হিমাংশু স্যারের সাইকেল

Reading Time: 2 minutes

আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমিও একসময় কাঁদতাম। না, প্রেমিকার বিয়ে হচ্ছে অন্যছেলের সাথে, সেই অবস্থায় যেরকমের কান্না পায়, সেরকম মোটেও নয়। যাকে বলে ভেউভেউ করে কাঁদা। তার সাথে সবসময় যুক্ত থাকত নোনাজলের ধারা। কপোল দিয়েই গড়িয়ে নামত, কপাল দিয়ে নয়। আমার মা রাগ করে বলতেন মরাকান্না। আমি সেই মরাকান্নাই কাঁদতেছিলাম। কী, নতুন কোন খেলনার জন্য নয়, কিংবা আরেক টুকরো কলাপিঠার জন্যও নয়। আমার বড়ভাই স্কুলে যায়, নতুন নতুন বই নিয়ে আমার দুই বোনও স্কুলে যায়। কিন্তু আমাকে স্কুলে যেতে দেয় না। কী ব্যাপার? সবাই বলেঃ এখনও স্কুলে যাবার বয়স হয়নি। আমি কিন্তু আমাদের মফস্বল টাউনের কথা বলছি। এখনকার কথা জানি না, তখন বয়স পাঁচ বছর হওয়ার আগে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর বাতিক ছিল না। আমার বাবা-মা এই আইন (অলিখিত) মেনে চলতেন। কিন্তু বাচ্ছালোক তো অতোশত বুঝে না। ফলে আমি, তখনও চার, স্কুলে যাবার জন্য কাঁদতেছিলাম আমাদের বাসার সামনে দূর্বাঘাস-ঢাকা যে জায়গাটা ছিল সেখানটায় বসে। জায়গাটার পাশ দিয়ে চলে গেছে পাকারাস্তা সোজা পূর্ব দিকে শাহগন্জ্ঞ। উত্তরদিক থেকে একটা কাঁচারাস্তা এসে মিশেছে রাস্তাটার সাথে আমাদের বাসা বরাবর। কাঁচারাস্তার অপর মাথায় কালীপুর। সেইখানেই সরযূবালা স্কুল। আমার ভাই ও বোনেরা পড়ত। আমার বাবা যে কলেজের শিক্ষক ছিলেন, সেখানেও এই পথ দিয়ে যেতে হতো। তো হিমাংশু স্যার সাইকেলে চেপে সরযূবালা স্কুলে যাচ্ছিলেন । তিনি আমার সামনে এসে সাইকেল থামালেন।

‘কী, খোকা, কাঁদছ কেন?’

(এখন যেমন চশমার কাচের ভেতর দিয়ে দেখি) তখন আমি সেরকম তাকালাম স্যারের দিকে অশ্রুর আড়াল থেকে। কাঁদতে কাঁদতে বললামঃ ‘আমাকে কেউ স্কুলে নেয় না। আমি স্কুলে যাব।’

হিমাংশু স্যার সাইকেলটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করালেন, তারপর আমাকে দু’হাতে তুলে সাইকেলের কেরিয়ারে বসিয়ে দিলেন। বললেনঃ

‘শক্ত করে ধরে বসে থাক, খোকা।’

সেই আমার প্রথম স্কুলে যাওয়া। হিমাংশু স্যার আমাকে স্কুল ঘুরিয়ে বাসায় দিয়ে গেলেন।

পরে যখন স্কুলে ভর্তি হলাম এবং হিমাংশু স্যারের ক্লাসে উঠলাম তখন স্যারের কাছ থেকে শিখলামঃ গসাগু হচ্ছে গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক, লসাগু হচ্ছে লগিষ্ঠ সাধারণ গুণীতক। তিনি পড়াতেন ভাল, কিন্তু আমি সর্বদা গুণনীয়ক ও গুণীতক নিয়ে ধন্দে থাকতাম।

আমার বাবা-মা বলতেন তুমি যদি কারও কাছ থেকে ভালো কিছু শিখতে পার, সে যে পেশারই হোক না কেন, সে তোমার শিক্ষক। এই ধারণাটা বাবা মায়ের কাছ থেকে নাকি মা বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন, তা এখন আর আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তবে শিক্ষা তো জ্ঞান, ধারণা, অনুধ্যান ইত্যাদির আদান-প্রদানের উপর জোর দাঁড়িয়ে আছে। যাহোক, বাবা-মা’র কথা ধরে নিলে আমার শিক্ষকের সংখ্যা তো কম নয়! মনে হয় আমি একটা সাইকেলে বসে আছি, আর ভিন্ন ভিন্ন হিমাংশু স্যার বলছেনঃ ‘শক্ত করে ধরে বসে থাক, খোকা।’ ‘শক্ত করে ধরে বসে থাক।’

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>