ রাতের দিকে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায়, নিজের বিয়ের খাবার খেয়ে নিজেই সুখি হতে পারেনি। শ্যামাকে নিয়ে আসার সময় তার আকাশ-বাতাসমথিত ক্রন্দনে তার চোখে জল চলে এলো। এ দৃশ্য দেখে দু চারজন কাছের আত্মীয় হাসতে লাগলো। পুরুষের চোখের জল নাকি! মেয়েলি!

ফেরার পথে, শ্যামার মাথা, একভাবে ওর কাঁধে পড়ে রইলো, অবসন্ন। কাঁধে সে মাথাটিকে অনুভব করে বিহবল হয়ে বসেছিলো আর রাস্তার গর্তজনিত কারণে যখনই গাড়ি ঝাঁকুনি দিয়েছে আরো কাছাকাছি হওয়ার সুযোগে নিজের মধ্যে এক ধরণের মায়ার উৎসার অনুভব করেছে। মনোরঞ্জনের বন্ধুরা স্কুলে কলেজে পড়বার সময় নিজেদের আড্ডায় নারীকে কেন্দ্র করে কতোরকম গল্প করেছে আদিরসাত্মক, কোনোদিন এক বিন্দু আনন্দ পায়নি। তাই বন্ধুমহলে সে অস্বাভাবিক। বন্ধু বলতে যা বোঝায় খুব বেশি নেই।
– শ্যামা? বউ আবার মাথা তুলে তাকায়, মুখে ঘাম।
– আমি কেটে দিই? তুমি তো অনেকক্ষণ কাটলে-
– না না এইতো আর বেশি নেই, তারপর স্নানে যাব, স্নান সেরে এসে ঠাকুরের আসন দিয়ে রাঁধবো।
– তাহলে আমিই রেঁধে ফেলি আজ।

শ্যামা মুখ টিপে হাসে। মাঝে মাঝে তার স্বামীর ভালোবাসাটুকু অনুভব করে ঈশ্বরের প্রতি এক ধরণের কৃতজ্ঞতাবোধ করে। সবজি কাটাকুটি সেরে স্নানে যায়।বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে হোস্টেলে থাকার সময় রান্নাবান্না যা শিখেছিলো সেটুকু সম্বল করে নিরামিষ ঘন্ট রাঁধতে শুরু করে। সেলফোনের এফ এমে গান ছেড়ে দেয়।আইয়ূব বাচ্চু গেয়ে ওঠেন, আমি তো প্রেমে পড়িনি প্রেম আমার উপর পড়েছে।’

 

সীতা সকালে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিলো পাটকলশ্রমিকদের জন্য। বিগত দিনগুলোর অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলো প্রশাসন উত্তেজিত হয়ে আছে, ছুতো পেলেই মারবে। সেই ভয়ে তো আন্দোলন থেকে পিছিয়ে আসা যায় না। সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিলো।মানববন্ধনের শেষ দিকে দিগন্তবিস্তারী বৃষ্টি নামলো। তারা কেউ কিন্তু রাস্তা ছাড়লো না। ছাব্বিশজনের প্রত্যেকেই ভিজতে লাগলো হাতে হাত ধরে। হাতে ধরা মাইকে প্রীতিশ দা দাবিগুলো বলা শেষ করে মিছিল শুরুর কথা বললেন।

মাঝারি রুটের মিছিল। মিছিল যখন মাঝামাঝি রাস্তায়, বৃষ্টির জোর যখন খানিক কম ঠিক তখন পুলিশ কথাবার্তা ছাড়া লাঠিচার্জ করলো। রশীদ স্যার স্থানীয় কলেজের শিক্ষক, নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের আড়াল দিতে গিয়ে তিনি মারের বেশির ভাগ গায়ে নিলেন। আর রশীদ স্যারের অবস্থা দেখে সীতা এগিয়ে যেতে পুলিশের লাঠি নেমে এলো একেবারে সিঁথি বরাবর। আর মার খেয়ে রাস্তায় পড়ে যেতে যেতে আরো যখন লাঠি নেমে আসছিলো ব্যথা ভুলে সে ভাবছিলো এই পুলিশটা তো রফিকুল দা!অনেক ছোটোবেলায় দেখেছে কাকার কাছে টিউশন নিতে আসতে। একবার ভাবলো, ডেকে উঠবে, ও রফিকুল দা, তুমি আমায় ভুলে গেলে! আমি তোমার ছোটো বোন সীতা গো। লক্ষ্মীপুজার দিন আমার বানানো নাড়ু খেয়ে আমার মাথার চুল ঘেটে দিয়েছিলে।একদিন একটা টিনটিনের বই দিয়েছিলে সেই সীতা গো আমি! কিন্তু কোনো কথা বলার আগেই তার চেতনা লুপ্ত হয়ে গেলো। জ্ঞান ফিরে দেখলো পাশে বাবা মা। আর প্রীতিশ দা দাঁড়িয়ে। মাথায় খুব ব্যথা। হাসপাতাল। কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই মা মাথা এগিয়ে আনলেন মুখের কাছে। হাতের স্যালাইন। হাতের ইশারায় প্রীতিশ দাকে দেখালো। এবার দাদা মুখ এগিয়ে আনলেন। খুব আস্তে অস্ফূটপ্রায় জিজ্ঞেস করলো, রশীদ স্যার কেমন আছেন? আরো ম্লান হয়ে এলো দাদার মুখ, জোর করে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ভালো। কিন্তু ভালো বলবার ধরণ ভালো লাগলো না তার। এই প্রথম খেয়াল করলো দাদার ডান হাত গলার সাথে বাধা।

ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে এলো। মা বাদে সবাইকে চলে যেতে হলো। মা আস্তে আস্তে বললেন, কে এক সুধন্য ফোন করেছিলো, তোকে চাইলো ফোনে। ফেসবুকে নিউজ দেখে তার চিন্তা হচ্ছিলো। সীতা কিছু বললো না। চোখ বন্ধ করে রাখলো। তার ভালো লাগছিলো অনেকক্ষণ পর। সুধন্য দা দ্য বিকিপার্স দেখতে বলেছিলো। আজো দেখা হয়নি। প্রায়ই লোকটাকে গায়ে পড়া মনে হয়। কিন্তু এই প্রথম মনে হলো এই স্নেহটুকুর দরকার ছিলো।

মা ডাকলেন আবার। আধশোয়া হয়ে সে স্যুপ খেতে লাগলো। বাবা কাছের রেস্টুরেন্ট থেকে
কিনে এনেছেন। প্রত্যেকটা ঢোকে তার আরাম লাগছিলো। মায়ের চোখে জল টলমল। সে মায়ের জল মুছে দেয় হাতের উলটো পিঠে।

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>