বই ফেরি করে বেড়ানো এক বিজ্ঞানীর গল্প
দৃশ্যপট ১
ডঃ ফয়জুর রহমান আল সিদ্দিকের জন্ম ১৯৩৪ সালে ঢাকা জেলার অন্তর্গত নবাবগঞ্জ থানাধীন চরমধু চাবিয়া গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নশাস্ত্রে অনার্স এবং থিসিস গ্রপে এম.এস.সি ডিগ্রি অর্জন ও পোস্ট এম. এস. সি গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন। কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লীয় রসায়নে পি. এইচ. ডি ডিগ্রী প্রাপ্ত হন। এছাড়াও ইরানের তেহরান নিউক্লীয় বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল নিউক্লীয় চুল্লি গবেষণা ইনস্টিটিউটে যথাক্রমে পোস্ট. এম. এসসি ও পোস্ট ডক্টরাল গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন।
তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধীনে এসিস্ট্যান্ট কেমিক্যাল একজামিনার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে নিউক্লীয় শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উপড় দীর্ঘকাল গবেষণা করার পর ১৯৯২ সালে পরিচালক পদে উন্নীত হন। বর্তমানে তিনি ইন্টারনেশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার এন্ড টেকনোলজির (IUBAT) রসায়ন বিভাগের শিক্ষক হিসাবে কর্মরত আছেন।
এখানেই শেষ নয়। তিনি একাধারে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং গবেষণা করেছেন প্রাক্তন সোভিয়েত রাশিয়া, পূর্ব জার্মানী, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, গণচীন, জাপানের মতো রাষ্ট্রগুলোতে। রিজিওনাল কো-অপারেটিভ এগ্রিমেন্ট নামক একটি দক্ষিণ এশিয় আঞ্চলিক ফোরামে দীর্ঘ ৭ বছর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার নিজস্ব গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
দৃশ্যপট ২
অমর একুশে বইমেলা। সেখানে একজন মানুষ আপন মনে নিজের বই ফেরি করে বেড়াচ্ছেন। বয়স আশির বেশিই হবে । তবুও তিনি বয়সের ভারে ক্লান্ত হননি। বরং তার একাগ্রতায় তারুণ্যকে জয় করেছেন।
একটা সময় ছিলো যখন লেখকেরা লেখালেখির মাধ্যমেই জনপ্রিয় হতো। এখন সময়টা সোশ্যাল মিডিয়ার। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ ভাইরাল কিংবা জনপ্রিয় হয়ে গেলে বইমেলায় তাঁর বই প্রকাশ করাটাই এখনকার ট্রেন্ড। মেধা আছে কি নেই সেটা বিবেচ্য নয়, জনপ্রিয়তাই এখন বই প্রকাশের মাপকাঠি। প্রতিভা কিংবা মেধার দরকার নেই। ভাইরাল হলেই হলো আরকি! দৃশ্যপট একের মানুষটিই যদি দৃশ্যপট দুইয়ের বই ফেরিওয়ালা হয় তখন নিশ্চয় থমকে দাঁড়াবেন? কিংবা জানতে চাইবেন কি বই? কি নিয়ে লিখেছেন ডাঃ ফয়জুর রহমান আল সিদ্দিক?
‘বাঙালির জয়, বাঙালির ব্যর্থতা’ নামের বইটি ২০০০ সালে পাঁচশ কপি প্রকাশ করে পরমা প্রকাশন। এরপর প্রকাশক কথা দিলেও আর প্রকাশ করেননি। পরে প্রকাশক বলে দিয়েছেন, অন্য প্রকাশনি থেকে বই প্রকাশ করার জন্য। এরপর থেকে প্রতি বছর নিজেই দুইশ কপি বই ফটোকপি বের করে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন তিনি। এ বছর বইমেলাতে বই ঘুরে ঘুরে বিক্রি করবেন, তাই ফটোকপি করেছেন একশ কপি।
এক গণমাধ্যম কর্মীর সাথে কথা বলতে গিয়ে তিনি তাই আক্ষেপ নিয়ে বলেন-
বাঙালির ব্যর্থতার জায়গা কোথায় ফ র আল-সিদ্দিক মনে করেন, ‘‘দেশভাগের সময় আমরা পাকিস্তান ভালো মন নিয়েই চেয়েছিলাম। কিন্তু পাকিস্তান ‘ফাঁকিস্তান’ হয়ে গেল। তখন আমাদের লড়াই করতে হলো। লড়াই করে জিতলাম। কিন্তু এখন আমরা তো সবকিছুতেই ব্যর্থ। আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছি, কিন্তু স্বাধীনতা রাখতে পারলাম না। আবার স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে গেল ‘ফাঁকিস্তান’। দেশে যেরকম চুরিচামারি হচ্ছে, এটা কী স্বাধীন দেশ হলো?’’
‘আমাদের কী কী অর্জন করেছি, কী কী আমাদের ব্যর্থতা সেটা আমি তুলে ধরতে চাই। যে জাতি যারা ভুল না জানতে পারে, সেই জাতি বড় হতে পারে না। তাই ভুলগুলো জানা জরুরি’, যোগ করেন আল-সিদ্দিক।
সফলতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এই যে বইমেলা হচ্ছে, এই একটা জিনিসই আমাদের অর্জন। এটাই বাঙালির জয়।’
তবে বইমেলাকেও সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখেননি ফ. র. আল-সিদ্দিক, ‘যাদের বই বাজারে প্রচলিত না, তাদের জন্য বইমেলায় আলাদা স্টল দিচ্ছে না কেন? যারা নিজেরা নিজেদের বই প্রকাশ করছে, কিন্তু প্রকাশক না। তাদের জন্যও তো স্টল থাকা দরকার। যেখানে তারা নিজেদের বই বিক্রি করতে পারবেন। অনেক ভালো ভালো বই প্রকাশ হয় না।’
চলমান অমর একুশে বইমেলার দ্বিতীয় প্যাভিলিয়ন পুথিনিলয় এ তাঁর বই পাওয়া যাবে। বইটির নাম ‘বাঙালির জয়, বাঙালির ব্যর্থতা’।
