| 19 মার্চ 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

এইম ইন লাইফ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

ছোটোবেলায় আমি একটা গাছ হতে চেয়েছিলাম। এই গাছ হতে চাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। আমি দেখতাম, চারপাশের মানুষজন কেবল ছুটছে। কেউ তাঁতী, কেউ টিনের দোকানি, কেউ কাপড়ের ব্যবসা করে, কেউ সিনেমা হলের পাহাড়াদার, কেউ ম্যানেজার, কেউ ভ্যান চালায়, কেউ স্কুলে পড়ায়, কেউ উকিল। আমার দেখা সব মানুষকে কিছু না কিছু করতে হয়। আর আমরা ছোটোরা বড় হয়ে কী হবো, সেই ভাবনায় পীড়িত থাকতাম। সেই ছোট্টো বয়সে আমার মধ্যে প্রশ্ন জাগতো, কেন? কেন সবাইকে কিছু না কিছু হতে হয়? আর আমি অবাক হয়ে দেখতাম, আমাদের বাড়ির আঙিনায় যে কদম গাছ রয়েছে, তাকে কিচ্ছু করতে হয়না। সেই গাছে যে পাখিটা এসে বসে, তাকে কিচ্ছু হতে হয় না। তাদের স্কুলে যেতে হয়না। বাবার জন্য দুপুরে খাবার নিয়ে যেতে হয়না। পরিবারের কারো বকুনি খেতে হয়না। কেউ তাকে কোনো কাজ করতে বলে না। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, উদরপূর্তির জন্য গাছকে কোনো পরিশ্রম করতে হয়না। অথচ, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে দাবি করেও উদরপূর্তির জন্য পৃথিবীর নিকৃষ্ট কাজগুলো করে। অন্য কোনো প্রাণি এতোটা জঘন্য কাজ করে না। এমনকি, গণহারে প্রাণিহত্যা! তাও করতে পিছপা হয়না মানুষ। ভাবতাম, আর মনে হতো, যদি একটা গাছ হতে পারতাম!

এই গাছ হতে চাওয়ার পেছনে অবশ্য অন্য একটা কারণ ছিল। আমার বাবা ছিলেন ভীষণ রাগী। তাকে লোকজন ভয় পেত। সারাক্ষণ টাকা উপার্জনের নেশায় ছটফট করতেন। তাঁর মাথায় অন্য কোনো চিন্তা ছিল না। কী করে দুটো টাকা বেশি আসবে, এই চিন্তা। এজন্য তাকে ছোটোখাটো মিথ্যাও বলতে দেখেছি। ওদিকে আমি বইয়ে পড়ি, মিথ্যা বলা মহাপাপ! যা পড়ি তাই বিশ্বাস করি, এই আমার মনের অবস্থা তখন। ফলে, আমি ভাবতাম, একটা গাছ, একই স্থানে দাঁড়িয়ে, কোনো পরিশ্রম না করে, কোনো মিথ্যা না বলে, বিনা আয়াসে, কারো কোনো ক্ষতি না করে, অন্য কোনো প্রাণকে আঘাত না করে উদরপূর্তি করে, দিব্যি বেঁচে থাকে। আমি কেন পারবো না?

আপনাদের একটা দৃশ্য বলি, একটা গ্রাম, উপজেলা সদরের বাজার, রাস্তার পাশে একটা দোকান, সেই দোকানে একটি শিশু বসে থাকে, তাঁর হাতে সারাক্ষণ বই, সে দোকানে বসে থাকে- তাঁর মন কিন্তু দোকানে থাকে না, মনটা কল্পনার রাজ্যে ভেসে বেড়ায়, রাস্তা দিয়ে কত মানুষ যাতায়াত করে, রাতে সিনেমা হলের শো শেষ হওয়ার পর সেই গ্রামে নীরবতা নেমে আসে, লোকজনেরা বাড়ি ফেরে আর দিনের অভিজ্ঞতা মনে করতে করতে বা বলতে বলতে যায়, আর আমি সেই রাতেও জেগে জেগে বই পড়ি, পত্রিকা পড়ি, যা সামনে পাই- সব পড়ি। পড়তে পড়তে চারপাশের মানুষ সম্পর্কে আমার নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। ফলে আমি বেঁচে থাকার জন্য, সবচেয়ে সহজ সুন্দর উপায়ে উদরপূর্তির জন্য বিকল্প হিসেবে গাছ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় দেখিনা। এ নিয়ে একটু আধটু পড়াশোনা করি। দেখি, আলেক্সান্দর বেলায়েভ মানুষের শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভেবেছেন। তাঁর উভচর মানুষ ইকথিয়ান্ডরের শরীরে তিনি ছোট্টো অস্ত্রোপচার করিয়ে জলের মধ্যে বাসযোগ্য করিয়েছেন। বাহ! এই ঘটনা সত্যি আমায় চমৎকৃত করে। বাস্তবে কি এটা সম্ভব? বা মানুষের শরীরে অস্ত্রোপচার করিয়ে গাছ বা অন্য উদ্ভিদ যেভাবে খাদ্যউৎপাদন ও গ্রহণ করে তা কি তৈরি করা সম্ভব? এইসব ভাবি, আর পড়াশোনার পরিধি বাড়িয়ে দেই। একসময় আমি জেনে হতাশ হই যে, মানুষ বা প্রাণির সঙ্গে উদ্ভিদের শরীর কাঠামোয় পার্থক্য যোজন যোজন দূরের। হতে পারে তা বিবর্তনের কোটি বছরের দূরত্ব। এই সব জেনে ক্রমে আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়, ভীষণ খারাপ হয়।

আমি যখন স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে গাছ হতে পারবো না, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমি কবি হবো। এই সিদ্ধান্ত নিতে আমার জীবনের ত্রিশটা বসন্ত কেটে গেছে। বললেই তো কবি হওয়া যায়না। সেজন্য সাধনা করতে হয়, ধ্যান ও চর্চা করতে হয়। তো কবি হওয়ার সাধনা করতে গিয়ে আমি টের পেলাম, আমি আসলে একটা গাছ হয়ে গিয়েছি। চারপাশে জগতে কত কিছু ঘটে, কত মানুষ জন্ম নেয়, কত মানুষের মৃত্যু হয়, কত মানুষের মন ভাঙে-সংসার ভাঙে, কত মানুষ কত তুচ্ছ কারণে হানাহানি করে, খুনোখুনি করে, যুদ্ধ হয়, দেশ দখল হয়, ক্ষমতা দখল হয়, ভুল চিন্তার খপ্পরে পড়ে কতজন আত্মঘাতি হয়; কত কিছু ঘটে- কিন্তু, বিশ্বজগৎ আপন নিয়মে চলতে থাকে, কোথাও কোনো ত্রুটি হয়না, কিছুতে কারো কিচ্ছু যায় আসে না, আমার ছেলে বেলার সেই গাছটার মতো, তাঁর মতো আমিও দিব্যি বেঁচে থাকি, নির্বিকার, আমারও কিছুতে কিচ্ছু যায় আসেনা।
আমি আসলে কবি হতে গিয়ে একটা গাছ হয়ে গিয়েছি।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত