| 19 মার্চ 2024
Categories
অন্য দেয়াল

সুয়োরাণী এ্যালফাবেট ও দুয়োরাণী বর্ণমালার রূপকথা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

অনেক আগে এক দেশে ছিল এক রাজা। তাঁর ছিল দুই রাণী। প্রথমা স্ত্রী বা দুয়োরাণীর নাম ছিল ‘বর্ণমালা।’ তার শ্যামবর্ণ রঙ আর গভীর কালো দুই চোখ, দীঘল কালো চুল। বর্ণমালাকে সংক্ষেপে ডাকা হত ‘বর্ণ’ বলে। আর দ্বিতীয়া স্ত্রী বা সুয়োরাণী এ্যালফাবেটকে রাজা সংক্ষেপে আদর করে ডাকতেন ‘এ্যালফা’ বলে। সমুদ্রের তীরে ঝড়ে একবার একটি বিদেশী জাহাজ বিধ্বস্ত হবার পর এক অচেতন গোরা, ফিরিঙ্গি মেয়েকে বালুচরে পড়ে থাকতে দেখে রাজা তাকে ভালবেসে ফেলেন। তা’ প্রেমে পড়ে গিয়ে সেই যে রাজা এ্যালফাবেটকেও রাণী করে রাজপ্রাসাদে এনে তুললেন, তারপর থেকে বর্ণমালার সব আদর গেল ঘুচে।
রাজার ঘরে এ্যালফাবেট থাকে সাতমহলা ঘরে। তার সেবায় নিয়োজিত থাকে সাতশ’ দাসী। তার স্বচ্ছ, শ্বেত ত্বকে চন্দন আর গোলাপজল ঘষে দেওয়া, পাটকিলে চুল ধোবার পর ধূপের গন্ধে শুকিয়ে দেওয়া আর তার নিত্য-নতুন গাউনের সেলাই-ইস্ত্রি-নক্সা করায় ব্যস্ত থাকে শ’য়ে শ’য়ে দাসী আর দর্জি। আর এ্যালফাবেট রাজার ঘরে আসার পর থেকে প্রথমা স্ত্রী বর্ণমালার জায়গা হলো সাতমহলা ঘর থেকে দূরে রাজবাড়ির বাগানের শেষে একটি ছোট্ট কুঁড়েয়। বর্ণমালা এখন রাজবাড়ির বাগানের যত গাছের কাঁটা আর ঝোপ-ঝাড় কাটে, রাজবাড়ির মেঝে মোছে, রান্না করে- এককথায় যাবতীয় দাসীবৃত্তি করে। তাঁর ঘরে রাজার প্রথম সন্তান বা কিশোর যুবরাজ ‘চর্যাপদ’ মায়ের মতই শ্যামবর্ণ। সে লেখে বর্ণমালায় আর কথা বলে বাংলা ভাষায়। তাকে তাই কেউ রাজপুত্র বলে মনেই করে না। আর এ্যালফাবেটের ঘরে রাজার দ্বিতীয় পুত্র ‘সনেট’ মা-বাবার মিশ্র বা দোআঁশলা রং, পাটকিল চুল আর চোখের জন্য আর ফিরিঙ্গি মা’র কাছ থেকে শেখা বিদেশী ভাষার জন্য সবার খুব প্রিয়। সবাই মনে করে সে-ই প্রকৃত রাজপুত্র! অবশ্য সনেট রাজ্যের কাউকেই, তার মায়ের মতই, মানুষ বলে মনে করে না। এদেশের সব কিছু খুব খারাপ। সবকিছু ভারি বাজে। সবই নোংরা, ময়লা আর জঞ্জাল! কালো বাবাকেও মাঝে মাঝে তার অসহ্য লাগে। তবু তার বাবা তাকে এবং তার মা’কে নিত্য তোয়াজ করে চলেন। আর চর্যাপদ যত বড় হয়ে উঠছে, ততই দেশের মানুষের সব কাজে, বিপদে-আপদে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজের খাবার যেটুকু দিনের শেষে মেলে, সেটাও সে সবার সাথে ভাগ করে খায়। তাই বলে কেউ তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না।

তবে বছরে একটা মাস অবশ্য বর্ণমালা আর তার ছেলে চর্যাপদকে রাজার বনের পাশের কুঁড়ে থেকে নিজের ঘরে আনতেই হয়। কারণ ঐ মাসেই বর্ণমালার বাবা এবং চর্যাপদের মাতামহ সিদ্ধাচার্য ভুসুকু পা রাজাকে এই গোটা রাজত্ব দান করে চলে গেছিলেন দূর তিব্বত দেশে। বর্ণমালার চার ভাই বিদেশীদের সাথে এক প্রবল যুদ্ধে মারা গেছিল। সিদ্ধাচার্য তাঁর প্রিয় সেনাপতিকে মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে আর রাজত্ব দান করে সন্ন্যাস নিয়ে চলে যান। সংসারে তাঁর আর মন বসছিল না। স্ত্রী বহু আগেই বিগত। সত্যি বলতে এই দেশ বা রাজ্যটি প্রথমা স্ত্রী বা দুয়োরাণী বর্ণমালারই দেশ। কিন্ত বর্ণমালার পৈতৃক এ রাজ্যে রাজপ্রাসাদ, কাছাড়িবাড়ি, কোষাগার বা খাজাঞ্চিখানা থেকে কোথাও কেউ বর্ণমালায় কিছু লিখতে বা বলতে পারে না। ফিরিঙ্গি এ্যালফাবেটের ভাষায় তাদের লিখতে বা কথা বলতে হয়। এ্যালফাবেট লিখতে বা পড়তে না পারলে কেউ কাজ পায় না। কিম্বা কাজ পেলেও খুব কম টাকার কাজ পায় যাতে জীবন চলে না। তবে কিনা ঐ এক মাস! পুরণো সময়ের কথা মনে করে রাজা ঐ একটি মাস সাতমহলা ঘরের একটি কক্ষে তখন দুয়োরাণী আর তার ছেলে চর্যাপদকে থাকতে দেন। শ্বশুর সিদ্ধাচার্যের রাজত্বদানের কথা স্মরণ করা হয়। এক মাস সবাই রাজপ্রাসাদেও বর্ণমালায় কথা বলে বা লেখে। ঐ একমাস বর্ণমালাকেও ভাল শাড়ি আর গয়না দেয়া হয়। মাস ফুরোতেই আবার সব ভাল শাড়ি আর গয়না রেখে, ছেঁড়া শাড়ি পরে আর গোবরের বালতি হাতে বর্ণমালাকে চলে যেতে হয় কুটিরে তার কিশোর ছেলে চর্যাপদের হাত ধরে। একমাস একটু চুপচাপ থাকে এ্যালফা আর তার ছেলে সনেট। মাস ফুরোতেই আবার তারা তাদের ফিরিঙ্গি ভাষার কলহাস্যে কেক-পেস্ট্রি টেবিলে সাজিয়ে খেতে শুরু করে। রন্ধনশালা থেকে ফেলে দেয় পৌষ পার্বণের সব পিঠের ছাঁচ। তারপর আবার যেমন চলছিল তেমন চলতে থাকে।

আজ সেই মাসের শেষ দিন। কাল আমাদের দুয়োরাণী বর্ণমালা আবার তার কুটিরে ফিরে যাবেন আমাদের বড় রাজপুত্র চর্যাপদকে নিয়ে। যে সুয়োরাণী এ্যালফাবেট আর তার ছেলে সনেট আমাদের সবসময় ধমকের উপর রাখে আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, আমরা তাদের বন্দনায় আবার মেতে উঠবো। যদিও এই রাজ্য, এই রাষ্ট্র ঐ ঘুঁটেকুড়–নী বর্ণমালারই দান।

 

(শৈশবে পাঠ্যপুস্তকে পড়া অবনীন্দ্রনাথের ‘সুয়োরাণী ও দুয়োরাণী’র একটি নতুন নির্মাণ করার চেষ্টা করলাম। গল্পটি খুঁজছিলাম। পেলাম না। যাক- পড়ার স্মৃতির উপরই নতুন করে সাজালাম।)

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত