| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

হৃদয়ঙ্গম

আনুমানিক পঠনকাল: 32 মিনিট
 
বিছানায় শুয়েই সূর্য টের পেল বউদি দাদাকে তাতাচ্ছে। ওপাশের বারান্দায় খাওয়ার টেবিল। দাদা ব্রেকফাস্ট খায় টেবিলে বসে। এইসময় বউদি একপ্রস্থ চুকলি কাটবেই। দাদাটা সচরাচর কিছু বলে না। ওই এক অদ্ভুত লোক। অত চুকলি কী করে হজম করে কে জানে। চুকলির নমুনাগুলো মজার। কাল রাত্রে বারোটা পর্যন্ত সূর্য আলো জ্বেলে রেখেছিল। বাপের বাড়ির একটা খবর নিতে বলেছিল বউদি কিন্তু সূর্য যায়নি। সকালে গ্যাস ধরাতে পারিনি কালীর মা না আসা পর্যন্ত। রান্নাঘরে দেশলাই রেখেছিল কালকেও, সকালে দেখি নেই। কালীর মাকে দোকানে পাঠিয়ে আনতে হল। তুমি এত রোজগার করো, এক-আধটা সিগারেটও তো খেতে পারো, তাহলে আমার দেশলাই-এর কষ্ট হত না।
 
মা মারা গেছেন অনেকদিন। বাবা বছর দুয়েক। বাড়িটা পৈতৃক। হ্যাঁ একথা ঠিক, সূর্য চাকরিবাকরি করে না। কিন্তু প্রতি মাসে একশোটি টাকা খাই-খরচা দেয়। দাদা বলেছিল দরকার নেই কিন্তু তবু সে দেয়। দিলে বেশ ভালো লাগে। খাওয়াটা নিজের খাবার বলে মনে হয়।
দাদা খেয়ে-দেয়ে ভেতরে চলে গেলে সূর্য উঠল। শনি-রবিবার দাদার ছুটি। এই দুটো দিন খুব বিশ্রী কাটে সূর্যর। দাদার সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য প্রায় বারো। কিন্তু চিরকালই দূরত্ব অনেক। মুখ ধুয়ে আসার মুখে সে কালীর মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপ আর দুটো থিন অ্যারারুট বিস্কুট নিল। টেবিল থেকে খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এসে আরাম করে জাঁকিয়ে বসল।
 
পেছনের পাতাটা খুলেই চোখ কুঁচকে উঠল তার। বিহারের বিরুদ্ধে বাংলার অধীপ ব্যানার্জী সেঞ্চুরি করেছে। অধীপের ছবিও ছেপেছে কাগজে। এই অধীপের সঙ্গে তার কখনও আলাপ নেই। তবু খুব খারাপ লাগছিল সূর্যর। ছবি এবং খবর বলছে অধীপ তারই বয়সি। একেবারে সেঞ্চুরি করে ফেলল? নিরানব্বইতে আউট হতে তো পারত। ধরা যাক ইন্ডিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়ান ডে হচ্ছে। এর আগে তিন-তিনটে ওয়ান ডে-তে ইন্ডিয়া হেরেছে। ইডেনে ম্যাচ। আগের বিকেলে সে সোজা বাপু নাদকার্নির সঙ্গে দেখা করল, একজন ইন্ডিয়ান হিসেবে বলছি এভাবে ভারতকে বেইজ্জত করার কোনও রাইট আপনার নেই।
সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান নাদকার্নি হতাশ গলায় বললেন, কি করব ভাই। টিমে একটা ভালো বোলার নেই, একটা ব্যাটসম্যান নেই যার ওপর নির্ভর করতে পারি। এই নিয়ে লড়তে হচ্ছে।
 
সূর্য বলল, নেই মানে? আপনি টিমকে জেতাতে চাইলে আমি খেলতে রাজি।
 
বাপু অবাক, আপনি খেলেন?
 
সূর্য হাসল, কাজে দেখাব। কথা দিচ্ছি টিম জিতবেই।
 
বাপু আগ্রহী হন, আপনি কি রঞ্জিতে খেলেছেন?
 
না। রঞ্জি, ক্লাব কোনও কিছুতেই খেলিনি আমি। ফালতু খেলাখেলি করে সময় নষ্ট করার লোক আমি নই। ইন্ডিয়া বিপন্ন তাই এগিয়ে এসেছি। আপনার মুখ বাঁচাতে চান তো আমাকে নিন।
 
পরের দিন কাগজে খুব লেখালেখি হল। ইন্ডিয়া টিমে সূর্য মিত্র নামে যাকে ঢোকানো হয়েছে তার ইতিহাস কী। সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল। পাড়ার মালতি লন্ড্রি থেকে একজোড়া সাদা শার্ট প্যান্ট ধার নিয়ে সে যখন সাড়ে আটটায় মাঠে পৌঁছল তখন বাপু দুটো হাত জড়িয়ে ধরলেন, আমার মুখ রাখবেন। আপনি যদি ডুবিয়ে দেন তো সবাই আমাকে ছিঁড়ে খাবে।
বেঙ্গসরকার টসে জিতে ব্যাটিং নিল। দলের কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে না। ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করল, আপনি শুনলাম ফাস্ট বোলিং করেন। আট নম্বরে ব্যাট করতে নামবেন।
 
প্রায় এক লক্ষ লোক দেখল ভারতীয় ব্যাটসম্যান ক্রিজে যাচ্ছে আর ফিরে আসছে। সাত উইকেটে পঁয়ত্রিশ, ওভার তখন উনিশ। সূর্য প্যাড পরতে লাগল। ফিতেগুলো বাঁধতে সে একটু হিমশিম খেল। শিরস্ত্রাণ মাথায় তুলে অস্বস্তি বেড়ে যাওয়ায় সেটাকে রেখে দিয়ে ব্যাট হাতে মাঠের দিকে এগোতে লাগল। একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। সবার কৌতূহল বেড়ে গিয়েছিল দেরি দেখে। সূর্যকে দেখামাত্র হাততালির ঝড় উঠল। এই প্রথম কোনও বাঙালি খেলোয়াড় ওয়ানডে খেলতে নামছে ইডেনে। হঠাৎ হাঁটুদুটো কেঁপে উঠল। প্যাটারসনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়। কলজেটা নড়ে উঠল। উইকেটের ও-প্রান্তে টিকে আছে অমরনাথ। এগিয়ে এসে ইংরেজিতে বলল, আমাকে ফেস করতে দিয়ো, তুমি চেষ্টা করো অ্যাভয়েড করতে।
 
কথাটা খুব মনে ধরল সূর্যর। কিন্তু শেষ বলটা তো তাকেই ফেস করতে হবে। ইডেন এখন স্তব্ধ। হাঁটুর কাঁপুনি এখন সমস্ত শরীরে। দৈত্যের মতো তেড়ে আসছে প্যাটারসন। বলটাকে বুঝতে পারার আগেই হাততালি উঠল। উইকেটকিপারের হাতে বল। ফিল্ডিং চেঞ্জ হচ্ছে। সে নড়েনি। ব্যাট চালায়নি। অথচ বল হয়ে গেল। পাবলিক কী বুঝল কে জানে। পরের ওভার করল গার্নার। অমরনাথ কোনওমতে ঠেকিয়ে গেল। রান হল না। সূর্য হাসল, এই যদি ফেস করার নমুনা হয়। তো সেই নিজেই ওটা করতে পারে। সোজা ব্যাট নিয়ে ঝুঁকে পড়ল সূর্য। প্যাটারসনের বলটা গুড লেংথে পড়ছে। দ্রুত এগিয়ে সে মরীয়া হয়ে ব্যাট চালাল। চিৎকারে কান ঝালাপালা হওয়ার। জোগাড়। আম্পায়ার মাথার ওপরে হাত তুলেছেন। ছয়। প্যাটারসন রাগি মুখে দ্বিতীয়বার তেড়ে এল। অফ স্টাম্পের বাইরে বল পড়ে আরও বেরিয়ে যাচ্ছিল। সূর্য ঘুরে গিয়ে ব্যাট চালাল। ছয়। পরপর পাঁচটা ছয় মারার পর ফিল্ডাররা চলে গেল বাউন্ডারি লাইনে। ষষ্ঠ বলটা ব্যাট তুলে পায়ের কাছে ফেলে রান নেওয়ার জন্যে ছুটল সে। অমরনাথ ভাবেনি এতে রান হয়। সাত উইকেটে ছেষট্টি, সূর্যর একত্রিশ। এবার গার্নার। পরপর পাঁচ বলে তিরিশ। শেষ বলে এক। দু ওভার ব্যাট করে সুর্যর রান বাষট্টি, বাইশ ওভারে ইন্ডিয়ার রান সাতানব্লুই। অ্যাভারেজ তখন। প্রায় সাড়ে চার। পঞ্চাশ ওভার পর ভারত ফিরে এল সাত উইকেটে নশো চল্লিশ। সূর্য নট আউট নশো। পৃথিবীর সব কালের রেকর্ড। গ্যালারি থেকে সোবার্স নেমে এসে করমর্দন করলেন। মাঠ তখন পাগল। বাপুনাদকার্নি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। গম্ভীর মুখে চেয়ারে বসল সূর্য। বলে দিল খেলা শেষ হওয়ার আগে সে কাউকে অটোগ্রাফ দিতে পারবে না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট করতে নেমে রানের তুফান তুলল। কপিল আর শর্মার বল মেরে ছাতু। তিন ওভারে ষাট রান। এগিয়ে গেল সূর্য বেঙ্গসরকারের কাছে। একটু অনিচ্ছায় বল তার হাতে তুলে দিল ক্যাপ্টেন। গ্রিনিজ উইকেটে। দূর থেকে ছুটে এসে আঙুল টেনে দিল সূর্য। বলটা গুড লেংথে পড়ে মাটি আঁকড়ে ধরে গ্রিনিজের পাশ কাটিয়ে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘুরে উইকেট উড়িয়ে দিল। যে চিৎকার উঠল ইডেনে তা বর্ধমান থেকেও শোনা গিয়েছিল। এক ওভারে ছটা উইকেট। ডাবল হ্যাট্রিক। পরের ওভারে হেনেস কপিলের বলে একটা রান নিল। সূর্যর দ্বিতীয় ওভারের প্রথম খদ্দের সে। দশটা বল করতে হল সূর্যকে। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ তো সে-ই। কিন্তু পুরস্কার নিতে আসতে তাকে দেখা গেল না। বদলে এক অফিসার একটি চিরকুট এগিয়ে দিলেন বাপু নাদকার্নির দিকে। তাতে লেখা আছে, ইন্ডিয়া জিততে পারে দেখিয়ে দিলাম। পুরস্কার-টুরস্কার নিতে আমার ভালো লাগে না। খেলাখেলি নিয়ে সময় কাটাতেও না। অতএব আমি চললাম। আমাকে আর খেলতে ডাকবেন না। দোহাই। সূর্য মিত্র।
 
*
 
চোখ খুলল সূর্য। তৃপ্ত মুখে খবরের কাগজ সরিয়ে ঠান্ডা হয়ে আসা চায়ের কাপে চুমুক মারল। যেন এইমাত্র একটা স্বপ্নের ইনিংস খেলে এল সে। এরকমটা হতে পারত যদি স্কুলে ক্রিকেট খেলার রেওয়াজ থাকত। হয়নি তাই বলে হতে পারবে না এ কেমন কথা! সূর্য নিশ্বাস ফেলল। ভাবতে যা এত ভালো লাগে তা জীবনে হয় না কেন? সে কখনও ক্রিকেটের ব্যাট হাতে নেয়নি, যেখানে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা হয় সেখানে থাকলে কথা বলতে ঠিক সাহস পায় না, কিন্তু একা থাকলে এইরকম ছবি স্বচ্ছন্দে এঁকে ফেলতে পারে।
 
সূর্য মাঝে-মাঝে খুব অসহায় হয়ে যায়। তার কোনও বন্ধু নেই। স্কুল কলেজে দু-তিনজনের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। কিন্তু কারও সঙ্গে মন খুলে বন্ধুত্ব করা তার কিছুতেই হয়ে ওঠে না। এখন সুব্রতর সঙ্গে তার সংযোগ আছে। দেশ পত্রিকায় সুব্রতর গল্প ছাপা হয়, একটা স্কুলে পড়ায়। এর মধ্যে অন্তত তিনটে প্রেম করেছে সুব্রত। ওর সঙ্গে দেখা করতে কলেজ স্ট্রিটের চায়ের দোকানে সে যায়। কিন্তু দুসপ্তাহ আগে সুব্রত যখন বলল, দ্যাখ সূর্য, তোকে একটা কথা বলি, তোর এই কমপ্লেক্স তাড়া। সবসময় ভাবছিস পৃথিবীর সবাই তোকে ইগনোর করছে আর তাই কারও সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারছিস না। যা ভাবিস তা কাউকে বলতে পারিস না। তুই মরে যাবি শালা!
 
 
গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল সূর্য। তারপর আর যায়নি কলেজ স্ট্রিটে। সুব্রতটা আজকাল নিজেকে কেউকেটা ভাবতে শুরু করেছে। সে নিজে যদি গল্প লিখতে শুরু করে! সূর্য একটা ছবি এঁকে নিল। উপন্যাসের ম্যানাসক্রিপ্ট-এর বিষয় সে সুব্রতকে বলেছিল। সুব্রত আনন্দবাজারে গিয়ে তাই নিয়ে গল্প করেছিল। সম্পাদক সেটা শুনেই এত উত্তেজিত যে সূর্যর বাড়িতে ছুটে এসেছিলেন। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে ভদ্রলোককে ম্যানাসক্রিপ্ট দিয়েছিল সূর্য। সেটা পত্রিকায় ধারাবাহিক বেরোতেই পাঠকমহলে হইচই পড়ে গেল। তাকে সবাই বাংলা সাহিত্যের আলেকজান্ডার বলতে লাগল। এইসময় পেঙ্গুইন থেকে টেলিফোন, আপনার উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ বের করতে চাই। সেটাও বেরুল সাগরপার থেকে। সঙ্গে আমেরিকা ইংলন্ডের সমস্ত কাগজের বেস্ট সেলার লিস্টের এক নম্বরে তার নাম। এক বছরে তার রয়ালটি হল পাঁচ। লক্ষ পাউন্ড। তারপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রকাশক এ বাড়ির দরজায়। সে সবাইকে বলে দিচ্ছে, লেখালেখি আর ভালো লাগে না, সে লিখবে না।
 
পোশাক পালটে তৈরি হয়ে নিল সূর্য। তিরিশ মিনিটের মধ্যে ছাত্রের বাড়িতে পৌঁছোতে হবে। আজ অবধি কখনও সে দেরি করে ওখানে যায়নি। পকেটে এখনও সাত টাকা তিরিশ পয়সা। পড়ে রয়েছে। মাইনে পেতে দিন দশেক দেরি। চাকরি-বাকরি যতক্ষণ জুটছে না ততক্ষণ টিউশনি দুটোই ভরসা। সকালেরটা হেঁটেই যাওয়া যায়, বিকেলেরটা বেলেঘাটায়। জামার কলারটা। ফাটব-ফাটব হয়ে এসেছে। সেলাই করে দেওয়ার লোক এ বাড়িতে নেই। ভালো জামাপ্যান্ট এখন একটাতে ঠেকেছে। সাতটা চাকরির দরখাস্ত এখনও ঝুলছে। আশা-টাশা করা সে ছেড়ে দিয়েছে।
 
দরজায় শেকল তুলে বারান্দায় পা দিতেই বউদিকে দেখতে পেল। আড়চোখে তাকে দেখে নিয়ে ভদ্রমহিলা এমন উদাস ভঙ্গিতে চলে গেলেন যে সূর্যর পিত্তি জ্বলে উঠল। সুন্দরী বলে খুব অহঙ্কার আছে ওই মহিলার। দশবছর বিয়ে হয়েছে, স্বাস্থ্য এখন মোটার দিকে তবু হাঁটাচলা দেখলে কচি খুকি বলে মনে হয়। প্রথমদিকে খুব ভাব ছিল সূর্যর সঙ্গে। কিন্তু যেই সূর্য বুঝল তার পয়সায় সিনেমা দেখা রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার মতো সুখ বউদি আর কিছুতেই পায় না তখন থেকেই নির্লিপ্ত হয়েছিল। এবং তারপর থেকেই বউদি তাকে দেখতে পারে না। সুব্রতর একটা কথা মনে পড়ল তার, তোকে তোর বউদি নিশ্চয়ই অমল ভাবত, তুই তো একটা গাধা তাই চান্স নিতে। পারলি না।
চান্স নিতে বয়ে গেছে তার। সে কি ইচ্ছে করলে প্রচুর মেয়েবন্ধু নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত না? এই তো ওপাশে মিত্তিররা থাকে। তাদের ছোটমেয়ে এমনভাবে তাকাত যে সে ডাকলেই দেখা করত। সে ডাকেনি বলেই তো মেয়েটা মাসতুতো ভাই-এর বন্ধুর সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করে ফেলল। অবশ্য এটা ঠিক, মানে ওপর থেকে দেখলে লোকে ভাববে যে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার জিভ শুকিয়ে আসে। ঠিক বউদি ছাড়া কোনও কিশোরী বা যুবতী কখনও তার সঙ্গে এগিয়ে এসে কথা বলেনি। এই নিয়ে সুব্রত তার পেছনে লাগে। বলে, তুই শালা একটা। মরুভুমি। জবাবটা দেয়নি সে। সুব্রতর মতো জামা পালটানো প্রেম করার রুচি তার নেই, এটা অবশ্য বলবে ভেবেছিল তখন। তিনদিন পরে একটু নরম করে কথাটা জানাতে সুব্রত মাথা নেড়েছিল, নাচতে জানিস না তাই উঠোনটাকে বাঁকা বলছিস। আসলে তোর ভেতরে এত কমপ্লেক্স যে কোনও মেয়ে কাছে ভিড়বে না।
 
এই কমপ্লেক্স শব্দটাকে ঠিকঠাক বুঝতে পারে না সূর্য। হ্যাঁ এটা ঠিক, আর পাঁচটা ছেলের মতো সে ঝটপট কিছু করতে পারে না। কিন্তু ভাবতে তো পারে। কাল রাত্রেও বাড়ির সামনে টাঙানো সিনেমার বিরাট হোর্ডিং থেকে নায়িকা নেমে এসে তাকে বলেছিল, আপনি এত একা কেন?
 
সে গম্ভীর গলায় জবাব দিয়েছিল, আমি একা কোথায়? রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমার সঙ্গী।
 
নায়িকা বলেছিল, আমি আপনার পাশে বসব?
 
সে জবাব দিয়েছিল, এখানে, মানে আমার এই ঘর কি আপনার উপযুক্ত?
 
নায়িকা চুলে হাত দিয়ে ঘাড় কাত করে হেসেছিল, যেখানে আপনি থাকবেন সেটাই আমার জায়গা।
 
সে বলেছিল, কিন্তু দু-দিন পরেই তো আপনি চলে যাবেন। ওরা হোর্ডিং খুলে ফেলবে ছবিটা উঠে গেলেই। তখন? দোহাই, আমাকে স্বপ্ন দেখাবেন না।
 
নায়িকা এগিয়ে এসেছিল কাছে, না গো, এর পরের ছবি, যার হোর্ডিং ওখানে লাগবে, তার নায়িকাও আমি। আমার হাতে এখন অনেক ছবি। তোমার জীবনে হোর্ডিং-ছাড়া হব না আমি।
 
তারপরেই বিহুল চোখে নায়িকা তাকে প্রশ্ন করেছিল, বলো তো প্রেমের সার্থকতা কীসে?
 
সে জবাব দিয়েছে, দানে। নিজেকে উজাড় করে দেওয়ায়। পাওয়ার আশা না করে।
 
দু-আঙুলে তার থুতনি ছুঁয়ে নায়িকা বলল, তাই করো গো। দান করো উজাড় হয়ে।
 
বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু-পাশ দেখে নিল সূর্য। ওপাশের রকে কয়েকটি মস্তান আড্ডা মারছে। ওরা ওকে দেখতে পেলেই ইদানীং টিপ্পনী কাটে। যেহেতু এ পাড়ায় তার কোনও বন্ধু নেই তাই। পেছনে লাগতে ওরা সাহস পায়। দূর থেকেই আওয়াজটা কানে এল, এসো খুকু, এসো। কান। লাল হয়ে গেল সূর্যর। সে ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল ছেলেগুলোর দিকে। ওরা কিছু বলার আগেই সে অমিতাভ বচ্চনদের ওপর শরীর চালাল। সে যেন ব্রুসলি হয়ে গেছে ততক্ষণে। দু-মিনিটের। মধ্যে প্রতিটি ছেলে হাঁটু মুড়ে বসে হাতজোড় করে বলতে লাগল, গুরু ছেড়ে দাও, আর কখনও তোমার পেছনে লাগব না।
 
 
হঠাৎ সূর্যর মনে হল জায়গাটা পেরিয়ে এসেছে সে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক চিৎকার করে ওদের। গালাগালি দিচ্ছেন। বৃদ্ধর সঙ্গে যে কিশোরীটি আসছিল তার উদ্দেশেই কি কথাটা ছুঁড়েছিল ওরা? তাকে কি ওরা আজ ধর্তব্যের মধ্যেই ধরেনি? কিন্তু যদি কোনওদিন ওরা কিছু বলে, তাহলে একদিন-না-একদিন সে সত্যি ব্রুসলি হয়ে যাবে। ঘড়ি দেখল সূর্য। একটু দেরি হয়ে গেছে। ছাত্রের পিসি কথা শোনাতে ছাড়বে না। অমন কুশ্রী মহিলা কোন বিধাতার সৃষ্টি, তাই মাঝে-মাঝে জানতে ইচ্ছে করে। দ্রুত পা চালাল সে।
 
দূর থেকে গাড়িটাকে দেখতে পেল সূর্য। লাল টুকটুকে মারুতি ওদের পাড়ার শেষ প্রান্তের একটি বিশাল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এবার বাড়ির দরজা খুলে যে মেয়েটি বেরিয়ে এল তার হাঁটা, ফিগার দেখে বুকের মধ্যে ড্রাম বাজতে লাগল। একটা মোটা বই হাতে নিয়ে মেয়েটি গাড়িতে উঠে বসতেই সেটা মসৃণ ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। কিন্তু সূর্যর মনে হল গাড়িতে ওঠার মুহূর্তে মেয়েটির বই থেকে কিছু একটা পড়ে গেল। সে বাড়িটার সামনে এসে বস্তুটিকে কুড়িয়ে পেল। একটা লাইব্রেরির কার্ড। মানসী সোম। ঠিকানাটাও এই বাড়ির। কার্ডের একপাশে মেয়েটির ছবি। অপূর্ব! এইরকম মেয়ে কি ওই একই ভগবান সৃষ্টি করেছেন? ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে প্রায় নীরক্ত হয়ে গেল সূর্য। একটি কবিতার লাইনকে ঘুরিয়ে ভাবল সে, এইরকম একই মুখের জন্যে তিন জন্ম হেঁটে আসা যায়।
 
কিন্তু যার ছবি, সে তো চলে গেছে অনেকক্ষণ। কার্ডটাকে নিয়ে কী করবে সূর্য? আবার মাটিতে ফেলে যেতে খারাপ লাগছে। বাড়িটার দরজা আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নেমপ্লেটের গাম্ভীর্য। তাকে সন্ত্রস্ত করল। একজন রিটায়ার্ড ব্রিগেডিয়ার থাকেন ও বাড়িতে। পরক্ষণেই মনে হল ব্রিগেডিয়ার তো তার কি? সে কার্ড কুড়িয়ে পেয়েছে তাই ফেরত দিতে বেল বাজিয়েছে। ব্যস! আর একটা কাজ অবশ্য করা যায়। কার্ডটা নিয়ে গিয়ে সুব্রতর হাতে দিলে সে এসে ফেরত দিতে পারে। কিন্তু সুব্রত এটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে। অথচ কার্ড হারিয়ে ফেলায় মেয়েটির মানে। মানসীর, কতই না অসুবিধে হবে। এইসব ভাবনার পাকে সে যখন পাক খাচ্ছে তখনই মারুতি ফিরে এল। মেয়েটি সূর্যর দশ হাত দূরে নেমে এল গাড়ি থেকে। বিরক্ত মুখে বাড়ির দরজার দিকে যেতে-যেতে অন্যমনে সূর্যর দিকে তাকাতেই দাঁড়িয়ে পড়ল সে। চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। তারপর কাছে এগিয়ে এসে বলল, কিছু মনে করবেন না, ওটা কি আমার কার্ড?
 
জিভ গলা শুকিয়ে কাঠ, সূর্য কোনওমতে মাথা নাচাল। মানসী সোম বলল, এখানে পড়ে গিয়েছিল, না? আমি না এমন কেয়ারলেস! কী বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব! হাত বাড়াল সে।
 
সূর্য কার্ডটা হস্তান্তরিত করার মুহূর্তে কি ইলেকট্রিকের শক খেল? সমস্ত শরীরে একটা শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল কেন?তার হাঁটু কাঁপতে লাগল। মানসী কী বলবে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি অসুস্থ?
 
না। শব্দটা যত না জোরে উচ্চারিত হল, ঘাড় নাড়া তার দ্বিগুণ হল।
 
মানসী হাসল, আপনার নামটা জানতে পারি?
 
সূর্য মিত্র। এ পাড়াতেই থাকি। খুব বেশি এইটুকু বলতে ঘাম তৈরি হয়ে গেল ওর।
 
মানসী মাথা নাড়ল, আবার আপনাকে ধন্যবাদ, সূর্যবাবু। আমি চলি। রাজেন্দ্রাণীর মতো লাল মারুতিতে সে উঠে বসতেই গাড়িটা উধাও হয়ে গেল। রুমালে মুখ মুছল সূর্য। এরকম হয়? পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী এইভাবে ডেকে তার সঙ্গে কথা বলল? কিছুক্ষণ বাদে সে যখন ছাত্রের বাড়িতে পৌঁছোল তখন ভয় সঙ্কোচ কিংবা আড়ষ্টতা কোথাও নেই, সমস্ত মন জুড়ে শুধু আনন্দ। এমনকী দেরি হয়েছে বলে ছাত্রের পিসি তাকে দুকথা শোনালেও সে একটুও রাগ করল না। কিন্তু পড়াতে একদম ইচ্ছে করছিল না সূর্যর। গত কয়েকদিনে যে পড়া পড়িয়েছিল তার ওপর প্রশ্ন দিয়ে ছাত্রকে লিখতে বলে চোখ বন্ধ করে বসে রইল সে। চোখের পাতায় মানসী। লাল ঠোঁট সামান্য কাঁপিয়ে প্রশ্ন করছে, আপনার নামটা জানতে পারি?
 
 
কী মাস্টারমশাই, ঘুমোচ্ছেন নাকি? ছাত্রের পিসি দরজায় দাঁড়িয়ে প্রায় হেঁকে উঠল।
 
চমকে চোখ মেলল সূর্য, না-না। ভাবছিলাম।
 
তিরিশ বছরের পিসির আফ্রিকার ম্যাপের মতো মুখ দুমড়ে উঠল, খালি নকশা! দাদা আর মাস্টার পায় না! কোন কাজটা আপনাকে দিয়ে হয় বলুন তো?
 
কথাটার মধ্যে কি চাকরি হারাবার সম্ভাবনা আছে? সে সোজা হয়ে জিজ্ঞাসা করল, সব কাজই তো করি।
 
ছাই করেন। ঠিক আছে, শাহেনশা-র টিকিট কেটে এনে দিন তো দুটো।
 
ঢোঁক গিলল সূর্য। কিন্তু আজ ছাত্রের পিসির মুখটা অত কুৎসিত দেখাচ্ছে কেন?বলতে কি, বেশ আটপৌরেই মনে হচ্ছে। কিন্তু ওই ছবির টিকিট কাটতে গেলে যে মারপিট করতে হবে। সে কোনওমতে বলল, দুটো কেন? ওকে নিয়ে এসব ছবি দেখা কি ঠিক হবে?
 
আপনার ছাত্রকে কে নিয়ে যাচ্ছে! আমাকে নিয়ে যে যাবে সে সময় পায় না টিকিট কাটার। আপনার মতো বেকার লোক নয় তো। শনিবার হলে ভালো হয়।
 
বাড়ি ফেরার পথে এটাকেও সে মেনে নিল। ওই পিসির যদি প্রেমিক থাকে তাতে অবাক হওয়ার কী আছে। মানসী তার সঙ্গে কথা বলেছে। কাল আবার সে ওইরকম মানসীর বাড়ির সামনে। পৌঁছে যাবে। কিন্তু তিনদিন যাওয়া-আসা করেও মানসীর দর্শন পেল না সূর্য। মানসী কি সপ্তাহে একদিনই লাইব্রেরিতে যায়? রাত্রে ঘুম আসছে না, খাবার দেখলেই বিস্বাদ লাগছে। ঘন-ঘন সিগারেট খাচ্ছে সূর্য। এবং শেষপর্যন্ত সুব্রতকে সব খুলে বলল সে। চোখ বন্ধ করে সুব্রত চায়ের দোকানে বসে নতুন কাপের অর্ডার দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী করতে চাস?
 
সূর্যর দু-হাতের দশটা আঙুল পরস্পরকে আঁকড়ে ধরল। আর একবার দেখতে চাই?
 
দেখে কি হবে? মানসী কি জিনিস তুই জানিস না। এর মধ্যে দু-ডজন ছেলে লেঙ্গি খেয়েছে। ওর। বাপের প্রতাপ ও টাকা দুই-ই আছে। তোকে পাত্তাই দেবে না। ধন্যবাদ দিয়েছে বলে ভিরমি খেয়ো না বন্ধু। মানসী সোম গভীর জলের মাছ। আমাদেরই পাত্তা দেয় না। ঠোঁট ওলটাল সুব্রত। কিন্তু কথাটা মনে ধরল না সূর্যর। মানসী যখন হেসে তার সঙ্গে কথা বলছিল সেই দৃশ্যটা কিছুতেই তো ভোলা সম্ভব নয়। তার মনে হল সুব্রত তাকে আন্ডার এস্টিমেট করছে।
 
দু-দিন বাদে সিদ্ধান্ত নিল সে। সুন্দর একটা কাগজে সে আরও সুন্দর করে লিখল, সেদিন পথে আপনার লাইব্রেরির কার্ড পড়ে গিয়েছিল বলে আপনি কৃপা করে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমারও যে কয়েকটা কথা বলার আছে। আপনি কি দয়া করে পাঁচ মিনিট সময় আমাকে দিতে পারেন? যে-কোনওদিন যে-কোনও সময়। ব্যাপারটা খুব জরুরি। শুভেচ্ছাসহ, সূর্য মিত্র। নিচে অনেক ভেবেচিন্তে চায়ের দোকানটার ঠিকানা লিখল। আগামী দশদিন ধরে রোজ সে পিওন আসার সময় যদি বসে থাকে তো চিঠি মার যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা থাকবে না। কিন্তু ব্রিগেডিয়ারের ঠিকানায় এই চিঠি না পাঠিয়ে সে সোজা লাইব্রেরিতে হাজির হল মুখ বন্ধ করা খাম নিয়ে। একটা বেয়ারাকে ডেকে দুটো টাকা দিয়ে জানতে চাইল মানসী সোম কবে আসে পড়তে। বেয়ারাটির দুটো টাকা খুব ভালো লাগল। সে জানাল, দিদিমণি আজই আসবে।
 
চিঠিটা তাকে দিয়ে সূর্য পইপই করে বলে দিল এটা যেন সে দিদিমণির হাতে দিয়ে দেয়। খুব জরুরি বিষয়। অন্য কেউ যেন চিঠি না পায়।
 
মানসী সোম সেদিন কখন লাইব্রেরিতে এসেছিল সূর্য জানে না। তিনঘণ্টা অপেক্ষা করে ফিরে এসেছিল সে। পরদিন আবার লাইব্রেরিতে গিয়ে বেয়ারাটার কাছে জেনেছিল চিঠি ঠিক হাতে পৌঁছে গিয়েছে। অথচ তারপরে ছয়দিন কেটে গেল, কোনও চিঠি নেই সূর্যর নামে। সকালে পৌঁছোতেই চায়ের দোকানের মালিক সবার সামনে বলে উঠলেন, এই যে সূর্যবাবু, আপনার নামে একটা চিঠি এসেছে আমার ঠিকানায়। হকচকিয়ে গেল সূর্য। ব্যাপারটা কী হল?গতকালও তো পিয়নের কাছে কোনও চিঠি ছিল না।
 
সুব্রত চেঁচিয়ে বলল, দিন চিঠিটা।
 
একটা সুন্দর খাম সূর্যর হাতে দিয়ে মালিক জানালেন, আজ ভোরে একটা চাকর গোছের লোক এসে দিয়ে গেছে।
 
সে সূর্য ছাড়া কারও হাতে দেবে না বলে জিদ ধরেছিল, মালিক অনেক বুঝিয়ে নিয়েছেন চিঠিটা। সমস্ত শরীরে আবার সেই কাঁপুনি। সূর্যর মনে হচ্ছিল, সে মরে যাবে। মানসী সোম তার চিঠির উত্তর দিয়েছে। তাকে যদি গালাগালিও দিয়ে থাকে তবু তো দিয়েছে। কিন্তু এখন সুব্রতর কাছে চেপে যাবে কী করে। সুব্রত বলল, এখানে বসে চিঠিটা পড়ো গুরু। ডুবে-ডুবে খুব জল খাচ্ছ। হাতের লেখা বলছে তেনাদের চিঠি।
 
এই চায়ের দোকানে খামটা খুলতে মোটেই ইচ্ছে করছিল না। তবু খুলতে হল। আকাশি রঙের। কাগজে সবুজ কালিতে লেখা, সেদিন আপনি আমার উপকার করেছেন। এত ভদ্রভাবে কোনও ছেলেকে কথা বলতেও শুনিনি। কিন্তু এখন আমি যে খুব ব্যস্ত। একটা কাজ করা যেতে পারে। আগামীকাল সন্ধেবেলায় রবীন্দ্রসদনে আমাদের একটা অনুষ্ঠান আছে। ঠিক নটা নাগাদ আপনি যদি গ্রীনরুমের দরজার মুখে অপেক্ষা করেন তো আধঘণ্টা কথা বলা যেতে পারে ফেরার সময়। মানসী।
 
হঠাৎ খুব উদার হয়ে গেল সূর্য। এই মুহূর্তে কেউ চাইলে সে পৃথিবীটাকেও দান করে দিতে পারত। চোখের পাতায় মানসীর লাল ঠোঁটের হাসি। তার হাত থেকে চিঠিটা ততক্ষণে নিয়ে নিয়েছে সুব্রত। চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কেসটা কী?
 
সূর্যর কথা বলতে সময় লাগল। সমস্ত ব্যাপারটা জানার পর সুব্রত জিজ্ঞাসা করল, কী করবি?
 
কী করব মানে? সূর্য মুখ ফেরাল, যাব।
 
পাগল! তুই শালা এটা গাধা। খিঁচিয়ে উঠল সুব্রত।
 
মানে? হঠাৎ যেন ধাক্কা খেল সূর্য।
 
তুই কি বুঝতে পারছিস না এটা একটা ট্র্যাপ? অতদিন আগে তোর চিঠি পেয়ে চাকরকে দিয়ে এখানে পাঠাবে কেন আজ এই চিঠি? ওই শালা ব্রিগেডিয়ারই হয়তো লিখেছে। আমি তোকে সাবধান করে দিচ্ছি সূর্য, যাস না। বেছে-বেছে রবীন্দ্রসদনের পেছনের গেটে যেতে বলেছে। ওখানে ধোলাই দিলে কোনও পাবলিক বাধা দিতে যাবে না।
 
চিঠি ফেরত নিয়ে প্রতিবাদ করল সূর্য, কিন্তু খামোকা আমাকে মারতে যাবে কেন?
 
সুব্রত এক মুহূর্ত সূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার স্ট্যাটাস কী?নাথিং। দুটো টিউশনি করিস। বাড়ির অবস্থা?বুক ফুলিয়ে বলার মতো নয়। কোনও স্পেশাল কোয়ালিফিকেশন? নাথিং। চেহারা? জনতা ব্র্যান্ডের। তোর চেয়ে একশোগুণ এসব ব্যাপারে কোয়ালিফায়েড ক্যান্ডিডেটকে বাদ দিয়ে মানসী কেন তোকে সিলেক্ট করবে? প্রেম তোর কাছে স্বপ্নের জিনিস, প্লেটোনিক ব্যাপার, তুই প্রচুর কবিতা পড়িস, এসব ওর জানার কথা নয়। স্রেফ তোকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে প্যাঁদানির জন্যে।
 
সারাদিন ধরে ব্যাপারটা ভাবল সে। মানসী তাকে মার খাওয়াবে? যে মেয়ে অমন মিষ্টি করে হাসতে পারে সে এমন খারাপ হতে পারে? কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না মন। আচ্ছা, একটু দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ রাখলে কেমন হয়? সত্যি গুন্ডারা ওখানে তার জন্যে অপেক্ষা করছে কিনা বুঝতে পারবে তাহলে। কিন্তু সেসব কিছু না হয়ে যদি সত্যি-সত্যি মানসী এগিয়ে এসে বলে, চলুন কোথাও গিয়ে বসি তাহলে কোথায় বসবে? ও-পাড়ার রেস্টুরেন্ট মানেই তো বিরাট খরচ। নিজে কোনওদিন ঢোকেনি। পকেটে অন্তত দুশো টাকা থাকা দরকার। বেলেঘাটার টিউশনির টাকা। আজ যেমন করে হোক আদায় করবে বলে ঠিক করল। ছাত্রের বাবাকে ফোনে জানিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। তারপর নিজের সেরা জামা-প্যান্ট ঠিকঠাক করে নিতে লাগল।
 
ছাত্রটি জিজ্ঞাসা করল, মাস্টারমশাই, আপনার কী হয়েছে?
 
কিছু না। রুমালে মুখ মুছল সূর্য, তোমার বাবা এখনও এলেন না?
 
সে ঘড়ি দেখল সাতটা বেজে চল্লিশ। ছাত্রের মা এল চা নিয়ে, ও একদম পড়াশুনা করছে না মাস্টারমশাই। আপনি দেখুন। ওর বাবা বলছিল আপনাকে বলতে।
 
চায়ের স্বাদ বিশ্রী লাগছিল। পড়াতেও মন বসছিল না। ঘড়ির কাঁটা যেন প্রিন্ট করছিল। ভদ্রলোক এলেন সোওয়া আটটায়। এসে কিছু খোশগল্প করার ধান্দায় ছিলেন কিন্তু তার আগেই সূর্য উঠে দাঁড়াল। ভদ্রলোক বললেন, কি মশাই, ট্রেন ধরার তাড়া নাকি আপনার?
 
সূর্য মাথা নাড়ল, সেই রকমই। একজন বাইরে যাবে।
 
টাকা নিয়ে সূর্য যখন পথে নামল তখন আটটা পঁচিশ। টিমটিমে আলো জ্বলছে। রাস্তাঘাটে লোকজন নেই তেমন। এখান থেকে কোন বাস রবীন্দ্রসদন যায়? বাসস্টপে মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে কোনও গাড়ি দেখতে পেল না সে। আর পঁচিশ মিনিট। সূর্যর মনে হচ্ছিল তার কলজে ছিঁড়ে যাবে। এখান থেকে দৌড়ে গেলেও পঁচিশ মিনিটে রবীন্দ্রসদনে পৌঁছোনা যাবে না। উদ্বেগে সে অস্থির হয়ে উঠল। অসহায়ের মতো চারপাশে তাকাল। একটাও ট্যাক্সি নেই। ট্যাক্সিতে সে কখনও চাপে না। কিন্তু আর পনের মিনিট রয়েছে হাতে। ভীষণ রাগ হচ্ছিল সূর্যর। সমস্ত পৃথিবীর ওপর। তার কান্না পাচ্ছিল। আর এই সময় মাথায় আলো জ্বেলে একটা দ্রুতগামী ট্যাক্সিকে ছুটে আসতে দেখল সে। রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে দু-হাত মাথার ওপরে তুলে সে চিৎকার করতে লাগল, রোককে রোককে! ব্রেক কষেও একটু এগিয়ে গেল ট্যাক্সিটা। ভেতরেও কোনও লোক নেই। দৌড়ে পেছনের দরজা খুলতেই মিটার নামাল ড্রাইভার। স্টার্ট নিতেই ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে প্রায় আর্তনাদ করল সূর্য, দাদা, খুব জরুরি দরকার, আমাকে পনেরো মিনিটের মধ্যে রবীন্দ্রসদনে পৌঁছে দিন। প্লিজ। আর কী বললে গুরুত্বটা বোঝানো যায় ভেবে পাচ্ছিল না সে।
 
ঠিক আছে। পেছনের গেটে নটার মধ্যে পৌঁছে যাবেন। ড্রাইভার স্পিড বাড়াতেই হঠাৎ ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগল যেন। লোকটাকী বলল?পেছনের গেট? এই কথাটা জানল কী করে? প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে নিজের সিটে শরীরটাকে ছেড়ে দিল। ট্যাক্সিটা চলছে না উড়ছে বোঝা যাচ্ছে না। পেছনের গেট এবং ন-টা–কোনও ট্যাক্সিওয়ালা একথা বলবে না। লোকটা অন্তর্যামী নাকি? সুব্রতর মুখ মনে পড়ল। ব্রিগেডিয়ার একে পাঠায়নি তো? দূর! সে বেলেঘাটায় পড়াতে আসবে এবং এই সময় বের হবে, এতক্ষণ অপেক্ষা করবে, বাসে না গিয়ে ট্যাক্সি ডাকবে, তা কারোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু লোকটা এদিকে একবারও তাকায়নি। এমনকী বাসস্টপে তাকে পেরিয়ে যাচ্ছিল। সে তো ডেকে থামাল। কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল সূর্যর। এবং এই সময় রাস্তার আলো পড়তেই সে দেখল লোকটার হাতে সবুজ সুতোর গ্লাভস। হাঁ হয়ে গেল সূর্য। কলকাতার কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভার গ্লাভস পরে ট্যাক্সি চালায় এমন দৃশ্য কে কবে দেখেছে। চোখ কচলে নিল সূর্য। না, সে স্বপ্ন দেখছেনা। শীতকাল হলে তবু হজম করা যেত কিন্তু এই সময়ে লোকটা গ্লাভস পরে আছে কেন যখন ঘাম বের হচ্ছে অকারণে! সূর্য তাকিয়ে দেখল ট্যাক্সিটা ঠিক পথেই যাচ্ছে। ন-টা বাজতে পাঁচ, এখন তারা কলামন্দির ছাড়াল। চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল সে। হঠাৎ গাড়ি গতি কমিয়ে বাঁক নিতেই সে দেখল রবীন্দ্রসদনের পেছনের গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে। ইতিমধ্যে। চেঁচিয়ে উঠতেই ব্রেক কষল লোকটা। আলো জ্বেলে ভাড়ার অঙ্কটা বলতেই টাকা এগিয়ে দিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল সে। শুধু গ্লাভস নয়, এ গরমে লোকটা একটা সবুজ মাঙ্কি ক্যাপ পরে আছে। লোকটা যখন টাকা ফেরত দিয়ে আলো নেভাল তখন সে কাঠ-গলায় জিজ্ঞাসা করল, কিছু মনে করবেন না, আপনি মাথায় হাতে ওসব পরে আছেন কেন?
 
শীতল গলায় লোকটি বলল, আমার খুব ঠান্ডা লাগে। বলে গাড়ি থেকে নেমে বনেট খুলে ঝুঁকে ইঞ্জিন দেখতে লাগল। ব্যাপারটা মন থেকে সরিয়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সে ঘড়ি দেখল, ন-টা বাজতে চল্লিশ সেকেন্ড বাকি। সামনে কোনও গুন্ডা ধাঁচের লোক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সূর্য বেশ কিছুটা ঘুরে আড়ালে দাঁড়াতেই বুঝতে পারল অনুষ্ঠান ভেঙেছে। গ্রীনরুমের ভেতরে থাকা নারী-পুরুষ এবার পেছনের গেট দিয়ে বের হচ্ছে। মানসী কি একা আসবে?নাকি সঙ্গে কোনও বান্ধবী থাকবে?বন্ধুও তো থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সূর্য সামনে। আসবে না। উত্তেজনা বাড়ছিল। বেরিয়ে আসা জনতা গেটের দিকে চলে গেল। এবং তখনই সে। দেখল ট্যাক্সিওয়ালাটা গেটের এপাশে তখনও ইঞ্জিন দেখে যাচ্ছে। এতক্ষণ যে গাড়ি পক্ষীরাজের মতো উড়ল তার ইঞ্জিন হঠাৎ এমন খারাপ হতে পারে?নাকি লোকটা ইচ্ছে করেই ওখান থেকে। নড়ছে না? সুব্রতর হুঁশিয়ারি মনে এল, তুই কি বুঝতে পারছিস না এটা একটা ট্রাপ? নইলে লোকটা জানবে কী করে সে পেছনের গেটে আসবে। গ্লাভস এবং মাঙ্কি ক্যাপ পরে আছে যাতে কোনও সূত্র কেউ খুঁজে না পায়। এই সময় কোনও ট্যাক্সিওয়ালা ভাড়া না খেটে অকারণে সময় নষ্ট করবে না। তাহলে?
 
ঢোঁক গিলল সূর্য। পেছনের দরজা দিয়ে আর কেউ বের হচ্ছে না। দু-তিনটে ছাড়া প্রায় সব গাড়ি চলে গেছে এর মধ্যে। কী করবে বুঝতে পারছিল না সূর্য। ন-টা বেজে পাঁচ। মানসী কি আগে। বেরিয়ে তাকে না দেখে চলে গেছে? তা কী করে হবে? সে আজ রেডিওর সঙ্গে ঘড়ি মিলিয়েছে। কিন্তু লাল মারুতিটা তো গোড়া থেকেই ছিল না। ভেতর থেকে সাজুগুজু করা দুটি মানুষ বেরিয়ে আসছে। তাদের একজন মহিলা। টানটান হয়ে দাঁড়াল সূর্য। মানসী কি কোনও বন্ধুকে নিয়ে। আসছে। প্রথমবার অবশ্য কোনও মেয়ের পক্ষে একা দেখা করতে সঙ্কোচ লাগবে। কিন্তু ওরা যেভাবে গল্প করছে, হতাশ হল সূর্য। মানসী নয়। ওরা এগিয়ে গিয়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল যাবে কিনা। মাথা নাড়া দেখে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। শালা ট্যাক্সিওয়ালা তো যাওয়ার নাম করছে না। আড়াল থেকে বেরিয়ে নন্দনের পেছনের দিকটায় দাঁড়াল সে। এখান থেকে গেটটা সামনাসামনি দেখা যাবে না, গুন্ডা ভাড়া করবে না মানসী। শুধু ট্যাক্সিওয়ালা ছাড়া এখন পর্যন্ত সন্দেহজনক কাউকে নজরেও পড়েনি। একবার ভেতরে গিয়ে খবর নেবে নাকি? সূর্য এগিয়ে যাচ্ছিল। এই সময় রবীন্দ্রসদনের ভেতর থেকে কথা বলতে-বলতে চারটে লোক বেরিয়ে এল। এরা যদি গুন্ডা হয়, নিজেকে ব্রুসলি ভাবতে চেষ্টা করল। লোকগুলো তাকে ঘিরে ধরেছে। এইবার সেশূন্যে লাফিয়ে পা-হাত ছুড়বে। কিন্তু তার আগেই সে-যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অজস্র কিল চড় লাথি নেমে আসছে শরীরে।
 
শূন্যে না ভাসালে শরীরটাকে ব্রুসলি করে তুলবে সে কি করে? মুখে কী রক্তের স্বাদ লাগল? সমস্ত শরীরে এত ব্যথা কেন? দামি জামাটাও ছিঁড়ে গেছে। চোখের সামনে সমস্ত আলো ঝাঁপসা হয়ে আসছিল। চার জোড়া পায়ের আওয়াজ দ্রুত মিলিয়ে গেল। জ্ঞান হারাবার আগে সে গ্লাভস হাতে মাঙ্কি ক্যাপ পরা ট্যাক্সিওয়ালাকে এগিয়ে আসতে দেখল। কথা বলার শক্তি লোপ পেয়ে গেছে। লোকটা ঝুঁকে তাকে দেখল। তারপর নিজের মনে বলল, বড় গরম লেগেছিল। বেচারা। এবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
 
দু-হাতে তাকে এমনভাবে তুলে নিল ট্যাক্সিওয়ালা যেন সে একটা শিশু। ট্যাক্সির পেছনের সিটে শুইয়ে দিতেই সে জ্ঞান হারাল। দক্ষ হাতে ট্যাক্সিটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে ড্রাইভার বেরিয়ে গেল রবীন্দ্রসদন থেকে।
 
জ্ঞান ফিরতেই মনে হল সে মরে যায়নি। সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। চোখ বন্ধ করেও বুঝল সে শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানার ওপরে। তার সমস্ত শরীরে কি এখন ব্যান্ডেজ? সূর্য ককিয়ে। উঠল। তার মুখ থেকে উঃ আঃ ধ্বনি ছিটকে বেরুতে লাগল। এবং তখনই সে গলা শুনল, ওগুলো বলার দরকার নেই।
 
সে চোখ মেলতেইট্যাক্সিওয়ালার মাঙ্কি ক্যাপ পরা মুখ দেখতে পেল। লোকটা বলল, আপনার আর রক্ত পড়ছেনা, গায়েও ব্যথা নেই। উঠে বসুন।
 
হকচকিয়ে নিজের শরীরে হাত বোলাল সূর্য। কি আশ্চর্য, কোথাও তো আঘাতের চিহ্ন নেই! ব্যথাও নেই! এমনকী ছেঁড়া জামাটাও ঠিক হয়ে গেছে। সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে আরও অবাক হল। সুন্দর বাগানে ঘাসের ওপর শুয়ে সে এতক্ষণ ভেবে যাচ্ছিল হাসপাতালের বেডে রয়েছে? নিরুদ্দিষ্ট বালকের মতো সূর্য প্রশ্ন করল, আমি কোথায়?
 
ড্রাইভার জবাব দিল, হাসপাতালে।
 
সূর্য চারপাশে তাকাল। গাছপালা, বাগান, ফুল, নীল আকাশ এবং তার গায়ে বউদির বগি থালার চেয়ে বড় একটা হলদে লালে গোলা চাঁদ। বেদম ভড়কে গিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, এ কেমন হাসপাতাল?
 
ড্রাইভার বলল, সেটা নিজের চোখে দেখুন।
 
আমাকে এখানে এনেছেন কেন?
 
আপনার খুব গরম লাগছিল। উত্তপ্ত আহত রক্তাক্ত মানুষরা এখানে এলে স্বাভাবিক হন। তখন তাঁদের ঠান্ডা লাগে। হাসপাতালটা ঘুরে দেখুন আপনি। যখন আপনার গরম কেটে যাবে, শীত শীত করবে, তখন এখানে চলে আসবেন। বুঝে যাবেন আপনি স্বাভাবিক হয়ে গেছেন। উঠে। দাঁড়ান। ড্রাইভার ফিরে গেল দূরে দাঁড়ানো ট্যাক্সির কাছে। তারপর বনেট খুলে আবার ইঞ্জিন দেখতে আরম্ভ করল।
 
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জামাকাপড় থেকে ঘাসের কুচি ঝেড়ে নিল। কোথাও কি কোকিল ডাকছে? আঃ, ফুলের গন্ধ এত মধুর হয়? এরকম হাসপাতালের নাম কেউ কখনও শুনেছে? সূর্য ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল। চারপাশে বড়-বড় গাছ থাকায় জায়গাটা খুব রহস্যময় হয়ে উঠেছে। কলকাতা শহরে কি সে এই মুহূর্তে আছে? ট্রাম বাস দূরের কথা, একটা গাড়ির হর্নও কানে আসছে না। আরও কিছুটা এগিয়ে পেছনে তাকিয়ে সে আর ড্রাইভারকে দেখতে পেল না। ইউক্যালিপটাস গাছ পাতা নাড়ছে বাতাসে। হঠাৎ গাছের ফাঁক দিয়ে একটা সাদা বাড়ি দেখতে পেল সে। ছবির মতো আঁকা সেই বাড়ি বড় রহস্যময়। ধীরে-ধীরে কাছে এগিয়ে এল সূর্য। বাড়িতে কেউ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু জানলার শার্সিতে আলো পড়ছে। একটা ছায়া সরে গেল বলে মনে হল। না, ছায়াটা আবার ফিরে এল। অর্থাৎ ওখানে কেউ পায়চারি করছে। সূর্য ধীরে-ধীরে বাড়িটার সদর দরজায় চলে এল। কোথাও কোনও শব্দ নেই। সদর দরজা বলতে যা মনে আসে এটি তেমন নয়। ভেতরে পা বাড়াতেই সে একটা সিঁড়িতে পৌঁছে গেল। দু-পাশে দেওয়াল রেখে সিঁড়িটা সোজা ওপরে উঠে গেছে। নিঃশব্দে উঠে আসতেই গলাটা কানে এল। মোটা গলায় একটা লোক কিছু বলছে। পায়ে-পায়ে বারান্দায় পৌঁছে উঁকি মারল সূর্য। একটা লোক, যার পরনে আলখাল্লা জাতীয় পোশাক, পায়চারি করতে-করতে বলছে, ওর শরীরে রক্ত ঝরাতে অথবা ওর তুষারের চেয়ে সাদা চামড়ায় ছুরি বসাতে চাই না আমি। কিন্তু ওকে মরতে হবে। ওকে বেঁচে থাকতে দেওয়া যায় না। ও বেঁচে থাকলে আরও অনেক পুরুষ। বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হবে। প্রথমে আমি আলোটাকে নিভিয়ে দিই, তাহলে ডেসডিমনার জীবনটাকে অন্ধকার করে দেওয়া সহজ হবে। এই আলো নেভালে আমি আবার জ্বালাতে পারব কিন্তু ডেসডিমনা, তোমার জীবনপ্রদীপ যদি নিভিয়ে দিই, প্রকৃতির এই সুন্দর সৃষ্টি যদি ধ্বংস। করে দিই, নতুন করে তা নির্মাণ করার কোনও মন্ত্র আমার জানা নেই। গাছ থেকে একটা গোলাপ ছিঁড়ে নিয়ে তাকে সতেজ রাখার কায়দা আমি জানি না সুতরাং এই প্রস্ফুটিত ফুলটিকেই আপাতত উপভোগ করা যাক। আলখাল্লা পরা লোকটি ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল ঘরের একপাশে। সূর্য উঁকি মারল। লোকটাকে খুব উত্তেজিত এবং রাগি মনে হচ্ছে। দীর্ঘকায় স্বাস্থ্যবান নিগ্রোটি একটি বিছানার পাশে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল। সেখানে দুধের চেয়ে সাদা বিছানায় এক সুন্দরী শ্বেতাঙ্গিনী শুয়ে আছে। মেয়েটি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। লোকটি ঝুঁকে মৃদু চুম্বন দিল মেয়েটির ঠোঁটে। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, তোমার নিশ্বাসের গন্ধ এত মনোরম যে আমি প্রলুব্ধ হচ্ছি সিদ্ধান্তকে অমান্য করতে। আমি কি তোমাকে শাস্তি না দিয়ে মুক্তি দেব?মৃত্যুর পরেও যদি তুমি এমন সুন্দর থাকো তাহলে প্রথমে তোমায় সেই শাস্তি দেব তারপর আবার ভালোবাসব। তোমাকে আর একবার চুম্বন করি সুন্দরী। এই আমার শেষ চুম্বন। পৃথিবীতে তোমার চেয়ে মধুর আর আমার কেউ নেই। তোমার মতো মারাত্মক কেউ নেই। চোখের জল আমি এড়াতে পারছি না কিন্তু যে কঠিন সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি তা পরিবর্তন করার কোনও কারণ নেই।
 
হঠাৎ মেয়েটি জেগে উঠল, কে এখানে? ওথেলো?
 
লোকটি সোজা হল, আ, ডেসডিমনা।
 
ডেসডিমনা বলল, তোমার কি ঘুম পেয়েছে? তুমি আমার বিছানায় আসবে?
 
লোকটি বলল, আজ রাত্রে কি তাই কামনা করেছ ডেসডিমনা?
 
ডেসডিমনা হাসল, হ্যাঁ।
 
ওথেলো সরে দাঁড়াল এক পা, তোমার জীবনের কোনও অপরাধের জন্যে যদি তুমি কখনও অনুশোচনা না করে থাকো, তাহলে প্রার্থনা করো।
 
ডেসডিমনা অবাক, কী বলছ তুমি?
 
ওথেলো মাথা নাড়ল, সেরকম হলে খুব সংক্ষেপে প্রার্থনাটা সেরে ফেল। আমি কোনও আত্মাকে মেরে ফেলতে চাই না এইভাবে।
 
ডেসডিমনা উঠে বসল, তুমি মেরে ফেলার কথা বলছ?
 
ওথেলো দৃঢ় গলায় জানাল, হ্যাঁ বলছি।
 
ডেসডিমনা উঠে বসল, ও ভগবান, তুমি আমায় দয়া করো।
 
ওথেলো বলল, হ্যাঁ, আমিও তাই চাই।
 
ডেসডিমনা মাথা নাড়ল, একথা বললে যখন, তখন তুমি আমায় খুন করতে পারো না। কিন্তু তবু তোমাকে দেখে আমার ভয় লাগছে। তোমার চোখের মণি কী হিংস্রভাবে ঘুরছে। কোনও অপরাধ করিনি আমি কিন্তু তবু তোমাকে দেখে ভয় পাচ্ছি।
 
নিজের পাপের কথা চিন্তা করো।
 
তোমাকে ভালোবাসা যদি পাপ হয় তাহলে এছাড়া অন্য কোনও পাপ আমি করিনি।
 
তাহলে ওই জন্যেই তোমাকে মরতে হবে।
 
তোমাকে ভালোবাসার জন্যে আমাকে মরতে হবে? ডেসডিমনা চট করে বিছানা ছেড়ে নেমে এল, আমার অপরাধটা কী, তা জানতে পারি?
 
ওথেলোর মুখ ব্যথায় ভরে উঠল, যে রুমালটা আমি তোমায় ভালোবেসে উপহার দিয়েছিলাম তা তুমি ক্যাসিওকে ব্যবহার করতে দিয়েছ।
 
না। চিৎকার করে উঠল ডেসডিমনা, মিথ্যে কথা। ক্যাসিওকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করো।
 
মিথ্যে বোলোনা। এখনও মিথ্যে বললে নিজের আত্মার প্রতি অবিচার করবে।
 
মিথ্যে বলছিনা। কিন্তু আমি কিছুতেই এখন মরতে পারব না।
 
না, মরতে হবেই এবং এই মুহূর্তেই।
 
দয়া করো। তোমাকে ছাড়া আমি আর কাউকে ভালোবাসি না। ক্যাসিওকে আমি রুমাল দিইনি।
 
কিন্তু আমি নিজের চোখে ওর হাতে রুমাল দেখেছি। তুমি একটি মিথ্যেবাদী স্ত্রীলোক। তোমার শাস্তি আমি নিজের হাতে দেব।
 
ক্যাসিওকে ডেকে আনো। সে কোথাও কুড়িয়ে পেতে পারে রুমালটা।
 
ক্যাসিও নেই।
 
নেই মানে?
 
তার বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই বলেই নেই।
 
ও! ভগবান! এ অন্যায়, এ অবিচার। ডেসডিমনা খানিকটা সরে এল। ওথেলোর হাতে ছুরি ঝলসে উঠল। ডেসডিমনা চিৎকার করে উঠল, আমি তোমাকে ঘেন্না করি।
 
ঘেন্না করো? এছাড়া আর কী করতে পারো তুমি? তোমার মতো অসতী মেয়ের আর কী করার ক্ষমতা আছে। প্রতারণা তোমার অভ্যাস।
 
চুপ করো। অনেক সহ্য করেছি আমি। বাবার অমতে আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। কারণ আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু একটি সন্দেহপরায়ণ পুরুষের সঙ্গে ঘর করা আর। সাপের খাঁচায় বাস করা যে এক, তা আমি বুঝিনি। তুমি আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছ। আমি আর কিছুতেই তোমার সঙ্গে থাকব না। ডেসডিমনা সরে আসছিল দরজার দিকে।
 
ওথেলো এগিয়ে আসছিল, কোথায় পালাবে তুমি? আমার হাত থেকে তোমার পরিত্রাণ নেই। অসতী স্ত্রীকে শাস্তি না দিলে আমি মহাপাপ করব।
 
সূর্য কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। চোখের সামনে একটা খুন হতে যাচ্ছে। সে কি চিৎকার করবে? কী দরকার তার? সেক্সপিয়ারের নাটকে পড়েছিল ডেসডিমনাকে ওথেলো খুন করেছিল। এরা কি সেই নাটক করছে? অভিনয়? এই সময় ডেসডিমনা ছুটে এল দরজায়। আর তার চোখ পড়ল সূর্যর ওপরে। সঙ্গে-সঙ্গে সে সূর্যর হাত আঁকড়ে ধরল, আমাকে বাঁচান। দোহাই আপনার, ওই মুরটার হাত থেকে আমাকে বাঁচান।
 
সূর্য মুখ ফিরিয়ে দেখল ওথেলো ছুরি হাতে ছুটে এসেছে তার সামনে। ডেসডিমনা আশ্রয় নিয়েছে তার পেছনে। ওথেলো তাকে দেখে অত্যন্ত বিরক্ত হল, এ আবার কে?
 
সূর্য খুব ঘাবড়ে গিয়ে তোতলালো, আ-আ-আমি সূর্য।
 
সূর্য? তা এখানে কী চাই? ধমকে উঠল ওথেলো।
 
কিছু না। আপনাদের রিহার্সাল দেখছিলাম।
 
রিহার্সাল? আমরা নাটক করছি? ওই স্ত্রীলোকটি আমার জীবন নষ্ট করেছে আর তুমি বলছ আমি রিহার্সাল দিচ্ছি? ছাড়ো পথ। আমি ওকে খুন করব।
 
ওথেলো তার একটা হাত এমনভাবে নাড়ল যেন মাছি মারছে। সঙ্গে-সঙ্গে ডেসডিমনা আর্তনাদ করে উঠল, প্লিজ আমাকে আপনি ওর হাতে ছেড়ে দেবেন না। আমি বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করিনি, ও অন্যায় করছে।
 
হঠাৎ সূর্য বলে ফেলল, আমি জানি আপনি খুব ভালো। খুব সৎ।
 
সৎ মানে? প্রায় লাফিয়ে উঠল ওথেলো, তুমি–তুমি ওকে চেনো?
 
চিনি না তবে জানি। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনারা আসল না নকল?
 
ওথেলোর ছুরিটা এবার সূর্যর গলার সামনে চলে এল, এই ছোঁকরা, আর একবার যদি আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ করো তাহলে খুন করে ফেলব তোমাকে। কী জানেনা ওর?
 
হৃৎপিণ্ড বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল সূর্যর, ওটা নামান বলছি। ওথেলোর ছুরি ঈষৎ নিম্নমুখী হল। সূর্য বলল, আপনি বরং এমিলিয়াকে ডেকে পাঠান। সে সব জানে।
 
এমিলিয়া? আমার প্রিয় ইয়াগোর স্ত্রী?
 
আজ্ঞে হ্যাঁ।
 
কী জানে সে? আমার আর অপেক্ষা করার সময় নেই, বলো কী জানে সে?
 
সূর্য ঢোঁক গিলল, ক্যাসিও মারা যায়নি।
 
ক্যাসিও মারা যায়নি? চমকে উঠল ওথেলো।
 
হ্যাঁ। ঘাতক লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। তাছাড়া যে রুমালটা ক্যাসিওর হাতে দেখে আপনি এই ভদ্রমহিলাকে হত্যা করতে যাচ্ছেন, সেই রুমাল উনি ক্যাসিওকে দেননি।
 
বাঃ! তাহলে আমার স্ত্রীর রুমাল উড়ে চলে গেল ক্যাসিওর কাছে?
 
আজ্ঞে না। ইয়াগো তার স্ত্রী এমিলিয়াকে দিয়ে রুমালটা চুরি করে আনিয়ে নিজে ক্যাসিওর ঘরে রেখে এসেছিল। সেই লোকটা হল ভিলেন। আপনাকে আপনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিষাক্ত করেছে।
 
তুমি জানলে কী করে?
 
বাঃ, আমরা সেক্সপিয়ারের নাটকের ওপর প্রশ্নোত্তর লিখেছি কত, কত ব্যাখ্যা!
 
সেক্সপিয়ার? কে সে?
 
আপনাকে নিয়ে যিনি নাটক লিখেছেন। আপনাকে বিখ্যাত করেছেন।
 
নাটকে কী ছিল?
 
আপনি ডেসডিমনাকে হত্যা করবেন।
 
সূর্য কথাগুলো বলামাত্র ডেসডিমনা আর্তনাদ করে উঠল।
 
তারপর? ওথেলো জিজ্ঞাসা করল।
 
তারপর? এমিলিয়া এসে আপনাকে অনেক বোঝাতে চাইবে। আপনি বুঝবেন না। সে আপনাকে দোষী করবে, আপনি শুনবেন না। শেষ পর্যন্ত সে যখন চিৎকার করে উঠবে, দিমুর হ্যাজ কিন্ড। মাই মিসট্রেস। মার্ডার! মার্ডার! তখন মল্টানো ইয়াগোরা এখানে আসবে। সূর্য স্মৃতি থেকে বলে যাচ্ছিল, সেখানে এমিলিয়া তার স্বামীর মুখোশ খুলে দিলে আপনার চৈতন্য হবে। কিন্তু ততক্ষণে খুন করবে ইয়াগো এমিলিয়াকে। আপনি গ্রেপ্তার হবেন।
 
তোমার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এমিলিয়া এখনও আসছে না কেন?
 
আপনি ডেসডিমনাকে খুন না করলে তো সে মঞ্চে আসতে পারে না।
 
হঠাৎ ঠক করে শব্দ হল। সূর্য দেখল ওথেলোর হাত থেকে ছুরিটা পড়ে গেছে। তার মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত। ধীরে-ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ওথেলো। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, ওছ ডেসডিমনা, প্রিয়া আমার, আমাকে ক্ষমা করো। এই লোকটির মুখে যদি ভবিষ্যৎ না জানতে পারতাম তাহলে কি ভুলই না করতে যাচ্ছিলাম।
 
তৎক্ষণাৎ সূর্যর আড়াল থেকে সরে দাঁড়াল ডেসডিমনা, না।
 
না? হে প্রিয়, তুমি আমাকে নিরাশ কোরো না।
 
না। তোমার মতো সন্দেহপরায়ণ স্বার্থপর মানুষকে ক্ষমা করা আর নিজের বুকে ছুরি মারা একই ব্যাপার। ভালোবাসার মূল্য তুমি দিতে পারোনি। যে পুরুষ তার নারীকে, নারীর ভালোবাসাকে। নিজের প্রাপ্য সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করে, তার সঙ্গে বাস করা অসম্ভব। আমি এতকাল ভালোবাসায় অন্ধ হয়েছিলাম। আজ আমার চোখ খুলে গেছে। ওথেলো, আমি চললাম।
 
তুমি, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ?
 
হ্যাঁ।
 
না যেয়ো না। আমি মিনতি করছি আমাকে ত্যাগ কোরো না।
 
ডেসডিমনা হাসল, বেশ। হয় তুমি আমাকে খুন করো, করে বিখ্যাত হও, নয় পড়ে থাকো একা, অন্ধকার নিয়ে। ওথেলো জবাব দিল না। বারংবার মাথা নাড়তে লাগল মুখ নিচু করে।
 
সূর্য দেখল, ডেসডিমনা বেরিয়ে গেল অন্ধকারে। ওথেলো যখন মুখ তুলল তখন তার পায়ের। আওয়াজ মিলিয়ে গেছে। বিড় বিড় করে উচ্চারণ করল ওথেলো, হে ঈশ্বর, তুমি কেন নারী সৃষ্টি করলে! যাকে দু-হাতের মধ্যে রেখেও মনে হয় হারিয়ে ফেলছি, বিশ্বাস করলেও ভয় সন্দেহকে ডেকে আনে, যাকে না পেলে মরে যেতে ইচ্ছে করে আবার সামান্য বক্র ব্যবহার উন্মাদ করে তোলে! ঈশ্বর, তোমাকে আমার হিংসে হচ্ছে, কারণ তোমায় কোনও নারীর সঙ্গে বাস করতে হয়নি।
 
ক্রন্দনরত ওথেলোকে দেখে করুণা হল সূর্যর। একটু আগে দেখা মানুষটিকে ওই নারী কি দ্রুত বদলে দিয়ে গেল। সে পায়ে-পায়ে নিচে নেমে এল। পেছনের বাড়িটি এখন ঘন অন্ধকারে ঢাকা। ডেসডিমনা হারিয়ে গেছে এর মধ্যে। বড়-বড় গাছপালার মধ্যে দিয়ে পা ফেলে সে এগোতেই পাতা মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল। ঠিক তার সামনে দিয়ে কেউ যাচ্ছে। সূর্য পেছন ফিরে আর বাড়িটাকে দেখতে পেল না। চাঁদের আলোয় পৃথিবী এখন স্বপ্নময়। সামনে যিনি যাচ্ছেন। তাঁর কি খুব তাড়া। গাছের আড়াল সামান্য সরতেই সে ছায়ামূর্তিটিকে দেখতে পেল। সূর্যর সন্দেহ রইল না, ঘাগরা ওড়না এবং পিঠের ওপর মোটা বেণী ঝুলিয়ে যিনি যাচ্ছেন তিনি সন্ত্রস্তা। হঠাৎ একটা বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসতেই ছায়াবৃতা দাঁড়িয়ে পড়লেন। ক্রমশ তাঁর মুখ পেছন দিকে ফিরল। সূর্য বুঝতে পারছিল না, মহিলা তার অস্তিত্ব সন্দেহ করেছেন কিনা। সে একটি দেবদারু গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। মহিলা এবার এগিয়ে গেলেন। তাঁর চলায় ছন্দ এল। জ্যোৎস্নায় মাখামাখি শরীরে ঢেউ উঠল। সূর্য সম্মোহিতের মতো তাঁকে অনুসরণ করল।
 
গাছপালা যেখানে আচমকা শেষ হয়েছে সেখানে একটি শান্ত নদী থাকবে এবং নদীর তীরে কদম গাছ বাতাসে আন্দোলিত হবে, এমনটা কল্পনা করেনি সূর্য। মহিলা এগিয়ে যাচ্ছিলেন বাঁশির শব্দ লক্ষ করে। কোনও মহিলাকে এভাবে অনুসরণ করা শোভন নয় জেনেও কৌতূহল সংবরণ করতে পারছিল না সে। আচমকা বাঁশি থেমে গেল। সূর্য দেখল মহিলা একটি কদম গাছের নিচে উপস্থিত হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছেন। আর বেশি এগোলে নিজেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সূর্য। গাছের আড়ালে-আড়ালে যতটা সম্ভব কাছাকাছি চলে এল। মহিলা সুন্দরী, যুবতী। উদাস গলায় যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাছে না এলে আমার কি, সময় ফুরিয়ে গেলেই আমি। ফিরে যাব। সঙ্গে-সঙ্গে পাশের কদম গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক তরুণ। এবং সূর্যর আর সন্দেহ রইল না।
 
রাধা পিঠের বেণী বুকের ওপর নিয়ে এসে অযথা আঙুলের ডগায় সেটাকে নিটোল করতে-করতে বললেন, বৃন্দাকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলে কেন?
 
জানো না, কেন খবর পাঠাই? কৃষ্ণর গলায় আমেজ, আমার বাঁশির সুর যেখানে পৌঁছায় না সেখানে তো বৃন্দার সাহায্য দরকার হয়ই।
 
আমি এভাবে আসতে পারব না। কথাগুলো বলে লম্বা-লম্বা পা ফেলে নদীর তীরে পড়ে থাকা একটি শ্বেতপাথরের ওপর গিয়ে বসলেন রাধা।
 
অবাক হয়ে কৃষ্ণ তাঁর অনুসরণ করে বললেন, কেন, আবার কী হল?
 
রাধা মুখ ফেরালেন অন্যদিকে, কিছুই হয়নি।
 
এবার সূর্যর খানিকটা সুবিধে হল। সে এগিয়ে গেল গাছের আড়ালে-আড়ালে ঠিক ওদের পেছনে। কিন্তু শেষ পদক্ষেপে একটি শুকনো পাতা চৌচির হতেই রাধা চমকে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁকে খুব ভীত এবং সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। উদ্বিগ্ন মুখে তিনি পেছনের গাছপালার দিকে তাকাচ্ছিলেন। কৃষ্ণ সেটা লক্ষ করে হাসলেন, না না, ভয়ে কিছু নেই। এখানে কেউ তোমাকে অনুসরণ করে আসবে না। কোনও কাঠবিড়ালি দৌড়ে গেল। কিন্তু প্রিয়া, তোমার মুখে মেঘ। কেন?
 
রাধা বললেন, আমার শাশুড়িটিকে তো তুমি চেনোনা! জটিলা তো জটিলাই।
 
কৃষ্ণ বললেন, ধ্যেৎ! আমার দিদিমাকে আমি মোটেই ভয় পাই না। গোলমাল করতে পারে কুটিলামাসি। তুমি যখন এখানে এলে তখন ওরা কী করছিল?
 
তোমার মামা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। ওঁদের খবর জানি না। রাধা এক-পা সরে দাঁড়ালেন, কারণ কৃষ্ণ তাঁর ঘনিষ্ঠ হচ্ছিলেন।
 
কৃষ্ণ একটু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে বলো তো? তুমি অন্যদিন এমন করো না, আমি বুঝতে পারছি না।
 
তুমি কিছুই বুঝবে না। রাধা পাথরের ওপর বসে পড়লেন।
 
দ্যাখো রাধা, আমার পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমার নিশ্বাসে তুমি। প্রতিদিন বেঁচে থাকি কারণ তোমার প্রেম আমাকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে বলে। কৃষ্ণ চোখ বন্ধ করলেন।
 
মিথ্যেবাদী পুরুষগুলোকে আমি একদম দেখতে পারি না। ঝাঁঝিয়ে উঠলেন রাধা, মেয়ে দেখলেই হল, জিভে যেন জল আসে। সবকটা গোপিনীকে তুমি–
 
ছি ছি ছি! কৃষ্ণ প্রতিবাদ করে উঠলেন, সেসব তো অতীন্দ্রিয় প্রেম। তা ছাড়া যখন আমি গোপিনীদের মধ্যে তোমাকে দেখি তখনই তারা আমার মধুরবাক্য শ্রবণ করে। তুমি প্রমাণ দিতে পারবে, আমি কোনও গোপিনীর সঙ্গে একা বিচরণ করেছি!
 
তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। বিরজার ঘটনা আমি ভুলিনি। আমার সখীর সঙ্গে তুমি এমন কাণ্ড করেছিলে যে, পাঁচজনে গিয়ে আমায় বলল। আমি আসছি জেনে তুমি পালালে আর সেই মেয়েটি নদীতে লুকিয়ে পড়ল। যেই আমি চলে গেছি অমনি দুজনে আবার মিলিত হয়েছ। তোমাদের সাত-সাতটা পুত্র আছে, আমি জানি না ভেবেছ?
 
প্রশ্নের উত্তরে কৃষ্ণের গলা মিনমিনে শোনাল, কে বলল তোমাকে?
 
রাধা আর ওই প্রসঙ্গে গেলেন না। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, শোনো, আমি আর এভাবে পারছি না। এই চোরের মতো দেখা করা আমার ভালো লাগছে না।
 
কৃষ্ণ জবাব দিলেন না। নিশ্বাস ফেলে নদীর দিকে তাকালেন।
 
রাধা বললেন, কথাগুলো কানে যাচ্ছে না কি!
 
কৃষ্ণ বললেন, যাচ্ছে। কিন্তু কী করব বলো?
 
তুমি আমাকে চাও না?
 
প্রশ্নটা করতে পারলে?
 
তাহলে তুমি কী ধরনের পুরুষমানুষ? যে পুরুষ নিজের নারীকে পরের কাছে ফেলে রেখে লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রেম করতে আসে, তার সম্পর্কে শ্রদ্ধা রাখা যায়? আমি তোমাকে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, এভাবে আমি প্রেম করতে পারব না। রাধা ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠলেন।
 
কীভাবে করবে?
 
আমাকে বিয়ে করতে হবে। স্বীকৃতি দিতে হবে।
 
কী আশ্চর্য! তুমি অন্যের বিবাহিত স্ত্রী, তোমাকে বিয়ে করা–
 
ই-ইস! আমার সঙ্গে পরকীয়া প্রেম করা যায় আর বিয়ে করা যায় না? রাধা মাথা নাড়লেন, এই তো একটা ঘাটের মড়ার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল এক গোপিনীর। তাকে ছেড়ে পরবাসে চলে গেল সে মনের মানুষকে নিয়ে বিয়ে-থা করে। তুমি পারছ না কেন?
 
মানে, হাজার হোক, তুমি আমার মামি।
 
রাধা হঠাৎ দু-হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কৃষ্ণ কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। তিনি ডানহাত বাড়িয়ে রাধার বাজু স্পর্শ করতে চাইলে রাধা এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন, ছুঁয়ো না তুমি আমাকে। এতকাল প্রেম করার পর এখন বলা হচ্ছে আমি তোমার মামিমা।
 
কৃষ্ণ কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, না, না, আমি ঠিক সেকথা বলতে চাইনি। আসলে ব্যাপারটা কী জানো, এই যে তুমি গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছ, আমি তোমার বিরহে ব্যাকুল হয়ে বাঁশি বাজাচ্ছি লোকে এইটাই মনে রাখবে। আমাদের প্রেমের মধ্যে যে বিরহের জ্বালা আছে তাই যুগযুগান্তর ধরে মানুষের ভালো লাগবে। আমি যদি তোমাকে বিয়ে করি তাহলে তো এই সব মহান ব্যাপারগুলো থাকবে না। বিবাহিত নারী-পুরুষের প্রেম নিয়ে লোকে মোটেই মাথা ঘামায় না। বিয়ে মানেই আমরা সাধারণের দলে মিশে যাব। কথাগুলো বলার সময় কৃষ্ণকে খুব সন্তুষ্ট দেখাছিল।
 
কিন্তু হিংস্র বাঘিনীর মতো উঠে দাঁড়ালেন রাধা, চমৎকার! তোমার মতলব আমি আগে বুঝিনি। ঝুঁকি যা নেওয়ার নিচ্ছি আমি, তুমি সামান্য দায়িত্বটুকুও নেবে না! আমি কী পেলাম বলো? বিয়ের পর যে সংসারে বউ হয়ে এলাম সেখানে মন বসাতে পারলাম না। শাশুড়ি ননদের খোঁটা খাচ্ছি। অনবরত। ওদের সন্দেহের বিষ আমার স্বামীকেও বিষাক্ত করেছে। যার জন্যে আমি পাগল তিনি বলছেন, জলে নামব কিন্তু বেণী ভেজাব না। রাধা এগিয়ে এলেন কৃষ্ণের মুখোমুখি, তোমাকে। আজ এই মুহূর্তে একটা কথা স্পষ্ট করে বলতে হবে, আমাকে স্বীকৃতি দেবে কি না?
 
কৃষ্ণ কিছু বলার আগেই পেছনে পায়ের আওয়াজ হল। সূর্য মুখ ঘুরিয়ে দেখল, একটি রমণী গাছের আড়ালে-আড়ালে এগিয়ে আসছে। রমণী এবার দেখতে পেল দৃশ্যটি। তার মুখে কুর হাসি ফুটে উঠল। তারপরেই সে দৌড়ে ফিরে গেল উলটোদিকে।
 
এই পায়ের শব্দ পাওয়ামাত্রই কৃষ্ণ চমকে উঠলেন। তারপরেই দ্রুত চলে এলেন গাছের সামনে। এবং তখনই তিনি সূর্যকে দেখতে পেলেন। তাঁর মুখে ক্রোধ ফুটে উঠল। খুব ঘাবড়ে গিয়ে সূর্য। নমস্কার করল। কৃষ্ণ রুষ্ট গলায় বললেন, কে আপনি? পোশাক দেখে মনে হচ্ছে আপনি বিধর্মী। এখানে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
 
সূর্য বলল, আজ্ঞে অপরাধ ক্ষমা করবেন। আমি বিধর্মী নই। কিন্তু আপনারা যার পায়ের শব্দ শুনলেন সে আমি নই। একটি রমণী আপনাদের দেখে ছুটে চলে গেল।
 
রমণী। কৃষ্ণের কপালে ভাঁজ পড়ল, কে রমণী?
 
আমি চিনি না। ওই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে দেখছিল। মুখে কুটিল হাসি ফুটেছিল।
 
কী রকম দেখতে সে? কৃষ্ণ উত্তেজিত। রাধা বেতস পাতার মতো পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলেন।
 
আজ্ঞে, রমণী মোটেই সুশ্রী নয়। কপালে একটা জরুল ছিল মনে আছে।
 
সঙ্গে-সঙ্গে রাধা অস্ফুটে বলে উঠলেন, কুটিলা।
 
কৃষ্ণ মাথা নাড়ল, তাই মনে হচ্ছে, চলো, আমরা অন্য কোথাও গিয়ে কথা বলি।
 
রাধা ভীত গলায় বললেন, এখন কী হবে? বাড়িতে ফিরব কী করে?
 
কৃষ্ণ বলল, রাত শেষ হতে দেরি আছে। পরে ভাবা যাবে। চলো।
 
সূর্য না বলে পারল না, কিছু মনে করবেন না, বিপদ কিন্তু আসছে।
 
বিপদ? কৃষ্ণ অবাক হল।
 
হ্যাঁ।
 
আপনি আমাদের চেনেন?
 
আজ্ঞে হ্যাঁ। ছেলেবেলা থেকে জানি।
 
কৃষ্ণ রাধার দিকে তাকলেন। রাধার চোখে বিস্ময়। তিনি জিজ্ঞাসা না করে পারলেন না, আপনি জানেন? আমাদের সম্পর্ক জানেন? সূর্য ঢোঁক গিলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
 
কী জানেন?
 
কৃষ্ণ হাত তুললেন, আঃ, এ সব কথা কেন? আপনি বিপদের কথা কী বলছিলেন?
 
সূর্য বলল, একটু বাদেই কুটিলাদেবী তার দাদা মানে আপনার মামাকে ডেকে আনবেন। তিনি এসে আপনাদের দেখলে কী হবে, বুঝতে পারছেন?
 
কৃষ্ণ বললেন, এই কথা! মামা শাক্ত, কালীর ভক্ত। মামা এলেই আমি কালীর রূপ ধারণ করব আর তুমি আমাকে আরাধনা কোরো। ব্যস, তিনি গলে জল হয়ে যাবেন। এর আগেও তো একবার এমন করেছি, তোমার মনে নেই?
 
সূর্য সমর্থনের মাথা নাড়ল। এই গল্প সে পড়েছে, একদিন আয়ান যখন কালীপূজা করছিলেন তখন তাঁর বোন কৃষ্ণ-রাধার বনবিহারের খবর দেয়। ক্রুদ্ধ আয়ান রাধাকে মারতে এলে কৃষ্ণ। কালীমূর্তি ধারণ করেন এবং রাধা কালীর পায়ে ফুল অর্পণ করতে থাকেন। এই দৃশ্য দেখে কালীভক্ত আয়ান রাধার ওপর খুব সন্তুষ্ট হয়ে কুটিলাকে তিরস্কার করেন ভুল খবর এনে দেওয়ার জন্যে।
 
কিন্তু রাধা বেঁকে বসলেন, অসম্ভব। তুমি মেয়ে সেজে আমার সামনে দাঁড়াবে আর আমি সেই মেয়েকে আবার পুজো করব? পারব না। আমি পারব না। তা ছাড়া এতকাল অনেক ঠকিয়েছি। আমি, নতুন করে ওকে ঠকাতে পারব না। চোরের সাক্ষী মাতাল, ইনি আবার তোমাকে সমর্থন করছেন!।
 
কৃষ্ণ বললেন, এ কি কথা বলছ তুমি? আমার জন্যে তুমি খুশি হয়ে কিছু করবে না?
 
এতকাল তো করেছি। কিন্তু মনে রেখো, আমার যিনি স্বামী তিনি ঘোর তপস্যার পর পৃথিবীর কোনও ধনসম্পদ, ক্ষমতা না চেয়ে শুধু আমাকেই স্ত্রী হিসেবে চেয়েছিলেন। আমি জানি, প্রচণ্ড ভালোবাসা না থাকলে এমন চাওয়া যায় না। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে তাঁকে আমি ভালোবাসতে পারলাম না। তাই বলে এই যে ক্রমাগত তাঁকে ঠকিয়ে যাচ্ছি, এ আর কদ্দিন ভালো লাগে। রাধা বললেন, তবু আমি পারি যদি তুমি পাঁচজনের সামনে আমাকে স্বীকৃতি দাও।
 
সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন দাঁড়াও, আমি কালীরূপ ধারণ করি।
 
অসম্ভব। আমি ফিরলাম। তিনি আমাকে আজ যে শাস্তি ইচ্ছে দিন আমি সহ্য করব কিন্তু এবার যেদিন তুমি আমায় ডাকবে সেদিন তৈরি থাকবে স্বীকৃতি দিতে। রাধা কৃষ্ণের কোনও অনুনয় শুনলেন না। দ্রুত পায়ে পাতা মাড়িয়ে বনের ভেতর মিলিয়ে গেলেন। কৃষ্ণ হতাশ, করুণ মুখে যেন কী করবেন বুঝতে না পেরে বসে পড়লেন মাটিতে।
 
সূর্যর খুব খারাপ লাগছিল। নদীর ওপার থেকে বয়ে আসা শীতল বাতাস তাকে একটু কাঁপিয়ে দিল। সে এক-পা এগিয়ে এল, আচ্ছা আপনি, মানে উনি যা চাইছেন তা দিচ্ছেন না কেন? দিলেই তো আর সমস্যা থাকে না।
 
কৃষ্ণ বললেন, আপনি নাবালক। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেম হল পরকীয়া প্রেম। এই প্রেম ধিকিধিকি জ্বলা আগুনের মতো। বুকের মধ্যে ওম তৈরি করবে কিন্তু পুড়িয়ে মারবে না। এই যে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে, চলে যাচ্ছে–এই ভালো। একসঙ্গে বাস করলেই দুজনের নানান খুঁত দৈনন্দিন দেখায় বড় হয়ে ওঠে। প্রেম তো মহান হয়ে ওঠে বিরহে। প্রেম তীব্র হয়ে ওঠে সন্দেহে। এই যে রাধা সন্দেহ করে আমি গোপিনীদের সঙ্গে মজে আছি, এটা তো ওর প্রেম তীব্রতর করছে।
 
আবার স্বামীর ঘর করছে যে মেয়ে, তার সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক কতটা তা নিয়ে তো আমার মন নিমেষ নয়। তবু রাধার বিরহে আমি পুড়ে মরি।
 
কৃষ্ণ যখন এইসব কথা বললেন, তখন ক্রুদ্ধ আয়ান বেরিয়ে এলেন জঙ্গল ভেদ করে। চিৎকার করে বললেন, কোথায় সেই পাপিষ্ঠা?
 
সূর্য দেখল আয়ানের হাতে তলোয়ার। আয়ানের পেছনে দাঁড়িয়ে কুটিলা বলল, এইখানেই ছিল দাদা। আমি নিজের চোখে দেখেছি। এখনই ওই কৃষ্ণ কালীর রূপ নিয়ে নেবে এবং তোমার বউ কত ভক্তিভরে পুজো করে তোমাকে ঠকাবে।
 
আয়ান বললেন, ঠকানো বের করছি। এই কেষ্ট, বল কোথায় সে?
 
কৃষ্ণ যেন খুব অবাক, এমন গলায় বললেন, কার কথা জিজ্ঞাসা করছেন আপনি?
 
তোর মামি, যে এখানে এতক্ষণ ছিল।
 
কৃষ্ণ বললেন, আমি তো তাঁকে দেখিনি।
 
মিথ্যে কথা! চিৎকার করে উঠল কুটিলা, একটু আগে এখানে দাঁড়িয়ে মায়াকান্না কাঁদছিল। নিশ্চয়ই আছে আশেপাশে কোথাও। দাঁড়াও দেখছি। কুটিলা জঙ্গল খুঁজতে গেল।
 
কৃষ্ণ বললেন, মামা, তোমার কী হয়েছে বলো তো, যে যা বোঝায় তাই বোঝে। এত রাত্রে মামি এখানে আসতে যাবেন কেন? নারায়ণকে তপস্যায় সন্তুষ্ট করে তুমি পেয়েছ মামিকে। নারায়ণ অসন্তুষ্ট হবেন না?
 
এই সময়ে কুটিলা হতাশ হয়ে ফিরে এসে সূর্যর দিকে তাকাল, এটা আবার কে?
 
সূর্য কী করবে বুঝতে পারছিল না। কৃষ্ণ বললেন, পরদেশি।
 
কুটিলা বলল, না দাদা, কীরকম মেয়েলি-মেয়েলি গড়ন। আমার সন্দেহ হচ্ছে। রাধাকে এর ভেক ধারণ করিয়ে দেয়নি তো! কথাগুলো বলতে-বলতে সূর্যর হাতে চিমটি কাটল কুটিলা। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল সূর্য। কুটিলা জিজ্ঞাসা করল, দাদা, বউদির গলার সঙ্গে মিল আছে কি?
 
আয়ান বললেন, মারব এক থাপ্পড়। এই রোগা সিঁটকে পরদেশির সঙ্গে আমার সতী-লক্ষ্মী সুন্দরী স্ত্রী-র তুলনা করছিস তুই? সে এখানে মোটেই আসেনি। তুই তাকে সহ্য করতে পারিস না বলে নিন্দা রটাস। আয়ানের পিছুপিছু কুটিলা চলে যেতে-যেতে সূর্যর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল।
 
সূর্যর হাত তখনও জ্বলছিল। কিন্তু ওই হাসি দেখামাত্র তার শীত-শীত ভাব এল। কৃষ্ণ তখন পরমানন্দে একটা দূর্বার ডাঁটা চিবোচ্ছেন। সূর্য জিজ্ঞাসা করল, রাধাদেবীর কী অবস্থা হবে?
 
কৃষ্ণ বললেন, এতক্ষণে সে বিছানায় ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গিয়েছে।
 
সূর্য বলল, আপনি কিন্তু মিথ্যেটাকে সত্যি করে বুঝিয়ে দিলেন।
 
কৃষ্ণ বললেন, মিথ্যে? মিথ্যে কোনটা? ভালোবাসা হচ্ছে একটা মহান যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের অন্যতম একটা অস্ত্র হল ছলনা। এই ছলনায় কোনও পাপ হয় না। কৃষ্ণ চলে গেলেন বিপরীত দিকে।
 
একা দাঁড়িয়ে কেমন শীত-শীত করতে লাগল সূর্যর। জোলো বাতাস নদীর শীতলতা তুলে নিয়ে আসছে মধ্যরাতে। ভালোবাসা জিনিসটা কী? যে পুরুষের জন্যে নারী জীবন দিতে তৈরি সেই পুরুষ সম্পর্কে তার মোহভঙ্গ হলে নিমেষে ছেড়ে যেতে পারে? ডেসডিমনার মুখে প্রেম থেকে ঘৃণা তৈরি হতে দেখেছিল সে। ওথেলোর অত অনুশোচনায় কান দিল না মেয়েটা। আবার শুধু প্রেম। নয়, স্ত্রীর মর্যাদা না পেলে নারী নিজেকে প্রতারিত ভাবে। রাধা বলে গেলেন, তিনি আর শুধু প্রেম করতে আসবেন না। কৃষ্ণ যা বলেছেন তা যদি সত্যি হয় তাহলে তো ওঁদের সম্পর্কের এখানেই। ইতি। ভালোবাসার কত মুখ? সূর্যর সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। সে দ্রুত পা চালাল নদীর কাছ থেকে সরে যেতে।
 
কিছুদূর অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটার পর সে বিলাপ শুনতে পেল। কোনও পুরুষ আকুল গলায় কিছু বলছে। সূর্য দাঁড়িয়ে পড়ল। খানিকটা এগোতেই সে রাজপ্রাসাদের মতো একটি অট্টালিকা দেখতে পেল। দুয়ারে কেউ নেই। চওড়া সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। সূর্য ওপরে চলে এল। সামনের ঘর থেকেই সেই বিলাপ ভেসে আসছে। উঁকি মারতে সূর্য সুসজ্জিত একটি ঘর দেখতে পেল। এক বৃদ্ধ চুপ করে বসে আছেন কেদারায়। তাঁর সামনে বসে এক যুবক বিলাপ করছিল। দুজনের পোশাক দেখেই বোঝা যায় এঁদের ধনসম্পত্তি প্রচুর। যুবক বলছিল, আর এসবের জন্যে আপনি দায়ী।
 
আমি? পুত্র, তুমি এ কী কথা বলছ? বৃদ্ধ নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন।
 
নিশ্চয়ই। সেই যখন মনসাকে পুজো করবেনই তখন ওঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাওয়ার কি দরকার ছিল?
 
সেটা আমার আত্মসম্মানের প্রশ্ন ছিল। মানুষ হিসেবে আমি শেষপর্যন্ত দেবীর অহঙ্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। এবং শেষপর্যন্ত বাঁ হাতে তাঁকে অর্ঘ্য দিয়েছি। বৃদ্ধকে এখনও গর্বিত মনে হচ্ছিল।
 
কিন্তু আপনাদের এই জেদাজেদিতে আমার এত বড় সর্বনাশ করলেন কেন?
 
কী সর্বনাশ করেছি তোমার? পিতা কখনও পুত্রের সর্বনাশ করতে পারে?
 
আপনি করেছেন। মনসা আমাকে বধ করতে চেয়েছিলেন। আপনার অন্যান্য সর্বনাশের সঙ্গে না হয় আমারও প্রাণহানি হত। কী দরকার ছিল আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করার? আপনি আমাকে বাঁচাবেন আর দেবী আমাকে মারবেন। আমি পড়লাম মাঝখানে। যখন বাঁচাতে পারবেনই না তখন এই জেদের কোনও মূল্য ছিল? যুবক উঠে দাঁড়াল। তাকে খুব হতাশ দেখাচ্ছিল।
 
কিন্তু পুত্র, তুমি বেঁচে আছ এখনও।
 
এরকম বাঁচতে আমি চাইনি। ঠিক আছে, আপনি আমাকে একটু একা থাকতে দিন।
 
পুত্র, তোমার কষ্টের কারণ আমায় খুলে বলো।
 
বেশ, না-হয় দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করবেন বলে আমায় লোহার ঘরে রেখেছিলেন যাতে কোনও সাপ দংশন করতে না পারে, কিন্তু আমায় বিয়ে দিয়েছিলেন কেন?
 
কেন? বেহুলা তো যথেষ্ট রূপবতী, দেবতারা পর্যন্ত তার প্রশংসা করেছেন।
 
ওকথা থাক। আমার প্রশ্নের উত্তর এখনও পাইনি।
 
বেহুলার মধ্যে যেসব লক্ষণ ছিল তার একটি হল, সে কখনও বিধবা হবে না। তোমার সঙ্গে তার বিয়ে দিলে দেবী মনসা তোমাকে বধ করতে পারবেন না বলে আমার ধারণা ছিল। সে যে বিধবা হয়নি তা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এই কি তোমার বিলাপের কারণ? আমি তোমাকে বুঝতে পারি না।
 
কথাগুলো বলে চাঁদসদাগর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
 
সূর্য দেখল, লখীন্দর অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন। এই সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হল। সূর্য দ্রুত চলে এল একটা থামের আড়ালে। একজন সুন্দরী মহিলা হাতের রেকাবিতে নানা ফুল ও ফল। নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বোঝা যায় তিনি পূজা দিয়ে এলেন। লখীন্দরকে দেখে একমুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে মহিলা প্রফুল্লমুখে বললেন, স্বামী পূজার ফুল গ্রহণ করুন।
 
না থাক। উলটোমুখে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে লখীন্দর তাঁকে যেতে নির্দেশ করলেন, আমি একা থাকতে চাই। বিরক্ত কোরো না আমাকে।
 
কী হয়েছে আপনার? আপনি কি অসুস্থ নারী এগিয়ে গেলেন।
 
অসুস্থ? আমি তার চাইতেও বেশি।
 
আপনি এমন আচরণ করছেন কেন?
 
ঘুরে দাঁড়ালেন লখীন্দর, শোনো বেহুলা, তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই। এসব কথা কখনও বলব না ভেবেছিলাম কিন্তু আমি আর জ্বালা সহ্য করতে পারছি না।
 
আমাকে নিয়ে আপনি জ্বলছেন? বেহুলা যেন পাথর হয়ে গেল।
 
হ্যাঁ। তোমাকে আমি চিনতাম না। আমার সম্পর্কে তোমার অন্য মমতা থাকার কথাও নয়। পিতা যখন তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করলেন তখন তুমি রাজি হলে কেন?
 
কারণ আপনি সুপুরুষ এবং সৌম্য। কি
 
ন্তু আমার মৃত্যুযোগ ছিল।
 
আমার বৈধব্যযোগ ছিল না।
 
বেশ। সাপ যখন আমায় দংশন করল তখন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে কেন?
 
আমাকে দেবী কপটভাবে তন্দ্রাচ্ছন্ন করেছিলেন।
 
যখন আমি মৃত তখন তুমি ভেলায় উঠলে কেন?
 
আমার বৈধব্যযোগ নেই সেটা প্রমাণ করতে।
 
উঃ, আমি আর পারছি না!
 
কী হয়েছে স্বামী?
 
তুমি সতী হতে চাওনি।
 
সতী হওয়া তো আমার ইচ্ছাধীন। কেউ জোর করতে পারত না। এমনকী আমি পুনর্বিবাহ করতে পারতাম।
 
তাহলে তুমি ভেলায় চেপে আমার মৃতদেহের সঙ্গে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেলে কেন?
 
আমার মনে বিশ্বাস ছিল, আপনাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবই। আপনি যখন লৌহবাসরে নিদ্রামগ্ন, সাপ যখন আপনাকে দংশন করেনি, তখন আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল আমার জীবন ধন্য। আর সেই কারণেই নদীপথের সমস্ত বাধা আমি অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছিলাম।
 
কিন্তু, কিন্তু তুমি কেন দেবসভায় গিয়ে নাচলে? তীব্র স্বর লখীন্দরের।
 
তা না করলে দেবতার কৃপা পেতাম না আমি।
 
কিন্তু ওই নোংরা লোলুপ চোখের সামনে আমার স্ত্রী নাচছে তার যৌবন নিয়ে? যেখানে রম্ভা উর্বশীর মতো বারবনিতা নাচে? তোমাকে দর্শনে ভোগ করল দেবতারা। তুমি শরীরের মোহে তাদের সন্তুষ্ট করে আমায় প্রাণ ফিরিয়ে দিলে। কে চেয়েছিল এই প্রাণ? প্রতিরাত্রে যখন তুমি ঘুমিয়ে থাকো তখন আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠি। যে নাচ দর্শককে সন্তুষ্ট করে সেই নাচে নাচিয়ের অংশ থাকে। তার মনেও সেই সন্তুষ্টি জন্ম নেয়। তুমি দেবতাদের। সামনে ওই নৃত্য পরিবেশন করে আমাকে অপবিত্র করেছ।
 
স্বামী, পঙ্কেই পঙ্কজ জন্মায়। তাই বলে পঙ্কজের পবিত্রতা ম্লান হয় না। দেবসভায় আমি এমন কোনও আচরণ করিনি যাতে আপনার অসম্মান হয়, আমার হৃদয় অপবিত্র হয়। আপনার পিতা দেবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন কিন্তু তিনি পরাজিত। আমি ভাগ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী। আর কে না জানে, ভালোবাসা এবং যুদ্ধে কোনওকিছুই অন্যায় নয়।
 
চুপ করো। আমি মেনে নিতে পারছি না একথা।
 
স্বামী, এভাবে বলবেন না। আপনি যদি আমাকে সন্দেহ করেন তাহলে আমি আপনার সঙ্গে বাস করতে পারব না। আমার বৈধব্যযোগ নেই কিন্তু আপনার স্ত্রীহানি ঘটবে না একথা কোনও দৈবজ্ঞ বলেনি। প্রচণ্ড মর্যাদায় পা ফেলে বেহুলা লখীন্দরের সামনে এগিয়ে গিয়ে নিজের আংটি খুললেন। আংটির ঢাকা সরিয়ে সেটা স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই আংটিতে বিষ আছে। ভেলা কিংবা দেবসভায় এটি আমার হাতে ছিল। তখন প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু মনে হচ্ছে সেই সময় এসেছে। আপনি আমার মুখে ওই বিষ ঢেলে দিন।
 
বেহুলা মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট আলগা করলেন। লখীন্দর কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। আড়ালে দাঁড়িয়ে সূর্য কেঁপে উঠল থরথর করে। সে আর দাঁড়াতে পারল না। দৌড়ে নামতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। সেই পায়ের আওয়াজ কানে যাওয়ামাত্র লখীন্দর চিৎকার করে উঠল, কে, কে ওখানে?
 
পাগলের মতো দৌড়োচ্ছিল সূর্য। তৃতীয় প্রহরের বাতাস এখন আরও শীতল। তার শরীরে কাঁপুনি এসেছিল। অনেক খোঁজার পর সে সেই ইউক্যালিপটাস গাছটাকে দেখতে পেয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে তার তলায় পৌঁছে গেল। সূর্য দেখল ড্রাইভার তখনও গাড়ির বনেট খুলে ইঞ্জিন দেখছে। পায়ের আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল, কী খবর?ঠান্ডা লাগছে। বলে মনে হচ্ছে?
 
কোনওরকমে মাথা নাড়ল সূর্য। হ্যাঁ।
 
হাসপাতালটা ঘুরে দেখলেন?
 
সব দেখিনি। তবে যা দেখেছি, তাতেই–।
 
উঠে বসুন। ড্রাইভার নিজের সিটে বসল। গাড়িতে ওঠার আগে সূর্য জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, বেহুলাকে কি লখীন্দর খুন করেছে এর মধ্যে?
 
জানি না। শুধু জানি, দুটো নারী-পুরুষ যতক্ষণ একত্রিত না হয় ততক্ষণ উষ্ণ থাকে।
 
*
 
কপালে জ্বালা বোধ হওয়ায় হাত উঠে গেল নিজে থেকেই। কিন্তু মশাটা মরল না। সূর্য আবিষ্কার করল সে বসে আছে নন্দনের পাঁচিলে। চারধার শুনশান। তন্দ্রার ঘোর কাটতেই সে ঘড়ি দেখল। নটা কুড়ি। এবং এই সময় পায়ের আওয়াজ হতেই চোখে পড়ল রবীন্দ্রসদনের পেছনে দরজা। দিয়ে মানসী সোম হাইহিল পরে এগিয়ে আসছে একা। সোজা হয়ে দাঁড়াল সূর্য। মানসী অবাক। তার সামনে অত্যন্ত স্মার্ট একটি পুরুষ দাঁড়িয়ে। সে বলল, খুব দুঃখিত। আসলে ফাংশন শেষ।
 
হওয়ার পর সবাই এমন ধরল না! চলুন, কোথাও গিয়ে মিনিট পনেরো বসি।
 
সূর্য হাসল, থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। আপনি এসেছেন তাতেই ধন্যবাদ দিচ্ছি। কিন্তু আমার অন্য কাজ আছে। যদি কখনও সময় পাই দেখা হবে। কথাটা বলার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
 
মাথা নেড়ে নায়কের মতো পা ফেলে সূর্য রবীন্দ্রসদনের পেছন থেকে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। সে চকিতে দেখে নিল সেই ট্যাক্সি বা তার ড্রাইভার কোথাও নেই। বরং লাল মারুতি অপেক্ষা করছে। জীবনে এই প্রথম নিজেকে খুব হালকা এবং স্মার্ট মনে হচ্ছিল তার।
 
এই মুহূর্তে আর এক সূর্য যেন তাকে দখল করেছে যে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় হাঁটছিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত