| 29 মার্চ 2024
Categories
সাক্ষাৎকার সাহিত্য

মানুষ সমন্ধে আমার কোনো তত্ত্ব নেই: পাবলো নেরুদা

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

মেহেদী হাসান

১৯৭১ সালের শেষের দিকে এই সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ ‘নেরুদা, একজন আমেরিকান কবি’ শিরোনামে রেডিও কানাডা থেকে প্রচারিত একঘণ্টার রেডিও অনুষ্ঠানে প্রথম ব্যবহার করা হয়। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল ফরাসি ভাষায়, যে ভাষাটি নেরুদা খুব ভালোভাবে জানতেন, ১৯২০-এর প্রথমদিকে নেরুদা সান্তিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাষায় লেখাপড়া করেছেন। এই প্রথমবারের মতো সাক্ষাৎকারটি সম্পূর্ণভাবে এখানে প্রকাশ করা হল। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন এরিক বকস্টায়েল। বাংলা ভাষায় এই প্রথম এটি অনুবাদ করেছেন মেহেদী হাসান।

পাবলো নেরুদার রেডিও সাক্ষাৎকার
পাবলো নেরুদা


এরিক বকস্টায়েল : আপনার কবিতার পাঠকরা খুব সহজেই আপনার কবিতার মধ্যে ‘শ্রমজীবীশ্রেণির বিশ্ব’-র অস্তিত্ব টের পায় এবং কেউ কেউ আপনাকে একজন রাজনৈতিক কবি হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।

পাবলো নেরুদা : এই কথাটি জোর দিয়ে বলতে চাই যে আমি কোনো রাজনৈতিক কবি নই। আমি সেই ধরনের শ্রেণি বিভাগকে ঘৃণা করি, যেখানে আমাকে মতাদর্শে দায়বদ্ধ কবিতার একজন প্রতিনিধি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। একজন লেখক হিসেবে আমার বাসনা হচ্ছে, যদি কোনো বাসনা থেকে থাকে, তা হল চারপাশে যা কিছু আমি অনুভব করি, যেগুলো আমাকে ছুঁয়ে যায়, যা কিছু আমি জানি, যে সমস্ত জিনিস আমি ভালোবাসি অথবা যে সকল কিছুকে আমি ঘৃণা করি তাদের সবকিছু সমন্ধে লিখে যাওয়া। কিন্তু আমার সঙ্গে ‘শ্রমজীবীশ্রেণির বিশ্ব’-কে জড়িত করার মধ্য দিয়ে আপনি আমাকে অবচেতন এবং সুহৃদয়ভাবে জনমানুষের অথবা সুসংগঠিত শ্রমিকশ্রেণির সংগঠনগুলোর উদ্বেগ-আকাঙ্ক্ষার মুখপাত্র বানিয়ে দিয়েছেন, তবে এটা ধর্তব্য বিষয় নয়। আমার কবিতার একটি সুনির্দিষ্ট অংশে আমি সমসাময়িক বিশ্বের ও ল্যাটিন আমেরিকান জগতের উদ্বেগ- আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি করেছি মাত্র। তবে আমি রাজনৈতিক কবি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হতে অস্বীকার করি।

যে সমস্ত কবি তাদের জনগণের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে মিলিত হয় না বা কখনও হয়নি, যারা সবসময় নিস্পৃহ থাকে, অথবা যারা নিদারুণ বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে তাদের কবিতা লেখা চালিয়ে যায় এবং প্রচার করে, তারাই কেবলমাত্র আমাদের যুগের রাজনৈতিক কবি হিসেবে যোগ্য হতে পারে। সামাজিক বিকাশের গণআন্দোলন, বৈশ্বিক এগিয়ে চলা তাদের কবিতায় অনুপুস্থিত থাকে বিধায় তারা অগ্রগতিকে পিছনে ধরে রাখে। এ ব্যাপারে তারাই প্রকৃতজন— এ ধরনের কবিরাই রাজনৈতিক কবি। তারাই মূলত প্রতিক্রিয়াশীল কবি এবং লেখক।

আমার জন্য, শ্রমজীবীশ্রেণি ও গণমানুষ সমন্ধে লেখে যাওয়াটাই হচ্ছে আমার আবেগ-অনুভূতির বিকাশ। এটা নির্দেশিত কোনো কিছু নয়। আমার কবিতাতে মতাদর্শিক নির্দেশনার সঙ্গে এর কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। অপার সমুদ্র, পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য অথবা সর্বোপরি জীবন সমন্ধে আমি যেমন অবহিত ঠিক তেমনিভাবে ল্যাটিন আমেরিকা এবং বিশ্ব সমাজব্যবস্থাপনার বিষয়েও সচেতন হয়ে উঠেছি। সত্যিকার অর্থে, এই উল্লেখযোগ্য বিষয়টি অনেকবেশি স্পন্দনশীল, অনেক উন্নত এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত— যা সকল মানবিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। তাই এটা আমার কবিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিনির্মিত হয়েছে। কিন্তু সাধারণভাবে আপনি যদি আমার সৃষ্টিকর্মের রাজনৈতিক অংশটুকু গ্রহণ করেন, আমার সৃষ্টিকর্মের যে অংশটুকুকে কেউ একজন রাজনৈতিক অথবা সামাজিক অভিধায় আখ্যায়িত করতে পারে, এটা আসলে ওই সৃষ্টিকর্মের চতুর্থাংশ কি পঞ্চমাংশও হবে না। সুতরাং আমি সবসময় কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করে এসেছি। এই শ্রেণিভুক্তকরণে যেখানে তারা আমাকে ফেলতে চায় তা হচ্ছে একটি শত্রুভাবাপন্ন ও বিদ্বেষী শ্রেণিভুক্তকরণ। আমি চাঁদের কবি, ফুলের কবি, সর্বোপরি একজন প্রেমের কবি। এর ফলে বোঝা যায় যে, কবিতার বেশ পুরাতন ধ্যানধারণা আমি লালন করি। আমি যা লিখেছি এবং লিখে চলেছি সেসব কবিতা সমাজের অগ্রগতি এবং প্রগতি ও শান্তির শক্তির দিকে নিয়োজিত থাকার সম্ভাবনার বিরুদ্ধতা করে না।

এরিক বকস্টায়েল : আপনি এই মাত্র বললেন যে আপনি চাঁদের কবি, ফুলের কবি, এবং প্রেমের কবি। কেউ হয়তো আরও বলতে পারে, এই নতুন মহাদেশের প্রস্তর ভূমি, গাছপালা, নদীনালা, পাহাড়-পর্বতের কথা। আমি প্রায়ই ভাবি, ইউরোপিয়ানরা প্রথম এই নতুন জগতটাকে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছিলেন; হারনান্দো করটেজ মেক্সিকো থেকে পঞ্চম চার্লসের কাছে লিখে জানাতেন যে তিনি যা দেখছেন তার খুব কমই তিনি বর্ণনা করতে পারেন। কারণ প্রকাশ করার মতো সঠিক ভাষা তার জানা নেই। কী গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটাই না তৈরি হয়েছিল এই ‘নতুন’ জগতটাকে সংজ্ঞায়িত করতে?

পাবলো নেরুদা : আমি বলতে চাই যে এটা কোনো সমস্যা ছিল না; এটা আসলে ছিল আমাদের দ্বায়িত্বের অন্তর্গত। ল্যাটিন আমেরিকার কবিদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের নতুন জগতটাকে সংজ্ঞায়িত করা, এই কাজের মাধ্যমে বিশ্বের সৃষ্টিকর্মকে পরিপূর্ণ করে তোলাকেই বুঝায়। সংজ্ঞায়িত করা হয়ে গেলে, বিশ্বটা হচ্ছে প্রথম জিনিস, যা মানুষের সজ্ঞানতা অথবা মৌলিক জিনিসের সংজ্ঞায়নের উর্ধ্বে থেকে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে। সুতরাং আমাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অন্তর্গত বস্তুটি অত্যধিক মাত্রায় অস্পষ্ট এবং রহস্যময়। এবং আমাদের নিজস্ব মহাদেশের এই জ্ঞান— বিশেষ করে এই আমলের শেষ বছরগুলোতে নিজেই একটি দায়িত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়, যখন থেকে আমি লিখতে শুরু করেছি, আমার বিশ বছর বয়সের পর থেকে, যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন যুবক ছাত্র ও একজন তরুণ কবি ছিলাম।

সবচেয়ে বড় এবং চৌম্বকীয় আকর্ষণ ছিল ইউরোপীয়ান সংস্কৃতি এবং বিশেষ করে ফরাসী সংস্কৃতির প্রতি। এমনকি আমাদের লেখকও ছিল, অধিকন্তু বেশ মেধাবী লেখক, যারা ফরাসি ভাষা ব্যতীত লিখতেন না। ইকুয়েডরিয়ানরা তাদের মহাদেশকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করত, যাকে তারা ভালো করে জানত না। এর মাধ্যমে তারা শুধুমাত্র নিজেদের গতিপথই ঘুরিয়ে দেয়নি, তাদের ভাষাকেও পরিবর্তন করে ফেলেছে। তাদের এই নান্দনিক অবস্থানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, তদুপরি যেটি একটি শ্রেণি অবস্থানও বটে, ল্যাটিন আমেরিকার উচ্চ গোষ্ঠীর লোকজন সর্বদা উন্নত সংস্কৃতির একজন হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করত এবং আধুনিক ইউরোপিয়ান সমাজ এবং এর ইউরোপিয়ান জনগণের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে চাইত।

ঠিক সেই সময় এক বিশেষ ধরনের ‘শিল্পের খাতিরে শিল্প’ ল্যাটিন আমেরিকাতে প্রাধান্য বিস্তার করে। আমি এবং এমনকি যারা ঠিক একই সময়ে লিখতে শুরু করেছি— তারা কেউ উদ্ভাবন করতে পারিনি, কোন বিষয়টা আসলে আমাদের নিজেদের, আমাদের দেশ, আমাদের জনগণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই তত্ত্বের আবিষ্কারক আমরা ছিলাম না। এটা একেবারে শুরু থেকেই অস্তিত্বময় ছিল, এমনকি সেই প্রথম কবির মধ্য দিয়েও শক্তিমত্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। কবি এক্রিলার উদাহরণ আমাদের হাতে আছে। আমাদের দেশে কাব্যসাহিত্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন স্পেনীয়, রাজা পঞ্চম চার্লসের নাইট, যে প্রথম বিরাট সাফল্যের মধ্যদিয়ে আবির্ভূত হয়। এই লোকটিই চিলি সমন্ধে সবচেয়ে নাটকীয় এবং আগ্রহউদ্দীপক লেখা লেখেছিলেন। লিখেছিলেন এটার আদিম ইন্ডিয়ান লোকজন সমন্ধে, যারা তিনশত বছর যাবত তাদের স্বাধীনতা সুরক্ষা করে আসছিল। এক্রিলাই সেই ব্যক্তি যার মধ্যে আমাদের একাগ্রতার বীজ অন্তর্নিহিত ছিল।

কিন্তু বিংশ শতাব্দীতেই আমাদের উচ্চগোষ্ঠীর মানুষজন ধনী হয়ে ওঠে, পুঁজিবাদ দ্বারা আমাদের মহাদেশে শোষণপর্ব শুরু হয়, যা একটি অভিজাতশ্রেণিকে জনগণের উপর বড় মাপের শোষক হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার অনুমতি প্রদান করে। যা ইউরোপিয়ান ধরনে জীবনযাপনকেই কেবল সময়োচিত করে তোলে। এই প্রভাব বলয়ের মধ্যে থেকে এবং যে প্রণোদনা আমাদের বর্তমান সময়েও সচেতন ও অবচেতনভাবে বিরাজমান। অনেক কবি বৈশ্বিক ব্যক্তিত্ব হতে চান। নিজেদের ইউরোপিয়ান সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে মিশিয়ে দিতে চান বৈশ্বিক সংস্কৃতির সঙ্গে। কিন্তু আমরা আমাদের মহান পূর্ববর্তীদের উদাহরণ অনুসরণ করেছি। আমাদের চোখ রেখেছি জীবনের উপর, জনগণের দুর্ভোগ ও দুর্দশার উপর এবং আমাদের ল্যাটিন আমেরিকার অসাধারণ ভূমি ও চমৎকার আবাসস্থল, গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু, সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর। এটা নতুন কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু আমরা এমন একটি নতুন প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম যেখানে শ্রেণিসংগ্রাম অনেক, অনেক বেশি নিদারুণভাবে প্রকট হয়ে উঠেছিল। আমরা শ্রমিকদের আলাদা অথবা সামষ্টিক ব্যক্তিগত জীবন সংগ্রামেও সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। এটা করার মাধ্যমে আমরা ছিন্ন করে ফেলেছিলাম সেই বন্ধন, যা উচ্চতর গোষ্ঠীর নিম্নভূমির সঙ্গে আমাদের বেঁধে রেখেছিল। নিশ্চিতভাবে ইউরোপিয়ান জীবনযাপন পদ্ধতির সঙ্গেও যা আসলে বাস্তবিক অর্থে মৃত ছিল না। অধিকিন্তু এটাকে বাঁচানো প্রয়োজন ছিল। কারণ কেউ একজন নিশ্চয় ওই পরিস্থিতির ভালো এবং মন্দ দুটোকেই একই ঝুড়িতে রাখবে না।

তার মানে আমাদের আছে ইউরোপিয়ান সংস্কৃতির বিশাল ঐতিহ্য যেটাকে আমরা যথেষ্ট মূল্যায়ন করি এবং শ্রদ্ধা করি। এটা ব্যতীত আমাদের যেমন বেঁচে থাকা কঠিন, তেমনি লেখক হিসেবে, চিন্তাবিদ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আমরা ইউরোপিয়ান সংস্কৃতিকে ব্যাপক আকারে ধারণ করি। আমাদের গড়ে তুলতে হবে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। নিজস্বতা অর্জন করতে হলে মনোযোগ দিতে হবে নিজেদের মহাদেশের প্রতি। যা অনেক কঠিন একটি পথ। এই পথটাই অনেক বেশি সঠিক। এটা এমন একটি রাস্তা যা মাঝে মাঝে আমাদের বিপথে নিয়ে যায়। যাহোক, আমরা বিপথ বা বাস্তবতার ভয়ে ভীত নই। কিন্তু আমরা বিশ্বের প্রত্যেকটা দেশের সংস্কৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের সম্ভাব্যতাকে গ্রহণ করি, স্বভাবতই যখন চিনতে পারি ইউরোপিয়ান সংস্কৃতির কিছু অপরিহার্যতাকে।

এরিক বকস্টায়েল : ‘কান্টো জেনারেল’-এর মূল লক্ষ্য কী?

পাবলো নেরুদা : ‘কান্টো জেনারেল’-এ কোনো তাত্ত্বিকতা নেই। আমি যে বিষয়টি খুঁজে পেয়েছিলাম, কাজ শুরুর সময়েই, তা সেখানে ছিল। সাধারণত আমি তত্ত্বের বিরোধিতা করি। ‘কান্টো জেনারেল’ হচ্ছে সুবিন্যস্ত একটি কাজ, যা একটি নির্দিষ্ট অবয়ব নিয়ে গড়ে উঠেছে, যাকে আমি চিরায়ত কাব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করতে চাই না। কিন্তু শেষ বিচারে এটার একটা সার্বিক অবয়ব আছে, যদিও এটার সাধারনতা শুধুমাত্র হঠাৎ উত্থিত কোনো সচেতনতার ব্যাপার নয়। বরঞ্চ এটা আমার প্রতিদিনের জীবনযাত্রার জৈব জীবন, ওই সচেতনতাটাকে বড় করে তোলার সময় আমেরিকা মহাদেশের সকল অঞ্চল ও সমস্ত দেশের জন্য একই ধরনের আন্তরিকতা, একই ধরনের ভালোবাসা নিয়ে আমি বইটি লিখতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমি অনুধাবন করতে পারি যে, এটা শুধুমাত্র কোনো বিশ্লেষণের বিচ্ছিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল মাত্র নয়, যা একটি কাজ সম্পাদন করার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটা বরঞ্চ এমন একটি বই, যা শুরু হয়েছে আমার নিজের জন্মের সঙ্গে, অথবা নিজেকে একজন লেখক মনে করার হঠাৎ উত্থিত সচেতনতার মধ্য দিয়ে। ‘কান্টো জেনারেল’-এ আছে কার্যত সকল কিছুর ভেতরে নিজেকে বিশাল করে তোলার বাসনা, আমাদের আমেরিকা মহাদেশের সকল বোধগম্য বিষয়ের কথা। এবং এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর আমেরিকার বিষয়ও এখানে স্থান পেয়েছে। কিন্তু মূলত এটা হচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকার একজন কবির ব্যক্তিত্বের বিকাশ, যে তার মহাদেশকে জানে। যে এমন কিছুর ভেতরে প্রবেশ করতে চায়, যা সে জানে না। এটা এমন একটা কবিতা যা শেষ হয়নি, যা অন্য সব কবিদের দ্বারা চলতে থাকবে; এটা কোনো ধরনের আবদ্ধ কাজ নয়, এটা উন্মুক্ত একটি কাজ যেখানে সকল ধরনের চলমানতা এবং সকল নতুন সৃষ্টি এবং এই নতুন মহাদেশের সকল নতুন সমস্যা প্রবাহিত হতে পারবে।

এরিক বকস্টায়েল : আবির্ভূত হওয়া মহাদেশীয় সচেতনতাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

পাবলো নেরুদা : রুবেন দারিয়োর সময়ে ল্যাটিন আমেরিকার উচ্চ গোষ্ঠীর লোকজনের, শ্রেণিসমূহের এবং বুর্জোয়াশ্রেণির উন্নতির পূর্বপর্যন্ত তা ঐতিহাসিকভাবে বিশাল গুরুত্বের সঙ্গেই চলে আসছিল। ওই সমাজে এমন একটি আবেগ ছিল, কেউ একজন যেটাকে ‘প্রতি-বিপ্লবী’ হিসেবে অভিহিত করতে পারে। আমরা যদি বিকল্প কোনো শব্দ ব্যবহার করতে চাই— তা হতে পারে ‘অ্যান্টি-বলিভারিয়ান’। সিমন বলিভার সামগ্রিকভাবে পুরো মহাদেশের কথা ভাবতেন। সান মার্টিন, সুক্রে ও ও’হিগিনসদের মতো স্বাধীনতাবাদীরা সর্বদা ল্যাটিন আমেরিকাকে একটি বিশাল একক মহাদেশ, অনেকটা যেন একটি একক দেশ হিসেবে চিন্তা করতেন। বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনগুলো পারস্পারিকভাবে একে অপরের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সিমন বলিভার যিনি ভেনেজুয়েলাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কাজ করেছিলেন পেরুর জন্য; সান মার্টিন, যে একজন আর্জেন্টাইন ছিলেন, চলে গিয়েছিলেন ইকুয়েডর পর্যন্ত; ও’হিগিনস, যিনি চিলির অধিবাসী ছিলেন, পেরুর জন্য গঠন করেছিলেন মুক্তিকামী নৌবহর। তখনকার দিনে জাতীয়তাবাদী আবেগ অনেক শক্তিশালী ছিল, কিন্তু তারা মহাদেশীয় দেশপ্রেমে নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু বুর্জোয়াশ্রেণি, গ্রান্ড বুর্জোয়াশ্রেণি ল্যাটিন আমেরিকাতে স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন সময়েই সামনে চলে এসেছিল, বিশাল প্রভাবের সঙ্গে অবদান রেখেছিল ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে। এটা ছিল অনেক দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া, যা নিশ্চিতভাবেই জোড় বেঁধেছিল সামন্তবাদের সঙ্গে, একাত্মতা ছিল সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেও। তখন ল্যাটিন আমেরিকা হয়ে পড়েছিল একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু বাক্সের সমষ্টি। এর ফলে বেড়ে উঠে প্রতিবেশী দমনের রাজনীতি যেখানে ব্রিটিশ ও জার্মান অথবা পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব এই বিচ্ছিন্নকরণে পালন করেছিল ব্যাপক ভূমিকা, যা বাস্তবিকভাবে দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পারিক যোগাযোগকে নিরুৎসাহিত করেছিল, যে দেশগুলো একই ভাষায় কথা বলে এবং যেগুলোর উৎপত্তি হয়েছে একই উৎস থেকে।

এই বিচ্ছিন্নকরণ এখন পর্যন্ত চলছে। আমাদের ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর মাঝখানকার ভূমিকম্প অথবা বিপ্লবী আন্দোলন অথবা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের খবরগুলোই কেবল জানতে পারি। কিন্তু উত্তর আমেরিকা সমন্ধে আমরা সবকিছু জানি। বর্তমান সময়ের মামুলি পাঠকরা হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিবাহ-বিচ্ছেদের সমস্ত কিছু সমন্ধে এবং স্বাভাবিকভাবেই প্রিন্সেস মোনাকোর সকল বিষয়ে অবগত থাকে। কিন্তু সকল শ্রমজীবীশ্রেণির সংগ্রাম অথবা ট্রেড ইউনিয়নের সামাজিক অগ্রগতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ড, মেধাবী লেখকদের বই খুব কমই নিজ নিজ দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে যেতে পারে।

তবে যে কোনো ক্ষেত্রে, পেরুর মহান বস্তুবাদী দার্শনিক এবং লেখক মারিয়ারতেগুই-র কথা মতে, আমাদের আন্দোলন এবং এই প্রজন্ম ‘প্রত্যেকটি ল্যাটিন আমেরিকান মানুষের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একই’ বলিভারিয়ান আদর্শের এই কথা নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। তার মানে আমরা যে কাজগুলো করেছি সেগুলো তার এই উদাহরণ এবং এই নতুন আবিষ্কারগুলোকে অনুসরণ করে চলেছে। এবং ‘কান্টো জেনারেল’ হচ্ছে এই ধরনের একটি কাজ। কিন্তু আমার মনে হয় যে রাজনৈতিক চিন্তা হচ্ছে মহাদেশীয়, এবং এটাই হচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্মের লেখকদের আবেগ, প্রায় ত্রিশ বছর পর, যা অনেক বেশি পরিমাণে সাদৃশ্যপূর্ণ হচ্ছে এবং একই ধরনের চিন্তার উত্থান ঘটাচ্ছে— স্বাভাবিকভাবে অনেক বিভিন্নতা সঙ্গে নিয়েই, কিন্তু একটা একক মহাদেশের মতো যার আছে একই ধরনের নিরক্ষরতা, অজ্ঞানতা, অনুন্নয়নের সমস্যা।

এরিক বকস্টায়েল : স্পেনের গৃহযুদ্ধেরও মনে হয় একই ধরনের প্রভাব ছিল।

পাবলো নেরুদা : অবশ্যই, স্পেনের গৃহ যুদ্ধ সাহিত্যে নতুন একটি পরিপেক্ষিত এনে দিয়েছিল এবং ল্যাটিন আমেরিকার লেখকদের নাড়িয়ে দিয়েছিল ভয়ানকভাবে। এটা খুবই স্পষ্ট যে সমকালীন ইতিহাসে ল্যাটিন আমেরিকার লেখক ও জনগণের কাছে স্পেনের গৃহযুদ্ধের মতো এমন গভীর বোধগম্য আর কোনো বিষয় ছিল না। স্পেনের এই যুদ্ধ আমাদের সমস্যা এবং চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে ব্যাপক ও অনেক বেশি সামষ্টিক বহুত্ববাদী নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছিল। এটা ছিল ল্যাটিন আমেরিকার লেখকদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করার সময়। আসল কথা হল, ভাইয়েহো, অক্তাবিও পাস ও আমি ছিলাম তার চেয়েও একধাপ এগিয়ে, এটা আমাদের চিন্তাভাবনা এবং আমাদের প্রত্যেকের কাজের মধ্যকার বিভিন্নতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যে কোনো ক্ষেত্রে এটা খুঁজে বের করা তোমাদের জন্য উপযুক্ত কাজ হবে। কারণ আমি যেমন বলেছি স্পেনের এই যুদ্ধ প্রথম বারের মতো ল্যাটিন আমেরিকার লেখকদের একতাকে বের করে নিয়ে এসেছিল একটি ঐতিহাসিক বোধগম্যতার দিকে, যার প্রভাব খুব স্বাভাবিকভাবেই ল্যাটিন আমেরিকার ব্যাপারে তাদের উন্নতিকে তরান্বিত করেছিল।

এরিক বকস্টায়েল : এমন অনেকেই আছেন যারা ঐ কাব্যের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে, এটাকে বস্তুবাদী অথবা এমনকি ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করবেন।

পাবলো নেরুদা : আমি মনে করি না যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ থেকে কবিতা তৈরি হতে পারে। বলতে হয় যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হচ্ছে এমন একটি বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক সম্ভাবনা সেখানে সকল ধরনের বোধগম্যতা অন্তর্ভুক্ত আছে। কেউ যদি আমার কবিতার মধ্যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ খুঁজে পায়, তাহলে তা পুরোপুরিভাবে আমার ধারণার বাইরে। আমি আমার কাজের মধ্যে বস্তুবাদ, বস্তুবাদী বা ঐতিহাসিক আধ্যাত্মিকতা খুঁজে বেড়াই না। আমি শুধু লেখে যাই। লেখার জন্য আমার প্রয়োজন হয় কেবল লেখার ইচ্ছা এবং কাগজ-কলম। লোকজন যে সমস্ত তত্ত্ব আমার কবিতা সমন্ধে তৈরি করে থাকে তা পুরোপুরিভাবে আমার আওতার বাইরের বিষয়। যদি কেউ আমার কাজের সঙ্গে দার্শনিক সম্পর্কসূত্র খুঁজে পায় তাহলে তা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। আমি সকল কিছুর জন্য দরজা খুলে রেখেছি। কিন্তু আমি বলতে পারি যে দৃষ্টিগ্রাহ্য কবিতার ক্ষেত্রে আমি বস্তুবাদী, যেটাকে বলা যায় চরম মাত্রায় দৃষ্টিগ্রাহ্য এবং স্পর্শযোগ্য জিনিস ব্যতীত আমি তা উচ্চারণ করতে পারি না, গাইতে পারি না, লিখতে পারি না। কেউ যদি এটাকে বস্তুবাদী বলে তাহলে আমি বস্তুবাদী।

আমার কবিতাগুলো আপনাকে পড়ে দেখতে হবে। শুধুমাত্র কবিতার শিরোনামগুলো পড়লেই চলবে। কল্পনার মধ্যে নিয়ে আসা যায় এমন সবকিছুর বিষয়েই আমি লিখি। ঠিক তেমনিভাবে মানুষের বিদ্রোহের ব্যাপারেও। এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কবিতার একটি অংশ। বলা যেতে পারে, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, খুবই শ্রদ্ধার্হ। এটা আমার সকল কবিতার ক্ষেত্রে খাটে না; কাউকে হয়তো বিষয়টা পরিষ্কার করতে হবে। আমি বলতে যাচ্ছিলাম যে, কবিদের মধ্যে আমি সবচেয়ে পুরাতন; আমি যথাযথভাবে সুল্লি প্রুধোম, ভিক্টর হুগো অথবা এর পূর্বে আর সকলে যারা ছিলেন— সকল সময়ের সকল কবিদের মতো চাঁদ, তারা, ফুল, ভালোবাসা সমন্ধে গান গাইতে চাই। কবিতাতে আমি বিপ্লবী হয়ে উঠতে চাই না; কবিতাসমন্ধীয় আমার নিজস্ব কোনো মতবাদ নেই; কবিতার বিষয়ে আমার কোনো মতাদর্শ নেই। অপরিহার্য জৈবিক প্রয়োজনের কারণেই আমি কবি। এটাই হচ্ছে আমার একমাত্র মতবাদ। আমি অধিকাংশক্ষেত্রে ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে অপছন্দ করি। না, ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনেকটাই বাইরের ব্যাপার, তবে আমি স্বাভাবিকভাবে কবিতাতে দার্শনিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে অনেক বেশি ঘৃণা করি।

শুধুমাত্র আমার ক্ষেত্রেই নয়। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে, কবিদের অস্তিত্ব আছে এটাই যথেষ্ট। এটা অনেক ভালো যে, কবিরা লিখে চলেছে। কিন্তু যদি কবিদের চল্লিশটি বইয়ের কারণে কাব্য-বিশ্লেষণের চল্লিশ হাজার বইয়ের আগমন ঘটে, তাহলে কবিরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আমি সম্পূর্ণভাবে আক্ষরিক অর্থেই একজন কবি। আমি আমার কবিতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বেশি দূর এগোতে চাই না, তার চেয়ে আমার বেশি প্রয়োজন হচ্ছে গাওয়া, নিজেকে প্রকাশ করা, পৃথিবীর গভীর বিস্ময়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা।

পৃথিবীর চমৎকারিত্বের মধ্যেও আমি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য মানবজাতির তালিকাভুক্ত ধারাবাহিক সংগ্রাম খুঁজে পাই। মানবজাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার ফলে তা আমার গভীর মনযোগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এরিক বকস্টায়েল : এখানে আমার মনে হচ্ছে যে মানবজাতি সমন্ধীয় এই আলোচনাকে আপনি অনেকটা বাস্তবজীবনের সম্মুখ থেকে খুব সহজেই কৌশলে দূরে সরে যাওয়া হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

পাবলো নেরুদা : মানুষ সমন্ধে আমার কোনো তত্ত্ব নেই। আমার তত্ত্ব আছে জুতার উপর যা আমি কিনতে যাচ্ছি যখন আমারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে অথবা আমার কাপড়-চোপড়ের উপর যা ইতিমধ্যেই জীর্ণ হয়ে গেছে। আমি জানি না মানুষ আসলে কী! আমি একজন জীবিত মানুষ এবং ওই ব্যাপারে বলতে গেলে ‘মানুষ’ স্বাভাবিকভাবে আসলে কী তা ভাবার জন্য জীবন নয়। এটা সম্ভবত এমন একটা বিষয়, যা একজন মিস্ত্রী অথবা একজন ভূতত্ত্ববিদের পেশার চেয়েও আমাকে কম আকর্ষণ করে; এটাই আসল বিষয়। কিন্তু মানুষ আসলে কী এই বিষয়ে অন্তহীন বিতর্ক, অনেক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, যা আমাকে আকর্ষণ করে না। আমরা জানি যে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি এবং আমরা মারা যেতে এগিয়ে যাচ্ছি, ব্যাপারগুলো এ রকমই। কিন্তু সবকিছুর মাঝে সম্ভবত এটা বলাই সবচেয়ে কঠিন অথবা সবচেয়ে সহজ বিষয়। এখানে আমার কিছুই করার নেই। আমি বলতে পারব না সমগ্র বিষয়টা আসলে কী। দার্শনিক মতাদর্শ সমন্ধে আসলে সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এটা সম্ভবত তারই একটা উপলদ্ধি— এমন একটা বিষয় নিয়ে অন্তহীনভাবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া যার আসলে কোনো সমাধান নেই। সাধারণভাবে আমি একজন বাস্তববাদী কবি। কবিতা আসলে একটি নির্দিষ্ট ব্যাপারে বাস্তববাদী হতে বাধ্য। কেন নয়? কেন বাস্তববাদী কবিতা অর্থহীন কবিতার মতো, কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়াবে না বা কোনো স্বপ্ন দেখবে না?

তবে এই ভিন্নচিন্তার মাঝে মতদ্বৈততা খুঁজে বের করার চেষ্টা— এই বিষয়টাই আমি বুঝে উঠতে পারি না। এ রকম এড়িয়ে চলা আমাদের নিয়ে যায় সীমাবদ্ধ দার্শনিক অবকাঠামো অথবা অন্তহীন আলাপ-আলোচনা এবং যুক্তিকে সীমাবদ্ধ করার দিকে, যেটা অনেকটা ধর্মীয় প্রয়োজনের মতো; যেটা সম্ভবত অতল অথবা রহস্যময়তার দিকে আমাদের আকর্ষণ। কিন্তু আমরা এই পৃথিবীতে অনেক বেশি ব্যস্ত। ফলে যদি আমরা দেখি যে এই অনুসন্ধান অনেক শতাব্দী ধরে ব্যর্থ হয়ে আসছে, তাহলে কেন আমরা অন্যদের জন্য নির্যাতনের একটি কৌশল হিসেবে এটাকে চালিয়ে নিয়ে যাব। মানুষ আসলে কী এই বিষয় নিয়ে দার্শনিকরা যতখুশি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করুক তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমাকে যেন এই বিষয়ে কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করে। কারণ আমি এই বিষয়ে পুরোপুরিভাবে অজ্ঞ।

এরিক বকস্টায়েল : বাস্তববাদী এবং অবাস্তববাদী কবিতার মধ্যে কাব্যভাষায় মতদ্বৈততা সমন্ধে আপনি যা বলছিলেন, আমি এখন সেখানে ফিরে যেতে চাই।

পাবলো নেরুদা : প্রথমত এটা বিবেচনায় আনা দরকার যে, সরল এবং জটিলতাবিহীন কবিতার জন্য এবং পরীক্ষামূলক কবিতার জন্য, ভাষার পরিবর্তনের জন্য জায়গা আছে। কবি ও লেখক স্বাভাবিকভাবে অনুধাবন করে যে ভাষা অথবা অভিব্যক্তি প্রকাশ করার উপায়ের পরিমাণ ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এর ফলে শুরু হয় অন্তহীন পরিবর্তনের, জন্ম হয় বিরামহীন শিক্ষাবিষয়ক এবং সাহিত্য আন্দোলনের। শিল্পকলার ক্ষেত্রে নন্দনতাত্ত্বিক অবকাঠামোর পোশাক পরিবর্তনকে কেউ প্রত্যাখান করতে পারেনা। শিক্ষার্থীদের জন্য বলব যে, এমনকি যদিও এটা সামান্য একটু নেতিবাচক, নৈরাশ্যবাদী, ধ্বংশাত্বক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, কিন্তু তারপরেও এমনকিছু স্থায়ী বৈশিষ্ট আছে, যা শুধুমাত্র কাব্যের সীমার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে তা নয় শিল্পকলার সকল শাখা সমন্ধেই একথা বলা যায় এবং বিশেষ করে চিত্র কলার ক্ষেত্রে।

তবে এখন শুধু চিত্রকলা এবং কবিতার বিষয়েই কেবল কথা বলা যাক। বুর্জোয়াশ্রেণির অগ্রগতি ও বিশাল বিশাল মহানগরী গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখক এবং চিত্রশিল্পীরা জনগণ এবং সর্বোপরি প্রত্যেকটা মানুষকে অনুধাবন করা থেকে অনেক দূরে চলে যায়। এই (বিংশ) শতাব্দীর শুরু থেকেই বড় বড় শিল্প-কারখানার মালিক বুর্জোয়াশ্রেণি তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে। আমরা সাদা চোখে এটাকে ঠাহর করতে পারি না। কী পরিণতি এটা আমাদের জন্য বহন করে নিয়ে আসবে তা লক্ষ করা এবং পরীক্ষা করে দেখাটাকেও আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। এই শতাব্দী শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিল্প-কারখানার মালিক বুর্জোয়াশ্রেণির বিশাল উত্থানের ফলে গ্যাটে, শিলার, কিটস, বায়রনদের মতো রোমান্টিক কবিদের ভূমিকা হারিয়ে গেছে। কবিরা নিজেদের পরিবর্তন করে ফেলেছে। কবি ও চিত্রশিল্পীরা নিজেদের পরিণত করে ফেলেছে একেকজন বিশেষজ্ঞে। জ্ঞান এবং আবেগ-অনুভূতি, যা লেখার মাধ্যমে অথবা অলংকারিক ভাবপ্রকাশের মধ্য দিয়ে একখাতে প্রবাহিত হয় এবং চিত্রকলারও প্রতিনিধিত্ব করে, তা অনেকটাই দূরে সরে গেছে। তারা ইতিমধ্যেই শিল্প-কলার মধ্যে পেটি এবং গ্রান্ড বুর্জোয়াদের একটি নিশ্চিত আবাদযোগ্য ভূমির জন্য একটি বিশেষায়িত জিনিস হিসেবে জায়গা তৈরি করেছে। শ্রেণি পরিহার করার নৈতিকতার মধ্য দিয়ে পেটি বুর্জোয়াশ্রেণি তার নিজস্ব পথেই গ্রান্ড বুর্জোয়াশ্রেণি হতে এই শিক্ষাটাকে নিজের করে নিতে চায়। প্রেটি বুর্জোয়াশ্রেণি শ্রমজীবীশ্রেণির সঙ্গে নয় বরঞ্চ নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চায় বিশাল পুঁজিপতিদের সঙ্গে।

এই পুরো অর্থনৈতিক অস্তিত্বের নিজের মধ্যেই ছিল তার পরিণতি। কীভাবে আমরা নিজেদের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছি। অর্থনৈতিক ইতিহাস এবং শ্রেণি সম্পর্ক পরিবর্তন করে ফেলার মধ্য দিয়ে কীভাবে নিজেদের নতুন ভাবের পরিস্থিতির মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাব? বিমূর্ত চিত্রকলার মতো উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালানোর সকল পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে আমরা নিজেদের নিয়ে যাব এমন একটি জায়গায় যেখানে যেতে হলে অনেক পথ হাঁটতে হবে। বিমূর্ত চিত্রকলা মহৎ শিল্প উৎপাদন করেছে, কিন্তু এই শিল্পগুলো জনপ্রিয় আবেগ-অনুভূতি থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। কে সঠিক, জনগণ নাকি বিমূর্ত চিত্রকলার শিল্পী? অথবা সবচেয়ে দুর্বোধ্য কবি?

আমি নিজেকে এই সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু মনে করি না। কারণ আমার কবিতা বুঝতে পারাও বেশ কঠিন। কিন্তু আমি একটা জিনিস বলতে পারি, আমার কবিতা পুরোপুরিভাবে একটি আন্তরিকতার প্রকাশ। এটা সম্ভবত একই রকমভাবে অন্যান্য কবিদের বেলায়ও খাটে। কিন্তু চিত্রকলা, নাট্যমঞ্চ, চলচ্চিত্র, কবিতা, কথাসাহিত্য অথবা সংগীত, প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের পুরোপুরিভাবে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, এটাকে একটা ভুল পথ বলেই আমার মনে হয়, বুঝতে পারি এটা এমন একটা কানাগলি, যা আমাদের খুব বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু অপরদিকে, আমি নিজেকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। একজনকে প্রত্যাখ্যান করা হবে পুরোপুরি অযৌক্তিক। চালিয়ে যেতে হবে ক্রমাগত অনুসন্ধান, বড় করে তুলতে হবে আমাদের অভিব্যক্তির সম্ভাবনাকে। সুতরাং সমস্যাগুলো এমন সমালোচনার দ্বারা যেগুলোর কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব নয়, এমনকি অনুধাবন এবং আমাদের কাজের দ্বারাও নয় তবে আমাদের সামাজিক শক্তিগুলোর সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সম্ভব। যখন শ্রেণিসংগ্রাম, মানবিক পরিস্থিতি বিশ্বজনীনভাবে একটি নতুন যৌক্তিকতায় গিয়ে দাঁড়াবে শুধুমাত্র কিছু সুনির্দিষ্ট দেশে নয়। আরেকটু স্পষ্ট করে বলি, যখন প্রাশ্চাত্য সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করবে, তখন হয়তো আমরা একটি ভিন্নসূত্রায়ন দেখতে যাচ্ছি, অথবা একটি ভিন্নব্যবস্থা যেখানে জনগণের আবেগ-অনুভূতি ব্যতিরেকেই জনপ্রিয় সাহিত্য আলোতে আসতে সক্ষম হবে। শৈল্পিক অনুধাবন এবং পরীক্ষণ সম্ভব হবে ব্যাক্তিপরায়ণতা ও স্বাতন্ত্রবাদ বাদে, কিন্তু তা মানবসম্প্রদায়কে শিল্পকলা, সমসাময়িক শিল্পকলা এবং ভবিষ্যতের শিল্পকলাতে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখতে সক্ষম করে তুলবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত