| 24 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ গল্প সাহিত্য

আন্তন চেখভের গল্প : বহুরূপী

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

পুলিশ ইনস্পেক্টর ওচুমেলভ হেঁটে যাচ্ছিলেন বাজারের মধ্যে দিয়ে। গায়ে তার নতুন ওভারকোট, হাতে পুটুলি এবং পিছনে এক কনস্টেবল। চুলের রংটা তার লাল, হাতের চালুনিটা ভর্তি হয়ে গেছে বাজেয়াপ্ত করা গুজবেরিতে। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই…বাজার একেবারে খালি…ক্ষুদে ক্ষুদে দোকান আর সরাইখানার খোলা দরজাগুলো যেন একসার ক্ষুধার্ত মুখ-গহবরের মতো দীনদুনিয়ার দিকে হাঁ করে আছে। ধারে কাছে একটি ভিখিরি পর্যন্ত দাঁড়িয়ে নেই।

হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘কামড়াতে এসেছ হতচ্ছাড়া, বটে? ওকে ছেড়ো না হে। কামড়ে বেড়াবে সে আইন নেই আর। পাকড়ো পাকড়ো! হেই’।

কুকুরের ঘ্যান ঘ্যান ডাকও শোনা গেল একটা। ওচুমেলভ সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, পিচুগিন দোকানীর কাঠগোলা থেকে বেরিয়ে এসে একটি কুকুর তিন ঠ্যাংগে লাফাতে লাফাতে ছুটছে আর তার পিছু পিছু তাড়া করেছে একটি লোক, গায়ে তার মড়মড়ে ইস্ত্রির ছাপা কাপড়ের জামা, ওয়েস্টকোটের বোতাম সব খোলা, সারা শরীর ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে লোকটা কুকুরের পিছনের পাটা চেপে ধরল। কুকুরটা আবার কেউ কেউ করে উঠল, আবার চিৎকার শোনা গেল,’পাকড়ো, পাকড়ো’! দোকানগুলো থেকে উঁকি মারতে লাগল নানা তন্দ্রাচ্ছন্দ মুখ। দেখতে দেখতে যেন মাটি ফুঁড়ে ভিড় জমে উঠল কাঠগোলার কাছে।

কনস্টেবল বললে, ‘বেআইনী হল্লা মনে হচ্ছে, হুজুর।’

ওচুমেলভ ঘুরে দাঁড়িয়ে দুমদুম করে গেলেন ভিড়টার কাছে। কাঠগোলার ফটোকটার ঠিক সামনেই তার নজরে পড়ল ‘বোতাম খোলা ওয়েস্টকোস্ট পরা সেই মূর্তিটি দাঁড়িয়ে। ডান হাত উঁচু করে লোকটা তার রক্ত মাখা আঙুলখানা সবাইকে দেখাচ্ছে। তার মাতাল চোখগুলো যেন বলছে ‘শালাকে দেখে নেবো!’ আঙুলটা যেন তার দিগ্বিজয়েরই নিশান! লোকটাকে ওচুমেলভ চেনেন– স্যাকরা খ্রিউকিন। ভিড়ের ঠিক মাঝখানে বসে আছে আসামী, অর্থাৎ বর্জোই জাতের একটা বাচ্চা কুকুর—চোখ নাক পিঠের ওপর হলদে ছোপ। সর্বাঙ্গ তার কাঁপছে। সামনের দুপা ফাঁক করে সে বসে, সজল দুই চোখে ক্লেশ আর আতঙ্কের ছাপ।

ভিড় ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে ওচুমেলভ জিজ্ঞেস করেন,’ ব্যাপারটা কী? কী লাগিয়েছো তোমরা? আঙুল তুলে রেখেছিস কী জন্যে? চিল্লাচ্ছিল কে? কে চিল্লাচ্ছিস?’

খ্রিউকিন মুঠো করা হাতের ওপর একটু কেশে নিয়ে শুরু করলে, ‘ আমি হুজুর, হেঁটে যাচ্ছিলাম নিজের মনে, কারুর কোনো ক্ষেতি না করে। ওই তো রয়েছে মিত্রি মিত্রিচ — উর ঠেয়ে লকড়ীর দরকার ছিল হুজুর– তা খামকা, হুজুর, এই কুত্তার বাচ্চাটা এসে কামড়ে দিলে একেবারে। বুঝুন হুজুর, মেহনত করে খেতে হয় আমাদের…আমার ব্যবসার কাজটিও তেমন সাদামাটা নয়। হুজুর– এর লেগে ক্ষেতিপুরণ করা করান উদিকে। যা গদিক তাতে আঙুলটি তো আর হপ্তাখানেক লড়াচড়া চলবে না। আইনে তো ইসব নাই হুজুর কি বুনো জানোয়ার-মানোয়ারদের সহ্য করতে হবে আমাদের? সব কিছুই যদি কামড়াতে লেগে যায় তবে জীবনে সুখ কী রইল, আজ্ঞা’?

‘হুম! বটে! গলাখাকরি দিয়ে ভুরু কুঁচকে ওচুমেলভ বললেন কড়া সুরে, ‘ আচ্ছা!.. কার কুকুর এটা? এ আমি সহজে ছাড়ছি না! কুকুরটা ছেড়ে রাখার মজাই দেখিয়ে ছাড়ব! যেসব ভদ্রলোক আইন মেনে চলতে চান না তাদের ওপর মন দেবার সময় এসেছে। শালার ওপর এমন জরিমানা চাপাবো যে শিক্ষা হয়ে যাবে : যতো রাজ্যের গরু ভেড়া কুকুরকে চরতে ছেড়ে দেওয়ার মানে কী!কতো ধানে কতো চাল তা টের পাওয়াচ্ছি!’

কনেস্টবলের দিকে ফিরে ওচুমেলভ হাঁকলেন, ‘এলদীরিন, তল্লাস লাগাও কার কুত্তা, আর একটা এজাহারও লিখে ফেলো। যা মনে হচ্ছে এ কুকুর ক্ষ্যাপা না হয়ে যায় না—ওটাকে সাবাড় করে ফেলা দরকার এখুনি!…কার কুকুর একটা, জবাব দাও, কার কুকুর?’

ভিড় থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘মনে হচ্ছে ওটা জেনারেল ঝিগালভের কুকুর!’

‘জেনারেল ঝিগালভ? হুম… উহ কী গরম! বোধ হয় বৃষ্টি পড়বে। ইনস্পেকটর খ্রিউকিনের দিকে তাকালেন, ‘কিন্তু একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না, তোকে কামড়ালো কী করে? একেবারে হাতের আঙুলে গিয়ে কামড় বসালো, এটা কী রকম? এইটুকু একটা বাচ্চা কুকুর আর তুই বেটা এমন এক মদ্দ জোয়ান? আলবৎ ও আঙুল তুই পেরেক-মেরেকে খুঁচিয়ে এমন মতলব করেছিস ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায় কিনা। তোদের চিনতে আমার বাকি নেই, শয়তানের ঝাড় সবাই!’

‘ও লোকটা হুজুর, তামাসা করে কুকুরটার নাকে সিগারেটের ছেঁকা দিতে গিয়েছিল। কুকুরটা অমনি কামড় লাগিয়েছে। ঐ খ্রিউকিন হুজুর, চিরকালই বদমাইসি করে বেড়ায়।’

‘মিছে কথা বলছিস, ট্যারা চোখো কোথাকার! আমাকে ছেঁকা দিতে দেখেছো? তবে মিছে কথা বলছো কেনে? হুজুরের বুদ্ধি বিবেচনা আছে। উনি নিজেই বুঝতে পারবেন কে মিছে বলছে, কে ধম্মকথা বলছে। মিছে কথা বললে আদালতে বিচার হোক কেনে। আইন হয়ে গেইছে…সব মানুষ এখন সমান বটে। না জানো তো বলি, আমারও এক ভাই পুলিশে আছে…’

‘তর্ক কোরো না, তর্ক কোরো না বলছি!’

‘উঁহু, এটা জেনারেলের কুকুর নয়,’ কনেস্টবল বললে বিচক্ষণের মতো, ‘ অমন কোনো কুকুরই জেনারেলের নয়। ওনার সবকটা কুকুরই শিকারী কুকুর।’

‘ঠিক জানিস?’

‘ঠিক জানি, হুজুর।’

‘ঠিক বটে, আমিও তাই ভাবছিলাম! জেনারেলের কুকুরগুলো সব দামী দামী, উঁচু জাতের কুকুর। আর এটা—তাকাতেই ইচ্ছে করে না, হতকুচ্ছিৎ খেঁকি একটা। অমন কুকুর কেউ পোষে নাকি? তোদের মাথা খারাপ? মস্কো কি পিটার্সবুর্গে ওরকম কুকুর দেখা গেলে কী হত জানো? আইন দেখত না ছাই, পেলেই দফারফা করে ছাড়ত। খ্রিউকিন, তোমাকে কামড়েছে মনে রেখো, সহজে ব্যাপারটা ছাড়া হবে না। শিক্ষা দেওয়া দরকার! সময় হয়েছে…’

কনেস্টবল আপন মনে বলতে শুরু করলে, ‘ তা জেনারেলের কুকুরও হয়ে যেতে পারে শেষ পর্যন্ত। চেহারা দেখে কি কিছু বলা যায়। সেদিন জেনারেলের উঠোনে এমনি একটা কুকুর দেখেছিলাম যেন।’

‘জেনারেলের কুকুরই তো বটে!’ ভিড় থেকে কে একজন বললে।

‘হুঁ!…এলদীরিন কোটটা পরিয়ে দে।দমকা হাওয়া দিল কেমন, শীত করছে…জেনারেলের কাছে এটা নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয়। বলবি, আমি কুকুরটাকে পেয়ে পাঠিয়েছি। বলবি, অমন করে যেন রাস্তায় ছেড়ে না দেন। হয়ত বা দামী কুকুর। শুয়োরগুলো যদি সবাই অমন করে নাকে ছ্যাঁকা দিতে থাকে তবে অমন দামী কুকুরের বারোটা বেজে যেতে কতোক্ষণ? কুকুর হল গিয়ে আদুরে জীব… আর তুই ব্যাটা আহাম্মক, হাত নামা শীগগির! উজবুকের মতো আঙ্গুল দেখাচ্ছিস কাকে? তোরই তো দোষ!…’

ওই তো জেনারেলের বাবুর্চি এসে গেছে। ওকেই জিগ্যেস করা যাক… ওহে, ও ভাই প্রোখর, এসো তো বাপু একটু! দেখতো ভালো করে, কুকরটা কি তোমাদের?’

‘মানে! কস্মিনকালেও অমন কোনো কুকুর আমাদের ছিল না!’

‘বাস, বাস! ব্যাপারটা বোঝা গেল তাহলে।’ ওচেমেলভ বললেন, ‘ বেওয়ারিশ একটা কুকুর। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুলতানি করে আর কী হবে। বলছি বেওয়ারিশ কুকুর, বাস, ওটাকে খতম করে ঝামেলা চুকিয়ে দেওয়া যাক।’

প্রোখর কিন্তু বলে চলল, ‘এটা আমাদের নয়। এই কিছুদিন হল জেনারেলের ভাই এসেছেন, এটা তাঁরই কুকুর। বর্জোই জাতের কুকুর সম্পর্কে আমাদের জেনারেলের কোনোই শখ নেই। কিন্তু ওঁর ভাই–ওঁর পছন্দ হল গিয়ে…’

‘কী বললে, জেনারেলের ভাই? ভ্লামিদিমির ইভানিচ এসেছেন?’ ওচুমেলভ চেঁচিয়ে উঠলেন, তাঁর সারা মুখ ভরে উঠল এক অপার্থিব হাসিতে, ‘কী কাণ্ড। আর আমিনা জানি না! এখন থাকবেন বুঝি?’

‘হ্যাঁ থাকবেন।’

‘কী কাণ্ড। ভাইকে দেখতে এসেছেন। আর আমি খবর পাইনি! কুকুরটা তাহলে ওঁরই? ভারি আনন্দের কথা। নাও হে নাও ওটিকে।। তোফা ছোট্ট কুকুরটি। ওর আঙুলে কামড়ে দিয়েছিল! হাঃ হাঃ হাঃ! তু-তু, আরে কাঁপছিস কেন? বিচ্ছুটা চটেছে… কী তোফা বাচ্চা।’

প্রোখর কুকুরটাকে ডেকে নিয়ে কাঠগোলা থেকে চলে গেল। ভিড়ের লোকগুলো হেসে উঠল খ্রিউকিনের দিকে চেয়ে। ওচুমেলভ হুমকি দিলেন, ‘দাঁড়া না, তোকে আমি দেখাচ্ছি পরে!’ তারপর ওভারকোটটা ভালো করে গায়ে টেনে নিয়ে বাজারের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চললেন।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত