লেখায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করাটা জরুরি: হুমায়ূন আহমেদ
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী: কাঠপেন্সিল বইয়ের ভূমিকায় আপনি লিখেছেন, ‘বলপয়েন্ট’, ‘কাঠপেন্সিল’ সহজিয়া ধারার লেখা। শেষপর্ব ‘ফাউনটেনপেন’ হবে কঠিনিয়া। কঠিনিয়া ব্যাপারটা আসলে কী?
হুমায়ূন আহমেদ: কাঠপেন্সিলের লেখা রাবার দিয়ে মুছে ফেলা যায়। ফাউনটেনপেনের লেখা মুছে ফেলা কঠিন। বোধ হয় সে অর্থে বলা। ফাউনটেনপেন ধরনের লেখা লেখার জন্য বয়সটা মনে হয় আরেকটু বেশি হওয়া দরকার। দেখি কতদিন টিকে থাকা যায়।
ইকবাল: বৃদ্ধ বোকা সংঘের প্রসঙ্গ অনেকবার এসেছে কাঠপেন্সিল-এ। এই সংঘের শুরুটা কীভাবে?
হুমায়ূন আহমেদ: ধানমন্ডির দখিন হাওয়ায় তখন আমি একা থাকি। আগের গিন্নির সঙ্গে একটা সমস্যার কারণে আমি ছিলাম একরকম পরিবার থেকে বিতাড়িত। সেই সময়ে একাকিত্ব কাটানোর জন্য আমি আমার বন্ধুবান্ধবদের কাছাকাছি নিয়ে আসার একটা চেষ্টা করলাম। আলমগীর রহমান, মাজহার, করিম—ওরা সবাই আমার কাছাকাছি বাসায় থাকতে শুরু করল। সন্ধ্যা হলেই ওরা সবাই আমার এখানে এসে বসত। বাড়িতে গৃহিণীরা থাকলে তারা তো আড্ডা দিতে দেয় না। আমার এখানে সে অসুবিধে নেই। আড্ডায় প্রায় সবাই মোটামুটি বৃদ্ধ। তাই নাম দিলাম বৃদ্ধ বোকা সংঘ বা ওল্ড ফুলস ক্লাব। বৃদ্ধ বোকা সংঘের সদস্য হওয়ার বিশেষ কোনো শর্ত নেই। শুধু বৃদ্ধ আর বোকা হওয়াটা জরুরি।
ইকবাল: বলপয়েন্ট এবং কাঠপেন্সিল দুটো বইই সুখপাঠ্য। আত্মস্মৃতি উপভোগ্য করে লেখার কৌশলটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ: কোনো সূত্র তো বলতে পারি না। লেখালেখির কৌশল জেনে যদি বড় লেখক হওয়া যায় তাহলে রবীন্দ্রনাথের পরে সবচেয়ে বড় লেখক হতেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ছেলে। সেটা হয়নি। সহজ এবং আন্তরিকভাবে যদি লেখা যায় সে লেখা অবশ্যই ভালো হবে। যেটা লিখছি, সেটা বিশ্বাস করে লিখতে হবে। লেখায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করাটা জরুরি। এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। আমার ছেলেবেলা এবং কিছু শৈশব—এ দুটো স্মৃতিকথা লিখে আমি নিজে খুব আনন্দ পেয়েছি।
ইকবাল: কাঠপেন্সিলে রাইটার্স ব্লক নিয়ে একটা অধ্যায় আছে। আপনার কখনো ‘ব্লক’ হয়নি ভেবে আপনি মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদ: এখনো আমি ব্লকের মধ্যে আছি। আমি চাই যে প্রতি মেলায় হিমুর একটা বই থাকুক। পয়লা ফাল্গুন হিমুর একটা বই প্রকাশ করার ইচ্ছে ছিল। এবার এত চেষ্টা করলাম, হলো না। বারবার কাহিনি পাল্টাচ্ছি, কিন্তু হচ্ছে না। এবার নুহাশ পল্লিতে আসার প্রধান কারণ হিমুর উপন্যাসটা শেষ করা। দেখি পরিবেশ-টরিবেশ বদলে যদি কিছু লাভ হয়।
ইকবাল: বইমেলায় আপনি খুব কম যান। কোনোদিন আপনি গেলেই মহা হুুলস্থুল পড়ে যায়।
হুমায়ূন আহমেদ: ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের নাম লেখার মতো ক্লান্তিকর কাজ আর আছে কিনা আমি জানি না। আবার মেলায় অন্যরকম বিড়ম্বনা তো আছেই। ধরো, এক অটোগ্রাফ শিকারি বালককে জিজ্ঞেস করলাম— তোমার নামের বানান কী? সে নিজেই সবকিছু গুলিয়ে ফেলল। হতবিহ্বল হয়ে তার মাকেই জিজ্ঞেস করল—মা আমার নামের বানান কী? যাই হোক, নাম লিখে দিলাম। তারপর বলল, স্যার, আপনার হাতটা একটু ধরি। বললাম, ধরো। এদিকে পেছন থেকে অন্য লোকজন সমানে ধাক্কাচ্ছে। আমার ওপরেই টেবিল ভেঙে পড়ার জোগাড়। একটা বয়সে এসব ভালো লাগত।
ইকবাল: কাঠপেন্সিল বা বলপয়েন্টে অনেক ঘটনা আপনি লিখেছেন। এর বাইরে বলার মতো কোনো ঘটনা কি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, যেটা লেখা হয়নি?
হুমায়ূন আহমেদ: সেবার চট্টগ্রামে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমাকে খুব আদরযত্ন করে নিয়ে যাওয়া হলো। গিয়ে বুঝলাম, জীবনে যত বোকামি করেছি, তার মধ্যে এটা অন্যতম। একজন বক্তা মঞ্চে গেলেন আমার সম্পর্কে বলতে। ভদ্রলোক যা বললেন তার সারবস্তু হচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের পাঠকদের সবাই ‘পোলাপান’ এবং এই লেখক শুধু মধ্যবিত্তদের নিয়ে লেখেন। উনি মাঝিদের নিয়ে কিছু লেখেননি। খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে কিছু লেখেননি। যিনি বলছেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। একসময় আমার বন্ধুমানুষ ছিলেন। অকস্মাত্ এই কঠিন আক্রমণে আমি যাকে বলে হতবাক। তার চেয়ে বেশি অবাক হলো অনুষ্ঠানে আগত দর্শকেরা। দেখলাম, তারা এই মন্তব্য নিতে পারছে না। আমি বক্তৃতা দিতে উঠে অতি বিনয়ের সঙ্গে জানালাম—এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক যাকে বলা হয় তিনি সারা জীবন রাজা-বাদশা-রাজকন্যা ছাড়া অন্যদের নিয়ে কিছুই লেখেননি। আমি তো তাও মধ্যবিত্ত নিয়ে লিখি। উনি তো রাজা-বাদশার নিচেই নামেননি। তাঁর নাম উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। লেখকের যদি ক্ষমতা থাকে তিনি যেকোনো বিষয় নিয়ে ভালো লিখতে পারেন। কোন বিষয় নিয়ে লিখছেন সেটা নয়। লেখকের ক্ষমতা কতটুকু সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। লেখক হতে হলেই শুধু মাঝিদের নিয়ে লিখতে হবে, এই যুক্তি ভুল যুক্তি। মানুষের সম্পর্কটা আসলে গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্ক রাজা-রানির বেলায় যা মধ্যবিত্তদের বেলায়ও তা।
ইকবাল: কাছের-দূরের, খ্যাত-অখ্যাত বহু মানুষজনের কথা আপনি স্মৃতিকথায় লিখেছেন। এই লেখালেখির কারণে কোনো বিড়ম্বনায় কি পড়তে হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ: আমার প্রথম ছবি আগুনের পরশমণি তৈরির সময়কার কথা। সংগীত পরিচালক সত্য সাহা একদিন আমার কাছে এলেন। বললেন, আমি এতদিন কাজ করছি কিন্তু একটা জাতীয় পুরস্কার পেলাম না। এবার ভালো একটা কাজ করতে চাই। তাঁর কথা শুনে আমার খারাপ লাগল খুব। তাঁর ছাত্ররা সবাই জাতীয় পুরস্কার পেয়ে গেছে। তিনি এত গুণী একজন শিল্পী, জাতীয় পুরস্কার পেলেন না! কিন্তু এর মধ্যে আমি মিন্টুকে কথা দিয়ে ফেলেছি। একরকম নিয়ম ভঙ্গ করে মিন্টুকে বাদ দিয়ে সত্য সাহাকে নিলাম। সে বছরের জাতীয় পুরস্কারটা তিনিই পেয়েছিলেন। সত্য সাহাই খবরটা আগে ফোনে আমাকে জানিয়েছিলেন। পরদিন একদম ভোরবেলায় মিষ্টি নিয়ে তিনি চলে এলেন আমার বাসায়। এত আনন্দিত মনে হচ্ছিল তাঁকে। আমি সেই ঘটনা আমার বইয়ে লিখলাম। লেখাটা তিনি নিতে পারলেন না। বললেন—তিনি তো পুরস্কারের জন্য কাজ করেননি। এটা একটা কষ্টের ঘটনা। কে ইচ্ছে করে অন্যকে আঘাত করতে চায় বলো?
ইকবাল: মানুষের স্বল্প আয়ু নিয়ে আপনার দুঃখবোধ আছে।
হুমায়ূন আহমেদ: অবশ্যই। আমি অন্তত ১০০০ বছর বেঁচে থাকতে চাই। বাঁচতে চাই মানুষের বিজয় দেখার জন্য। একটা সাধারণ কচ্ছপ ৩০০-৪০০ বছর বাঁচে। অথচ মানুষের মতো বুদ্ধিমান একটা প্রাণী বাঁচে বড়জোর শখানেক বছর। বিশাল দুঃখের ব্যাপার।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০১০