| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে যা কিছু প্রথম

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ekushe-february

বায়ান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারি বসন্তের বাতাস ও পলাশ রঙে রাঙানো প্রভাতের সূর্য অমিত সম্ভাবনার যে স্বপ্ন, যে প্রত্যয় জাতির হৃদয়ে বপন হয়েছিল, সেই তেজোদীপ্ত বিদ্রোহের সুর আজো প্রতিটি ক্রান্তিকালে ধ্বনিত হয় বাঙালির হৃদয়ে।ভাষা আন্দোলন আমাদের চেতনার ইতিহাস। ভাষার অধিকার আদায়ের সেই রাজপথ রঞ্জিত করা ইতিহাস এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের একুশ এখন বিশ্বের। কিন্তু কেমন ছিল একুশের প্রথম প্রহর। কিংবা একুশের সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গে প্রথম যে বারুদের সংযোজন কেমন ছিল সেই বিদ্রোহের অনুষঙ্গ। সেইসব প্রথম নিয়েই এই লেখা।

প্রথম বুলেটিন:

একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার পর কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মী রাতের মধ্যেই একটি বুলেটিন প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও পলাশী ব্যারাক এলাকায় বিলি করেন। সন্ধ্যায় আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ফজলে লোহানী, হাসান হাফিজুর রহমান পাটুয়াটুলির সওগাত অফিসের বিপরীতে গলিতে অবস্থিত পাইওনিয়ার প্রেসে যান। দুটি টেবিলে বসে ঘণ্টা-খানেকের মধ্যে তাঁরা ছাত্র হত্যার সংবাদের হেডলাইনের সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখে ফেলেন। তাৎক্ষণিক একটি বুলেটিন তৈরি হয়ে যায়। বড় এক শীট কাগজে যত শীঘ্র সম্ভব রাতের মধ্যে ছেপে ফেলার ব্যবস্থা করে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফিরে আসেন। এ বুলেটিনের ভাষ্যে একটি মন্তব্য জুড়ে দেয়া হয়, ‘বিপ্লবের কোদাল দিয়ে আমরা অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর কবর রচনা করব।’ (সূত্র : দৈনিক সমকাল, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৭)। উক্ত মন্তব্যটি লিখেছিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। তাঁর মতে, এটাই ছিল একুশের প্রথম বুলেটিন।

প্রথম প্রকাশ্য জনসভা :

একুশের শহীদদের স্মরণে ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজার পর একটি সংক্ষিপ্ত সভা হয়। একুশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রথম প্রকাশ্য ওই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন যুবলীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক মহম্মদ এমাদুল্লাহ। সভাপতির ভাষণে তিনি দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। সভাপতির ভাষণের আগে একমাত্র অলি আহাদই এ সভায় বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘নূরুল আমীন সরকারের হত্যার জবাব দিব ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মারফত, মাতৃভাষা বাংলাকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার দ্বারা।’

একুশের প্রথম শহীদ :

মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে সর্বপ্রথম শহীদ হয়েছেন মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের আইকম দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ২৬ বছর বয়সী রফিক উদ্দিন আহমেদ। তিনি বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিক মরহুম আবদুল লতিফের জ্যেষ্ঠ সন্তান। তার মায়ের নাম রাফিজা খাতুন। তাদের গ্রামের বাড়ি ছিল সিংগাইর উপজেলার পারিল বলধারায়।
উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র-জনতার মিছিলে রফিক অংশগ্রহণ করেন। পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ায় ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ব্যারাকে আশ্রয় নেয়ার সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন রফিক। বিকেল সোয়া ৩টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গণে পুলিশ গুলি চালালে রফিকের মাথায় গুলি লাগে। এতে মাথার খুলি উড়ে গেলে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।
রাত তিনটায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ওবায়দুল্লাহর উপস্থিতিতে আজিমপুর মসজিদের ইমাম হাফেজ আবদুর গফুর তাঁর জানাজা পড়ান। সংগোপনে, আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতে আজিমপুর কবরস্থানের অসংরক্ষিত এলাকায় দাফন করা হয় শহীদ রফিকের মরদেহ।

প্রথম লিফলেট :

‘বায়ান্নর ভাষার লড়াই’ প্রবন্ধে হাসান হাফিজুর রহমান ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের পরের বিষয়ে লেখেন, ‘‘আমরা তিনজন মধুর ক্যান্টিনে ফিরে আসি এবং জেলখানার উল্টোদিকে ক্যাপিটাল প্রেসে যাই। সেখানে বসে একটা লিফলেট লিখে ফেলি। সেখানে ঘণ্টা দু তিনেকের মধ্যে প্রুফ দেখে লিফলেটটি ছাপিয়ে আনি। প্রেসটি সেদিন আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল।…লিফলেট প্রায় ২-৩ হাজার ছিল।”

পুরান ঢাকার ৫০-৫১ বেগম বাজার রোডের ক্যাপিটাল প্রেস, একেবারে কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের সামনে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ইতিহাসের সঙ্গী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে।

এখন একটি তিনতলা দালানে অবস্থান হলেও ১৯৫২ সালে টিন শেইডে ছিল এই প্রেস। স্মৃতি হাতড়ে জানান খান আলি ইমাম। তারই বাবা মৃত ইব্রাহিম খলিল খান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই ছাপাখানা, সেই ১৯৪৮ সালে। লিফলেটটির আকার ছিল প্লেট অনুযায়ী ১/১৬। উৎসাহী ছাত্ররাই এ লিফলেটগুলো চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। চকবাজার, নাজিরা বাজার এবং ঢাকার অন্য সব এলাকাতেও লিফলেটগুলো কর্মীদের মাধ্যমে ঐদিনই ছড়িয়ে দেয়া হয়।

প্রথম ইশতেহার :

একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের পর ওই দিনই পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ববঙ্গ কমিটি ‘অত্যাচারী নূরুল আমীন সরকারের বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সারা পূর্ববঙ্গ ব্যাপী তুমুল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়িয়া তুলুন’ শীর্ষক একটি ইশতেহার প্রচার করে। সাইক্লোস্টাইল করা ওই ইশতেহারই ছিল একুশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রথম ইশতেহার।

পূর্ববঙ্গ পরিষদে প্রথম বক্তব্য :

একুশে ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে তিনটায় পূর্ববঙ্গ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। মাত্র ঘণ্টা কয়েক আগে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে জাতীয় অধিবেশন সেদিনের জন্য স্থগিত রাখার দাবি জানান আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। তিনি বলেন, ‘জনাব স্পিকার সাহেব, প্রশ্নোত্তরের পূর্বে আমি আপনার কাছে একটা নিবেদন করতে চাই। যখন দেশের ছাত্ররা, যারা আমাদের ভাবী আশা-ভরসাস্থল, পুলিশের গুলির আঘাতে জীবনলীলা সাঙ্গ করছে, সেই সময় আমরা এখানে বসে সভা করতে চাই না। প্রথমে ইনকোয়ারি তারপর হাউস চলবে।’ একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে এটাই ছিল আইন পরিষদে প্রথম বক্তব্য।

প্রথম নিয়ন্ত্রণ কক্ষ :

একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ২০ নম্বর ব্যারাকের ১ নম্বর কক্ষে স্থাপন করা হয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বা কন্ট্রোল রুম। ওখান থেকেই পরিচালিত হতে থাকে আন্দোলন। ওই কক্ষ থেকেই মাইকে জ্বালাময়ী বক্তৃতা, উদ্দীপনামূলক গান এবং আন্দোলনের নানাবিধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হতো। মাইকটি লাগানো হয়েছিল ব্যারাকের উত্তর-পশ্চিম কোনায় অবস্থিত আম বাগানের ডালে, একেবারে পরিষদ ভবনের নাকের ডগায়।

প্রথম মিছিল :

একুশে নিহতের পর প্রথমবাবেরর মতো ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজা শেষে সমবেত হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে হাইকোর্টের পথ ধরে নবাবপুর রোডের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘খুনী নূরুল আমীনের বিচার চাই’, ‘খুনের বদলে খুন চাই’ ইত্যাদি শ্লোগান দিতে দিতে মিছিলটি হাইকোর্টের গেইটের সামনে উপস্থিত হলে বিপুল সংখ্যক পুলিশ তাদের পথ রোধ করে। মিছিলটি সেক্রেটারিয়েটের পাশ দিয়ে আবদুল গণি রোড ধরে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিছিল গনি রোডের দিকে মোড় নিতে শুরু করামাত্র পুলিশ একই সঙ্গে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ শুরু করে। মিছিলকারীদের অনেকেই এ সময় ফজলুল হক হল, কার্জন হল, ঢাকা হলসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ও হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে আশ্রয় গ্রহণ করে।

আইন পরিষদ থেকে পদত্যাগকারী প্রথম সদস্য :

একুশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্যপদ থেকে প্রথম পদত্যাগ করেন দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। গভর্নর ও পরিষদের স্পিকারকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করায় ছাত্রদের ওপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়াছে, তাহার প্রতিবাদে আমি পরিষদে আমার সদস্যপদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি। যে নূরুল আমীন সরকারের আমিও একজন সমর্থক, এ ব্যাপারে তাহাদের ভূমিকা এত দূর লজ্জাজনক যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এই দলের সহিত সংযুক্ত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসাবে বহাল থাকিতে আমি লজ্জাবোধ করিতেছি।’


আরো পড়ুন: একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য ও প্রশ্নোত্তর

 

প্রথম কবিতা :

একুশের প্রথম কবিতার জনক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার গুলি বর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনিই প্রথম কবিতা লেখেন। তিনি সে সময় চট্টগ্রামে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারির ঠিক দুদিন আগে হঠাৎ তিনি জলবসন্তে আক্রান্ত হন। ফলে একুশ এবং তৎপরবর্তী সময়ের উত্তাল আন্দোলনে তিনি অংশ নিতে পারেননি। সেই বিক্ষুব্ধ মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কবিতার মাধ্যমে।

মাহবুব-উল-আলম রচিত ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শীর্ষক কবিতাটি ভাষা-আন্দোলন তথা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি (মতান্তরে ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে বিশাল জনসভায় ৫০ হাজার লোকের উপস্থিতিতে কবিতাটি পাঠ করেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ। কবিতাটি প্রকাশের সাথে সাথে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। কবিতাটি মুদ্রণের দায়ে প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদ, লেখক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ও জনসভায় এর প্রথম পাঠক চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং মুদ্রক দবির আহমেদ চৌধুরীর নামে হুলিয়া জারি হয় এবং পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।

প্রথম কবিতা সংকলন :

১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় একুশের কবিতার সংকলন। সংকলনটির নাম ছিল ‘ওরা প্রাণ দিল’। এটি ২০ বি, বালিগঞ্জ স্টেশন রোড, কলকাতা-১৯৬ থেকে বেনু প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত। বিশ পৃষ্ঠার এ সংকলনটির প্রকাশক-শিবব্রত সেন। এছাড়া সংকলনটিতে লেখা ছিল সম্পাদনা-সহকর্মী, প্রচ্ছদ: গণ-আন্দোলনের অংশীদার জনৈক শিল্পী । এদের নাম গোপন করা হয়েছিল নিরাপত্তার কারণে। প্রচ্ছদে ছিল কাঠের খোদাই করা একটি উডকাট চিত্র। তাতে লেখা ছিল, ‘বাংলা ভাষার কণ্ঠ রোধ করা চলবে না।’ নিরাপত্তার কারণে প্রচ্ছদ শিরোনাম নাম উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু প্রচ্ছদ একেঁছিলেন ভারতের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী সোমনাথ হুড়। যে ৭টি কবিতা স্থান পেয়েছিল সেগুলো হলও: শহীদ বাংলা- বিমল চন্দ্র ঘোষ, জন্মভূমি-সৈয়দ আবুল হুদা, ঢাকার ডাক-হেমাঙ্গ বিশ্বাস, পারবে না- মুর্তজা বশীর, জননী গো- নিত্য বসু, বন্ধুর খোঁজে- তানিয়া বেগম, প্রিয় বন্ধু আমার- সহকর্মী (প্রমথ নন্দী)

ভাষা আন্দোলনের প্রথম গল্প :

ভাষা আন্দোলনের স্মরণে লিখিত প্রথম গল্পের নাম ‘মন ও ময়দান’। এর রচয়িতা হলেন ভাষাসৈনিক ও বিশিষ্ট কথাশিল্পী মরহুম শাহেদ আলী। ১৯৫০ সালে সাপ্তাহিক সৈনিকের ‘ঈদ ও আজাদী দিবস’ সংখ্যায় গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
একুশের প্রথম গল্প : ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার পর অর্থাৎ একুশের প্রথম গল্পের নাম ‘মৌন নয়ন’। গল্পটির রচয়িতা বিশিষ্ট কবি ও কথাশিল্পী শওকত ওসমান। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রন্থে গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

প্রথম ক্রোড়পত্র ও অঙ্কিত চিত্র বা স্কেচ :

২১ ফেব্রুয়ারির পরের দিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় একুশের প্রথম ক্রোড়পত্র এবং প্রথম অঙ্কিত চিত্র। ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেন তৎকালীন ‘দিলরুবা’ পত্রিকার প্রকাশক এবং এতে স্কেচ আঁকেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম আর লেখেন ফয়েজ আহমদ এবং আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন। বিকেল পাঁচটার মধ্যে কাগজ ছাপা হয়ে যায় এবং পত্রিকার কর্মীরাই রাজপথে কাগজগুলো বিলি করেন। সেদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ ছিল বলে ৬টার আগেই হাতে হাতে কাগজ বিলি করা হয়ে যায়।

একুশের প্রথম ছাপচিত্র :

প্রথম ছাপচিত্র অঙ্কন করেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী, বায়ান্নর ভাষাকর্মী মুর্তজা বশীর। ছাপচিত্রটির শিরোনাম হলো ‘রক্তাক্ত একুশে’। মুর্তজা বশীর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্রহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। শহীদ বরকতের রক্তে তার সাদা রুমাল রঞ্জিত হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আঁকা তাঁর এই ছাপচিত্রটিতে তিনি একুশের ঘটনা অঙ্কিত করেছেন। একজন গুলিবিদ্ধ ছাত্রনেতাকে এঁকেছেন যিনি মিছিলে গুলি বর্ষণের ফলে পড়ে যান, তার স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ডটি পড়ে যায় এবং তার হাতে থাকা বইটিও মাটিতে পড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়।

প্রথম নাটক :

একুশের প্রথম নাটকের নাম ‘কবর’। নাটকটি লিখেছিলেন আমাদের দেশের সেরা অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার মুনীর চৌধুরী। ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার ‘অপরাধে’ ১৯৫২ সালে জেলে আটক ছিলেন মুনীর চৌধুরী ও রণেশ দাশগুপ্তসহ অনেক লেখক-সাংবাদিক। রণেশ দাশগুপ্ত অন্য সেলে আটক মুনীর চৌধুরীকে ভাষা আন্দোলনের ওপর একটি নাটক লিখে দেওয়ার অনুরোধ করে একটি চিরকুট পাঠান।
শহীদ দিবসে রাজবন্দীরাই নাটকটি মঞ্চস্থ করবে, জেলে মঞ্চসজ্জা ও আলোর ব্যবস্থা করা যাবে না। তাই মুনীর চৌধুরীকে বলা হয়, নাটকটি এমনভাবে লিখতে হবে, যাতে খুব সহজে জেলেই এটি অভিনয় করা যায়। মুনীর চৌধুরী ’৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি নাটকটি লিখে শেষ করেন। ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি, রাত ১০টায় জেল কক্ষগুলোর বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর হ্যারিকেনের আলো-আঁধারিতে মঞ্চস্থ হয় ‘কবর’। এতে অভিনয়ে অংশ নেন জেলেবন্দী সংগ্রামী বন্দী নলিনী দাস, অজয় রায় প্রমুখ।

একুশের প্রথম গান :

একুশের প্রথম গান রচনা করেন ভাষাসৈনিক আ.ন.ম. গাজীউল হক। গানটির প্রথম লাইন: ‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না…’ ভাষা-আন্দোলনের সূচনার গান হিসেবে এটি সে সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং আন্দোলনের মহা অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছিল। গানটির সুর দেয়া হয়েছিল হিন্দি গান ‘দূর হাঁটো, দূর হাঁটো, ঐ দুনিয়াওয়ালে, হিন্দুস্তান হামারা হায়’ এর অনুকরণে।

একুশের হত্যাকাণ্ডের পর গাজীউল হকের এই গানটি ছিল ভাষা কর্মীদের প্রেরণার মন্ত্র। শুধু রাজপথের আন্দোলনে নয়, জেলখানায় রাজবন্দীদের দুঃখ কষ্ট নিবারণে এবং তাদের মনোবল চাঙ্গা করতে এই গান ছিল প্রধান হাতিয়ার। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকীতে আরমানিটোলার ময়দানে আয়োজিত জনসভায় গানটি প্রথম গাওয়া হয়।

প্রভাতফেরির প্রথম গান :

১৯৫৩ সালে প্রথম শহীদ দিবসের প্রথম প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয়- ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল/ভাষা বাঁচাবার তরে/আজিকে স্মরিও তারে।’ গানটির রচয়িতা বরিশালের প্রকৌশলী মোশারেফ উদ্দিন আহমদ। ৫৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে লেখা হয়েছিল এ গান। হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ লিখেছেন, ‘সেই সংগীতই হয়ে ওঠে অমর একুশের প্রথম বার্ষিকীর প্রভাতফেরির গান। আলতাফ মাহমুদের অপূর্ব সুর সংযোজন। আলতাফের সঙ্গে প্রথম কণ্ঠ মেলান শিল্পী সংসদের নিজামুল হক, মোমিনুল হক, ছাত্রনেতা গাজীউল হক।

 

তথ্যসূত্র :
১. রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও একুশের ইতিহাসে প্রথম, এম আর মাহবুব, সূচীপত্র, ২০০৯
২. দৈনিক প্রথম আলো, ১৮ নভেম্বর, ১৯৯৯ ও ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০০০

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত