গান কি এখন আর গান আছে: অমর পাল
ভবনদীর ওপারে চলে গিয়েছেন শিল্পী। সঙ্গীতমুখর এক দীর্ঘ জীবনে ইতি পড়েছে, কিন্তু এই প্রজন্মের জন্য রেখে গিয়েছে উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। আদ্যন্ত সুরের অববাহিকায় যাপিত এই জীবনে কি বেদনা ছিল না, ছিল না আক্ষেপ, অশ্রু? বিশেষত এই সময়ের বাংলা গান, বদলে যাওয়া লোকসঙ্গীতের আঙ্গিকে কতটা রক্তাক্ত হয়েছিল নবতিপর শিল্পীর হৃদয়? একান্ত আলাপচারিতায় টালিগঞ্জের কে এম নস্কর রোডের বাড়িতে সে কথা বলেছিলেন অমর পাল।আজ তাঁর প্রথম প্রয়াণ দিবসে সেইসব কথাতেই তাঁকে ইরাবতীর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লোকসঙ্গীতে যে বদল এসেছে, সেটা আপনি কী চোখে দেখেন?
লোকসঙ্গীত শব্দটা আমি বলব না। বলব পল্লিগীতি। শচীন দেব বর্মন, আব্বাসউদ্দিন আহমেদ বলতেন পল্লীগীতি। পল্লীগ্রামের কথা উঠে আসত গানে। নৌকো বাইতে বাইতে মাঝি গাইত, ‘মাঝি বাইয়া যাও রে’। চাষি হাল টানতে টানতে গুনগুন করত। এটাই পল্লীর মানুষের গান। জীবন থেকে উঠে আসা গান।
হ্যাঁ, তাতেই যে এখন অনেক বদল এসেছে…
সে তো এসেইছে। গান কি এখন আর গান আছে? গানের সর্বনাশ হয়ে গেছে।
এত কঠোর মন্তব্য কেন করছেন? এই সময়ের গান কি আপনার পছন্দ হয় না?
এখন গান বিকৃত করা হচ্ছে। ছেলেবেলা থেকে যে গান শুনে বড় হয়েছি, এখন তা কোথায়! অপ্রিয় কথা বললে আমার শত্রু বাড়বে। এখন সময় বদলে গেছে, আমার কথা পছন্দ হবে না। বরং অন্য কথা বল।
শুধু ভালো আর খারাপ লাগাটুকু বলুন। গানের সর্বনাশ হয়েছে, কেন বলছেন?
তাহলে কয়েকটা কথা বলি। যেমন ধর, গানের বিশুদ্ধতা অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। গান বিকৃত করা হচ্ছে। লোকসঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্রই বদলে দিয়েছে। একতারা, দোতারা, খোল, ঢোল নিয়ে আমাদের সময়ে গান বাঁধা হত। এখন এই বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই গান গাওয়া হচ্ছে। লোকসুরের প্রাণ যে বাদ্য, তাকে ছাড়া কী গান হয় বল দেখি!
আপনি কি বাংলা ব্যান্ডের কথা বলছেন? এখন একটা নয়া আঙ্গিক আমরা পেয়েছি, নগর বাউল…
সে তোমরা যে নামই দাও। মাটির সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে লোকগান গাইবে কী করে? মাটির মানুষদের কাছাকাছি থাকতে হবে, তাঁদের সুখ-দুঃখ, জীবনযন্ত্রণা অনুভব করতে হবে। প্রকৃতিই আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। প্রকৃতির কাছে না গেলে কোনও পাঠই সম্পূর্ণ হয় না। মাঝি, চাষির গানের কথা বলেছি। আমরা গ্রামে দেখেছি, ছাদ পেটানোর সময় গান গাওয়া হত। মানুষ পথের ক্লান্তি ভুলতে গান গাইত। এ সবের অভিজ্ঞতা না থাকলে যে গান গাওয়া হয়, তাতে প্রাণ থাকে না।
এই কথাগুলি কি ব্যান্ডের গান নিয়ে বললেন?
ওই যে আগেই বললাম, ফোকের বাদ্য কী সেটা জানে না। অনেক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে লোকগান গাইছে, কিন্তু কোন বাদ্য ছাড়া তা গাওয়া যাবে না, সেটা তাদের কেউ বলে দেয়নি। বিদেশি যন্ত্র দিয়ে ফোক গাইলে আমাদের জাত যায়। শচীন দেব বর্মণ, আব্বাসউদ্দিনদের উত্তরাধিকার বহন করা যায় না।
কোন একটি বিশেষ গান ধরে যদি বিকৃতির কথাটা বুঝিয়ে বলেন…
বলছি না, এ সব বললে শত্রু বাড়বে। এই বয়সে আর সেটা চাই না।
ব্যান্ড ছাড়াও অনেকে একক শিল্পী আধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গে লোকসঙ্গীত গাইছেন। শ্রোতারা কিন্তু তা গ্রহণ করছেন।
শ্রোতার কথা যখন বললে, একটা গল্প বলি, তাহলে বুঝতে পারবে তখন শ্রোতারা কেমন ছিলেন। কালিকার (প্রয়াত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য) কাকা অমিয় ভট্টাচার্য আমাকে শিলচরে গান গাওয়াতে নিয়ে যান। তখন অমিয়র বাড়িতে গেছিলাম। অমিয়র মা, মানে কালিকার ঠাকুমা, আমি অমর পাল বলে রেয়াত করলেন না। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। মুখোমুখি হতেই দেখি তিনি অগ্নিমূর্তি, প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। আমার কাছে নির্মলেন্দু চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন।
সে কী, অভিযোগ কিসের?
‘সোহাগ চাঁদ বদনী ধনি’ গান নিয়ে অভিযোগ। আমাকে কালিকার ঠাকুমা বললেন, নির্মলেন্দু কেন গানটাকে বিকৃত করেছেন? ওই মহিলার রাগ দেখে বুঝলাম, আমাদের শ্রোতারা কেমন ছিলেন। এখন আর গান এত যত্ন নিয়ে কে শোনে? আসল কথাটা হল, ‘ভাইরে মানুষ নাইরে দেশে’! বৈষ্ণবেরা হরে কৃষ্ণ হরে রাম গান পেয়েছে ঈশ্বরের থেকেই। এখন মানুষই ভগবান। এখন ‘ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ’ গানটা নিয়ে মামলা চলছে।
তাহলে তালিমে সমস্যা আছে?
সেটা আছে। আরও একটা বড় ব্যাপার, সবটাই বাণিজ্যমুখী হয়ে উঠেছে। তার কথা বেশি ভাবছে সবাই, গানটা গৌণ হয়ে যাচ্ছে। মনে আছে, ১৯৫১ সালে প্রথম অডিশনের সুযোগ পেয়েছিলাম আকাশবাণীতে। গান রেকর্ডিং হওয়ার আগে কী ভয় যে লাগত! গানপিছু পারিশ্রমিক কত ছিল জানো? ২০ টাকা। আজকের সঙ্গে তার তুলনা চলে না। ‘ধান কাটি কাটি ধান’, ‘নবান্নের কুটিরে ধান’ এইসব গানে আমি লিড করি আর মানব (মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়) আর শ্যামল (শ্যামল মিত্র) আমার সঙ্গে গলা মিলিয়েছে। ‘দীনবন্ধু হে’ তখন কত জনপ্রিয় ছিল। কথা কী ছিল!
সবকিছুর সঙ্গে এই পরিবর্তনকে কি আমরা স্বাগত জানাব না?
ভালো কিছু হলে স্বাগত জানাতেই হবে। কিন্তু, মান খারাপ হলে কী বলব? এখন দেখি, বাউল গান গাইলেই নাচ করে। আমি পূর্ণচন্দ্রের (পূর্ণচন্দ্র দাস বাউল) বাবা নবীন দাসকে দেখেছি। তিনি যখন গাইতেন, তাঁর চোখে থাকত হাসি, মুখে কান্নার ছাপ। হৃদয় থেকে গান গাইতেন। ছিন্ন পোশাক পরতেন। এখন ওসব পাবে না।
এখন রিয়েলিটি শোতে বাউল গান গাওয়া হচ্ছে তো!
আগেই তো বললাম, গানের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। আমাকে এই গানের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তবেই না দেবকীকুমার বসু থেকে সত্যজিৎ রায়, সকলের মন জয় করতে পেরেছি!
বাংলাদেশেও লোকগানের চর্চা হচ্ছে। ওখানেও কি একই অবস্থা?
ওদের চর্চা ভালোই হচ্ছে। সারি, জারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি অনেকটাই ওপার বাংলায় পাওয়া যায় বেশি। এই বাংলায়ও লোকসঙ্গীতের শিকড় রয়েছে। কিন্তু শিকড় থাকলে তার তো যত্ন করতে হবে! সেটা হচ্ছে কই?
কৃতজ্ঞতা: ইন্ডিয়ানএক্সপ্রেসবাংলা