হাওড়া জেলায় রান্না পূজো বা অরন্ধন উৎসব । পলাশ পোড়েল
হাওড়া জেলায় ভাদ্র মাসে রান্না পূজাকে অরন্ধন উৎসবও বলে।ভাদ্রে মাঠ-ঘাট-পুকুর-রাস্তা সব জলে একাকার হয়ে যায়। চারিদিকে শুধু জল আর জল। তাই বিষধর সর্পেরা লোকালয়ে- গোরুর গোহালে, মানুষের ঘরের আনাচে- কানাচে, আড়কাঠায়, ঘুটে মাচায় এসে আশ্রয় নেয়। একটু অসাবধান হলেই মানুষকে ছোবল মারে।যার অবশ্যম্ভাবী ফল মৃত্যু। এইসব সাপের কবল থেকে বাঁচার জন্য ভাদ্র মাসে মনসা দেবী এ জেলার লোকসমাজে বিশেষরূপে পূজো পান। এই পূজোকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষরা অরন্ধন উৎসবে বা পান্তা পরবে মেতে ওঠে। দেবীকে নিবেদিত নৈবেদ্যগুলো সবই রান্না করা। এই সময়ের মনসা পূজোর নাম তাই ” রান্না পূজো ” । এই রান্নার আবার বিভিন্ন নাম আছে- ইচ্ছা রান্না, গাবড়া রান্না ( আটাশে রান্না), বুড়ো রান্না ও ষষ্ঠী রান্না।সব রান্নার নিয়মকানুন মোটামুটি এক। পার্থক্য শুধু সময়ের হেরফেরে।
ইচ্ছা রান্না— ভাদ্র মাসের যে কোন শনিবার ও মঙ্গলবার সাধারণ ভাবে এই পূজা হয়।( তবে কিছু কিছু জায়গায় সোমবার ও শুক্রবার )গৃহীরা তাদের মনমতো দিন ঠিক করে রান্না পূজো করে। তাই নাম ” ইচ্ছা রান্না ” । সূর্য ডোবার পর থেকে রান্নার শুরু আর সূর্য ওঠার আগে তা শেষ করতে হয়। আবার দুই দিন আলাদা ভাবেও অনেকেই পূজা করে। পুরুষানুক্রমে যাদের যেমন পূজা ঠিক তেমনিভাবেই এখনও চলে আসছে। অনেকের অর্থনৈতিক অবস্থার রকমফের ঘটলেও সামর্থ অনুযায়ী পূজা করে যাচ্ছে।
অবস্থাপন্ন লোকেরা যেমন পূজোর জন্য প্রচুর রান্নার আয়োজন করে, বহু লোকজনকে প্রসাদ খাওয়ানোর আমন্ত্রণ জানায়, তেমনি আবার গরীব লোকেরা তাদের সাধ্যের মধ্যে যা কুলায় তাই মনসা দেবীর জন্য আয়োজন করে।আর এক শ্রেণীর লোক আছে যারা নিজেদের আহারই জোটাতে পারে না, তারা ভাদ্র মাস পড়লেই একটা ধামা নিয়ে এ- পাড়া ও- পাড়া ঘুরে ” মা মনসার আয়োজন ” বলে ভিক্ষা করে দেবীর নৈবেদ্য যোগাড় করে। বহু কষ্টের মধ্যে পড়েও কেউ প্রথা ভঙ্গ করেনি। বরং বিশ্বাস,ভয়, শ্রদ্ধা ও ভক্তি দিয়ে আজও পূজো চালিয়ে যাচ্ছে।
সকাল থেকে পূজো বাড়ির সকলে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। নতুন উনান খোলা হয়। বহু রকমের আনাজ কেটে সারা বাড়ি ধোয়া- মোছার কাজ চলে। সূর্য ডুবলেই মাটির নতুন হাঁড়িতে চাল ও জল দিয়ে উনানে বসিয়ে তাতে সিঁদুর মাখিয়ে, নমস্কার করে, শঙ্খধ্বনি দিয়ে আগুন দেওয়া হয়।এটি ভোগের হাঁড়ি। নতুন বস্ত্র পরে বাড়ির গৃহিণী এটি রান্না করে। রান্না চলাকালীন কেউ কথা বলতে পারে না বা অন্যত্র যেতেও পারে না। নিয়মকানুন কঠিন হলেও নিষ্ঠার সঙ্গে আজও রান্না পূজো হয়ে আসছে।ভাত ভোগ হওয়ার পর একে একে অন্যান্য রান্না গুলো হয়। আবার অনেক বাড়িতে ঠাকুরের জন্য আলাদা ভাবেও রান্না করে নৈবেদ্য দেওয়া হয় এবং সেই প্রসাদ পরে অল্প করে সকলকে দেওয়া হয়। দুই দিন ঠাকুরের ভোগ দিতে হয়। সাধারণত চিনেমাটির খোরা করে ভোগ দেওয়া হয়। তবে যে যার সাধ্যমত পবিত্রভাবে নতুন জিনিসে ঠাকুরের ভোগ দেন। যাদের ইচ্ছা রান্না তারা যে কোন দিন রাত্রে ভাত,ভাজা, তরিতরকারি তৈরি করে রাখে। পরদিন উনুনে সিজ মনসার ডাল দিয়ে পূজো করে, বাসি বা পান্তা ভাত বাসি তরকারি লোকজনকে নিমন্ত্রণ করেও খাওয়ানো হয়ে থাকে। তবে অনেক জায়গায় পরদিন গরম ভাত, তরকারি ইত্যাদি অতিথিদের খাওয়ানোর চল আছে।
* ভাজার মধ্যে থাকে- নারকেল কোরা ও কোঁচানো, শাক ( কেবলমাত্র সজনা) , চিচিঙ্গে , ঝিঙে, ঢেঁড়স, বেগুন,ওল,আলু, শশা,কুমড়ো, চালকুমড়ো , কাঁচকলা, পেঁপে, উচ্ছে/ করলা এগুলো আবশ্যিক। অনেকে ইচ্ছানুযায়ী আরও আনাজ ভাজে।
* ডাল – কেবলমাত্র খেঁসারির ডালই রান্না হয়।এটি চালতা দিয়ে বানানো হয়। তবে দরিদ্র পরিবারে মুসুর ডালও করে।
* তরকারি- পুঁইশাকের তরকারি, নারকেল সহযোগে চালকুমড়োর তরকারি, নারকেল সহযোগে সারকচুর ডাটার তরকারি আবশ্যিক। এছাড়াও অন্য তরকারি করা যেতে পারে।
* ঝাল — মাছের ঝাল, ইলিশ মাছের ঝাল, চিংড়ির পদ থাকে। তবে সাধ্যমত কাটাপোনা বা পুকুরের মাছ , যাদের যা প্রথা সেই অনুযায়ী মাছ রান্না হয়।
* অম্বল ( টক) — পাকা তেঁতুল, কুমড়ো, ঢেঁড়স, চিংড়ি মাছ বা ইলিশ সহযোগে অম্বল। অথবা চুনোমাছ দিয়েও হয়।
* পায়েস— তালগুড়/ আখগুড়/ চিনি, নারকেল, দুধ ও আতপচাল দিয়ে পায়েস তৈরি হয়।
(২)
এতসব রান্না সারতে অনেক রাত হয়ে যায়। সমস্ত রান্নাকে একটি পরিষ্কার ঘরে রেখে ভোগের হাঁড়িতে জল দিয়ে পান্না করা হয়। সূর্য ওঠার পর ওই ঘরের একটি কোণে মনসা গাছ পুঁতে রান্নার ভাত তরকারি দুটি পাথরের থালায় সাজিয়ে মনসা গাছের দুই দিকে এবং মাঝখানে চাল,কলা ও দুধের পাত্রটি রেখে মনসা দেবীর পূজো করা হয়। পূজারী কুলোপুরোহিত। পূজোর প্রসাদ সমস্ত রান্নার মধ্যে মেশালেই রান্নাটি প্রসাদ হয়ে ওঠে। তবে অনেক সম্প্রদায়ের মহিলারা ভক্তিভরে নিজেরাই মায়ের প্রতি ভোগ নিবেদন করেন।পরে দেবীর কাছে পূজা দেন। বিভিন্ন স্থানে প্রভেদ দেখা যায়।
অনেক জায়গায় রান্নাঘরে এদিন উনুন জ্বালান হয়না ,উনুনের চারিদিকে ঘিরে শাপলা ফুল সহ লতা ঘিরেদেওয়া হয় মালার মত মনসা ডাল দেওয়া হয় ,আলপনা দেওয়া হয় পদ্মের মত নানা ফল চিনি বাতাসা ইত্যাদি দিয়ে পূজা হয় থকে নানা রকম ভাজা নানা রকম মাছের তরকারি দেওয়া হয় তবে সবার প্রথমে মনসার উদ্দেশে উনুনের কাছে ভোগ দেওয়া হয় , এঁরা চিঁড়ের সঙ্গে দই দিয়ে ভোগ দেন ।মনসা পূজার আগের দিন শুদ্ধ আচারে কঠোর নিয়মের মধ্যে মহিলারা এই সব ভোগ ও বিভিন্ন রকম তরকারি বিকেল থেকে রাত বা ভোর অবধি তৈরী করেন।
* এবার খাবার পালা। এদিন অনেক বাড়িতে উনান জ্বালানো হয় না। সুতরাং রান্নার ব্যাপারও থাকে না। তাই ” অরন্ধন ” । এই অরন্ধন উৎসবে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী সকলের আমন্ত্রণ থাকে। পাশাপাশি সকলের বাড়িতে রান্না পূজো হলেও একে অপরকে আমন্ত্রণ জানায়, প্রসাদ পাঠায়।সবাই সবারটা ভক্তিভরে খায়। আমন্ত্রিতরা রান্নার আগের দিন আমন্ত্রণকারীর বাড়িতে ঝাঁকা ভর্তি আনাজ, মাছের তত্ত্ব পাঠায়। এগুলো রান্নাতে লাগানো হয়। কিছু লোক আছে রান্না পূজোর অনুষ্ঠানের কথা শুনেই দূর থেকে এসে ঠাকুরের প্রসাদ বলে বিনা নিমন্ত্রণেই খেয়ে যায়। এদিন কেউ কাকেও খেতে মানা করে না বরং খুব খুশি করেই খাওয়ায়। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খাওয়ার পর্ব চলতেই থাকে।
(৩)
প্রসাদ খাওয়ার আন্তরিকতা যেমন সুগভীর, খাওয়ানোর আন্তরিকতাও কম নয়। এদিনের অনুষ্ঠানের নাম – ” পান্না ” । প্রসাদের ভাত, সমস্ত ভাজা, তরিতরকারি, পায়েস পর্যন্ত পরের দিনের জন্য খানিকটা করে তুলে হয় । স্বভাবতই সেগুলো সবই টক হয়ে যায়। সেগুলোও মানুষ ভক্তি ভরে খায়।পরের দিনের অনুষ্ঠানের নাম তাই ” টক পান্না ” ।এসব খেয়ে কারোর শরীর অসুস্থ হয় না।লোকসমাজের বিশ্বাস মা মনসার এই প্রসাদ খেয়ে অসুস্থ হয়েছে এমন নজির নাকি নেই। বরং অনেক দিনের পেটের গোলমাল থাকলে কিংবা জ্বরে ভুগছে এমন ব্যক্তি রান্না পূজোর প্রসাদ খেলে তাদের রোগ সারে বলে ধারণা। আবার বলতে শোনা যায়, পান্তা বা বাসী তরকারি খেলে অন্য দিন যাদের শরীর অসুস্থ হয় আশ্চর্যের ব্যাপার এদিন কোনো ক্ষতি করে না।এসব বিশ্বাস আজও মানুষের মধ্যে অটুট।
এখনও অনেক মানুষ আছে যারা পান্তা ভাতের আমানিকে পরিষ্কার শিশির মধ্যে রেখে মাটির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। প্রচণ্ড পেটের গণ্ডগোলে এটি দারুন ঔষধের কাজ করে। প্রয়োজনে শিশি থেকে নিয়ে আবার মাটির তলায় ঢুকিয়ে রাখা হয়। এইভাবে এক ভাদ্র থেকে আরেক ভাদ্র পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়। বিশ্বাস আছে পূজোর পান্তার আমানিকে গাছে দিলে গাছের বন্ধ্যাত্ব ঘোচে। তিন দিনের এই পান্তা পরবটি এ জেলার মানুষের কাছে একটি বড় ধরনের আনন্দ উৎসব। উৎসবটির পরিসমাপ্তি ঘটলেই পরের বছরের উৎসবের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সবাই।
* ষষ্ঠী রান্না— ষষ্ঠীর দিন রান্নাটি অনুষ্ঠিত হয় বলে এদিনের এই রান্নাটির নাম – ” ষষ্ঠী রান্না ” । ইলিশ মাছের প্রাধান্য থাকে এই রান্না উৎসবে।
(৪)
* গাবড়া/আটাশে রান্না— এই রান্না সাধারণত দক্ষিণদেশিদের (দক্ষণো) মধ্যে দেখা যায়। ভাদ্র মাসের আটাশ দিনের মাথায় এই রান্না হয়ে থাকে। এই রান্নায় – চাপ চাপ ডাল, নারকেল ভাজা, চালতার টক, এবং বিজোড় সংখ্যার ভাজা থাকবেই। বাকি নিয়ম একই পুরুষানুক্রমে যেমন চলে আসছে।
* বুড়ো রান্না— বুড়ো রান্না নির্দিষ্ট দিনে হয়।ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির আগের দিন রান্না আর সংক্রান্তির দিন পান্না উৎসব চলে। মাসের শেষ দিনে হয় বলে এই রান্নার নাম- ” বুড়ো রান্না ” । বুড়ো রান্নার পান্নার দিন বিশ্বকর্মা পূজা হয়। সেকারণে বুড়ো রান্না বড় উৎসবের মর্যাদা পায়।
* হাওড়া জেলার সোলাঙ্কিরা শ্রাবণ মাসে এবং রাজবংশীরা আশ্বিন মাসে অরন্ধন উৎসব করে থাকে। তবে সারা হাওড়া জেলার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভাদ্র মাসে অরন্ধন উৎসব হয়ে থাকে। ভাদ্র মাসের বিভিন্ন দিনে এই উৎসব হয়ে থাকে।

শিক্ষক, আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ক্যুইজমাস্টার, ও সম্পাদক।জন্ম – পিয়ারাপুর, উদয়নারায়ণপুর, হাওড়া। পিতা ও মাতার নাম- ৺নিমাই ,৺ আল্পনা। শিক্ষাগত যোগ্যতা- ডবল এম এ( ভূগোল, এডুকেশন) , বি এড। পেশা- সহ শিক্ষক, বড়দা গঙ্গাধর হাইস্কুল। *সম্পাদক- হাওড়া জেলার কথা ও আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিক পলাশ সাহিত্য পত্রিকা।* সাহিত্য চর্চা- পাঁচারুল শ্রীহরি বিদ্যামন্দিরে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তে পড়তে লেখালেখি শুরু। বিভিন্ন ছোট পত্রিকা( মেটেফুল, অভিযান, পাঞ্চজন্য, শম্পা,সারঙ্গ আলো ভূমিজ ইত্যাদি), রং বেরং, দৌড়, আমি অনন্যা, তথ্যকেন্দ্র, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান এর মতো কয়েকটি বড় বাণিজ্যিক পত্রিকায় লেখা প্রকাশ পায়।সারা ভারতবর্ষ এবং আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বাংলাদেশ, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। রেডিও তে নিয়মিত কবিতা পড়া হয়। * FM Rainbow থেকে সেরা পলেসুর সম্মান লাভ। হাওড়া জেলা বইমেলা কমিটির সম্মান, হাওড়ার বঙ্কিম মেলার সম্মান, হাওড়ার সত্যজিৎ রায় জন্মোৎসব কমিটির সম্মান, এই সময় পত্রিকা সম্মান ছাড়াও অনেক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান ও পত্রিকা থেকে সম্মান লাভ। *প্রকাশিত বই- গৌর দাসের আখড়ার বোষ্টমি,একতারার সুর, উদয়নারায়ণপুর জনপদ কথা ( ব্যক্তিগত ভাবে) , ভূমি (একটি আবাদের গল্প),বোষ্টমী ও বাউল কথা। হাওড়া জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে নিরন্তর কাজ চলছে। *ওয়েবসাইটে হাওড়া জেলার কথা গ্রুপ ও পেজ নিয়ত জনপ্রিয় হচ্ছে।
বর্তমান ঠিকানা : কুলডাঙা, পাঁচলা, হাওড়া