| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি

নারী পুরুষের মিলন কাহিনী (পর্ব-২২)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

বিবাহ  মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ২২পর্ব।


যে ব্রহ্মার বরে রাবণের এত বাড়বাড়ন্ত, এত শক্তি, এত দম্ভ; সেই ব্রহ্মাই আবার রেগে গিয়ে অভিশাপ দিয়েছিলেন, “জোর করে কোনো মেয়ের সঙ্গে সঙ্গম করলে তোমার মাথা শত টুকরো হয়ে যাবে”!
কারণ, এই রাবণ এককালে পুঞ্জিকস্থলা নামের এক অপ্সরাকে জোর করে ধরে তাকে নগ্ন করেন। সেই ছিন্নভিন্ন মেয়ে তখন ব্রহ্মার কাছে অভিযোগ জানায়। রাজনীতি তো তখনও ছিল! কিন্তু ব্রহ্মা বলেন না, এ খদ্দেরের সঙ্গে এক বেশ্যার সমস্যা । এও বলেন না যে বেশ্যাবৃত্তি করে, তাকে জোর করলে কিছু হয় না! বরং মেয়েটি সুবিচার পায়, রাবণ অভিশপ্ত হন। এই অভিশাপের ভয়েই সীতার বেঁচে যাওয়া! তা নয়ত একটি মেয়ের পতিপ্রেম বা সতীত্বকে থোড়াই কেয়ার করে বিকৃতকামী ধর্ষকেরা! রাবণ, মনে রাখুন, তেমনই একজন ছিলেন! মধুসূদন দত্ত যতোই তাঁকে অসামান্য করে তুলুন না কেন, রাবণ এমন দাদা, এমন এক বাবা; যিনি নিজের কাম চরিতার্থ করতে নিজের বংশকে ধ্বংস করেছিলেন! বিভীষণ নিমিত্তমাত্র। আর স্বামী রূপে তিনি মন্দোদরীকে কতখানি অপমানিত করেছিলেন, তা কী আর বলার অপেক্ষা রাখে!
শুধু পুঞ্জিকস্থলা নয়, আরো এক মেয়ে। স্বনামেই খ্যাত। স্বর্গের আরেক অপ্সরা, সুন্দরী রম্ভা। দেবলোক জয় করবার জন্য তৈরি রাবণ কৈলাসে সসৈন্য এসেছেন। রাতে সবাই ঘুমিয়ে, ক্লান্ত। একা রাবণ জেগে, চারিদিকের শোভা দেখে মনে কাম জেগেছে।
সেই সময় রম্ভা সেজেগুজে চলেছে নলকূবরের ডাকে, যিনি রাবণের ছোট ভাই কুবেরের পুত্র । রাবণ তো দেখেই লাফ দিয়ে উঠলেন! এই তো, কাম মেটানোর উপায় পাওয়া গেছে! শুরু করে দিলেন তার শরীরী সৌন্দর্য্য বর্ণনা। বললেন “এমন সুন্দর তোমার জঘন, তোমার দুই উরুর মাঝে, এমন নরম কোমল নিতম্বের ওপর কে শোবে আজ? তুমি আজ আমারই। এই আনন্দ তো আমারই পাওয়া উচিত”। রাবণের কথা শুনে রম্ভা বেচারি কাঁপতে শুরু করল। বলল, “আমি আজকের জন্য আপনার পুত্রবধূ। কারণ আমি যাচ্ছি নলকূবরের কাছে। আমাকে ছেড়ে দিন দয়া করে! তিনি আমার জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করে আছেন”! 
রাবণ উত্তরে যা বললেন, তা এখনকার রাজনৈতিক নেতারা বলে থাকেন আর বহু মানুষের সমর্থনও পান — “অপ্সরাদের আবার পতি কি!! তোমরা বহু ভোগ্যা”! কেমন চেনা চেনা লাগছে না ডায়ালগ! মেয়েদের আপত্তিতে কবে কোন পুরুষ নিজেকে আটকেছে! যত চিৎকার তত আনন্দ, কারণ ধর্ষণ একটা বিকৃতি! সুতরাং রাবণ একটা পাথরের ওপর শোওয়ালো রম্ভাকে, ছিঁড়ে দিল তার মালা, ছুঁড়ে ফেলল তার গয়না! ধর্ষিত স্খলিত বিস্রস্ত রম্ভা যখন শেষ পর্যন্ত নলকূবরের কাছে গিয়ে পৌঁছল, সব জেনে ক্রোধে আরক্ত হয়ে তিনি অভিশাপ দিলেন রাবণকে। সেই এক অভিশাপ! অনিচ্ছুক কোন মেয়েকে জোর করলে রাবণের মাথা ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে!!
আর কুশধ্বজের মেয়ে বেদবতীর কথা তো জানেনই সবাই। সেই বেদবতী, যে বিষ্ণুকে পাওয়ার জন্য তপস্যা করছিল, অরণ্যে, একা! সেই তাপসীকে দেখেও রাবণ তার চুলের মুঠি ধরে টেনেছিল, ভেবেছিল একেও জোর করে ধর্ষণ করবে! কিন্তু ক্ষত্রিয় রাজার মেয়ে বেদবতী, তারও জোর কম ছিল না। রাবণের মুঠি থেকে চুল ছাড়িয়ে নিতে তিনি তলোয়ার দিয়ে এক কোপে চুল কেটে ফেললেন আর রাবণের সামনেই আগুন জ্বালিয়ে প্রাণত্যাগ করল সেই জ্বলন্ত আগুনে মেয়ে । বলে গেল, “আবার আসিব ফিরে, তোর বিনাশের তরে”। এই বেদবতীই সীতা, জনককন্যা। 
সুতরাং, রাবণকে মহিমান্বিত করতে চান যাঁরা, তাঁরা এসব ঘটনা চেপে যান। “এমন ঘটনা তো কতই ঘটে!!!” তাই না??!!
 রাম আবার নিন্দিত হয়েছেন তাঁর আরেকটি ডায়ালোগের জন্য। ইন্দ্রজিতকে মারার পর শোকাহত রাবণ যখন শক্তিশেল নিক্ষেপ করে লক্ষ্মণকে হতচেতন করে দিলেন। দুঃখে মনোবেদনায় কাতর রাম তখন বলে বসেন, “দেশে দেশে স্ত্রী পাওয়া যায়, কিন্তু এমন ভাই পাওয়া যায় না”! পুরোটা পড়ি না আমরা! পুরোটা হল “দেশে দেশে স্ত্রী পাওয়া যায়, দেশে দেশে বন্ধু পাওয়া যায় কিন্তু এমন সহোদর ভাই পাওয়া যায় না”!! আচ্ছা, শোকে বিহ্বল অবস্থায় এই কথা বলা কি খুব ভুল? যেখানে লক্ষ্মণ নিজের মাকে ছেড়ে, রাজৈশ্বর্য ছেড়ে, এমনকী ঊর্মিলাকে ছেড়ে দাদাবৌদির সঙ্গে, তাঁদের সেবা করার জন্য বনে এসেছেন, যাঁর কথা রাম-সীতা শোনেন নি বলেই এই দুর্ভোগ; তখন এই উক্তি কি বিরাট অন্যায়? এই একই কথা রাম কিন্তু আগেও বলেছেন, যখন যুদ্ধ শুরুর আগেই রাবণকে দেখতে পেয়ে নিজেকে আটকাতে না পেরে সুগ্রীব লাফিয়ে পড়ে রাবণকে আক্রমণ করে বসেছিলেন! পরে তা জানতে পেরে রাম সুগ্রীবকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “তোমার কিছু ভালো-মন্দ হয়ে গেলে সীতাকে পেয়েই বা কি হবে”!
আবার এই রামই সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে পড়ে গেছিলেন, যখন যুদ্ধের মাঝে মায়াবী ইন্দ্রজিত মায়া সীতা বানিয়ে তাকে মেরে ফেলেন সবার চোখের সামনে। কোনো ডায়ালগ নয়, হা হুতাশ নয়, কান্না নয়; রাম স্রেফ যুদ্ধক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন!
তাই, যদি এ কথা বলি, যে রাম সীতাকে ভালো বাসতেন না, তা কি অসম্ভব একটা ভুল কথা নয়! তিনি সীতাকে ভালো বাসতেন প্রাণতুল্যই;  কিন্তু বার বার দেখছি, পুরুষ ভালোবাসার থেকে অনেক সময় তার সামাজিক প্রতিষ্ঠাকে, নিজের যশকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ফেলে।
হ্যাঁ,  রামেরও রাজ্যলোভ ছিল। শুরু থেকে তার প্রমাণ আছে, যদিও পিতৃভক্তি তার ওপরে! তবু অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। রামের উচিত ছিল প্রজারা যখন সীতার দিকে আঙুল তুলছে, তখন সীতার সঙ্গে বেরিয়ে আসা। কিন্তু দুটো কারণে সেটা করতে পারেন নি। এক তো অবশ্যই রাজ্যলোভ, যদিও এই লোভ এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের মত শুষে খাওয়ার বদলে সুশাসনের লোভ! যে কোনো কাজের মানুষ এটা মানবেন, যে ভালোভাবে কাজ করার একটা লোভ থাকে। যেমন আমি পড়াতে ভালোবাসি, আমি চাইব যেভাবে হোক আমার পড়ানোর কাজটা বজায় থাকুক । দ্বিতীয় কারণটা সেই পিতা দশরথ। কেন জিজ্ঞাসা করছেন? আচ্ছা, ভাবুন তো, দশরথকে আমরা কি ভাবি? একটা কামুক স্ত্রৈণ বুড়ো! মজা কি বলুন তো, কোনো পুরুষ যদি তার স্ত্রীর কথায় ওঠে-বসে, তাকে আমরা স্ত্রৈণ বলে বিশ্রী হাসি, আমরা মেয়েরাও! তা বাবার সেই স্ত্রৈণ তকমা যেন কখনো তাঁর গায়েও না এসে পড়ে, তা দেখার জন্য সীতার প্রতি অকারণ নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন রাম । হ্যাঁ,  অবশ্যই রাম খানিক মেরুদণ্ডহীনও। তাই বারবার অন্যের চোখে ঠিক থাকতে গিয়ে সীতাকে অপমান করেছেন । বারবার তাঁর মনে হয়েছে কেউ যেন তাঁকে বাবার মতো স্ত্রৈণ বা কামুক না ভাবে! তবু ভাবুন তো, রাম তো অনায়াসে সীতাকে প্রথমেই ত্যাগ করতে পারতে অনায়াসে অন্য বিয়ে করতে পারতেন। করেন নি। যজ্ঞ স্ত্রী ছাড়া অসম্পূর্ণ থাকবে জেনেও সোনার সীতা বানিয়েছেন, তবু বিয়ে করেন নি অন্য কোনো মেয়েকে।
আর নিজের সমস্ত ভুল আচরণের জন্য হতাশার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে শেষে সরযূর জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছেন!
কোনো অবতার কি আত্মহত্যা করতে পারে? মানুষ পারে। তাই রাম এখন আমার কাছে দোষে-গুণে প্রেমে-অপ্রেমে একটা মানুষ, যে শেষটায় একেবারে ভেঙেচুরে গেছিলেন!
দিনের শেষে তাই রাম একজন মানুষ শুধু । 
আর রামায়ণ আর মহাভারত মহাকাব্য আরোও বেশি করে এই জন্য যে রামায়ণ ভগবানের অবতারকে আর মহাভারত স্বয়ং ভগবানকে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ রূপে দেখাতে সক্ষম হয়েছে।
তবু যখন রাবণবধ হলো, সীতাকে নিয়ে আসা হলো আর রাম বললেন সীতাকে সবার সামনে হেঁটে তাঁর কাছে আসতে, এবং সবার সামনেই বললেন, “তোমার মতো অপরূপাকে হাতে পেয়ে রাবণ তো ছেড়ে দেয় নি, সুতরাং তোমাকে আর ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তুমি বরং এক কাজ করো, লক্ষ্মণ ভরত শত্রুঘ্ন সুগ্রীব বা বিভীষণ, যাকে খুশি বিয়ে করো গে!” কেমন প্রলাপ বকা দেখুন! সীতাকে ফিরিয়ে নিলে যদি বংশ কলঙ্কিত হয়, তাহলে ভাইদের সঙ্গে তাঁর বিয়ের প্রস্তাবই বা দেন কি করে!! অর্থাৎ মাথায় তখন শুধু ঘুরছে, কেউ যেন তাঁকে আদেখলাপনার অভিযোগ করতে না পারে! এই রামই কিন্তু যখন একা লক্ষ্মণের সঙ্গে ছিলেন, সীতাবিহনে কী বিলাপটাই না করেছেন! কিন্তু এখন সংযম দেখাতে হবে, দেখাতে হবে স্ত্রীর জন্য তিনি মোটেই বিচলিত নন! 
ভাববেন না, সীতা রামের কথা শুনে কান্না ধরলেন! তিনিও সবার সামনেই বললেন, “ছোটলোকের মতো কথা বলছ তুমি! এই যদি তোমার মনের কথা হয়, হনুমানকে যখন পাঠিয়েছিলে, তখনই বলতে যে আমাকে তুমি আর গ্রহণ করবে না ঠিক করেছ! আমাকে কেউ জোর করে অপহরণ করলে আমার দোষ কোথায়!! তোমাকে লোকে চরিত্রজ্ঞ বলে! কই, আমার মহৎ চরিত্র তো তুমি বুঝলেই না।” এই বলে লক্ষ্মণকে বললেন চিতা তৈরি করতে। সেই চিতায় প্রবেশ করামাত্র অগ্নিদেব সীতাকে কোলে নিয়ে রামকে ফিরিয়ে দিলেন।তখন আবার রাম বললেন, “আমি তো জানি। রাবণ মনে মনেও সীতাকে ধর্ষণ করতে পারবে না”! মেরুদণ্ড না থাকলে মানুষ ঠিক এমনভাবেই বলে থাকে!! তাই না?
[চলবে]
আগের সবকটি পর্ব পড়তে ও ড. রোহিণী ধর্মপালের অন্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত