| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

অথবা ছাদ-যাপন

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
এখন অনেকটা সময় ছাদেই কেটে যায়। রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে বসি। রোদ্দুর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে চলে যায়। শীতকাল এলে ছাদের সঙ্গে বন্ধুতা জমে ওঠে বেশ। একা একা নিজের কথা শুনি। গাছেদের কাছাকাছি থাকি। কোথাও পাতা ঝরে যায়, কোথাও ফুল। দূর থেকে ভেসে আসে কীর্তনের সুর। এই সুরের মাধুর্য আর শীতের রোদ্দুর মিশে গিয়ে পরিবেশ খুব অমৃতময় হয়ে ওঠে। তখন বেঁচে থাকাটা আনন্দময়, প্রাণময় মনে হয়। দূরে যাত্রী বোঝাই ট্রেন চলে যায় ম। ট্রেনের সঙ্গে রোদ্দুরও চলে যায় একটু একটু। দুপুরগুলো কেমন যেন কৃষ্ণময় হয়ে ওঠে — বেহালার সুর ওঠে করুণ। সুর গড়িয়ে নামে, যেন রসের ধারা। খেজুর গাছ, একটা হাড়ি বাঁধা। হাড়ির ওপর কাক। ট্রেন চলে যায় বনগ্রামের দিকে। বিভূতিভূষণের পাড়ায়, রাখালদাসের পাড়ায়…ট্রেনের শব্দ কমে গেলে পর আবার কৃষ্ণনাম ভেসে আসে। খোলের ওপর চাটি। আবেগে কাঁদতে থাকেন কীর্তন গায়ক। নামগানে কান্না ওঠে ভেতর ঘরে। 
       ছাদে দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় কেটে যায়। তারপর তৈলমর্দন শেষে স্নান। উত্তুরে হাওয়া আসে। উনুনে ফুটছে গরম জল। গাঁদাফুল মাথা দোলায়। মিহি হাওয়া। লেবুফুল এখন থেকেই ফুটছে — কিছু কিছু ঝরেও যাচ্ছে। পাতিলেবু, কাগজি, কমলা…এই কমলা দেখে সুখ। খেয়ে সুখ নেই। ভয়ংকর টক। ঠাকুরের বাসন মাজার কাজে লাগে। বাবা লাগিয়েছেন শখ করে। সাদাজবা, লালজবা, গোলাপিজবা আরো কত যে জবা আছে। ছাদ জুড়ে ফুটে থাকে নীলকণ্ঠ— শ্বেত অপরাজিতা বলে কেউ কেউ। তাও আছে। মাধবীলতা আগে ছিল। এখন নেই। কেটে ফেলা হয়েছে। ছাদে এলে মাধবীর কথা মনে পড়ে খুব। জঙ্গল হয়ে গিয়েছিল একেবারে। আমার প্রিয়ফুল। লোকে বলে সাপ আসে– কই আমার চোখে পড়ল না তো! আরো যে কত নাম না-জানা গাছ। 
     অনেকটা সময় ছাদে কেটে যায়। এখন ছাদে বসে কমলা খাওয়ার সময়। দূরের বাদামগাছটার দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখি। কমলা খাই। এইসব অবসর আমি হারিয়ে ফেলতে চাই না। ফোন নিচে থাকে। অধিকাংশ সময় অফ থাকে। এই সময়টা নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার সময়।
    “বেদানা গাছে ফুল এসেছে। তার নীচে ছায়া। তার নীচে মায়া। রোদের বিলম্বিত আলো মেখে শুয়ে আছে ছাদ। ছাদের ওপরে আমগাছ ঝুঁকে নেমেছে।গাছে হলুদ রঙের পাখি। সেদিকে তাকিয়ে বেলা যায়। শীত লেগে থাকে খসখসে চাতাল জুড়ে। কার্নিশে পালিত বিড়াল বসে থাকে পাখিটিকে শিকার করবে বলে। এভাবেই এক একটা দিন আসে। এক একটা দিন শেষ হয়। বেদানা গাছের পাশে জমা হয় অতীতের কত যে বেদনা…কত যে আনীল জীবন…বেদনা আর বেদানার রঙিন উদ্ যাপন… নীল আর লাল , লাল আর নীল …মিশে যায় — শীত আসে চলে যায়। বেদানার গাছে বেদনার ফুলগুলি ফুটে থাকে শুধু…” ( দিনলিপি :৪|১|২০১৮)
    শুনতে পাই ফেরিঅলার ডাক। কখনো কম্বল, কখনো শাল-চাদর, কখনো অন্যকিছু। ডেকে কথা বলি। খোঁজ-খবর নিই। সম্ভব হলে কেনাকাটাও করি। ছাদ আমাকে এইসব সুখ দিয়েছে। আমি অদ্ভুত বিস্ময়ে দেখি কীর্তনের সুরের ভিতর দিয়ে ইউক্যালিপটাস বা বাদামগাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে। এই ঝরে যাওয়ার ছন্দটাও অনুভব করার চেষ্টা করি। এমন সময় চেয়ারের হাতলে এসে বসে টুনটুনি পাখি। কিছু কি বলতে চাইল? বোঝার আগেই ট্রেনের ভোঁ শোনা গেল…পাখিটা চলে গেল…
   জীবন কিন্তু পাখি। অথবা পাখির মতোই। এই আছে এই নেই। খুব বেশি প্রকল্পনা করতে পারি না তাই। এই যে একা একা আত্ম-উন্মোচন। এই যে বাঁশি বাজে। কান্না উথলে ওঠে কৃষ্ণনামে। ওই যে ট্রেন চলে গেল  প্রিয় লেখকের গাঁয়ের দিকে। এসব থেকে আমি জীবনের মাধুর্য কুড়াই। নিজেকেও কুড়াই। তাকিয়ে থাকার  আনন্দ অনুভব করি। একা না হলে পরমের কাছে কীভাবে পৌঁছবে? পরম -ভবনে যাওয়ার আগে আত্মমন্থন জরুরি। জরুরি আত্মমোচনও। শীতের সকাল থেকে দুপুর নিজেকে ছড়িয়ে দিই , জ্যা মুক্ত করি। বলি যাও , উড়ে যাও — ভেসে যাও—মুক্ত হও , মুক্ত হও…

    “আজকাল আমার কেবল তাকিয়ে থাকতেই আনন্দ। মিহি হাওয়ায় পাতা উড়ে উড়ে ঝরে যায় আহত আনত অতীত।আমি ঝরে যাওয়ার আনন্দ বুঝি। টুপ করে খসে যাওয়ার বিরহ। আজকাল চুপ করে বসে থাকে বক। চুপ করে থাকে জল। এবং উজ্জ্বল রুপোলী শস্য , অচঞ্চল। আমি ভালোবাসার দিকে চোখ রেখেছি। সাঁকো। ছায়া। স্টেশান। সাজানো সবুজ। তাকিয়ে থাকি। বসে বসে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হলে পর দেখি স্টেশান রূপবতী কন্যার মতো সেজে ওঠে। ট্রেন আসে। চলে যায়। বসে থাকি। নীল- সাদা কাঠের বেঞ্চে ঝরে থাকে পাতা। বিষাদ- বৈভব।

তাকিয়ে থাকি। সবকিছুই চিরনতুন মনে হয়। দূরে , অনেক দূরে মন্দিরের ঘন্টা শোনা যায়। ধূপ গন্ধ ভেসে আসে। বুঝি , ওইটেই একটা আস্ত জীবন। যা বেঁধে রেখেছে আমায়…”(দিনলিপি: ১৯|০২|২০১৮)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত