| 18 এপ্রিল 2024
Categories
শিশুতোষ সাহিত্য

কিশোর যোদ্ধা বিজু

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

দেশে তুমুল যুদ্ধ চলছে। বিজুদের স্কুল বন্ধ। পাক বাহিনী স্কুল দখল করে ক্যাম্প করেছে। মাঠে তাবু টাঙিয়ে দিন-রাত বড় সড়ক পাহারা দেয় সৈন্যরা। স্কুলে মিলিটারির ক্যাম্প বসতেই যুবক ছেলেরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। আছে শুধু শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ আর মহিলা। দিনের বেলায় পাক সৈন্যরা আশপাশের গ্রামে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে আর মানুষের গরু-ছাগল ধরে নিয়ে স্কুলের মাঠে জবাই করে। প্রায় প্রতিদিনই স্কুল মাঠ থেকে ভুনা মাংসের গন্ধ ভেসে বেড়ায় বাতাসে। বিজুদের বাড়ি স্কুলের পূর্বদিকে। তাদের গ্রামেও খাকি পোশাকের সৈন্য দেখা গেছে। কবে, কোথায়, কখন দেখা গেছে তা ঠিক করে কেউ বলতে পারছে না। তবে গ্রামে সৈন্য দেখা গেছে এই কথাটি সত্য। এই সময়ে সৈন্য আসাটাই স্বাভাবিক।

৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেয়ার পর ২৫ শে মার্চ রাত থেকে পাক বাহিনী আক্রমণ করেছে দেশে। তারা মানুষ মারছে, বাড়ি-ঘরে আগুন দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাঙালিরাও পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেছে। কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে প্রধান করে দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে মুক্তিবাহিনী। বিজুর বাবাও যোগ দিয়েছেন এই বাহিনীতে।

গ্রামে সৈন্য দেখা যাওয়ার পর থেকে রাতের বেলা কারো বাড়িতেই আলো জ্বালানো হয় না। সন্ধ্যার আগেই খাওয়া-দাওয়া করে সবাই ঘুমায়। আজ সন্ধ্যার পর কী একটা জিনিস খোঁজার জন্য হারিকেন জ্বালায় বিজু। কিন্তু সাথে সাথে মা এসে হারিকেন নিভিয়ে দেন। ধমক দিয়ে বলেন- তুমি মরতে চাও, সাথে আমাকেও মারতে চাও? বিজু কোন কথা বলে না। মন খারাপ করে চুপচাপ বেরিয়ে আসে বারান্দায়। হঠাৎ বাড়ির উঠোনে আম গাছের নিচে ধপাস করে কিসের যেন একটা শব্দ শুনতে পায় সে। উঠোনে নেমে পা টিপে টিপে আম গাছের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ায়। ওখানে কে যেন মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বিজু সামনে আগায়। আবছা আলোয় বাবার মুখ দেখতে পায়। বাবার সারা শরীর রক্তে মাখা। বুকে হাত রেখে ছটফট করেছেন তিনি। বিজু তাকে ঝাপটে ধরে জানতে চায় তোমার এই অবস্থা কেনো বাবা? আজ তোদের স্কুলে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করেছিলাম আমরা। অনেকক্ষণ চলে সম্মুখযুদ্ধ। একে একে আমার সকল সহযোদ্ধা শত্রুর বুলেটে প্রাণ হারায়। এক সময় আমার বুকেও একটা গুলি এসে লাগে। তাদের ধাওয়া খেয়ে কোন রকমে পালিয়ে আসি আমি। ওরা নিশ্চই এখন এখানেও আসবে। এতক্ষণে মা এসে দাঁড়িয়েছে বিজুদের পাশে। হাঁটু গেড়ে বাবার কাছাকাছি বসেছে সে। মুখে কোন কথা নেই। কাঁধ থেকে স্টেনগান আর পকেট থেকে রক্তমাখা একটি লাল-সবুজের পতাকা বিজুর হাতে তুলে দেন বাবা। বলেন যদি কখনো এগুলো কাজে লাগানোর সুুযোগ আসে, কাজে লাগাতে পারবি? অবশ্যই পারবো বলে চোখের পানি ছেড়ে দেয় বিজু। বাবা চোখের পানি মুছে দিয়ে বলেন- যা এগুলো ঘরে রেখে আয়। স্টেনগান বুকে চেপে ধরে ঘরের দিকে পা বাড়ায় বিজু। ঠাস-ঠাস গুলির শব্দ। তাহলে নিশ্চয়ই পাক সেনারা চলে এসেছে। বারান্দায় বের হয় বিজু। দৌড়ে আম গাছের কাছে যেতেই দেখে একদল পাক সেনা চলে যাচ্ছে। বাবার পাশে মা’ও শুয়ে আছে। তাহলে কি বাবার সাথে মাকেও মেরে ফেলেছে? কিন্তু মায়ের গায়ে তো গুলি বা আঘাতের কোন চিহ্নই নেই। মা গুলির শব্দেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বুঝতে পারে বিজু। তাৎক্ষণিক ঘর থেকে পানি এনে মায়ের চোখে মুখে ছিটিয়ে দিতেই জ্ঞান ফিরে তার। আমি বেঁচে আছি? ওরা আমাকে মারে নাই? না মা। তবে বাবাকে মেরে ফেলেছে ওরা। মা চোখের জল ছেড়ে বলে- এখানে আমরা মোটেও নিরাপদ নই। চল তোর মামা বাড়ি চলে যাই। অনেক পথ হেঁটে মাঝ রাতে মামার বাড়ি পৌঁছে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে বিজু আর মা।

শেষ রাতে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে বিজুর। এই বিজু মিলিটারি আসছে। চল বাড়ির পেছনে পুকুরে গিয়ে লুকোতে হবে। বিজুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় মা। চোখ কচলাতে কচলাতে সাথে চলে বিজু। বাড়ির অন্য সবার মত কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে নামে তারা। গলা পানিতে নেমে মাথায় কচুরিপানা দিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে বিজু। চারিদিকে মশার গুনগুন আওয়াজ। পুকুরে মাছের ঝাপটানি। কয়েক মিনিটের জন্য মৃত্যুপুরীর মত নিস্তব্দ হয়ে যায় পুরো গ্রাম। নিস্তব্দতা ভেদ করে কিছুটা দূর থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসে বিজুর কানে। গাড়ি আর গুলির শব্দ বিলীন হতেই আবার জেগে ওঠে গ্রাম। পরদিন অনেক বেলা করেই ঘুম ভাঙে বিজুর। কিন্তু সারাদিনে একবারও ঘর থেকে বের হয়নি সে। সন্ধ্যায় বালিশের নিচ থেকে বাবার দেয়া স্টেনগানটি বের করে। মনে মনে ভাবছে কখন যে এটা কাজে লাগানোর সুযোগ আসে। স্টেনগানের ট্রিগারে চাপ দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু চাপ না দিয়েই সরিয়ে ফেলে আঙুল। এমন সময় দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকেন ছোট মামা। মামার সাথে তার বয়েসী আরেকজন লোক। দুজনের হাতেই স্টেনগান। মুখে ভয়ের ছাপ। বিজু প্রশ্ন করে কী হয়েছে মামা? পাক সেনারা আমাদের ধাওয়া করেছে। সৈন্যরা এদিকেই আসছে। শোন বিজু, ওরা যদি আমাদের কথা জিজ্ঞেস করে, বলিস আমরা এদিকে আসিনি। ঠিকাছে মামা। আপনারা লুকিয়ে থাকেন। আমি দেখছি কী করা যায়। স্টেনগান রেখে উঠোনে এসে দাঁড়ায় বিজু। বিজু জানে মিথ্যা বলা পাপ। কিন্তু আজ যে তাকে মিথ্যা বলতেই হবে। এই মিথ্যাটা তো আর সে এমনি এমনি বলছে না। এই মিথ্যাটা বলছে দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য। এমন সময় হুঙ্কার দিয়ে কে যেন বলে উঠলো, তুম কোন হ্যায়? পাক সেনাদের দেখে প্রথমে ভড়কে যায় বিজু। গোঁফওয়ালা সৈন্যটা আবার হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। বাতাও কোন হ্যায়? তোমারা যম হ্যায়। রাগের বশে কথাটা বললো বিজু। যম ক্যায়া হ্যায়? যখন বুঝলো সৈন্যরা তার তিরষ্কার বুঝেনি তখন সে মুচকি হেসে বললো- যম মানে আজরাঈল, মানে সাচ্চা পাকিস্তানি। বিজুর মুখে সাচ্চা পাকিস্তানি শব্দ শুনে দারুণ খুশি হলো তারা। বিজুর পিট চাপড়ে বললো তুম ভি আচ্চা ল্যাড়কা হোঁ। আচ্চা উদার মুক্তি মজুদ হ্যায়। ইয়া। কিদার তুম বাতাও। বিজু বাড়ির উত্তর দিকে আঙুল ইশারা করে দেখায়। ঠিক হ্যায় হামারা চালতা হোঁ বলে উত্তর দিকে হাঁটা শুরু করে সৈন্যরা। বিজু দৌড়ে ঘরে ঢুকে স্টেনগান হাতে নিয়ে বের হয়। আর পেছন থেকে পাকিদের লক্ষ্য করে ঠাস ঠাস করে গুলি ছুঁড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো পাক সৈন্যরা। গুলির শব্দ শুনে বেরিয়ে এলেন মামা ও তার সহযোদ্ধা। বিজুর কা- দেখে তারা দুজনেই হতবাক। বিজুর পিঠ চাপড়ে মামা বলেন- সাবাশ বিজু সাবাশ। এই না হলে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে!

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত