Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,bangla-sahitya-iftar-journal-part-9

সময়ের ডায়েরি: ইফতারি জার্নাল । মুম রহমান

Reading Time: 4 minutes
গাছটার বৈজ্ঞানিক নাম Moringa oleifera। ইংরেজিতে এই গাছটিকে বলে ““miracle tree,” “drumstick tree” কিংবা “horseradish tree” । এই গাছে প্রতি গ্রাম পাতায় গাজরের চারগুন বেশি ভিটামিন এ, দুধের চেয়ে ৪ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম, কলার চেয়ে ৩ গুণ বেশি পটাসিয়াম, কমলালেবুর চেয়ে সাতগুণ বেশি ভিটামিন দইয়ের চেয়ে ২ গুণ বেশি প্রোটিন আছে। চার হাজার বছর ধরে রন্ধন এবং নানা চিকিৎসায় এ গাছের ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রায় ৩০০ রকমের অসুখের চিকিৎসা হয় এই গাছটি দ্বারা। দক্ষিণ এশিয়ায় বহু বছর ধরে বাড়ির আনাচে কানাচে, বনে-জঙ্গলে, পুকুরের ধারে এই গাছ হয়ে আসছে। সম্প্রতি সেনেগাল, মালির মতো আফ্রিকান দেশগুলোতে এর চাষ হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। চাষও খুব সহজ। গাছের একটা ডাল পুতে দিলেই হলো। এই গাছ বাড়েও খুব দ্রুত। দু’তিন বছরে ফুল দেয়। এর ফুল, পাতা, ফল (ডাটা)– সব কিছুই সুস্বাদু।
ইচ্ছা করেই লেখাটা শুরু করেছিলাম গাছটার বৈজ্ঞানিক নাম আর ইংরেজি নাম দিয়ে। এতে করে গাছটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে। আমাদের দেশে তো আবার গেয়ো যোগি ভিখ পায় না, নিজের জিনিস সম্মান পায় না।
তো এতোক্ষণ যে বিস্ময়র গাছটির গুণগাণ গাইছিলাম তার বাংলা নামটা চেনেন না, এমন লোক কিন্তু এ দেশে নাই। চেনা জিনিসের মূল্য হয়তো আমরা কম দেই, তাই একটু কেতা করে ভূমিকা দিলাম। এবার আসল কথায় আসি এই আহামরি মরিঙ্গা বৃক্ষের বাংলা নাম সজনা বা সজিনা। আজ কিন্তু সারা বিশ্বই এই গাছ নিয়ে মাতামাতি করছে। বড় বড় ল্যাবে গবেষণা করছে, এই গাছের জয় জয়কার চারিদিকে। এর নাম উঠেছে সুপার ফুডের তালিকায়।
আমরা হয়তো কম-বেশি সবাই সজিনা’র ডাল বা তরকারি খেয়েছি। কিন্তু সজনে পাতাও যে শাক হিসাবে খাওয়া যায় এটা সবাই জানি না। তেল-রসুন দিয়ে বাগাড় দেয়া সজনে খেতেই শুধু সুস্বাদু নয় পুষ্টিকরও। সজিনা পাতা ও সজিনাতে প্রচুর আঁশ আছে যা খাদ্যনালি ও অন্ত্রতন্ত্রকে পরিষ্কার করে। বিশেষ করে তৈলাক্ত অনেক খাবার আমরা খাই যার তেল রক্ত নালিতে আটকে থাকে। সেগুলো বের করতে সজিনা সাহায্য করে। সজিনার মধ্যে আইসোথিয়োকাইনেটস (রংড়ঃযরড়পুধহধঃবং) নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে যা গ্যাস্ট্রিক, আলসার এবং গ্যাস্টিক জনিত ক্যানসার ঠেকাতে সহায়তা করে।
পানি বিশুদ্ধ করতে আমরা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম নানা পদ্ধতি ব্যবহার করি। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে সজিনার দান পানি বিশুদ্ধ করণে সবচেয়ে ভালো প্রাকৃতিক উপায়। উপস্যুলা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণা সন্দর্ভে বলা হয়েছে, সজিনার দানা পানি দূষণ ঠেকিয়ে দেয়, পানিতে কোন রকম দূষণীয় ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোন উপদান দ্রবীভূত হতে দেয় না। আমেরিকা, নামিবিয়া, ফ্রান্স, বোৎসোয়ানার বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের সাথে যৌথ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে সজিনার আনুবিক্ষণিক প্রোটিন উপাদান পানি বিশুদ্ধকরণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আমি নিজে সেন্ট মার্টিনে আমার এক বন্ধুর রিসোর্টের জলাশয়ে প্রচুর সজনে পাতা ঢেলে উত্তম ফলাফল পেয়েছিলাম। যেমন পানি বিশুদ্ধ করে তেমনি সজিনা শরীরকেও বিশুদ্ধ রাখে। আজকের বিশ্বের নয়া সুপার ফুড সজিনার আজ তারকা খ্যাতি। এই তারকার গুণাগুণ কিছু জেনে রাখলে সুবিধাই হবে। রোগ-শোকের এই কালে সজিনাও উপকারে আসবে।
 
 
 
১. পুষ্টির ভাণ্ডার: লেখার শুরুতেই সজিনার পুষ্টি গুণের কথা বলা হয়েছে। প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম এর পাশাপাশি এতে আয়রণও আছে। আয়রণের দিক থেকে এটি পালং শাকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি শক্তিশালী।
২. এন্টিঅক্সিডেন্টের খনি : সজিনার পাতাকে এন্টিঅক্সিডেন্টের খনি বলা যায়। এর মধ্যে ভিটামিন সি, বেটা-কেরোটিন, কিউরেকটিন এবং ক্লোরোজেনিক এসিড বিদ্যমান। উল্লেখ্য এই সব উপাদানই মানবদেহের জন্য উপকারী। বিশেষ করে ক্লোরোজেনিক এসিড রক্তেচাপ ও শর্করা কমাতে বিশেষ কাজে দেয়। এশিয়ান প্যাসিফিক জার্নাল অব ক্যান্সার প্রিভেনসন দাবী করছে, সজিনার পাতায় বিদ্যমান এন্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার কোষ গড়ে উঠতে বাধা দেয়।
৩. ডায়েবেটিস প্রতিরোধক : এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং আইসোথিয়োকাইনেটস নামের উপাদান সমূহ নিয়মিত গ্রহণে ডায়েবেটিস কমে যায়। প্রতিদিন মাত্র ৫০ গ্রাম সজিনার পাতা খেয়ে ডায়বেটিস ২১ শতাংশ হ্রাস পায়। তিন মাস এক চামুচ করে সজিনার পাতার গুড়া খেয়ে ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
৪. তেলেসমাতি : সজিনার বীজের তৈরি তেলে সত্যিই তেলেসমাতি আছে। অন্য যে কোন ভেজিটেবেল অয়েল-এর চেয়ে এর গুণাগুণি বেশি। দীর্ঘ দিনের লিভারের রোগীর যে এ তেল খুব উপকারী। সালাদা বা যে কোন কিছু ভাজার ক্ষেত্রে এ তেল ব্যবহার করা যায়। খাদ্যের গুণাগণ অটুট থাকে। পচনশীল খাবারকে দীর্ঘস্থায়ীত্ব দিতেও সজিনার তেলের তুলনা নাই। বাতের ব্যথা বেদনায় যেমন ব্যবহার করা যায় তেমনি শীতের আর্দ্রতা থেকে ত্বককে রক্ষা করা, রূপচর্চাতেও এ তেল কাজে লাগে।
৫. কোলেস্টেরল কিলার : ঘাতক কোলেস্টেরলকে হত্যা করে সজিনা আপনার হৃদপি-ের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। থাইল্যান্ডে বহু বছর ধরে সজিনাকে হৃদ রোগের ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ৩ মাসের ব্যবহারে এটি কোলেস্টেরল লেভেল অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারে।
৬. আর্সেনিক দূষণ আর নয় : পানিতে আর্সেনিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যা নিরোধে সজিনার বীজ কিংবা পাতা ভূমিকা রাখে। এমনকি আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করতে সজিনা বী জবা পাতা ব্যবহার কার্যকরী।
এই রকম উপকারী এবং সহজে প্রাপ্য সজিনার ব্যবহার এখন আমাদের কাছে সীমিত আকারেই রয়ে গেছে। সজিনা ডাল আর তরকারির পাশাপাশি খুব সহজেই এর কচি পাতা শাক হিসাবে খাওয়া যায়। পালং, মূলা শাকের মতোই এটিকে রান্না করা যায়। এমনকি সালাদেও টমেটো, শসার সাথে সজনে পাতা ব্যবহার করা যায়। যে কোন স্যুপেও কয়েকটি সজিনা পাতা বাড়তি স্বাদ আর পুষ্টি এনে দেবে। পাতা গুড়া বা বীজের তেল অবশ্য আমাদের দেশে ওভাবে ব্যবহৃত হয় না। সজিনার তেল অবশ্য বেশ দামী, অলিভ অয়েলে চেয়ে বেশি দামী। আমরা চাইলে সজিনার তেল ও গুড়াকে বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করার কথা ভাবতে পারি। ইউনানী ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বহু বছর ধরেই এর ব্যবহার চলে আসছে। আমরা নতুন করে এই সুপার ফুড আর বিস্ময়কর বৃক্ষের কথা ভাবতে পারি।
ও একটা ষড়যন্ত্র আগেই শিখিয়ে দেই। বাংলাদেশে তো ব্যবসায়ী আর মুনাফাখোরের অভাব নাই। এমনকি ফেরিঅলাও যদি জেনে যায়, সজিনার এতো গুণ, সজিনা সুপার ফুড তাহলে তো সাধারণের সাধ্যে আর থাকবে না এই সজিনা সখি। এমনিতেই সিজনেও এর দাম শত টাকা কেজি। তো সজিনার দাম নিয়ে কারসাজি ঠেকানোর আমার ষড়যন্ত্রমূলক পরামর্শ হলো, ঘরে সজিনা লাগান। নিজের জায়গা থাকলে জায়গায় লাগান, না থাকলে টবে। আর সজিনা হয় খুব দ্রুত। নেহাত ভালো দেখে একটা ডাল পুতে দিলেই হয়। সামান্য পানি আর রোদ পেলেই দেখবেন, নিজের হাতের মুঠোয় সুপার ফুড।
আরেকটা গোপন কথা, সজিনার ডালে দুটুকরা কাঁচা আম আর একটু ফোঁড়নও কিন্তু মারাত্মক। এ রেসিপি কিন্তু বিদেশি গবেষকরাও জানে না। সরিষাবাটা দিয়ে সজিনাও জিভ আর পেটের জন্য উপকারী, মনের জন্যও বটে। সত্যি বলছি, সজিনা আমার মনকেও আপ্লুত করে। তো, হয়ে যাক, একটু সজিনা ডাল। সেহেরিতে মন্দ লাগবে না।
শুভ রাত।
 
 
 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>