Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

অরণি এক স্পষ্ট কণ্ঠস্বর

Reading Time: 2 minutes

সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার সম্পাদিত পত্রিকা ‘অরণি’। গত শতকের চল্লিশের দশকের এক ব্যতিক্রমী পত্রিকা। শুধু সাহিত্যের পত্রিকা নয়, রাজনীতি ও রাজনৈতিক দশর্নেরও পত্রিকা। বিশেষ কোন দলের নয়, কিন্তু মার্কসবাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ‘অরণি’ নাম কেন? অরণি আসলে সেই কাঠ যার ঘর্ষণে জ্বলে ওঠে আগুন। তবে কি পত্রিকাটির পরিচালকেরা তাঁদের পাঠকের মনে জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আগুন? অসম্ভব নয়   সেটা। পত্রিকা প্রকাশের সাল-তারিখটা লক্ষ্য করলে বোঝা যায়। ‘অরণি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালের ২২ আগস্ট। তার ঠিক দুমাস আগে হিটলার আক্রমণ করেছে সোবিয়েত রাশিয়া। ফ্যাসিবাদের বিভীষিকা প্রবল হয়ে উঠেছে বিশ্বময়। প্রাথমিক বিভ্রান্তি কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেই ফ্যাসিবাদকে ‘ইতিহাসের গলিত নখদন্ত’ বলে সম্বোধন করছেন। বিশ্বের বিবেকবান মানুষ তীব্র ধিক্কার দিচ্ছেন ফ্যাসিবাদকে। ‘অরণি’র পরিচালকেরা তাঁদের স্বদেশবাসীর মনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জ্বালিয়ে দিতে চান ঘৃণা ও ক্রোধের আগুন। কিন্তু শুধু ফ্যাসিবাদ নয়। এদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের যে তাণ্ডব চলেছে তার বিরুদ্ধেও দেশবাসীর মনে ক্রোধের আগুন জ্বলাতে চান তাঁরা।

সংকীর্ণ অর্থে এ পত্রিকা কমিটেড নয়। নয় কোন দলীয় মুখপত্র। কিন্তু বৃহত্তর অর্থে কমিটেড। মানবতার দায় সে পালন করতে চায়। নির্ভেজাল ‘বুদ্ধিজীবী’র মতো ‘রুদ্ধঘরে সঙ্গীহীন’ হয়ে থাকতে চায় না। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ নীতিতে সে বিশ্বাসী নয়। শিল্পী সমাজের মানুষ, সামাজিক জীব। সমাজের কাছে তাই তার দায়বদ্ধতা আছে।

প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে সত্যেন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন জাতীয় জীবনের অভ্যুদয়ই তাঁর আকৈশোর আদর্শের ধ্যান। সেই আদর্শকে রূপ দেবার জন্য ‘ কতিপয় হিতৈষী বন্ধুর অর্থানুকূল্য এবং আমার তরুণ সহকর্মীদের উৎসাহ এ পত্রিকা প্রকাশ করিল’। এইসব সহকর্মীরা হলেন সুকুমার মিত্র, নিখিল সেন, বিনয় ঘোষ, সুশীল জানা, প্রফুল্ল ভট্টাচার্য, সরোজ দত্ত, প্রভাতকুমার গোস্বামী, স্বর্ণকমল ভট্টচার্য। ‘রাজনীতি ও সংস্কৃতিমূলক সাপ্তাহিক’ অরণি ছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা; আর্থিক জগৎ থেকে মুদ্রিত এবং ১২২ বউবাজার স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত। সেটাই পত্রিকার কার্যালয় । বছর তিনেক বাদে ১৯৪৪  সালে কার্যালয় উঠে আসে ৩৭/৭ বেনিয়াটোলা লেনে।

‘অরণি’তে কবিতা লিখেছেন অরুণ মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিমলচন্দ্র ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, গোলাম কুদ্দুস, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রাম বসু, সিদ্ধেশ্বে সেন প্রমুখেরা। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক নেতা হিসাবে যাঁরা পরিচিত হয়েছেন তাঁদের কয়েকটি কবিতা এই পত্রিকায় দেখতে পাই আমরা। যেমন গোপাল হালদার, সরোজ দত্ত, ভূপেশ গুপ্তের কবিতা। সোমেন চন্দের ‘মুহূর্ত’ গল্প প্রকাশিত হয় ‘অরণি’তে, প্রকাশিত হয় সুকান্ত ভট্টাচার্যের ৩টি গল্প, শম্ভু মিত্রের ১টি গল্প, বিজন ভট্টাচার্যের ৩টি গল্প। অন্নদাশংকর রায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, রমেশ চন্দ্র সেন, সমরেশ বসু, সাবিত্রী রায়, সুলেখা সান্যাল, সোমানাথ লাহিড়ী প্রভৃতির গল্পও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বিজন ভট্টাচার্যের সাড়াজাগানো ‘নবান্ন’ নাটক প্রকাশিত হয়েছিল ‘অরণি’তেই। পত্রিকার প্রবন্ধ বিভাগটি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ ল রাজনৈতিক দর্শন, সমকালীন রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে মনোজ্ঞ প্রবন্ধ লিখেছেন গোপাল হালদার, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, বিমানবিহারী মজুমদার, জ্যোতি বসু, মুজফফর আহমদ, বিনয় ঘোষ, নরহরি কবিরাজ, দেবীপদ ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, হীরেন মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, সুকুমার মিত্র, আবদুল হালিম, অচ্যুত গোস্বামী, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, মণিকুন্তলা সেন, নারায়ণ ভট্টাচার্য, শচীন সেনগুপ্ত, সুকান্ত ভট্টাচার্য, পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্য প্রভৃতি।

মৌলিক রচনার পাশাপাশি পত্রিকায় বিশ্বের বিভিন্ন বরেণ্য লেখকদের লেখার অনুবাদ প্রকাশিত হত। যেমন: মোপাসাঁর ‘সেন্ট আ্যন্টনি’, রোমাঁ রোলাঁর ‘কাদের জন্য লিখি’, টি এস এলিয়টের ‘সাহিত্য ও সাংবাদিকতা’, হেনরি বারবুসের ‘জন গ্রেসিয়া’, টম উইট্রিংহ্যামের ‘জনযুদ্ধ’, চেখভের ‘কসাক’, গোর্কির ‘একটি শরৎ’, র‍্যালফ ফক্সের ‘আলাপ’, টমাস মানের ‘সংস্কৃতির শত্রু ফ্যাসিজম’, ডিমিট্রভের ‘লেখক সংঘের প্রতি’ প্রভৃতি।

এই পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত কয়েকটি আকর্যণীয় ফিচার: মহাযুদ্ধের গতি, আন্দোলনের গতি, আমার দেশ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কথাপ্রসঙ্গে, এক সপ্তাহ, বাতায়ন। ছদ্মনামে ফিচারগুলি লিখতেন স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, প্রভাতকুমার গোস্বামী, অরুণ মিত্র, পরিমল চট্টোপাধ্যায়, অনিল কাঞ্জিলাল, অতুল দত্ত, বলাই বসু। কিন্তু পত্রিকার সব রচনার অভিমুখ ছিল মানবতার সাধনা। মানব-অতীত ও মানব-ব্যতীত কোন চিন্তা-ভাবনাকে ‘অরণি’ কখনও প্রশ্রয় দেয় নি।

 

[ ঋণ : দিলীপ মজুমদার সম্পাদিত ‘অরণি : সূচি ও সংকলন’]

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>