| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

আমার গল্পকার হবার নেপথ্য কাহিনি

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
ঠিক কবে থেকে গল্প লেখা শুরু করেছিলাম আজ আর মনে নেই। তবে আমার প্রথম গল্পের নাম “বাসীফুল”। রচনাকাল ১৯৯৮ সাল। তখন আমি কলেজের ছাত্র। কলেজ প্রেমের গল্প ছিল সেটা। একটা পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। পত্রিকার নামটা মনে হয় সৃজন। হাটথুবা থেকে একটি ছেলে সম্পাদনা করত। সে পত্রিকাটি ছিল হাতে লেখা পত্রিকা। তবে আমি ঠিক যেমন লিখতে চাই, যেভাবে লিখতে চাই, লিখতে পারছিলাম না বলে ভেতরে ভেতরে একটা খেদ ছিল। মাঝে সাময়িক বন্ধ ছিল কিছুদিন। তারপর আবার লিখি। যেন মনে হল, হচ্ছে, এবার হয়ত হচ্ছে! একটু একটু এগোচ্ছে। ২০০০ সালের সময় বা কিছুকাল পর আমি বেশ কিছু ছোটদের গল্প লিখতে শুরু করি। লিখে বেশ আনন্দও পাচ্ছিলাম। তখন দাবদাহ, সৃজন, জাগরণ, মাটির কাছাকাছি, আমার সম্পাদিত পত্রিকা অবগুণ্ঠনে নিয়মিত গল্প লিখেছি। লিখে ভালো লাগছিল। ২০০৩ এ দাবদাহতে প্রকাশিত ‘গাছবন্ধু ‘ গল্পটি তখন পঞ্চম শ্রেণীর সহায়ক গ্রন্থ ” কাহিনি মল্লিকা”তে স্থান পায়। এ এক বিশেষ প্রাপ্তি বলেই মনে করি লেখক জীবনে।
২০০৭ এ প্রথম গল্পের বই প্রকাশিত হয় ম্যালিফাউল থেকে। ওই নামে একটি পত্রিকা ছিল। সম্পাদক ছেলেটির তখন যুবক বয়স। প্রায় প্রতি সপ্তাহে একদিন সন্ধেবেলা সে আমাদের বাসাবাড়িতে আসত। খুব আড্ডা হত। নানা বিষয়ে চলত জোর আলোচনা। ও আমার গল্প খুব পছন্দ করত। নাম সুব্রত বিশ্বাস। ওর ইচ্ছে এবং আমার মৃদু আগ্রহে ২০০৭ এর আগষ্টে আমার প্রথম গল্পের বই “গাছবন্ধু” প্রকাশিত হয়। মূলত ছোটদের গল্প — পরিবেশ ভাবনা, পশু-পাখি- ভূত, মানুষের মূল্যবোধ, পুরনো স্মৃতি এসব নিয়েই লেখা। বইটি খুব পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। অনেক বিশিষ্ঠ মানুষের প্রশংসায় ধন্য হয়েছিলাম। রেডিওতেও এই বইটি নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্ট কবি ও আলোচক অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়। 
তারপরেও গল্প লিখেছি অনেক। কিন্তু নিজের কাছে স্যাটিসফাইড হচ্ছিলাম না। কিছুতেই তৃপ্তি হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল আমি আমার গল্পের ঠিকঠাক ভাষাটা খুঁজে পাচ্ছি না– কীভাবে লিখব, কেমন করে লিখব এইসব। তবু লিখেছি। লিখতে লিখতে নিজেকে খুঁজে চলেছি। নানা পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হচ্ছে সেসব। দৈনিক পত্রিকা সাময়িক পত্রিকা সবেতেই লিখছি।
বড়দের জন্য লেখা গল্প জমে গেল অনেক। ভাবলাম একটা বই করা দরকার। সে সময় এক লিটল ম্যাগের গল্পকারের ভক্ত ছিলাম। পান্ডুলিপি তৈরী করে তাঁকে পড়তে দিলাম। একমাস পর  তিনি ফাইলটি ফেরৎ দিয়ে এত নিরুৎসাহী করেন আমায়, যে বই ছাপানোর ভূত মাথা থেকে হাওয়া। এমনকি বুঝতে পারলাম, আমার দ্বারা গল্প লেখা কোনো কালেই সম্ভব নয়। আমি গল্প লিখতে পারি না এই রকম হীনমন্যতা চেপে ধরেছিল।
২০১২ সাল পর্যন্ত চুটিয়ে গল্প লেখার পর কোনো অজানা কারণে ছোটগল্প লেখায় ছেদ পরে। আমি ২০১৩ থেকে সিরিয়াসলি অণুগল্প লেখা শুরু করি। আর নিয়মিত চর্চা করতে থাকি। ততদিনে ফেসবুকেও চলে এসেছি। ২০১৩ এর সেপ্টেম্বরে একটা গ্রুপ খুলি ফেসবুকে কেবল অণুগল্প চর্চা করবার জন্য। নাম দিই “অবগুণ্ঠন অণুগল্প চর্চার গ্রুপ”। অনেক অণুগল্পকার এই গ্রুপে চর্চা করেছেন। আজ তাঁদের অনেকের নাম হয়েছে। বই-টইও বেরিয়েছে।
২০১৫- এর জানুয়ারিতে কলকাতা বই মেলায় আরেক অণুগল্পকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশ পায় প্রথম অণুগল্পগ্রন্থ “দুজনের গল্প স্বল্প “। ২০১৬-তে আমার একক অণুগল্প গ্রন্থ ” ছক্কুমামা, কর্নেল কাপুর ও অন্যান্য গল্প” প্রকাশিত হয় কলকাতায় অভিযান পাবলিশার্স থেকে। খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে বইটি। এতটা আমি আশাও করিনি। ছক্কুমামা ছোট-বড় সকলের প্রিয় চরিত্র হয়ে ওঠে। আর কর্নেল কাপুরকেও আপন করে নেয় পাঠক। এসব আমার অনেক পাওয়া। তাছাড়া আমার সম্পাদিত পত্রিকা অবগুণ্ঠনে ২০১৩ থেকেই প্রতি সংখ্যায় অণুগল্প থাকে– অণুগল্পের এবং ছোটগল্পের চর্চা হয়।
অণুগল্পের বইটির জনপ্রিয়তার পর সেই পুরনো গল্পের ফাইলটা খুঁজে বার করি। মনে হল গল্পগুলো ছাপা যাক। দেখিই না পাঠক কী বলে! একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম। তাছাড়া লেখাগুলো হারিয়ে যাবে। বই হলে লেখাগুলো থাকবে। ছাপা হল তবে খুব সংকোচ আর দ্বিধা ছিল মনে। ২০১৭ এর কলকাতা বইমেলায় অভিযান থেকেই প্রকাশিত হল। এক বছরেই কপি শেষ। ফেসবুকে , ফোনে, চিঠিতে প্রশংসা ভেসে এলো । মনে হল তাহলে আমিও গল্প লিখতে পারি! যেগুলি লিখি সেগুলি তাহলে গল্প পদবাচ্য!
২০১৭-তে আবার ছোটগল্পে ফিরে এসেছি। নিজস্ব ভাষা ও পথ খুঁজেও পেয়েছি মনে হয়। লিখে বড় তৃপ্তিও পাচ্ছি। ইতিমধ্যে অনেক গল্প সংকলনে আমার গল্প সংকলিত হয়েছে দুইবঙ্গেই। কিছুদিন আগেই ‘অনিলা দেবী সাহিত্য সম্মান-২০১৯ ‘ পেল আমার গল্পগ্রন্থ “বিষাদ-সুন্দরী ও লালপদ্ম “। শ্রমণা পত্রিকা থেকে পেয়েছি “সেরা গল্পকারে” র  সম্মান। গল্প লিখতে এসে , গল্পের পথে যেতে যেতে এসব পাথেয় সঞ্চয় করে হেঁটে চলেছি ।
কেন লিখতে এসেছি জানিনা। না লিখে থাকতে পারি না তাই হয়ত। প্রাণের আরাম আর আনন্দ আছে লেখায়, আছে আশ্রয়। তাই হয়ত লিখি। আমার কিছু কথা আছে । কিছু দেখা আছে। কিছু অভিজ্ঞতাও আছেতাই হয়ত শেয়ার করতে চাই। এই ইচ্ছে থেকেই হয়ত লিখতে আসা। লেখা তো একটা আয়না। নিজেকেই হয়ত সে আয়নায় দেখার চেষ্টা করি। নিজের ভেতরের লোকটাকে হয়ত খোঁজার চেষ্টা করি। একটা গল্প লেখার পর শিশুর মতোই আজো আমার আনন্দ হয়। সেই আনন্দের ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ হয় না। যতদিন বাঁচবো গল্প আমি লিখবোই। মূলত মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবনের কথাই লিখতে চেয়েছি এবং লিখব। নিজস্ব দেখার বাইরে জোর করে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না আমার। লিখিওনি। ভেতর থেকে তাগাদা না এলে জোর করে লিখি না। যা লিখি নিজস্ব বিশ্বাস থেকেই লিখি। ঐতিহাসিক সময় আমাকে ভীষণ টানে। সেই সময়টাকে মনের চোখে দেখতে চাই বলেই ঐতিহাসিক গল্প লিখি। কল্পনার পথে চরিত্রগুলির সঙ্গে অনেক দূর চলে যাই। ভূতের গল্প খুব পছন্দের। লিখেছি বেশ কিছু। এসব নিয়েই বেশ চলে যাচ্ছে। দেখা যাক, চলতে চলতে কতদূর যাওয়া যায়। যেতে যেতে পথের দু’পাশে আর কী কী ঘটনা উঠে আসে কলমে, একান্ত অনুভবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত