মহামারি ড্যান্সিং প্লেগ: নাচতে নাচতেই মারা গেলেন মানুষ
এক সপ্তাহ ধরে বিরামহীন নেচেই চলেছেন কয়েকশত নারী পুরুষ ঘটনাটি অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর শোনালেও সত্যি যে, ১৫১৮ সালে ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গ শহরের বাসিন্দারা আকস্মিকভাবে এক সকালে নিয়ন্ত্রণহীন এক অদ্ভুত খিঁচুনি নাচ প্রদর্শনের মতো বিরল এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। পরবর্তীতে ইতিহাসবিদরা যার নাম দেন ‘ড্যান্সিং প্লেগ’। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এই নাচ অব্যাহত রেখেছিলেন। পরবর্তীতে তার সঙ্গে আরও প্রায় ত্রিশজন এই নাচে অংশগ্রহণ করে। তারা অনেকেই একটা সময় পানিশূন্যতায় ভুগে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। এক মাসের মধ্যে নাচকেন্দ্রিক এই মহামারি প্রায় চারশ’ জনকে প্রলুব্দ করেছিল।
হ্যাঁ, এরকমটাই ঘটেছিল । ১৫১৮ সালে ফ্রান্সে ঘটেছিল এরকম এক রহস্যপূর্ণ, অথচ অমীমাংসিত ঘটনা!
মধ্যযুগীয় ফ্রান্সের একটি শহর স্ট্রাসবার্গ। ১৫১৮ সালের জুলাই মাসের কথা, রেনেসাঁ তখন কেবল শুরুর দিকে। আর দশদিনের মতো দিব্যি নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন ফ্রাঁউ ট্রফিয়া নামক এক গৃহবধূ। হঠাৎ আশাপাশের সবাইকে চমকে দিয়ে সকালবেলা নাচতে শুরু করলেন তিনি। নাচতে নাচতে বেরিয়ে এলেন প্রধান সড়কে। বলা নেই, কওয়া নেই রাস্তায় এমন করে কাউকে নাচতে দেখলে আপনি নিশ্চয়ই অবাক হবেন। আর রাস্তার লোকজন যে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। একই ঘটনা ঘটে ট্রফিয়ার সাথে। দর্শকরা মজা পেয়ে হাসতে লাগল, অত্যুৎসাহী কয়েকজন হাততালি দিয়ে উঠল এবং তারস্বরে চেঁচিয়ে ট্রফিয়াকে বাহ্বা দিতে লাগল। লোকজন ভাবতে বাধ্য হলো, ট্রফিয়াকে কি তবে ভূতে ধরেছে?
শুরুটা হয়েছিলো খুব স্বাভাবিকভাবেই! ফ্রাউ ত্রাফেয়া নামের এক ভদ্রমহিলা হঠাৎ শহরের রাস্তায় নেমে এলেন নাচতে নাচতে !আপাতদৃষ্টিতে এটাকে পাগলামিই বলা যায় । কিন্তু দৃশ্যপট বদলে গেল খানিক পরেই। একে একে নৃত্যরত ত্রাফোয়ার দল ভারী হতে লাগলো। একে একে তার চারপাশের সবাই যোগ দিল তার নাচে! এবং খুব দ্রুত অবস্থা চলে গেলো আয়ত্বের বাইরে!
কি পাঠক; কল্প কাহিনী শুনছেন ? কল্পকাহিনীর মতো শোনালেও এই ঘটনা সম্পূর্ণ বাস্তব ! হাতের মুঠোফোনে গুগল থেকে আপনি এই বিষয়ের সত্যাসত্য জেনি নিতে পারেন । তো ঘটনাটি এখানেই থেমে গেলে ভালো ছিল । কিন্তু তা হয়নি । নাচের দলের মানুষগুলো একে একে মৃত্যুতে গিয়ে ঠেকেছে !
নাচ শুরু হলো ঠিকই, শেষ হবার নাম ছিল না কোন ! একটানা ১ সপ্তাহ চলার পর, ভিন্ন জায়গা থেকে আসা আরো ৩৪ জন যোগ দিল এই নাচে। একমাসে এই সংখ্যাটা দাঁড়ালো ৪০০ জনেরও বেশি মানুষে! ৪০০ জন মানুষ একটানা একসাথে শুধু নেচেই যাচ্ছেন, সম্পূর্ণ বিরতিহীনভাবে ! কেনো এরকম হচ্ছে কেউ জানেন না, কেউ বুঝতে পারছেন না, কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাদের নাচিয়ে নিচ্ছে, শুধু নেচেই যাচ্ছেন তারা !
নৃত্যের মিছিল ধীরে ধীরে মৃত্যুর মিছিলে পরিণত হয় । যখন রাস্তায় একটানা নাচতে নাচতে মারা যায় এক ডজনেরও বেশি মানুষ! এদের বেশিরভাগই মারা যায় একটানা নাচার ফলে ডিহাইড্রেশনে, বা স্ট্রোকে, এবং ক্লান্তিতে। আশ্চর্যের বিষয়, সর্বপ্রথম নাচ শুরু করা ভদ্রমহিলা ফ্রাউ ত্রাফেয়া তখনও বেঁচে ছিলেন এবং নেচে চলেছিলেন! দীর্ঘ একমাস বিরামহীন নাচতে থাকেন তিনি! একমাস পর নৃত্যদলের শেষ মানুষ হিসেবে তিনিও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন!
নাচতে নাচতে মৃত্যু : কেনো হয়েছিলো এমন?
ঠিক কেনো এমনটা হয়েছিলো সে বিষয়ে পরিস্কার কোন বিশ্লেষণ এখনও পাওয়া যায় না । মৃত্যুর কারণের নেই কোন সঠিক তথ্য প্রমাণ। শুধু বুদবুদ হয়ে রয়েছে কিছু ধারণা।
ঐতিহাসিক জন ওয়ালার তার ‘এ টাইম টু ড্যান্স, এ টাইম টু ডাই: দ্য এক্সট্রাঅর্ডিনারি স্টোরি অফ দ্য ড্যান্সিং প্লেগ অফ ১৫১৮’ বইটিতে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করেন। “ঘটনাটিকে এককথায় অবিসংবাদিত বলা যায়,” বলেন মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন। “প্রশ্ন উঠতেই পারে যে ঘটনাটিকে আমরা নাচ বলে দাবি করছি আদৌ কী তা নাচ ছিল, নাকি পাগলের মতো হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি ছিল। ঐতিহাসিক রেকর্ড বলে ভিক্টিমরা কেবল কাঁপছিল বা হাত-পা ছুঁড়ছিল না, তাদের হাত-পায়ের নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছিল কেউ জোরপূর্বক তাদের দিয়ে নাচাচ্ছে”।
তবে ড্যান্সিং প্লেগের সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ইভান ক্রোজিয়ার, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক তিনি। ডিসকভারি নিউজকে দেয়া এক তথ্যমতে, জনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন তিনি। পুরো বিষয়টিকে তিনি ‘মাস হিস্টিরিয়া’ বলে অভিহিত করেন। রাইন নদীর তীরবর্তী জনগণের দুঃখ-কষ্টের স্বরূপ ছিল একই। একই দুর্ভাগ্যকে বরণ করে নেয়া জাতির মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এরগোটের প্রভাব। এর প্রভাবে তারা একপ্রকার ঘোরের মধ্যে চলে যায়, ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নাচতে শুরু করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতাব্দীতে এরকম একটি মাস হিস্টিরিয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। সে সময় অকস্মাৎ মানুষের শরীর কুঁচকে আসতে থাকে, যৌনাঙ্গ ভেতরে ঢুকে যেতে থাকে। আফ্রিকা আর এশিয়ায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, মাইলের পর মাইল এলাকা থেকে লোকজন যেন বেমালুম গায়েব হয়ে যায়। ১৯৬২ সালে উগান্ডা আর তানজানিয়ায় ঘটে ‘তানজানকিয়া লাফটার এপিডেমিকের’ ঘটনা। তানজানিয়ার এক মিশনারি স্কুলে হঠাৎ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে তিন স্কুল ছাত্রী। তাদের হাসি ছড়িয়ে পড়ে সারা স্কুলে, সারা গ্রামে, সারা দেশে, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ উগান্ডায়ও! আঠারো মাসব্যাপী চলে সে হাসি। সিঙ্গাপুর মেডিকেল জার্নালের মতে, ১৯৬৭ সালে গণভীতির শিকার হয়ে সিঙ্গাপুরে প্রায় ১,০০০ মানুষ মারা যায়। কাজেই মাস হিস্টিরিয়া কোনো নতুন বিষয় নয়, নতুন কেবল তাদের ধরন।
ভ্যান্ডারবিল্ট মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল প্রফেসর টিমোথি জোনসের মতে, এ ধরনের মাস হিস্টিরিয়া কেন হয় আর কীভাবে হয় তার সঠিক কোনো ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। তবে এরকম কোনো মহামারী ছড়িয়ে পড়লে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে সুস্থদের যতটা সম্ভব আলাদা রাখা প্রয়োজন। তেমন অবস্থা হলে অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ভূত এসব রোগের একটিই সমাধান আছে, বায়ু পরিবর্তন। তবে সাধারণত দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলে এসব রোগ বেশি দেখা যায়, যেখানে এমন বায়ু পরিবর্তনের চিন্তা বাহুল্য বৈকি।
নিজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখা তো নিজের হাতেই। টিমোথি বলেন, ড্যান্সিং প্লেগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যদি ট্রফিয়াকে সামলানোর চেষ্টা করতো, নিজেরা মাথা ঠাণ্ডা রাখত, তাহলে হয়তো অবস্থা এতটা খারাপ হতো না। তবে তখন কী ঘটেছিল, সেটা প্রত্যক্ষদর্শী আর আক্রান্তরাই ভালো বলতে পারবে। মাঝে মাঝে মানব মনে এমন কিছু অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হয় যা ব্যাখ্যাতীত। ড্যান্সিং প্লেগকেও তেমন একটি অস্বাভাবিক রোগ বলে ব্যাখ্যা করেছেন টিমোথি।
শুধু নাচেরই নয়, এরকম অদ্ভুত সব ঘটনা রয়েছে সারাবিশ্বজুড়ে, যা এখনো রহস্য। খুব নিকটতম উদাহরণ হচ্ছে তানজানিয়ার হাসি রোগ! যেখানে একটা শহরের বাসিন্দারা ১৮ মাস ধরে একটানা হাসছিলেন, কোণ কারণ ছাড়াই!
ঠিক কেনো শুরু হয়েছিলো এই নাচের, এবং ঠিক কি কারণে একটানা নাচতে নাচতে মৃত্যু হলো এতগুলো মানুষের, এই রহস্য আজও অজানা।
বিশেষজ্ঞরা এর নাম দিয়েছেন ড্যান্সিং প্লেগ! তবে কি এটি শুধুই একটি ছোঁয়াছে রোগ বা প্লেগ? এই ঘটনায় হয়তো বিশেষজ্ঞদের অনুমানই সঠিক, অথবা হয়তো এর পেছনে রয়েছে ব্যাখ্যাহীন কোন রহস্য!
