| 24 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে কবিতা সাহিত্য

ইমতিয়াজ মাহমুদের নির্বাচিত একগুচ্ছ কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

ইমতিয়াজ মাহমুদ আজ ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮০ সনে ঝালকাঠিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মতিথিতে ইরাবতী পরিবারের শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।

প্রকাশিত বই:
ম্যাক্সিম (২০১৬), কালো কৌতুক (২০১৬), পেন্টাকল (২০১৫), নদীর চোখে পানি ও অন্যান্য কোয়াটরেন (২০১৩), মানুষ দেখতে কেমন (২০১০), সার্কাসের সঙ (২০০৮), মৃত্যুর জন্মদাতা (২০০২), অন্ধকারের রোদ্দুরে (২০০০)।

পেন্টাকল গ্রন্থের জন্য কলকাতা থেকে পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার। প্রথম কবিতা দীর্ঘশ্বাসে প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে পাক্ষিক শৈলী পত্রিকায়।


একদিন

একদিন সব অবহেলা দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেব। সব দাঁড়িয়ে থাকা।
চেয়ার থাকতেও বসতে না বলা- ফিরিয়ে দেব। ঐদিন আমিও খুব
ভ্রু কুঁচকে তাকাব। এমন ভাব দেখাব যে কোন কথাই শুনছি
না। যেন আমার সময় নাই। আমি এসকল ব্যস্ততা ফিরিয়ে দেব।
সব অবহেলা দ্বিগুণ করে। একদিন আর কোথাও যাব না। আমার
কবরের পাশ দিয়ে তুমি হেঁটে যাবে ঠিকই। আমি ফিরেও তাকাবনা।

নিঃসঙ্গতা

আন্দামান সাগরের এক একলা দ্বীপে এক সাধু যখন একটা পাখির কিচির
মিচিরে অতিষ্ঠ হয়ে ভাবছিলো কিভাবে আরো একা হওয়া যায় তখন
জাকার্তার জনাকীর্ণ সড়কে হাজার হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে
একটা লোক একা একা হেঁটে যাচ্ছিলো

কাগজের প্রেম

চোখ থেকে জল পড়ে জল থেকে যদি
ভেসে ভেসে চলে যাই মাছরাঙা নদী
সেখানে কি পাবো আমি কোন খড়কুটো
পেলে ঠিক ধরে নেবো হাতে একমুঠো।

তাকে ধরে চলে যাবো রোদে পোড়া দ্বীপ
হাতে ধরা কুটো আর হাতে ধরা ছিপ
হোক না প্রবাল তলে তরুণীর বাসা
ছিপ গেঁথে তুলে নেবো তার ভালোবাসা।

তার আসা তার বসা তার চলাচল
চলে গেলে ভেসে যাবো ভেসে ভেসে জল
জেনে নেবো কে আপন কে আসলে পর
ডুবে যদি যাবো তবু হাতে থাক খড়।

কে কোথায় ডুবে যায় কোথায় যে তীর
মাছরাঙা নদীতে সে তরুণী কুমির!

আবর্তন

সময় শূন্য খায়
সেকেন্ড সময় খায়
মিনিটি সেকেন্ড খায়
ঘন্টা মিনিট খায়
দিন ঘন্টা খায়
মাস দিন খায়
বছর মাস খায়
যুগ বছর খায়
কাল যুগ খায়
মহাকাল কাল খায়
শূন্য মহাকাল খায়
সময় শূন্য খায়!

গোলাপ বিষয়ক কবিতা

একটি গোলাপ চারা/ না লেখা কাগজ
পানি ঢালো পানি ঢালো/ কালি ঢালো আরও
হয়ত মুকুল ধরে/ ছাপ ফেলো তারও
দেখো
গোলাপ ফোটার পর
কবিতাও ঘটে
কাগজে কলমে তার রূপ/টুপ রটে।
এ-ও বুঝি হয়—কী আশ্চর্য!
পানি ঢালো পানি ঢালো/ কালি ঢালো আরও
গোলাপের ঘ্রাণ
কাগজে; — পেলেও পেতে পারো।
পাপড়ি ছড়ানো শেষ হলে
তবু
যতি পড়ে।
তখন কে যেন বললো,
‘কবিতাটা হয়েছিলো তবে গোলাপের মতো?’
‘কী জানি কেমন—
গোলাপ-ও কবিতা পড়ে দেখেনি তো!’

চিঠি

প্রিয়, আমি এখানে খুব শোচনীয়
হয়ে আছি। তারা আমার
হাড়গুলো খুলে নিয়ে
গেছে। আর বলেছে
জীবন এভাবে ভালো।
আমি মাটিতে দেহ ঘষে ঘষে
এখন সে হাড়ের কথা ভাবি।
যারা আমার সাথে ছিলো কালও।
প্রিয়,
তুমি আমার
নিখোঁজ হাড়গুলির খবর নিও
নদীতে, ফুলের পাশে
থানায় না হলে মর্গে
হাড় ছাড়া
আমার
আর কিছু ভালো লাগছে না
এখানে
এই স্বর্গে!

আত্মহত্যা

আমি একটি পাথরের উপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বহুকাল আমার ঘুম হয়নি।
আমি তাই একটি পাথরের উপর ঘুমিয়ে পড়লাম। আর ঘুমানোর আগে আমি
পাথরটাকে একটা জলপাইর মতো করে… জলপাইর মতো করে আমি
পাথরটাকে খেয়ে ফেললাম। পাথরের খোসাগুলো নদীতে ভেসে যাচ্ছিলো।
নদীতে ভীষণ স্রোত । নদীতে তুমুল ঢেউ। আমি স্রোত ও ঢেউসহ নদীটি খেয়ে
ফেললাম। নদীর দুই তীরে কুচকাওয়াজে দাঁড়ানো বালকদের মতন সারি বেঁধে
দাঁড়িয়ে ছিলো কতগুলো গাছ। গাছগুলোর সব পাতা সবুজ। আর তার ডালে
ডালে হলুদ রঙের পাখি। আমি হলুদ পাখিসহ গাছগুলো সবুজ পাতাসহ
গাছগুলো খেয়ে ফেললাম।

আমি ভেসে উঠলাম নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে তৈরি হওয়া এক নগরীতে।
সেখানকার সবচেয়ে জমকালো স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছিলো। মাঠে ১১ দু’গুণে
২২ জন খেলোয়াড়, গ্যালারি ভর্তি দর্শক। আমি খেলোয়াড় ও দর্শকসহ
স্টেডিয়ামটি খেয়ে ফেললাম। নগরের এক প্রান্তে প্রাচীন ঋষিদের মতন ঠায়
দাঁড়িয়ে ছিলো একটি গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারের তাকে তাকে সাজানো রবীন্দ্রনাথ,
আইনস্টাইন, মার্কস, ডারউইন…। আমি রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনসহ
আমি মার্কস ও ডারউইনসহ গ্রন্থাগারটি খেয়ে ফেললাম।

এরপর আমি খেয়ে ফেললাম বিমানবন্দরের সবগুলো বিমান, সংসদ ভবন আর
জাতিসংঘ কার্যালয়। অরণ্য ও পর্বতমালা। মহাদেশ ও সাগরসমূহ। অর্থাৎ আমি
খেয়ে ফেললাম গোটা পৃথিবী। আর খেয়ে ফেললাম গ্রহ নক্ষত্র উল্কা আর
ধুমকেতুসহ সাত সাতটা আকাশ। হাত পা চোখ মাথাসহ গোটা শূন্য আর
মহাশূন্য।এরপর ধীরে ধীরে আমি ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম ঈশ্বরের দরবারে।
বহুকাল আমার ঘুম হয়নি। ঘুমে তাই আমার দু’চোখ কাতর হয়ে পড়েছিলো।
আমি কিছু বলার আগেই ঈশ্বর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি অনুতপ্ত?
ক্লান্তিতে আমার শরীর ভেঙে পড়ছিলো। আমার কাছে মনে হলো তিনি যেন
আমাকে প্রশ্ন করেছেন পৃথিবী কি অনুতপ্ত? আমি ঘুমানোর জন্য একটি পাথর
খুঁজছিলাম। ঈশ্বর আমাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন তুমি কি অনুতপ্ত? আমি
আবার শুনতে পেলাম ঈশ্বর আমার কাছে জানতে চেয়েছেন পৃথিবী কি অনুতপ্ত?
বহুকাল আমি ঘুমাতে পারিনি। আমার সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে আমার ঘুমহীনতার
সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে পরম করুণাময় ঈশ্বরের সামনে আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
পৃথিবী একটা শুয়োরের বাচ্চা!

কুকুর

পাড়ার কালো কুকুরের নাম অ্যামব্রোস। এই নামে ডাকলে
সে খুব উৎসাহ পায়। লেজ নাড়ে। দৌড়ায়। পাউরুটি
খাবার নানান বাহানা করে। পাউরুটি খায়। নতুন মানুষ
দেখলে ঘেউ ঘেউ করে। অচেনা কুকুর দেখলে হামলে পড়ে।
পাউরুটি খায়। দৌড়ায়। পূর্ণিমার রাতে তার খুব মন খারাপ
হয়। চাঁদের কালো দাগ দেখলে সে বুঝতে পারে, খুব বুঝতে
পারে—চাঁদের ভেতর একটা কালো কুকুর আটকা পড়েছে।

বাগান

বাগানে অনেক গাছ আছে। একটা তরুণ গাছে ফুল
ফুটেছে। সে খুব খুশি। এবারই তার ডালে প্রথম
ফুল ফুটলো। ফুল ফোটার আনন্দে সে লাল হয়ে
উঠছে। আর একটু পর পর বাতাসে ফুল দোলাচ্ছে।
পাশে কয়েকটা গাছ যারা ফুল ফোটাতে ফোটাতে
প্রবীণ হয়ে গেছে—তরুণ গাছটার বেহায়াপনা দেখে
তো অবাক। তারা বলছে, ‘ডালে এখনো ২/৪টা ভালো
পাখি বসলো না এরই মধ্যে এতো!’ —বাগানের শেষ
প্রান্তে একটা চারা নীরবে গাছ হবার সাধনা করছে।

আপন মাহমুদের মৃত্যু

আপন মাহমুদ ঐ অর্থে আমার আপন কেউ ছিলো না।
তার সাথে আমার ৪/৫ বার দেখা হয়েছে।
তারপর সে মারা গেছে।
আপন ভালো কবিতা লিখতো।
তার মৃত্যুর পর কবিমহলে খুব শোরগোল হয়।
আমার প্রথম মন খারাপ হয়েছিলো। পরে সব ঠিক হয়ে গেছে।
আমি ঐদিন খুব ভালোভাবে অফিস করেছি। টেলিভিশনে ফুটবল খেলা দেখেছি।

রাতের সংবাদের সময় এক মন্ত্রীকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করছিলাম।
তখন আপন মাহমুদ বললো, ইমতিয়াজ, আমি মারা গেছি আর আপনি হাসতেছেন!
আমি হাসি বন্ধ করলাম। আমি হাসি বন্ধ করে ঘুমাতে গেলাম।
আপন বললো, কবরের ভেতর খুব গরম।
ইমতিয়াজ এখানে কোন বাতাস নাই। ঘুম আসে না।
আমি বুঝতে পারলাম এক বন্ধুর মৃত্যুতে আমি সামান্য ঘোরগ্রস্থ হয়েছি।
আপন বললো, পরশু আপনার একটা কবিতা
আমার ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করে এসেছিলাম। দেখেছেন?
আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন ভোরে তাকে নিয়ে একটা গদ্য লিখতে বসলাম।
‘আমি মারা গেছি আর আপনি আমার মৃত্যু নিয়াও ব্যবসা শুরু করছেন!’
আমি আপন মাহমুদকে সাথে নিয়ে অফিস করলাম।
আপন বললো, কবরে এত নিঃসঙ্গ লাগে। এমন নিঃসঙ্গ!
সন্ধ্যায় তরুণ কবিকে নিয়ে একটা স্মরণ সভা ছিলো।
আমি যাবার জন্য রওয়ানা হয়েছিলাম।
আমাকে আটকে দিলো!

সবাই যখন শোক করছে। স্মৃতিচারণ করছে। অনেক অনেক সভা করছে।
আমি তখন আপন মাহমুদের কবরটা কাঁধে নিয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছি।

ঈদ

আমার কোন ঈদ নাই। এগার বছর আগে নামাজ পড়তে
যাবার সময় আমার ঈদ চুরি হয়ে গেছে। আমি ঐদিন
সবার মতো পাঞ্জাবি পরে নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম।
বাড়তি বলতে হাতে একটা তসবিহ ছিলো। ঐ তসবিহ’র
দিকে মন দিতে গিয়ে কোন ফাঁকে ঈদ হারিয়ে ফেলেছি টের
পাই নাই। থানা পুলিশ করার মতো সঙ্গতি বাবার ছিলো না।
তিনি বলেছিলেন মন খারাপ করিস না। সবার ঈদ থাকে না।
এর চেয়ে আমার ঈদটা তুই নিয়ে নে। আমি বললাম আপনি
ঈদ কোথায় পাবেন? আমি তো শুনেছি দাদা বেঁচে থাকতেই
আপনার ঈদ হারিয়ে গেছে। বাবা অপরাধীর মতো বললেন
তা ঠিক আছে, তবে তোর মায়ের ঈদটা আমি চুরি করে রেখেছি!

উন্মাদ

উন্মাদ হবার মুহূর্তটা অনেক ক্রিটিকাল
ঐ মুহূর্তটিতে মানুষ দুটি ভিন্ন ভিন্ন
জগতের নো ম্যানস ল্যান্ডে
চলে যায়
তখন তাকে ঠিক এই জগতের
বা

জগতের
মানুষ বলে চিহ্নিত করা যায় না
এই জগতহীনতার সময়টা অনেক ক্রিটিকাল
আপনি যদি
কখনো
এমন নো ম্যানস ল্যান্ডে পড়ে যান
তবে উচিত হবে দ্রুত
যেকোন একটি জগতকে বেছে নেয়া
একটু দেরি হলে আপনি আটকা
পড়ে যাবেন
আর বের হতে পারবেন না
আপনি
বের
হতে
পারবেন
না
নিঃসঙ্গ আর অভিশপ্ত
পৃথিবী থেকে
আপনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করবেন
কিন্তু কেউ তার অর্থ উদ্ধার
করতে পারবে না
কেননা আপনার চিৎকারটা
দুই ভাগ হয়ে যাবে
যার
অর্ধেক পৌঁছবে এই জগতে
বাকি
অর্ধেক
ঐ জগতে!

খ্যাতিমান

আমাদের মহল্লায় কোন বিখ্যাত লোক নাই। পোলিওতে শরীর বাঁকা হয়ে যাওয়া একজন ভিক্ষুক ছিলো। বিজয় সরণিতে দেহ গোল করে বসে থাকতো। তাকে আমরা সবাই চিনতাম। এখন সে এলাকায় থাকে না। একজন রিপোর্টার ছিলো। কী একটা চ্যানেলে শেয়ার বাজারের অনুষ্ঠান করতো। বাজারে ধ্বস নামার পর ঐ অনুষ্ঠান আর কেউ দেখে না। ফলে মহল্লায় একটা বিখ্যাত লোক-প্রাপ্তির সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যায়। তবে ইদানীং একটা ছাল ওঠা কুকুরের খ্যাতি আমরা লক্ষ করছি। হোটেলের এক বেয়াড়া তার গায়ে ভাতের মাড় ঢেলে দেয়ার পর তার চামড়া পুড়ে

ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এখন সে ফ্যাকাশে চামড়া নিয়ে গলির এক কোনায় ঝিমোয়। আমাদের কাউকে দেখে আর আগের মতো দৌড়ে আসে না। যদিও আমরা তাকে চিনি। সে আমাদের দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

বিখ্যাত লোকেরা বুঝি এমনই হয়!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত