| 16 এপ্রিল 2024
Categories
এই দিনে কবিতা সাহিত্য

অনিন্দিতা গুপ্ত রায়ের গুচ্ছকবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

আজ ৮ মে কবি অনিন্দিতা গুপ্ত রায়ের জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


আজ কাল পরশুগুলো

এক

বেড়াতে যাওয়ার আগে অভ্যেসবশত আয়নায়। চোখের জায়গায় দেখি আকোয়ারিয়াম। নীল লাল মাছগুলো বিস্মিত ঠুকরে তুলছে সাদাকালো নুড়ি।  আর জল—টলটল করছে। আমি নৌকো রাখি। ঠোঁট বরাবর। হাসির মুদ্রায় ভাসানের গল্প বলার প্রস্তুতি নিই। জল উপচে ভেসে যায় ডুবে যায় ফ্যাকাশে দিগন্তরেখা। কবেকার একটা ভুলে যাওয়া স্পর্শ আঁকড়ে ধরে পাটাতন—কিছুতেই ছেড়ে যাব না, কিছুতেই না! লবণের গন্ধ, সীগাল আর ফসফরাস—মাছঘরটিকে আকাশ করে দিল।

দুই

জুতোজোড়া চোখ পিটপিট করে কান নাড়াচ্ছে। ফোলাফোলা চোখে ছোট্ট লেজ হাত পায়ে জড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। জিভ দিয়ে চেটে দিচ্ছে পায়ের তলার জোড়াতালি। ওরা সমুদ্র অবধি নিয়ে যাবে পথ দেখিয়ে, জোয়ারের রাতে। এরকমই বলছিল, খুব স্পষ্ট মৃদু স্বরে—শুনতে পাচ্ছি। একটা  বুড়ি কচ্ছপের বাড়ি পৃথিবীর শেষ ডাকঘর। ততদূর চিঠি নিয়ে হেঁটে যেতে হবে। রাত্রির চেহারা সবসময় একটা তরমুজের মত মনে হয়। কালো, গোল খোসা ফাটিয়ে লালের উঠে আসা। টুপ করে পায়ের কাছ থেকে লাফ দিয়ে উঠলেই ওদের খেলা শুরু। সারাদিন দৌড়ে দৌড়ে লাইটহাউস অবধি। যাকে অবিকল তোমার মত দেখতে।

তিন

পাতাগুলো আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর গাছটি দিব্যি নিরালা—ভিড়ে মিশে যাচ্ছে। জানলা উড়ছে তখন পাখনায়। পাখিগুলো দানা খাওয়ার শব্দে ভোর ডাকছে। আসছিইইইই—-বলতে বলতে হলুদের গা থেকে কুড়িয়ে তুলছে আলো। চুলের ভাঁজে কুয়াশাগন্ধের বুনো পথঘাট। এই কলম আর খোলা খাতা পঁচিশ বছরের জমানো অক্ষরের ওপর স্থাপন করলাম। সরলরেখা আঁকার মত কঠিন কাজ অনায়াস হয়ে গেল। একগলা জল ঠেলে    শৈত্যপ্রবাহ থেকে উঠে আসি। তোমার শরীরে যে জোনাকি তখন, একশ বছরে এক আধবার সেরকম আলো দেখা যায়। লোকে বলে।  

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

বইঘর
 
এক
 
চোখ দেখিনি, মণিটি
যেরকম শ্রুতি ও কথ্যের মাঝখানে
দেখারূপ নেই
অনেকটা ধাপ উঠে আসতে আসতে
আসলে পিছিয়ে যাচ্ছিলাম
 
স্পর্ধার বিস্তারে
অসহমতের দিকে ইচ্ছেবশত
টুপটুপ পতনলিপিরা
 
 
 
 
দুই
 
মায়াময় ঘুরিয়ে বলেছ
আখ্যান, প্রত্যাখ্যান
এতটাই টানটান
যে কোনো মুহূর্তে
সুতো ছিঁড়ে যাওয়া থাকে
অসংলগ্নতায়
এরকম দুপুর লেখা হয়
হঠাৎ একা হয়ে আসা
রিডিং রুমের দিকে

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

কফিন
 
মনে করো সাদা বাক্সের পিউপা তুমি
নিজের চারপাশে কাঠের শুষ্কতায় এই যে শূন্যতা
রূপ পাচ্ছে অন্ধকার, আর অন্ধকার তোমার করোটির মত
জাফরি বসানো এক ঘুমের বিপরীতে ক্রমাগত খেয়ে ফেলছে মজ্জাসারণি
তাড়া খাওয়া পা থেকে সিঁড়ি খুলে পড়ে গেলে
হা হা পাল্লার কড়া সশব্দ ধাক্কায় হারানো তালার খোঁজে
চাবির আড়াল থেকে স্পৃষ্ট তরলে লেজ খসে
চোখ মাথা নাভি সহ স্পন্দন ফুলে ওঠে
কে তার শ্যাওলা মেখে ঠোঁট তুলে ডানায় কুসুম
কে বা দেখে নৌকোটি থইথই, আঁজলায় লবণ রেখেছে
মিথুন মূর্তির ভাঁজ শরীরের অলিগলি থেকে শুধু কান্নায়
অপসৃয়মান ছায়ার ভেতরে আয়, আয়– ডেকে ওঠে

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

ছায়া

আলোর ভিতর দিয়ে একটাই রাস্তা
তবু কতটা অন্ধকার মাড়িয়ে পা ক্লান্ত হয়ে উঠছে ক্রমশই
আসার কথা ছিল এখানেই, নির্ধারিত ছিল
নিয়তি নামের কোনও ছায়ার আড়াল
আমাদের আসা বা যাওয়ার মাঝামাঝি
হাইফেন হয়ে বসে থাকলে
তাকেই বিশ্বাস করে নৌকোরা পারাপারহীন যদি
তবে ছায়ানৃত্যের সেই চটুল ভঙ্গিমা ঘর ও দুয়ার এক করে দিক
অনুযোগহীন, নুপুরশব্দহীন সরে যাওয়ার ভেতর
শুধু অবিশ্রান্ত হাসির আওয়াজ তোমাকে জাগিয়ে রাখবে কয়েকটা রাত

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

বিপন্ন শব্দের কাছে যেভাবে আসি

 
এক
 
কাচঘরের ভেতরে এই হাওয়া পৌঁছবে না
এই নিঃশ্বাসের দ্রুততা, এই লবণজল
থেমে যাওয়া ঘড়ির ভেতর দুটো হাত দুপাশে ছড়িয়ে
শুধু পাতা ঝরে ঝরে নিঃস্ব হয়ে উঠবে পাঁজর
ছায়াদের অস্থিরতা অনেকটা বেড়ে গেলে একদিন
চরম অবিশ্বাসের গা থেকে ঝরে যাবে লালনীল রেশম
ক্রমশঃ অভ্যস্ত হয়ে উঠবে আবহাওয়া
আমাকেও সহ্য করে নেবে আলোর বিপরীতে
 
 
দুই
 
এই দমবন্ধ কুয়াশার ভেতর
আমি গড়িয়ে পড়েছি, পিন্ডের মতো
দেখতে পাচ্ছ না, জানছ না
অনুভূমিক পৃথিবীর দিকে একটা একটা করে
নুড়ি ছুঁড়ে ছুঁড়ে জানান দিচ্ছি বেঁচে থাকা
চেনা উপসংহারের দিকে ধাক্কা খেয়ে
ফিরে আসছে সেই সব বাতিল শব্দ
যাকে ঘিরে আশেপাশে শুধু সাদা স্তব্ধতা
মুঠোর ভেতরে ধুকপুক চেপে বরফপুতুল
হিমজলে বিন্দু বিন্দু ডুবে মরে যাচ্ছি
এত যে বাষ্পবিলাসিতা — সে কি চোখের জলের, বল?
 
 
তিন
 
নিজেকে এত বেশি অপরিহার্য ভেবে নেওয়া
পাখির স্বভাবে – অনুমতিহীন
তারপর ঝড় এসে ফিরে গেলে
কাঠকুড়নির ভিড়ে আদিখ্যেতায়
ভাঙা ডানা থেকে রঙ গলে পড়তে থাকে
আচমকা মাটির কাছে নেমে এলে
প্রকৃত দূরত্বে সরে যায় আকাশ
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
 
 
নভেম্বর
 
আসন্ন শীতের মধ্যে বসন্তগন্ধ নিয়ে
জানালার ফ্রেম, সাদা ক্যানভাস নীলচে ডুবুরি ও অবিন্যস্ত কুয়াশা
এসবই খুব অবিশ্বাস্য ভাবতে ভাবতে দেখতে পাই
ইচ্ছাকৃত বিঁধিয়ে দেওয়া আলপিনের ডগায়
কীরকম রক্তদানা করবীর আকার নিচ্ছে
কুয়াশার আখ্যানের মধ্যে
নাক অব্দি ডুবে থাকায় ওডিকলনের গন্ধ
আর ওই কোমল মাথাটি কোলে নিয়ে
ঘ্রাণে নিই দুধের ফেনার মতো
গাঢ় ঠোঁট, ক্লান্ত ও উদাসীন মায়ের শরীরে
নদীগুলো পরিপাটি – যা শুধুই দুই চোখ ভেদ করে
নিস্ক্রমণের পথ খুঁজতে থাকে, জলোচ্ছ্বাসের গল্পে
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
 
ডেডলাইন
 
 
জোড়াতালির সুষুম্নায় এক পাখি
দোল নেই, দোদুল নেই
মেঘ মুছতে মুছতে
চলে যাচ্ছ হাওয়ামোরগের দিকে
ফিরেও আসছ যত অবধি নতজানু
পোষ মেনে থাকে
মুখের ওপর ওই রহস্যরং দেখে নিতে
আর কতবার বলো
শূন্য থেকে ভানুমতী খেল্‌
দেখানোর
ছল ও ছলাৎ নদী হবে!
 
 
অসম্ভব পর্যন্ত যেতে পারি
তুমি তাকেও অতিক্রমের কথা বলো
তুলাদণ্ডের একদিকে আত্মা সাজিয়ে
যথাযোগ্য ভর খুঁজে যাচ্ছি
রাত্রি নামার পর এত ভয় কেন, এত দ্বিধা কেন
পালকের এলোমেলো তারও কিছু উদ্বেগ
বিস্তৃত আহ্লাদে যাকে এই বঁড়শীতে
আলগা টানে ছুঁড়ে ফেলা যায়
সেরকম সিঁড়ির নিচেই ঘর এক, আলোহীন
খসখসে স্মৃতির ভেতর দিয়ে সন্ধ্যা সাজিয়ে বসে আছে
স্টেশন অবধি যাতায়াত, ভুল ট্রেন, হুইসল, চাকার আওয়াজ
তারপরই আসা বা যাওয়ার দিকে সরলরেখার
গোল গোল ঘুরে চলা
ছেড়ে যাচ্ছ ভেবে যার আশেপাশে জড়িয়ে পড়ছ ক্রমাগত
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
সৈকতভুমি
ফেরতযোগ্য সমস্তই—এ হিসেব তোমারই স্পর্ধার মধ্যে
ওলোটপালোট খেতে খেতে গর্ভের ঢেউয়ে ফুলে ফেঁপে
নোনা জলের হাহাকার হয়ে ভেসে উঠছে—
আত্মীয় নই বলে স্বজনও কি নই?
ওই ডুবে যাচ্ছে বিবর্ণ কাঠপুতুল হাঁড়িকুড়ি সমেত
ফেনার মধ্যে মিশিয়ে দিচ্ছে বিষ নাকি আতর
প্রতিফলনের পর ফিরে আসা আলোর সরলে
কালোহাঁস ডানা ঝেড়ে উঠে বসছে
যেন অবিকল জলে ডোবা অথচ শুকনো দুটো চোখ
ফিরিয়ে নিচ্ছে সমস্ত লবণ ও ঢেউ
Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত