| 10 অক্টোবর 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

হিম (পর্ব-২৪)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
মনোরঞ্জনের দ্বিধা হয় আস্ত একটা জীবন সে কেমন করে কাটাবে! এখনো ছেলেপুলে হয়নি। এখনো অন্তত ত্রিশ বছর যদি বেঁচে থাকে তাহলে কয়েক হাজার রাত্রি ও দিন৷ অসুখ তেমন হয় না তার, সেদিক থেকে রক্ষা। সিনেমা নেই তার জীবনে,বই-ও। এক সময় ছিলো,এখন নেই। বিবাহিত পুরুষের জীবনে স্বপ্নে পূর্ব প্রেমিকা নেমে আসা কি খারাপ? না,ঠিক প্রেম নয়, ভালো লেগেছিলো মাত্র, লাল কার্ডিগান পরা মাসতুতো দিদিকে। মাত্র চার মাসের বড়ো৷ একটি শীতের সন্ধ্যা থেকে এই জীবনে আর বেরোনো গেলো না। খুব একা থাকলে মনে পড়ে৷ কিন্তু এই মনে পড়া ঠিক বউকে ঠকানো নয়, স্মৃতি রোমন্থন৷ 
চুপচাপ ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে সে। বউ বাপের বাড়ি৷ বাঙালি পুরুষ সাধারণত বউ বাপের বাড়ি গেলে উল্লসিত হয়, সে মিস করে বউকে। কেন না আলাদা করে উল্লাস করবার মতো কোনো কাজ কিংবা গোপনীয়তা নেই তার। খানিক আগে ফোনে কথা বলে নেয়া হয়েছে৷ অনেকদিন পর বাপের বাড়ি গিয়ে বউ ভারি খুশি। বাঙালি বিয়ের এই ধরণটা চিরকেলে অপছন্দ ছিলো তার। শিকড়বাকড় উপড়ে একটি মেয়েকে তার মূল থেকে ছিন্ন করে আনা। সাদামাটা মনোরঞ্জনের অবশ্য পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরর যাওয়ার মতো সাহসও ছিলো না। তারা চার বোন- সীমা ছিলো সবার ছোটোটি। আগের দিন পাড়ায় বিদ্যাদেবীর আরাধনা হয়ে গিয়েছে, তার রেশ এখনো রয়ে গিয়েছে। পিসিমণির বাড়ি থেকে মাসীমণির বাড়িতে পুজো হয়৷ শহর থেকে শীতের ছুটিতে বেড়াতে বেরিয়ে দুজনের বাড়িতেই দু’তিনদিন থেকে আসে। ছোটো রান্নাঘরে মাসীমা পিঠে বানাচ্ছিলেন। উঠোনে এমনি দাঁড়িয়েছিলো সীমা- কয়েক ফুট দূরে বিদ্যাদেবী বসে আছেন, তাঁর চারপাশে টুনি বাল্ব, সীমার লাল কার্ডিগান আশ্চর্য রঙিন হয়ে উঠেছিলো। সে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তার খুব ইচ্ছে করছিলো তাকে ছুঁতে। ইচ্ছে আর অপরাধবোধের মিশেলে সেই সন্ধ্যেটি-ছিঁড়ে ফেলছিলো মনো-কে। ‘মনো, তুই কি কিছু ভাবছিস?’ সীমা জিজ্ঞেস করেই ফেললো। ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় চোখে চোখে তাকাতে পারেনি৷ একটা দুটো তারা। ‘ভাবলাম, তোমায় একটু ছুঁই’- অবাক বড়ো বড়ো চোখ মেলে সীমা তাকিয়েছিলো- শহরে ফেরার পর দু একটি চিঠিপত্র পাল্টাপাল্টি৷ তারপর ওর বিয়ে হয়ে গেলো সময়মত৷ বিয়েতে মনো খেটেও ছিলো। সেদিন সীমা শেষ রাতে ছাদে এসেছিলো। মনোরঞ্জন নতুন সিগারেট খাওয়া ধরেছে৷ ‘মনো- সীমার ডাকে চমকে উঠে হাত থেকে সিগারেট ফেলে দেয়। ‘তুই ছুঁতে চেয়েছিলি না? ইচ্ছেটা কি এখনো আছে?’ মনো স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। সীমা ওর কপালে একটা চুমু খায়, তারপর নাকে, তারপর ঠোঁটে। তিনটি, চুমু নয় যেন ক্ষত। তিনটি বুলেটের ক্ষত যা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। সীমা খানিক দাঁড়িয়েছিলো চুপচাপ তারপর যেমন এসেছিলো তেমনি নিরবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। আরো ঘন্টা তিনেক পর বরের সাথে চলে যাওয়ার সময় একটুও কাঁদলো না৷ খটখটে শুকনো চোখ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। বাড়ির মহিলারা কেঁদেছিলেন সীমাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি৷ সীমার সম্বন্ধের বিয়ে৷ বর বেশ পয়সা করেছে। রড সিমেন্টের কারবারি৷ ওর বাবা ছিলেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির বিপ্লবী। তিনি একদিন হারিয়ে যান হয়তো গুম হয়ে গেলেন কিংবা সংসারে নিজে থেকেই ফিরলেন না৷ মা এখনো রঙিন কাপড় পরেন৷ আশা থেকে যায়, যদি ফেরে। এই যদির উপর নির্ভর করে কতো টলমলে সম্পর্ক টিকে আছে৷ ছেলে বাবার ভুল করেনি৷ নিম্ন মধ্যবিত্তের কাতার থেকে টেনে তুলেছে নিজেদের। বাবার স্মৃতি, আন্দোলন এসব তার ব্যক্তিত্ব গঠনে কোনো প্রভাব ফেলেনি৷ গরিবি ব্যাপারটাকে সে ছোটো বয়স থেকে মেনে নিতে পারেনি। স্কুল বয়সে ডিসেকশনের জন্যে ব্যাঙ বিক্রি করে তার ব্যবসায়ী জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিলো। ইজিচেয়ারে আধশোয়া ভাবে মনো- সে শেষরাত, ঐ সন্ধ্যে স্বপ্ন ছিলো না বাস্তব! পাশাপাশি অনেকগুলো পৃথিবীর তত্ত্বে সে বিশ্বাস করে৷ অন্য এক পৃথিবীতে হয়তো বই আর সিনেমা মনোকে ছেড়ে যায়নি৷ সে মনো হয়তো ঘন্টার পর ঘন্টা একা একা চিন্তা না করে পড়ে কিংবা লেখে। ফোন বেজে উঠলো। বউ। কান্না কান্না মুখ। ‘এখনই বাড়িতে আসো তুমি।’ উদ্বেগ সারা শরীর ছেয়ে যায়। ‘কি হলো?’ তুমি আগে আসো’- বউ ফোন কেটে দেয়৷ মনো জমানো টাকা কিছু নিয়ে ঘরের চাবি লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ঘন্টা আড়াই লাগবে। দুপুর পেরিয়েছে মাত্র। বাসস্টেশনে টিকিট কেটে ওঠার সময় স্কুলফ্রেন্ড সুধন্যকে দেখলো আমড়াওলার কাছ থেকে আমড়া কিনছে। বেশ মোটা হয়েছে কিন্তু মুখখানা সে-ই ক্লাস থ্রি-র, ওরা মজা করে বলতো, মুখেভাতের মুখ৷ নুনঝাল মাখিয়ে এক টুকরো মুখে পুরে ঘুরতেই সুধন্য মনোকে দেখে লাফিয়ে উঠলো-‘বোকাচোদা, তুই এদ্দিন পর-‘ দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে। ‘তারপর তুই কোথায় যাচ্ছিস?’ মনোরঞ্জন প্রশ্ন করে৷ ‘এম্নি বেরিয়ে পড়লাম বুঝলি- একটা উপন্যাস লিখতে ইচ্ছে করে কিন্তু কোনো এক্সপিরিয়েন্স নেই৷ মাছ গাছ ফুল ফল কিছুই চিনি না। ঘুরতে বেরিয়েছি তাই৷’ দুই বন্ধু পাশাপাশি সিটে৷ ‘এখনো আগের মতো আছিস। বাবামা কেমন আছেন?’ বন্ধুর প্রশ্নে সুধন্য বলে,’বয়সের নানা অসুখবিসুখ তো আছেই। এমনিতে ভালো। বাদ দে৷ তোর কথা বল।’ মনোরঞ্জন চুপ করে যায়৷ হাত বাড়িয়ে বন্ধুর হাত ধরে। ‘আমার বলবার মতো কথা নেই রে আর।’ ‘ধুর ব্যাটা, বলবার মতো কথা ছাড়া মানুষ হয়? আমাকে দেখে শেখ, ত্রিশ পেরিয়েছি সেই কবে! অথচ কোনো ব্যাংক একাউন্ট নেই।’ গাড়ি চলতে শুরু করেছে। শহরের বাইরে প্রকৃতির সবুজ বেঁচে আছে এখনো৷ ‘সু-‘ বন্ধুর কথায় তার দিকে তাকায়৷ ‘শোন, নিজের জীবন নিয়ে অন্তত একটা উপন্যাস লেখা-ই যায়।’ ‘তা ঠিক, কিন্তু আমার জীবনে তো কোনো ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটেনি বন্ধু।’ ‘মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বন্ধু বলে-‘বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব উপন্যাসে কিছু না কিছু ঘটে চলেছে। অন্তত একটা উপন্যাসে  কিছু না ঘটুক- কি বলিস?’ – মনোরঞ্জনের কথা শুনে হেসে ফেলে সুধন্য। আবার কিছু সময় চুপচাপ যায়। ‘আচ্ছা মনো, তোর দুই হাজার তিন লং মার্চের সেই আদিবাসী দম্পতির কথা মনে আছে?’ দুজনেই গলা ফাটিয়ে হাসে। মনো আর সুধন্য দুইজনই লং মার্চটাকে ডকুমেন্টেড করছিলো। লিখে লিখে৷ এক আদিবাসী দম্পতি বাস থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন৷ একটু আগেই পথসভা শেষ৷ কাছেই হাইস্কুল বিল্ডিং৷ আজ রাতে ওখানেই থাকবে। দুই বন্ধুর লেখা আর শেষই হয় না। তখনই শুনতে পায় একজন অন্যকে বলছেন, ‘ল্যাওড়া লেখে?’ ওরা দ্রুত ওখান থেকে সরে এসেছিলো। বুঝতে দেয়নি, গুপ্তসাহিত্য পড়বার ফলে শব্দটির অর্থ তারা জানে। তাঁদের বলা বাক্যের অবশ্য অন্য এক নিহিতার্থ আছে। তাঁদের জীবনে দৈনন্দিন এতোটাই পঞ্চেন্দ্রিয়ে মিশে আছে যে লেখাটাকে তাঁরা বাহুল্য ভাবছেন৷ তাঁদের ইতিহাস তো স্মৃতি আর শ্রুতিবাহিত। দুই বন্ধু ভেবেছিলো, নতুন কোন অভিজ্ঞান যুক্ত না করা গেলে যে কোনো লেখার চেষ্টাই বৃথা। 
***
মনোরঞ্জন শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে এসেছে বন্ধুকে। সারা বাড়ি চাপা কান্নায় স্তব্ধ৷ মনোর ছোটো শালার একমাত্র কন্যা শিশু সদ্য হামাগুড়ি দিতে শিখেছিলো। কেউ খেয়াল করেনি, হামাগুড়ি দিয়ে সে বাড়ির পেছনে পুকুরে পড়ে গিয়েছিলো। উঠোনের ঠিক মাঝখানে শিশুটি শুয়ে আছে৷ মনোকে একটু যেন বেশিই ভালোবাসতো সে৷ দেখলেই কোলে আসার জন্যে লাফালাফি করতো৷ মনোর জন্যেই অপেক্ষা। ছোট্টো এক কবর খুঁড়ে শুইয়ে দেয়া হলো তাকে। মনোরঞ্জনকে সেখান থেকে আর সরানো গেলো না৷ সে আরো চুপচাপ হয়ে গেলো। রাত আরেকটু গভীর হলে দেখা গেলো মনোরঞ্জন, তার ছোটো শালা আর সুধন্য ছোটো কবরের পাশে বসে আছে৷ কারো মুখে কথা নেই কোনো। একটু পর পর কারো চিৎকার করে বিলাপের শব্দ। রাতের কিছু এসে যায় না। সূর্যের দিকে বয়ে যাচ্ছে রাত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত