| 16 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস

টালা ট্যাঙ্কের ইতিহাস

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

জল মানে জীবন, আর জল ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব ভাবা যায় না। টালার ট্যাঙ্ক এক বিস্ময়কর জলাধার। শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, বিশ্বের অন্যতম বৃহত্ খাবার জলের ট্যাঙ্ক কলকাতার এই টালার ট্যাঙ্ক।  টানা ১০০ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে কলকাতার মানুষকে পরিশুদ্ধ খাবার জল সরবরাহ করে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে এই টালা ট্যাংক। বিশ্বের বৃহত্তম এই জলের ট্যাংকটি তৈরি হয়েছে গ্যালভানাইজড লোহার চাদর দিয়ে। ১১০ ফুট উচ্চতায় এই ৩২১ ফুট পরিধি বিশিষ্ট ট্যাংকটি দাঁড়িয়ে রয়েছে ৯০ লাখ গ্যালন জল ধারণ করে। ট্যাংকটির গভীরতা ১৬ ফুট। দিনের ২৪ ঘণ্টাই একদিক দিয়ে জল সরবরাহ করা হয়, অন্যদিক দিয়ে উত্তর শহরতলির পলতা থেকে পরিশুদ্ধ জল এসে ভর্তি করে ট্যাংকটি। আর সেই জল ভূগর্ভস্থ পাইপের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় উত্তর শহরতলির সিঁথি থেকে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর।

ব্রিটিশদের হাত ধরে ধীরে ধীরে কলকাতা যখন সাবালক শহরে পরিনত হচ্ছে, তখন নাগরিক পরিষেবা বাড়ানোর দিকে নজর দেয় ব্রিটিশরা। তখনকার পুর-ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার ডেভেরাল একটি ট্যাঙ্ক (রিজার্ভার) তৈরির প্রস্তাব দেন।প্রস্তাবের সঙ্গে সহমত হয় বেঙ্গল গভর্নমেন্টও। ১৯০১ সালের প্রস্তাব কর্পোরেশন গ্রহণ করে ১৯০২ সালে । এর ঠিক এক বছর পর এই প্রস্তাবে সামান্য অদলবদল আনেন পুরসভার নয়া নিযুক্ত ইঞ্জিনিয়র ডব্লু বি ম্যাকক্যাবে।তাতে প্রকল্পের প্রস্তাবিত অঙ্কের পরিমাণ বেড়ে হয় ৬৯ লক্ষ ১৭ হাজার ৮৭৪ টাকা। তবে আরও উন্নত জল পরিষেবা সম্ভব বলে তাতে সম্মত হয় পুরসভা। কিন্তু কোথায় হবে এই ওভারহেড ট্যাঙ্ক ? অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বেছে নেওয়া হয় টালাকেই।আজ টালার ট্যাঙ্ক যেখানে সেখানে তখন ছিল বেশ কয়েকটি পুকুর।সিদ্ধান্ত হয় যে, পুকুর বুজিয়ে তার ওপর গড়ে উঠবে ওভারহেড রিজর্ভর। প্রায় ১১০ ফিট উঁচুতে।যেখান থেকে মাধ্যাকর্ষণের স্বাভাবিক নিয়মে জল পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হবে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


১৯০৯ সালের ১৮ নভেম্বর টালা ট্যাঙ্ক নির্মাণের উদ্বোধন করেন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার এডওয়ার্ড বেকার।প্রথমেই শুরু হয় পুকুর বোজানো।পুকুরগুলিকে জলশূন্য করা হয়, চারদিকে শাল-বল্লার খুঁটি দিয়ে ২০-২৫ ফুট পাইল করে খোয়া দিয়ে ভর্তি করা হয়।ভারী স্টিম রোলার দিয়ে সমান করে তার ওপর খোয়া দিয়ে ৯ ইঞ্চি পুরু আরও একটি স্তর তৈরি করা হয়।এরপর আড়াই ফুট পুরু কংক্রিট সিমেন্টের ওপর ফ্ল্যাট স্টিল টাঁই-এর সঙ্গে বোল্ড স্টিল জয়েন্টের ওপর স্তম্ভগুলিকে দাঁড় করানো হয়। তবে টালা ট্যাঙ্কের ফাউন্ডেশনের কাজটি করে টি সি মুখার্জি অ্যান্ড কোম্পানি।কংক্রিট ফাউন্ডেশনের কাজটি করেন স্যার রাজেন্দ্রলাল মুখার্জির মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি। বাকি কাজ করে লিডসের ক্লেটন কোম্পানি। ১৯১১-র ১২ জানুয়ারি কাজ শেষ হয় এবং সে বছরের ১৬ মে থেকে এটি চালু করা হয় । ট্যাঙ্কটি তৈরি করতে খরচ হয় ২২ লক্ষ ২৫ হাজার ৪১ টাকা।

এবার জানা যাক কয়েকটি বিষয়। টালা ট্যাঙ্ক বিশ্বের বৃহত্তম ওভারহেড রিজার্ভার।  জলধারণ ক্ষমতা ৯ লক্ষ গ্যালন। যে পরিমাণ জল ধরে তার ওজন ৪০ হাজার টন এবং লোহার খাঁচাটির ওজন ৮ হাজার ৫০০ টন, ট্যাঙ্কে যে পাইপ দিয়ে জল ঢোকে বেরোয় সেই পাইপ ধরেই। তথ্য বলছে, টালা ট্যাঙ্ক নির্মাণের জন্য প্রায় ৮৫০০ টন লোহা লেগেছিল। যা ইংল্যান্ডের সুদূর ম্যাঞ্চেস্টার থেকে জাহাজে করে আনা হয়েছিল। মাটি থেকে ১১০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত ওই ট্যাঙ্ক আক্ষরিক অর্থেই এক বিস্ময়! সল্টলেক স্টেডিয়ামের মাপ হল ২৮০ ফুট বাই ২৮০ ফুট। সেখানে টালা ট্যাঙ্কের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের মাপ ৩২১ ফুট বাই ৩২১ ফুট! অর্থাৎ, ফুটবল মাঠের থেকেও আয়তনে বড় ওই জলাধার! ২১৫টি লোহার স্তম্ভের উপরে দাঁড়ানো ট্যাঙ্কটির উচ্চতা ২০ ফুট।

জনশ্রুতি বলছে, শুরুর দিকে নাকি এই জল খেতে চাননি শহরবাসী। কারণ, তখন ধারণা ছিল, গঙ্গার জল পবিত্র। সেই জল মেশিন ও পাইপের ভিতর দিয়ে আসার ফলে তার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! পাঁচ বছর তাই টালা ট্যাঙ্কের জল ব্রাত্যের তালিকায় ছিল। ব্রিটিশরা শেষ পর্যন্ত বোঝাতে পেরেছিল যে, টালা ট্যাঙ্কের জল ব্যবহার না করে উপায় নেই। সে দিন থেকে এখনও পর্যন্ত টালা ট্যাঙ্কের জল সত্যিই প্রাণবিন্দুসম! উত্তর ও মধ্য কোলকাতা তো বটেই, ভবানীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত এই প্রাণধারা।

ট্যাঙ্কটি চারটি কম্পার্টমেন্টে বিভক্ত যাতে জল সরবরাহ বন্ধ না রেথেই এক বা একাধিক কম্পার্টমেন্ট পরিষ্কার বা সারাই করা যেতে পারে। টালা ট্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে বিশেষ গ্রেডের ইস্পাত দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান টালার ট্যাঙ্কের ওপর বোমা ফেলে। জাপানি বোমায় টালা ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়নি। তাতে ৯টা মাত্র ফুটো হয়। ১৯৬২ ও ১৯৭১-এর যুদ্ধেও যথাক্রমে চিন ও পাকিস্তানের টার্গেট ছিল টালার ট্যাঙ্ক।কলকাতার বহু ইতিহাসের নীরব সাক্ষী এই টালার ট্যাঙ্ক।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত