কবিদের চিরকালই মন্দার বাজার: অমিত সাহা
আজ ২৩ শে ফেব্রুয়ারি কবি,সম্পাদক ও অধ্যাপক অমিত সাহার শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
অমিত সাহার কবিতা
দুঃখী প্রেম
দুঃখসমগ্রের আছে জানি
আকাশের উঠোনের ধান ।
পাখি এসে খেয়ে গেল কিছু,
রেখে গেল বিকল্প উড়ান !
গাছের পায়ের কাছে ঝুঁকে
সন্ধ্যালোক অজানাই লাগে ।
পেঁচার বিস্ময় নিয়ে দেখি
নদীটি তারার জন্য জাগে !
জাগে …
জাগে…
রাত্রি ক্রমে গাঢ়…
দুঃখী প্রেম, বাঁক নিতে পারো !
কবি অমিত সাহার সাক্ষাৎকার
‘কবিদের চিরকালই মন্দার বাজার। আর সে কারণেই তো সুনীল গাঙ্গুলি আজ এত বড় কথাসাহিত্যিক! আমি কবিতার মধ্যে একটা অন্যরকম টান অনুভব করি। এই টান এখনো গল্পের মধ্যে পাইনি। তবে পড়ি অবশ্যই। কবিতার মধ্যে একটা সূক্ষশিল্প আছে। গল্পেও আছে, সেটা মানি। কিন্তু কোথাও যেন কবিতার কাছে একটা আত্মিক টান উপভোগ করি।’
২০১৬ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশিত হবে কবি অমিত সাহা-র তৃতীয় কাব্যগ্রন্থঃ বিরহ কথকতা। প্রকাশকঃ হাওয়াকল। নতুন বই প্রকাশের মুখে কবি অমিত সাহার সাথে কথা বললেন কিরীটী সেনগুপ্ত।লেখাটি ২০১৬ তে ফেরারিতে প্রকাশিত।
মাস তিনেক বা তার কিছুটা আগে। রাত প্রায় একটা বাজে। ফেসবুকে এক অপরিচিত মানুষ ব্যক্তিগত বার্তায় লেখেন, “নমস্কার দাদা, ২০১৫-র বইমেলায় আমার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে সিগনেট প্রেস থেকে।” হকচকিয়ে গেলাম। এ আবার কি! আমি তো কিছুই জানতে চাইনি। কে এই অমিত সাহা? উত্তরে লিখলাম, “তো?” লিখিত জবাব এলো, “না, ওই আর কি! যদি বইটি পড়ে আপনি মতামত জানান ভালো লাগবে।” চটপট টাইপ করি, “আমি তো কবিতা পড়ি না। কিন্তু একটা কথা বলুন, সিগনেট প্রেস থেকে আপনার বইটি প্রকাশিত হয়েছে এটা জানানোর জন্যেই কী আমাকে বার্তাটি পাঠালেন? যদি তাই হয়, আপনার দুর্ভাগ্য। আপনাকে জানাতে হচ্ছে যে আপনার বই সিগনেট প্রকাশ করেছে। কতো কবির কতো বই খ্যাতনামা সংস্থা প্রকাশ করেন, তার কতটুকু পাঠক খবর রাখেন? কতটুকু জানানো হয় পাঠককে?” উত্তরের ঝাঁঝ তীব্র ছিল নিঃসন্দেহে। তবে মানুষটিও দমবার পাত্র নয়, বুঝলাম। বার্তা চালাচালি অব্যাহত থাকলো আরও কিছু সময়। আলাপ জমে গেলো। ফেসবুক থেকে ফোন, আর ফোন থেকে মুখোমুখি আলাপিত হওয়া। কোথায়? স্বয়ং কবিগুরুর জায়গাতে … বোলপুরে। পেশা শিক্ষকতা হলেও চেহারার গুণে কলেজ ছাত্র হিসেবে বেশ চালিয়ে দেওয়া যায়। এমনকি, প্রাপ্তবয়স্ক সিনেমা থিয়েটারে প্রবেশের অবাধ অনুমতি নিয়েও কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন। সোজা কথায়, তারুণ্যের ছায়ায় পালিত এক যুবক। কিন্তু চোখের দিকে তাকালেই যন্ত্রণার ছোঁয়া, অথচ অসামান্য বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি।
২০১৬ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রকাশিত হবে কবি অমিত সাহার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থঃ বিরহ কথকতা। প্রকাশকঃ হাওয়াকল। নতুন বই প্রকাশের মুখে কবি-লেখকদের একটু বেশি রকমের নিরুপায় মনে হয়। তাই আজ আমার সঙ্গে অমিতো। এই দেখুন, কবিগুরুর জায়গায় থাকতে থাকতে অমিত থেকে রাবিন্দ্রিক “অমিতো” হয়ে গেছেন কবি অমিত সাহা।
খ্যাতনামা প্রকাশকের ঘর থেকে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর, তৃতীয় বইয়ের জন্য ততটা-বিখ্যাত-নয় প্রকাশকের দ্বারস্থ কেন হতে হল?
যে প্রকাশক সৎ থেকে লেখকের প্রাপ্য ন্যূনতম সম্মানটা দিতে জানে সেই ভালো প্রকাশক। বিখ্যাত প্রকাশনা আমি তাদেরকেই বলবো। সেই অর্থে আমার চোখে ‘হাওয়াকল’ও বিখ্যাত প্রকাশনা। আর একটা ব্যাপার আমি বিশ্বাস করি, লেখক-প্রকাশকের সম্পর্কে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী না হলে একসাথে কাজ করা যায় না। আমার সঙ্গে বিতানের পরিচয় তোমার মাধ্যমেই। প্রথমত বিতান আমার বন্ধু, তারপর ও প্রকাশক। প্রথম পরিচয়ে আমি কিন্তু ভাবিনি আমি বিতান-কে দিয়ে বই করবো। প্রথম যে বই বিতান-কে প্রকাশ করতে বলেছি সেটা সুকান্ত-দার বই। তারপর হঠাৎ
মনে হলো আমার একটা পান্ডুলিপি পড়ে আছে সেটা যদি বই করা যায়! বলা মাত্র বিতান রাজি। বিতান অসম্ভব কাজপাগল ছেলে। প্রত্যেকটা পান্ডুলিপি ও পড়ে। মন দিয়ে কাজ করে, বই নিয়ে ভাবে।
এ যে প্রকাশক-স্তুতি হয়ে গেলো। বই প্রকাশের প্রাক্কালে এমন কথা লেখক-কবিরা হামেশাই বলে থাকেন।
কিন্তু বই প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পর কন্ঠ এতো মধুর থাকবে তো?
বিতান-স্তুতি বলতে পারো। বন্ধু তখনই ভালো যখন ঝগড়া হয়। ভবিষ্যতে মনোমালিন্য হতেই পারে, কিন্তু বন্ধুত্ব ক্ষুণ্ন হবে না।
তোমার দ্বিতীয় প্রকাশকের থেকে কোনও রয়্যালটি পেমেন্ট পেয়েছ? বইটির বিপণনে তোমার তরফ থেকে আলাদা কোনও উদ্যোগ নিয়েছিলে?
হ্যাঁ, রয়্যালটি পেমেন্ট পেয়েছি। গত এপ্রিল মাসে। জানুয়ারি থেকে মার্চ তিন মাসের হিসেব পেয়েছি। আমার তরফ থেকে ফেসবুক-প্রচার ছাড়া তেমন কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এই মন্দার বাজারে আরেকটি কবিতার বই? কবিদের কি গল্প উপন্যাস লিখতে নেই?
কবিদের চিরকালই মন্দার বাজার। আর সে কারণেই তো সুনীল গাঙ্গুলি আজ এত বড় কথাসাহিত্যিক!
আমি কবিতার মধ্যে একটা অন্যরকম টান অনুভব করি। এই টান এখনো গল্পের মধ্যে পাইনি।
তবে পড়ি অবশ্যই। কবিতার মধ্যে একটা সূক্ষশিল্প আছে। গল্পেও আছে, সেটা মানি।
কিন্তু কোথাও যেন কবিতার কাছে একটা আত্মিক টান উপভোগ করি।
দিন শেষে স্ত্রী যখন বলেন, ভাবছি আগামী মাসে নতুন একটা নেকলেস নেব, তখন কবিতায় মাখামাখি
করতে ইচ্ছে হয়?
ওটাও আমার কবিতার উপাদান হয়ে যায়। তবে তুমি যে সেন্সে বলছো সেটা আমাকে ভাবতে হয় না ঈশ্বরের কৃপায়। তাই হয়ত কবিতা বেরোয়। আমি এখনো লেখাটাকে পেশা হিসেবে নিইনি। যদিও সেটা হওয়া উচিত বলে মানি। এখনো আমি নেশায় লিখি। ভবিষ্যতে দেখি কি হয়! কবিতা সমাজেরই একটা অংশ। তাতে নেকলেসের আবদার থাকবে। এই লাইনটা আমার প্রকাশিতব্য বইটাতেও আছে।
সংস্কৃত বিষয়ের অধ্যাপনা করছ বেশ কয়েক বছর। আবার বলছ, কবিতায় আত্মিক টান উপভোগ কর।
ভাই অমিত,উপভোগ বিষয়টি অন্যায্য। অবৈধ। ভোগ বিষয়টি শাস্ত্রসম্মত। কবিতাই কি তোমার…
উপ এখানে উপসর্গ। যার অর্থ কাছে। কাছ থেকে ভোগ করি কবিতার টান। অনুভব করলেই শুধু হবে উপভোগও যে করতে হবে।
উত্তরটি অতি সংক্ষিপ্ত। অনেকটা সেই উপবাসের অর্থ বোঝানোর মতো শোনালো।
আমি খুব সচেতন ভাবেই বলেছি, দেখো। আগে অনুভব পরে উপভোগ। কোন কিছুর প্রতি আকর্ষণে প্রথম প্রয়োজন মন যা অনুভবের আশ্রয়। মন সজাগ থাকলে তবে অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো কাজ করতে পারে। তখনই উপভোগের বিষয়টা আসে। অনুভব কাউকে বোঝানো যায় না উপভোগটা বোঝানো যায়। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে আমি কবিতার কাছে যেতে চাই।
তোমার কবিতায় শরীর এবং আবেগ এই দুইই বড়ো মাখোমাখো। স্বীকার কর এই সত্য?
হ্যাঁ, স্বীকার করি। তবে সামাজিক উত্থান পতনও আছে কিছু কবিতার টুকরো কোলাজ-এ। আসলে আমার একটা কবিতার মাঝেই অনেকগুলো ইমেজকে কোলাজ এর আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করি। সেখানে প্রেম থাকে, বিরহ থাকে, থাকে খোয়াই-এর ক্ষয়ে যাওয়ার কষ্ট।
স্ত্রী-পুত্র নিয়ে দিব্য সংসার করছ। বিরহের কী আছে তোমার জীবনে?
প্রেমিক মানুষ আর বিরহ থাকবে না! আমার “বিরহ কথকতায়” শুধু মানুষের বিরহ নেই। আছে চেতন অচেতন সকলের। উল্কারও বিরহ আছে মহাকাশ-বিচ্ছেদের বিরহ। সাংসারিক মানুষদের বিরহ কী থাকতে নেই! অনুভূতিটাই আসল। প্রতিটি বস্তুর ভেতর নিজেকে মিশিয়ে দেওয়া। আমার কাছে কবিতা হল জাগতিক সমস্ত প্রকার অনুভূতির প্রকাশ — অভিজ্ঞতার প্রকাশ। যেটা কখনো একটু আড়াল দিয়ে অথবা আড়াল-না-দিয়ে প্রকাশ পায়।
তোমার প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থের নামঃ বিরহ কথকতা। তোমার টার্গেট রিডার্স কারা? এই প্রশ্নটি করার উদ্দেশ্য, কবিতা পাঠকেরাও সব কবিতা সমানভাবে গ্রহণ করেন না।
ঠিকই। যারা ভাবেন আধুনিক কবিতা মানেই অবোধ্য কিছু একটা তাদের প্রতি আমার আবেদন বইটি পড়ার। আমি চাইছি সেসব পাঠক যারা উদার মন নিয়ে কবিতা পড়ে। কোন ছুঁচি-বাই নেই। কবিতায় এটা বলা যাবে না, ওটা বলা উচিৎ হয়নি,ইত্যাদি ভাবনাগুলো পালটাতে হবে। তবে “বিরহ কথকতায়” প্রেমের ন্যাকামি নেই। আছে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব অবক্ষয়, মাসকাবাড়ি বাজার শেষের অভিজ্ঞতা।
বিগত বছরে তোমার পড়া পাঁচজন তরুণ এবং সম্ভাবনাময় কবির নাম তোমার থেকে জানতে চাই।
রাকা দাশগুপ্ত, ব্রতীন সরকার, সৈকত ঘোষ, নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়, অনির্বান দাশগুপ্ত, আরো অনেকের কবিতাই পছন্দ আমার।
কবিযশ কোনও প্রার্থিত, কাঙ্ক্ষিত, অপার্থিব সম্পদ বলে মনে হয় তোমার?
অবশ্যই। এটা সংস্কৃত আলংকারিকরা অনেক আগেই বলে গেছেন।“কাব্যং যশসে অর্থকৃতে…” কবি কবিতা লিখে যেটা প্রথম আশা করেন সেটা হল যশ বা খ্যাতি। এই বাস্তব আমি স্বীকার করি। তবে এই কাঙ্খিত যশ অপার্থিব নয়। পৃথিবীর মানুষই পারে কবিকে তার চাওয়া-পাওয়াগুলো মিটিয়ে দিতে। সোজা কথা, মনের আনন্দ থেকে কবিতা লিখি এবং প্রশংসা পাওয়ার জন্যই লিখি। কালিদাস বলেছেন “মন্দকবি যশঃপ্রার্থীঃ”।
[কবিতা, কবিতা বিষয়ক আলোচনা, লিটেরারি নন-ফিকশন, মেময়ার এবং অনুবাদ — ইংরেজি ভাষায় ভারতীয় লেখকদের মধ্যে কিরীটী সেনগুপ্ত একটি পরিচিত, আলোচিত এবং স্বীকৃত নাম। তাঁর কাজকর্মের প্রশংসা কেবল ভারতে নয়, আমেরিকা এবং ইংলন্ডের প্রখ্যাত সাহিত্য পত্রিকাতেও স্থান পেয়েছে বহুবার। তাঁর যৌথ সম্পাদনায় দেশ এবং বিদেশে প্রকাশিত চারটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা এবং গল্প সংকলন। তাঁর সর্বাধিক আলোচিত গ্রন্থ, মাই গ্লাস অফ ওয়াইন, নথিভুক্ত এবং সংকলিত হয়েছে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরের রায়ার্স মিউজিয়াম এন্ড লাইব্রেরিতে। বর্তমানে লিটারেচার স্টুডিও রিভিউ পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক।]