| 29 মার্চ 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

চিনে মাটির পুতুল

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

জ্বরের ঘোরে দুর্গা অপুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘সেরে উঠলে আমায় রেল দেখাতে নিয়ে যাবি অপু?’ অপু সে ইচ্ছে আর পূরণ করতে পারেনি।

আসলে আমাদের প্রত্যেকের মাথার মধ্যে একজন করে অপু বাস করে, আর বুকের ভিতর দুর্গা। আমরা চাই চাই করতে করতে একান্নবর্তী ভেঙে ফেলি, একা বাবা মা আর দুই ছেলেমেয়ে। তারপর ধীরে ধীরে তারাও কেমন একা একা হয়ে গিয়ে বাবা মা হয়ে গিয়ে ছেলে মেয়ে মানুষ করতে গিয়ে একা হয়ে পড়ে।

শহরগুলো কেমন ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে, বয়সের ভারে। আত্মীয়হীন, পরিজনহীন একাকী অরণ্যে বয়স কেমন ধীর পায়ে দখল নিয়ে নিচ্ছে অন্ধকারের। কী হবে এই শহরে থেকে? এই মলিন, প্রাক্তন বল্কল ছেড়ে নতুন খোলসে আমরা স্বচ্ছন্দ বোধ করি। উচ্চশিক্ষা, উচ্চ জীবন, উচ্চ জীবিকার খোঁজ করতে করতে যে লাফ মারি অনন্তের উদ্দেশ্যে মাটির শেষ ছোঁয়াটুকু ছেড়ে সেখানেই পড়েছিল আমার শিকড়। চোখ বন্ধ করে গলিখুঁজি ঘুরে ঘুরে যে বাড়িটায় পৌঁছে যেতে পারতাম, এখানেই ছিল আমার শৈশব, কৈশোর। খেলতাম, হাসতাম, কুড়তাম ফুল, আমের বোল, কখনও একা একা হেঁটে হেঁটে যেতাম এই শহরের স্বেদ রক্তের কালিমা মাখতে। সারা শরীরে ভর্তি কাদা, মুখ কিন্তু অনিবর্চনীয় উজ্জ্বল শিকড়ের আনন্দে।

এখানেই আমার মনুষ্য জীবনের আলো যাঁরা দেখিয়েছেন তাঁদের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল। আর আমি ছেড়ে চলে আসি নতুন শিকড়ের উদ্দেশ্যে। পরিচয়, শিকড়ের নাম পালটে পালটে যায়। আর আমি পরিযায়ী হয়ে চলে আসি অন্য আশ্রয়ে বাসা বাধিবার তরে।

ফিরে যাই, এক্কা দোক্কা পৃথিবীতে ফিরে ফিরে যাই। কিন্তু বুড়ি বাঁধা থাকে নতুন আশ্রয়ে। যেখানে আমি পরিচিত নিজনামে নিজগুণে নিজকর্মফলে।

শিকড়ের টানগুলো পদবী ছিঁড়ে ঝুলতে থাকে বিষণ্ণ ঘুলঘুলির আড়াল থেকে। বহুকালের চেনা চেনা হাওয়া অচেনা কায়দায় ফড়ফড় করে ওড়ায় সেই টান। ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। একদিন অসময়ে কেটে পড়ে সে, ভুলে যাওয়া কিছু অংশ তখনও জানলার খড়খড়ি খুলে শুকোয়, ধুলোমলিন সঙ্গীহীন নাড়িছেঁড়া সম্পর্কের ছোঁয়া।

শহরগুলো কেমন একা হয়ে পড়ছে বয়সের ভারে। রোজ রোজ ফোন আসে, ফোন যায়। আহ বিরক্ত কোর না এখন, কাজে আছি, স্বপ্নে আছি, আকাশে ভাসছি আমার নতুন ডানায় ভর করে। সে ডানায় তোমাদের স্থান নেই হে আমার নাড়ির বাঁধন। তাকে ফেলে এসেছি পিতৃপরিচয়ে, মায়ার বাঁধনে মিউজিয়ম হয়ে যাওয়া গলির বাঁকে।

শুধু মুখে মুখে জানি, বলে বেড়াই, চিৎকার করে করে জাহির করে বেড়াই, আমার একটা শিকড় আছে ধূসর দিগন্তের কাছে। সূর্যের ঝলকানিতে খুঁজে পাওয়া যায় না তাকে। লুকিয়ে থাকতে থাকতে খসে পড়ে কখন। তখন নিজেকেও দেখি নিদাঘের সূর্য থেকে ঢলে পড়েছি পশ্চিম পাড়ে। আর যে দুচারতে বিচ্ছুরণ আমায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে, তারাও তখন পাড়ি দিয়েছে আসমানি ফিকিরে।

ধীরে ধীরে আমিও মিশে যাই সেই একা হয়ে যাওয়া শহরের গন্ধে গন্ধে। হয়তো অন্য কোথাও অন্য কোনখানে। কিন্তু এখানেও আঁধার নামে কোনদিন। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে হয়। এভাবেই শহরে শহরে ঘুরে বেড়ায় আমার পরিচয়, পরিবার, পরিচিতি আমার অঙ্গীকার।

আমার এক বন্ধু তার বন্ধুকে অঙ্গীকার করেছিল, বোঁদে খাওয়াবে, বড় বড় ছানার মুড়কির মতো বোঁদে। সে বোঁদে আর তৈরি হয়ে ওঠে না। ঠিক যেভাবে ঠিক সময়ে দাঁড়াতে না পারায় মাটি সরে গেছে পায়ের তলা থেকে। বুড়ো আঙুলের উপর টলটলে চোখের জলে তার ছবি দেখা যায় সামান্য সময়। তারপর আবার অন্য অন্য অন্য কোনখানে। মানুষ অভিযোজন করে এভাবেই। একা একা হয়ে!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত