বনলতা
দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল।
নিঃশব্দে খুলবে মনে করেছিল হরিদাস। কিন্তু শব্দ হল। অন্ধকার রাত্রে হঠাৎ একবার গর্ভিণী মাজারীর চাপা অথচ তীব্র গোঙানির মতো। অনেক চেনা আর শোনা শব্দ। তবু একবার দাঁত খিচোল হরিদাস। রেগে নয়, অপ্রস্তুত হয়ে। তারপর মুখটা বাড়িয়ে দিল ঘরে। যেন অতর্কিতে। আক্রমণের পূর্বে সতর্ক আততায়ী এসেছে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে। তার পোকা খাওয়া চোখের পাতা আর রক্তাভ ছোট ছোট চোখ মেলে দেখে নিল ঘরের প্রত্যেকটি জিনিস। এবড়ো খেবড়ো মেঝে আর পলেস্তারা খসা দেয়াল। এখানে সেখানে কয়েকটা হাড়ল গর্ত। ঘরটার উদ্দীপ্ত চোখে চেয়ে থাকা তারার মতো গর্তগুলি কালো। সারাটা ঘর স্যাঁতসেতে, ভেজা ভেজা, নোনা নোনা গন্ধ। মেঝেটা একদিকে বেশি ঢালু। যেন গড়িয়ে পড়ে ঠেকে আছে। একটা দড়িতে শস্তা আর রঙিন কয়েকটা শাড়ি; সায়া আর ব্লাউজ। সব এলোমেলো অবিন্যস্ত। একটা নড়বড়ে টেবিলের উপর ছড়ানো অল্পদামি প্রসাধন সামগ্রী। স্নো, পাউডার, কাজলদানি, সাবান। আরও খুঁটিনাটি, নানা রকম। মেঝের উপর লুটিয়ে আছে একটা শাড়ি। টেবিলের পাশে, তক্তার ওপরে হারমোনিয়ম। তার উপরে গোলাপি সায়া ঢাকা ডুগিতবলা। দুই ছড়া ঘুঙুর, একটা মাটিতে, আর একটা তবলার উপরে। ঘরের মাঝখানে, মেঝেয় একটা বই। লেখা রয়েছে নাটক, ছত্রপতি শিবাজি। মলাটে শিবাজির ছবি।
সবটা মিলিয়ে কেমন যেন বেহায়া, উচ্ছৃঙ্খল কিন্তু করুণ। তারপর ঘুরে ফিরে এক কোণে কেন্নোর মতো ষাট পায়ে হরিদাসের দৃষ্টি এগিয়ে গেল, আধো আলো, আধো অন্ধকার ঝাপসা কোণটা। দুপুরেও ওই রকম থাকে। ওইখানে বিছানা, ঢালুতে ঢলে পড়েছে। শুয়ে আছে তিনজন জড়াজড়ি করে। গায়ে গায়ে গুটিশুটি হয়ে। তিনটি রং মাখা মুখ। খানে খানে রং উঠে গেছে। ঠোঁটের রং গালে লেগেছে। কাজলের কালি লেপে গেছে চোখের কোলে। একজনের বেণী আর একজনের কাঁধে পেঁচিয়ে ধরেছে সাপের মতো। কারও শিথিল খোঁপা কারও বুকের তলায় পড়েছে চাপা। অসাড়ে ঘুমুচ্ছে তিনজন। বিস্রস্ত, অবিন্যস্ত। এত অগোছাল যে চোখে লাগে। হাঁটু দেখা যাচ্ছে। নির্লজ্জ বলা যেত। কিন্তু তিনজনই মেয়ে। লজ্জার অবকাশ নেই। সব মিলিয়ে বিছানাটাও বেহায়া। রাতভর মাতামাতির উকট বেহায়াপনা, চটকানো বাসিফুলের মতো ছড়ানো। নিষ্ঠুর উচ্ছৃঙ্খলতা আর অসহায় করুণ, গলা থেকে ফেলে দেওয়া উৎসব শেষের তিনটি মালার মতো। কিংবা ভাঙা খেলাঘরের অগোছাল তিনটি রং ওঠা পুতুলের মতো।
হরিদাস যেন গুনে গুনে দেখল, এক, দুই তিন। টায়টিকে গোনগাঁথা, এদিক ওদিক হবার উপায় নেই। এক, দুই, তিন, পায়ে পায়ে হরিদাস এসে দাঁড়াল ঘরের মাঝখানে। খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা গোঁপদাড়ি। কাঁচাপাকা লম্বা লম্বা চুল। যাত্রার দলের অধিকারীর মতো। গোদা গোদা হাত পা, মোটা মানুষ। বুক ভোলা আধময়লা শার্ট। যেমন তেমন করে কোঁচা দেওয়া এলোমেলো কাপড়। বয়স হয়েছে প্রায় পঞ্চান্ন, কিন্তু বেশ শক্ত সমর্থ মনে হয় এখনও। এই বেলা নটাতেই তার পুরু ফাটা ঠোঁট পানের পিকে প্রায় কালো হয়ে উঠেছে। চোখের পাতা প্রায় নেই-ই। সব জড়িয়ে রাতজাগা নেশাখোরের মতো চেহারা হরিদাসের। তার ওপর রক্তাভ চোখের চাউনি সব সময় অনুসন্ধিৎসু, সন্ধিগ্ধ। নাকের পাটা ফুলিয়ে যেন অষ্টপ্রহর জীবন্ত বিষের গন্ধ শুকে বেড়াচ্ছে।
হরিদাস হাসল কিনা, বোঝা গেল না। চাপা খুশির আভাস দেখা গেল তার গালের ভাঁজে। মেঝেয় লুটানো শাড়িটা তুলে ছুড়ে দিল দড়িতে। পশ্চিমদিকের জানালাটা খুলে দিল সশব্দে। দিয়ে ফিরে তাকাল বিছানার দিকে। কোনও সাড়াশব্দ নেই। দক্ষিণের জানালাটা তেমনি করে দিল খুলে। শার্সিগুলি নেড়ে দিল ঘটাং ঘটাং করে। ঘুম ভাঙল না তিনজনের।
দক্ষিণের জানালার ধারে বারান্দা। তার নীচে উঠোন। সেখানে হাট বাজারের গণ্ডগোল। চারদিকে স্বামী পুত্রের হুঙ্কার, ছেলে বউয়ের কান্না। খুন্তি বেড়ি হাতার ঠনঠন, ঝনঝন।
বাড়িটা ছিল এককালে রাজবাড়ি। এক রাজার বাড়ি। এখন বাইশ রাজার রাজ্য। চৌত্রিশ ঘরে বাইশ ভাড়াটের আস্তানা।
তার মধ্যে এক রাজা হরিদাস। হরিদাস মুখুটি। দোতলায় পশ্চিমের প্রান্ত ঘেঁষে তার সীমানা। জায়গা একটু বেশি পেয়েছে কেননা এইদিকটা নড়বড়ে, ভাঙাচোরা। সারা বাড়িটা টাল খেয়েছে পশ্চিমে। চাপা পড়লে, এরা সবার আগে পড়বে। সেইজন্য ভাড়াও কম। সাড়া শব্দও কম এদিকটায়। লোক কম আছে বলে নয়। গুটি ছয়েক ছোট মাঝারি ছেলে মেয়ে আছে আরও। আছে হরিদাসের স্ত্রী স্নেহলতা। হরিদাসের কড়া শাসনে সবাই জুজুবুড়ি। পা টিপে টিপে চলে। ছয় ছেলেমেয়ের খেলাঘরে ভূতুড়ে বাড়ির ফিসফিসানি। ইশারায় চোখে চোখে কথা। শব্দ হলেই সর্বনাশ। তৎক্ষণাৎ সেখানে হরিদাসের দাঁত খিচোনো ভয়ঙ্কর মূর্তি আর উদ্যত থাবা। ছিঁড়ে ফেলবে যেন।
কড়াকড়ির বাড়াবাড়ি ততক্ষণ, যতক্ষণ ঘুম না ভাঙে এ ঘরের। এ ঘর, লোকে বলে, রাজা হরিদাসের রংমহল। ঘুম ভাঙলে শাসন একটু শিথিল হয়।
কিন্তু ঘুম ভাঙছে না। পশ্চিমে হেলেপড়া বারান্দা। ভাঙা তার রেলিং। তার ওপারে ঘন বন। বন শিউলির অরণ্য। মাঝে মাঝে বেঁটে ঝাড়ালো রাংচিতের বিস্তার। সেখানে পাতার বুকে রোদ। সওয়ার হয়ে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে, হুটোপুটি খেলছে। আবার হারিয়ে যাচ্ছে। ছায়া পড়ছে। শরতের সবুজ কালো হয়ে উঠছে। আরও পশ্চিমে টালিখোলা ছাওয়া পাড়ার মাথা। তারও পশ্চিমে ধোয়া মাজা ঝকঝকে নীল আকাশ। অনেক দূরের একখানি হাসকুটে উজ্জ্বল মুখের মতো। সব মিলিয়ে বোঝা যায়, বেলা তার লাগাম ছেড়ে দিয়েছে। অসহ্য, অস্থির হয়ে উঠল হরিদাস। মেঝে থেকে তুলে ঘুঙুরের ঝুঁটি ধরে নেড়ে দিল। নড়েচড়ে উঠল বিছানাটা। ঘুমন্ত আড়মোড়া ভাঙল দু একজন। ঘুম ভাঙল না। দুম করে হরিদাস ডুগিটার ওপর ছুড়ে দিল ঘুঙুরের গোছা আর তবলার উপর একচাঁটি। দিয়ে ও মুখ ফিরিয়ে আড়চোখে বিছানার দিকে তাকিয়ে রইল লাল ভ্যাবভ্যাবা চোখে।
চমকে উঠে বসেছে একজন। তার কাজল লেপে যাওয়া ঘুমন্ত চকিত চোখ। আর একজন উঠতে গিয়ে আধশোয়া হয়ে জোর করে তাকিয়েছে মাতালের মতো। তৃতীয় শুয়ে শুয়েই চোখ পিটপিট করছে। কয়েক মুহূর্ত। আবার ঢলে পড়ার উপক্রম করল তিনজনেই।
হা হা করে উঠল হরিদাস, না, না, না আর না। অনেক বেজেছে। দশটা, এগারোটা, বারোটা…দশটা, এগারোটা, বারোটা? তিনজনেই আড়ষ্ট হয়ে রইল তেমনি। হরিদাস আঙুল নেড়ে নেড়ে চাপা মোটা গলায় বলতে লাগল, গেটআপ, গেটআপ, গেটআপ। ঠাট্টা নয়, হাসি নয়, হরিদাসের সোহাগ কণ্ঠের ওইটি হুকুম। তবু পারুল বোধ হয় সর্বকনিষ্ঠ, বড় করুণভাবে আধবোজা। চোখে বলল, প্রায় ভোর চারটেয় শুয়েছি, আর পনেরো মিনিট…
আরে বাপরে বাপ! প্রায় আদরের চমকানিতে লাফিয়ে উঠল হরিদাস, হলধর এল বলে। রামাকানায়েরও দেরি নেই। পাবলিক নিয়ে কারবার। সব টিপটাপ তৈরি হয়ে নিতে হবে। সময় নেই, সময় নেই। পনেরো মিনিট নয়, এক মিনিট নয়…। প্রায় সুর করে বলতে বলতে চিৎকার করে উঠল, একটুও নয়। তেমনি গলায় দরজার দিকে ফিরে বলল, বড় বউ–চা, তাড়াতাড়ি। বীণা বিছানা তুলে দিয়ে যা, ঘর ঝাঁট দে..
ঘরটা যেন এতক্ষণ ঘুমের টুলুনিতে ঢালু হয়েছিল হঠাৎ সোজা হয়ে গেল।
হরিদাস একাই একশো। অন্ধকার এ ঘর ছেড়ে যাবার নয়। কিন্তু ঘুমের চিহ্নমাত্র নেই আর এ ঘরে। উঠতে উঠতে একেবারে দাঁড়িয়ে পড়েছে তিন জন। তিন জন, বেলা, জুঁই, পারুল। বেলা আর জুঁই হরিদাসের মেয়ে। বাপ মা হারা মেয়ে পারুল। বেলা, জুঁইয়ের মাসতুতো বোন। হরিদাসের মৃতা শালির কন্যা।
রং-মাখা মুখে তাদের রূপ ধরা কঠিন। তবু বোঝা যায়। বেলা ফরসা দোহারা, একটু খাটো। আলুথালু খোলা চুল ছড়িয়ে পড়েছে কোমর ভরে! পারুল অন্য ঝাড়ের। তবু মিল আছে বেলার সঙ্গেই। কম বয়সের ছাপ রয়েছে চোখে মুখে গায়ে। তার খোঁপা ভেঙে পড়েছে ঘাড়ের কাছে। জুঁইশ্যামাঙ্গিনী। একটু লম্বা, একহারা। তার দু পাশে দুই শিথিল বেণী। কেউ চোখে মুখে, হাতে। পায়ে ঠিক রূপসী নয়। একটি আটপৌরে মেয়েলি চটকে তারা হঠাৎ যেন অনেকখানি সুন্দরী হয়ে উঠেছে। শাণিত দীপ্তি নেই রূপে, হঠাৎ খানিকটা ভাললাগা, চোখ সওয়া বেলা যাওয়া মিঠে রোদের। মতো আলো ছড়ায়। দ্যুতি নেই, জ্যোতি আছে। একটি অনাড়ম্বর প্রাণের সুরের মতো। ভার লেগেছে বয়সের। ধারটুকুনি জীবন্ত, উঁকি দিয়ে আছে এখনও। বাইশ চব্বিশ ছাব্বিশ হতে পারে। হতে পারে ছাব্বিশ আঠাশ তিরিশের যৌবন। কিন্তু জল না পাওয়া চারা গাছের মতো ঠেকে আছে যেন আঠারোতে। মরে বেঁচে আছে অষ্টাদশীর ঝিলিকটুকু।
কারওর আঁচল লুটোচ্ছে। কাঁধ থেকে খসে পড়েছে জামা। অসমান বুক। রং ওঠা ওঠা তিনটি পুতুল। আঁকা ভ্রূ তুলে, কাজল কালো চোখে, চোরা দৃষ্টিতে তিন জনে দেখল হরিদাসকে। তারপরে পরস্পরকে। তারপরে সশব্দ দীর্ঘনিশ্বাসের কোরাস।
সারা রাত্রির গ্লানি সারা গায়ে। ঘুম জড়ানো চোখে, টলে টলে দড়ির কাছে গিয়ে, তিনজনের ছটি হাত টান দিল শাড়িতে। শাড়ি টানতে ব্লাউজ, ব্লাউজ পাড়তে সায়া। যা পেল, তা-ই নিয়ে। গায়ে গায়ে হেলান দিয়ে বেরিয়ে গেল তিনজনে।
সেইদিকে একবার দেখে চকিতে ফিরে তাকাল হরিদাস। কুটিল ভ্রুকুটি সন্দিগ্ধ দৃষ্টি বুলাল চারদিকে। অতবড় চেহারাটা নিয়ে দ্রুত নিঃশব্দে গেল টেবিলের কাছে।
সায়া উঠিয়ে দেখল বাঁয়া তবলা। ঢাকনা খুলে দেখল হারমোনিয়মের রিড। ভয়ে ভয়ে সন্দেহে কী যেন খুঁজছে। খোঁজে রোজ সকালে বিকালে সন্ধ্যায়। বড় বড় চকিত উদ্দীপ্ত চোখে, ইঁদুরের মতো আনাচে কানাচে।
এ যেন রূপকথার রাক্ষসপুরী। দৈত্য তার হরিদাস। তিন মেয়ে, বন্দিনী তিন রাজকন্যা। রাক্ষসপুরীর গচ্ছিত সোনা, জীবন ও যৌবন। ওরা জানে হরিদাসের মরণ ভোমরার সংবাদ। হরিদাস খোঁজে ওদের অদৃশ্য রাজপুত্রের অন্ধিসন্ধি; যে ওদের নিয়ে উধাও হবে, ভোমরার প্রাণ টিপে মারবে হরিদাসকে। তা হতে দেবে না হরিদাস। প্রাণ থাকতে নয়। ওরা-ই হরিদাসের জীবন সংসার-সুখ-আনন্দ। খোঁজে আর ফিসফিস করে বলে, কিছু নেই, কিছু নেই। খুশিতে নিঃশব্দ উল্লম্ফনে ঝাঁপ দেয় বিছানায়। বিছানার ওয়াড়, বালিশের তলা সব খোঁজে। চুলের কাঁটা, ফিতে, টুকিটাকি জিনিস। হঠাৎ এক টুকরো কাগজ।
ধক করে ওঠে বুক। ফেটে বেরোয় চোখ। বিন্দুবিন্দু করে ঘামে সারা মুখ। ফিসফিস করে পড়ে রুদ্ধনিশ্বাসে, প্রেয়সী, নিশিদিন সতর্ক চোখ ঘিরে থাকে তোমাকে। আমি ফিরি ছায়ার মতো। অসহ্য! মনে হয়, তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসি সহস্র চোখের সামনে। হৃদয়ের এ বিরহ যাতনা…
চাপা মোটা স্বরে আতঙ্কে আর্তনাদ ওঠে হরিদাসের গলায়। পর মুহূর্তেই হেসে ওঠে গোঙা সুরে। নিশাচর রক্ত চোখে বহে খুশির বন্যা। পার্ট! থিয়েটারের পার্ট, নায়িকার প্রতি নায়কের আকুতি। গতকাল রাত্রে যে নাটক করে এসেছে। বেলার প্রেমপত্র নয়, জুঁইকে ছিনিয়ে নেবার চিঠি নয়, পারুলকে আলিঙ্গনের ডাক দেয়নি কেউ। শুধু পার্ট! চাপা নিশ্বাসের শব্দে চমকে ফিরে তাকায় হরিদাস। বিষাদ মূর্তি স্নেহলতা। হরিদাসের বউ। হাতে চায়ের কেতলি আর গেলাস। বেলার মতো দোহারা, তার মতো ফরসা। আটচল্লিশে বাঁধুনি ঢালাঢিলা, মাথার চুল রূপালি। যেন রূপালি দুই বালুচরের মাঝখানে শ্রাবণের লাল জলের মতো চওড়া সিঁথিতে লেপা সিঁদুর।
তার দিকে ফিরে খুশির আবেগে বলে উঠল হরিদাস, পার্ট।
পরমুহূর্তেই তার গালের ভাঁজগুলি কড়া হয়ে উঠল। শক্ত হয়ে উঠল চোয়াল। কঠিন অপলক হল রক্তাভ চোখ। আর আরক্ত ছলছল চোখে, কেতলি গেলাস টেবিলে রেখে ঘর ঝাঁট দিতে লাগল স্নেহলতা।
স্বামী-স্ত্রীর এমনি ভাব চলে আসছে আজ ছবছর। যবে থেকে দেশ ছেড়ে এসেছে, দেশ ভাগাভাগির পর। ধলেশ্বরীর ওপারের শ্রীনগর ছেড়ে আসার পর থেকে শুধু এমনি চাওয়া। এমনি চোখ ছলছল করা। আর একদিকে পাথুরে কাঠিন্য, প্রস্তরবৎ চাউনি, অবিচল ও নিষ্ঠুর। তবু মুখ তোলে স্নেহলতা। বলে, আর কতদিন?
হরিদাস বলে, যতদিন চলে।
ব্যাকুল গলা কেঁপে ওঠে স্নেহলতার, ওরা যে মেয়ে! তোমার ছেলে নয়।
জানি।
তবে আর কতদিন? ওদের যে মেয়ের বয়স পার হয়ে গেল। মা হওয়ার বয়সে এসে ঠেকে আছে খালি কলসির মতো। চেয়ে দেখো না, হাতে পায়ে কোমরের গোছে। জন্মো-বিধবার মতো লক্ষ্মীছাড়ি গলার কাঁটা করে রেখেছ। মনেও কি পড়ে না, ওই বয়সে মুখুটি বাড়ির বড় বউকে?
চুপ! চু-প। চাপা মোটা গলায় ধমকে ওঠে হরিদাস। যেন কোনও অবৈধ কথা উচ্চারণ করেছে স্নেহলতা। যে কথা নির্বাসিত হয়েছে বহু দিন হরিদাসের বদ্ধপুরী থেকে। খোঁচাখাওয়া জানোয়ারের মতো চোখ দুটো তার আরও গর্তে ঢোকে, জ্বলে অঙ্গারের মতো ধকধক করে। বিশালবপু, মূর্তি তার ভয়ঙ্কর দেখায়। শির ফোলা গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, জানি জানি। তারপর? এই রাজবাড়ির ভাড়া, তোমার চুলোর আগুন, হাঁড়ির পিণ্ড, আরও ছটি ছেলেমেয়ে, তুমি, আমি, আমরা কী করব? আমাদের দিন, রাত্রি, গতর, পেট–
বলতেও ভয়। আতঙ্কে যেন কাঁপে হরিদাসের পুরুষগলা।
স্নেহলতা বলে, তার জন্য বলি হবে ওরা?
কীসের বলি?
ওদের প্রাণ, মন, দুঃখ। ওদের মেয়ে প্রাণ। তুমি বাপ, মেসোমশায় হয়ে পারো না রক্ষা করতে। ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ…
থাক। ঢের শুনেছি, অনেক হয়েছে। হরিদাসের তিক্ত তীব্র স্বর চাবুক মারে স্নেহলতার মুখে। যুক্তিহীন আক্রোশে ফুলে যেন উদ্যত হয় হিংস্র আঘাতের জন্য। থমিয়ে গিয়ে স্নেহলতা ঝুঁকে পড়ে কাজে।
সরে আসে হরিদাস। আবার খোঁজে। কোথায় না জানি আছে কোন অন্ধিসন্ধি। দৈত্যপুরীতে শত্রু স্বয়ং দৈত্যপত্নী। বিশ্বাস কী! কখন সর্বনাশ আঘাত করবে বজ্রের মতো। দিবানিশি পাতার। শিরে শিরে পোকার মতো ফিরছে সে মেয়েদের পিছনে পিছনে। কাছ ছাড়া করে না কখনও।
যত ভাবে, তত আরও অসহায় ক্রোধে জ্বলে হরিদাস। অসহায় ক্রোধ শুধু নয়, যেন ধুকধুকু স্পন্দন যাবে বন্ধ হয়ে হৃৎপিণ্ডের। মনেও কি পড়ে না সেই দিন! ছবছর আগের দিন! ভাগাভাগি হল দেশ। শ্রীনগরের মুখুটি বাড়ির বড় শরিক পালিয়ে এল দেশ ছেড়ে। সেখানে দুধে ভাতে ছিল না। ছিল মোটা ভাত কাপড়ে। বিলে ছিল শাপলা, কলমি, জঙ্গলে ছিল কচু। বুক দিয়ে হিঁচড়েও চলা যেত। বুদ্ধির দৌড়েও ভাগচাষির কাছে জেতা যেত দু কাঠার লাল চাল।
আর এখানে! এত কঠিন, বুক হিঁচড়েও চলা যায় না। ফেটে ফেটে রক্ত বেরোয়। প্রাণ যায়। একটা বছর পাগলের মতো ঘুরেছে হরিদাস। অফিসে আদালতে, স্যাকরা আর মুদি দোকানে। হিসাব লেখক হয়েও যদি ঢোকা যায় কোথাও। আর দিনে দিনে ভেঙেছে পুঁজি। হায়রে পুঁজি, তাঁবার তারে লেপা সোনা। চামড়ার ঘসটানিতে শুধু ক্ষার। ফুটো পয়সা নিয়ে ছেলেমানুষ হামলা করে খাবারের দোকানে। দোকানি হাসে নির্বিকার। সংসারে বুড়ো মানুষের সেই পুঁজি যে শুধু অপমান।
সেই সময়, বৈশাখের ক্ষুধার দাহ নিয়ে ফিরতি পথে দেখা দিল পাড়ার বখাটে ছেলেটা। দলবখাটের শিরোমণি। আড্ডা দেয় রকে বসে। একে তাকে কাটে টিপ্পনি। গান গায়, কখনও বিশ্বজয়ী গাণ্ডীবের মতো চ্যালেঞ্জ করে ভীষ্ম কর্ণকে। কখনও ষড়যন্ত্রী কণ্ঠে হাসে শকুনি হয়ে কিংবা অট্টহাস্যে পাড়া কাঁপায় কেদার রায়ের গোলন্দাজ কার্ভালোর বীরত্বে।
হরিদাস ভাবত, এই রকবাজগুলির হতভাগ্য বাপেদের কথা। মেয়ের চেয়েও গলার কাঁটা, এই জন্মবেকারগুলিকে গিলতে দেয় কে? তারই নেতা, নাম শিবনাথ। ডাকে সবাই শিবে নয়তো শিবু। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কথা বলে নাটুকে ঢঙে। কিন্তু বোকা বোকা চাউনি ও হাসি।
হরিদাসকে ডাকল, এই যে কাকাবাবু।
কাকাবাবু? ফিরে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত হা হয়ে গেল হরিদাস। একে ক্ষুধার দাহ। তার উপর বিরক্তি ও বিস্ময়। কথা বলতে পারেনি। একেবারে কাকাবাবু। যেন কতকালের!
শিবু বলল, আপনার মেয়ে গান করতে পারে। আমাদের ক্লাবের ফাংশানে যদি গাইতে দেন, এই পাড়াতেই…।
হাত কচলে কচলে হাসিতে একেবারে বিগলিত। কিন্তু গান গাইতে পারে? কে, কোন মেয়েটা? ও হ্যাঁ, জুঁই, জুঁইটা দিনরাত্রিই গুনগুন করে। সে খবরও জানে এরা? হুঁ পাড়ার নাড়ি-নক্ষত্র না জানলে অতক্ষণ রকে কাটে কী করে। খেঁকিয়ে উঠতে গিয়ে থমকে গেল হরিদাস। থাক, চটানো ঠিক হবে না। জানা শোনা হওয়া ভাল। সম্মান! হিন্দুস্থান, কলকাতায় ও মফস্বলে আজকে কে কার সম্মান দেখছে খতিয়ে। রাজবাড়ির একুশ ভাড়াটের সংবাদ তো আর অজানা নেই। মত দিয়ে ফেলল সে।
সেই শুরু। জুঁই একলা নয়। পারুলও একটু-আধটু গাইতে পারে। চেষ্টা করলে নাকি নাচতেও পারে। বেলার আবৃত্তির দিকে ঝোঁক আছে। জানত না শুধু হরিদাস। স্নেহলতার ঘোরতর আপত্তি। কে শোনে। যা তা হলেই হল। হরিদাস সঙ্গে নেই? হরিদাসকেও ডেকে নেয়, নিমন্ত্রণ করে। খাওয়ায় এটা সেটা। খাতির করে। বিরক্তও যে না হয় হরিদাস, তা নয়। ভয় পায়। কিন্তু খাওয়াটা! ওটা নেশার মতো ধরে যাচ্ছে।
আর ওই তিনজুটির তো কথাই নেই। হঠাৎ যেন মাঝে মাঝে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। অগণিত ভক্ত ঘুরঘুর করে কাছে কাছে। মন ভোলাবার সব পেখম খোলা গোলা পায়রার দল। তিন বোন হাসে খিলখিল করে।
প্রথম প্রথম একটু আধটু গান, আবৃত্তি। তারপরে আর একটু, ছোট খাটো পার্ট। আস্তে আস্তে আড় ভেঙে যায় লজ্জার। একদিকে ধিক্কার দুর্নাম, আর একদিকে প্রচুর নাম। পাড়ার, বে-পাড়ার ছেলেদের প্রচুর ভিড়। হাফপ্যান্ট থেকে গোঁফ কামানো, সকলের বেলাদি, জুঁইদি, পারুলদি আর কাকাবাবু।
হঠাৎ শিবু একদিন বলল, কাকাবাবু এমনিতে আর নয়।
হরিদাস বলল, কী ভাবে?
শিবু মাথা ঝেঁকে বলল, পয়সা চাই। টাকা দিতে হবে। ও সব ফোকটে আর হবে না, বুঝলেন। স্টেজ ভাড়া করতে তিনশো টাকা দেবে, আর পার্টের জন্য টাকা দেবে না? তাও আবার মেয়েমানুষ।
মেয়েমানুষ শব্দটা এমনভাবে বলল যে নিজেই একটু থতিয়ে গেল শিবু। কিন্তু মানিয়ে নিল ঠোঁট বাঁকিয়ে। বলল, আমার বাবা ওসব নেই। ভদ্দরলোক তো কী! কাজ করে টাকা নেওয়া যায়, নাটক করে টাকা নেওয়া যায় না? আরে আমি যে শিবে গাঙ্গুলি, রাতপিছু পাঁচটাকা না দিলে শিবে গঙ্গোর অর্জুন, কার্ভালো আর শকুনি দেখতে হবে না। শিশির ভাদুড়ি না হতে পারি, শিবে গঙ্গো তো।
টাকা! টাকা? একেবারে সোজা হৃৎপিণ্ডে এসে বিঁধল কথাটা। একে বলে মরমে পশিল গো! সেই হল পাকাপাকি বন্দোবস্ত। বাতাসে বাতাসে গেল সংবাদ। কাছে কাছে, দূরে দূরে, দূরান্তরের ক্লাব আর অ্যামেচার দলগুলি ছুটে এল মেয়ে অভিনেত্রীর জন্য।
প্রথম প্রথম বাহন শিবু। দরাদরির ভার শিবুর। ভদ্রলোকের মেয়ে, সেটুকু স্মরণ করিয়ে দেবার ভারও তার। খবরদার! বে-ইজ্জত না হয়।
কী বিচিত্র নগদ মূল্য! হরিদাসের লুব্ধ চোখ হল সতর্ক। মূলধন তিনটি, তিনটি মেয়ে। ওখানে না হাত পড়ে কারওর। টাকা, সত্যি টাকা! অনায়াস-লভ্য। অভাবের দুর্গদ্বারে ধরেছে ফাটল। বিচিত্রবেশিনী লক্ষ্মী দিয়েছে দেখা। মেয়েদের মন নিয়ে কথা। যদি একটু এদিক ওদিক হয়, দূর হয়ে যাবে লক্ষ্মী।
হরিদাস কাছ ছাড়া করে না শুধু নয়। উইংসের পাশ থেকে গ্রিনরুম পর্যন্ত নিঃশব্দে ভূতের মতো ঘুরে ঘুরে ফেরে। সিরাজদ্দৌলা যখন গ্রিনরুমে লুৎফাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনাদের বাড়িটা কোথায়? মাঝখানে ছুটে এসে দাঁড়ায় হরিদাস। ও তো লুৎফা নয় এখন, পারুল। যা বলো আমায় বলো। স্টেজের বাইরে যদি ঘোরে চন্দ্রগুপ্ত হেলেনের পেছনে কিংবা কর্ণ দাঁড়ায় মাতা কুন্তীর পাশে, হরিদাসের পোকা খাওয়া চোখের পাতা অপলক নিৰ্ণিমেষে সেখানে। কুন্তী হেলেন লুৎফা নয়, বেলা জুঁই পারুল। যা করো, তা মঞ্চের পাদপ্রদীপের সামনে। মূল্য তার গুনে গুনে নেবে হরিদাস। তারই প্রথম সোপান হিসাবে, লুব্ধ সন্দিগ্ধ চোখের কামান নিঃশব্দে ফিরল শিবুর মুখোমুখি। আর এক পা-ও নয়।
তা বললে কি হয়! শিবু ও সব বোঝে কম। সে আসে কামানের তলা দিয়ে, এপাশ ওপাশ দিয়ে। এ এক নিঃশব্দ গাদি খেলার মতো। পথ যত আটকায় হরিদাস, শিবু আসে অবলীলাক্রমে। মুখে কিছু বলে না হরিদাস, মায়াবী দৈত্যের মতো ছায়া হয়ে ফেরে। শিবু অত বোঝে কি বোঝে না, কে জানে। সে বলে, আসুন বেলাদি, ঘসেটির পার্টটা আপনার একটু দেখি। কিংবা, জুঁইদি, আমি কৃষ্ণ, ট্রাই করো তো সুভদ্রার ইলোপ হওয়ার সিনটা। বলে পারুলকে, দক্ষ-ভীতি করিয়োনা সতী। রুদ্র এ বক্ষমাঝে বীণাসম বাজিবে যে তুমি!
মনে মনে হরিদাস বলে, শয়তানের বাচ্চা! চোখ রাঙায় তিন মেয়েকে। চোখ রাঙায় সর্বত্র, পথে ঘাটে গাড়িতে, গ্রিনরুমে, উইংসের ধারে। ড্যাব ড্যাবা চোখে চায় উত্তেজিত অন্ধকার মঞ্চে। আজ ছবছর ধরে পাকাপাকি হয়েছে ব্যবস্থা। বর্ষা শেষ থেকে মরশুম শুরু হয়। শারদ উৎসবের মাতামাতি থেকে, কালবৈশাখী পর্যন্ত, প্রোগ্রামের ইতি নেই। প্রায় প্রতি রাত্রে নাটক, হরিদাসের সারা বছরের খরচ। এ সময়ে তার চোখ আরও সন্দিগ্ধ, অনুসন্ধিৎসু।
কাল রাত্রে নাটক গেছে। আজও রাত্রে আছে। দু দিন বাদেই, পুজোর দিন পুরোপুরি। তারপরে আবার, আবার…
ক্রুদ্ধ চোখে ফিরে তাকাল সে স্নেহলতার দিকে। বড় বউ মানে না তার কালাকানুন। বেআইনি। কথা বলে আইনরচয়িতার ঘরে। ঘর ঝাঁট দেওয়া থাক, ফিরে যাক স্নেহ তার কাজে। এ ঘরে আসছে তার তিন মেয়ে, এখানে স্নেহলতার ওই চোখের চাউনিও নিষিদ্ধ।
তাই চলে যায় স্নেহলতা। তিন মেয়ে আসে। সদ্যস্নাতা, এলানো চুল। ঘাড়ে পিঠে চোখে মুখে চুর্ণ কুন্তল। তেল নিষিদ্ধ অভিনয়ের দিনে। শস্তা শাম্পুতে তিন এলোকেশিনী। মুক্তা বিন্দুর মতো ঝিকিমিকি জলকণা চুলে। রঙিন শাড়ির ফেত্তাতেও যেন তিন বৈরাগিনী। এখনও যেন ঘুমঘোরে আঁচল লুটোয়, জামার বোতামে বিরাগ। গায়ে গায়ে ঢলে ঢলে হেসে হেসে আসে তিন বোন। চাপা একটি সুগন্ধের সঙ্গে বিচিত্র একটু হাসির নিক্কণ। সব থেমে যায় ঘরে এসে। হরিদাসের কাছে। হরিদাসের এ বিচিত্র রংমহল। আধো অন্ধকার ঘরটায় হাওয়া ঢোকে না। অদৃশ্য দৈত্যের থাবা যেন। ঘিরে আসে চারদিক থেকে। হাসতে ইচ্ছে করে না।
রং ধোয়া তিনটি মুখ। তবু ভোরের তাজা ফুল নয়। ধুয়ে ধুয়ে ও গ্লানি কাটে না চোখের কোলের। বৃন্তহীন ফুলদানির গুচ্ছ। অনেক হাতের পেষণের ও গন্ধের কলঙ্ক কাটে না সারা গায়ের। আজ শুধু অবসাদ।
এক দিন ছিল খেলা খেলা। কিছুটা ভাললাগা। আজ মেশিনের ডায়ামেটারে ঘূর্ণন শুধু কর্তব্যের খাতিরে। একটু এদিক ওদিক নয়। প্রাণ খুলে হাসলে ও নিষ্পলক সর্পচোখ দেখা দেয় সামনে। স্নেহলতা মা ও মাসি। কিন্তু কথা বলে না তিন জনের সঙ্গে। যেন হরিদাসের ব্যবসার দাসী ওরা সেধে হয়েছে।
তিন বোন এল। এসে চা ঢেলে নিল গেলাসে। তারপর শুরু হল রাত্রের প্রস্তুতি। প্রথম উদ্যোগ নেয় হরিদাস নিজেই, পণ্ডিত মশায়ের ভূমিকা। রুক্ষ মূর্তি নয়, হেসে ব্যস্ত হয়ে বলে, আজ কী প্লে? চাণক্য? নিজেই খুঁজে পেতে বের করে বই। মুরার পার্ট নিয়ে বসে বেলা, ছায়া নেয় পারুল, জুঁই পায়চারি করে হেলেনের ভূমিকায়, বোঝে কতটুকু কে জানে। সমঝদারের মতো খুশি রক্ত চোখে দেখে হরিদাস। মাথা নাড়ে, বলে, বাঃ!
তারপর গান, নাচ রিহার্সেলের পর রিহার্সেল।
পাঠে বসিয়ে পণ্ডিতমশাই-ই যায় সংসারের অন্য কাজে। অমনি ছড়িয়ে পড়ে ঘরময় পাটের কাগজ। পায়ের নুপূর যায় ছিটকে। হারমোনিয়মটা নিঃশব্দে পড়ে থাকে সাদা রিডের দাঁত বের করে।
তিন বোন হুমড়ি খেয়ে লুটিয়ে পড়ে মেঝেয়। বলে, নিকুচি করেছে চাণক্যের।
আর এক জন, মাইরি আর পারিনে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে প্রেম করতে।
পারুল বলে ঠোঁট ফুলিয়ে, আর আমাকে যে কেঁদে কেঁদে গাইতে হয়?
হেসে ওঠে তিন জনে। বুঝি নিজেদেরই বিদ্রূপ করে ওরা হাসে। ওইটুকু অবাধ স্বাধীনতা ওদের।
হেলে পড়া, বেঁকে পড়া রাজবাড়ির এ ঘরটা হঠাৎ সত্যি রংমহল হয়ে ওঠে। হাড়ল গর্তগুলি এবার হাসে মিটিমিটি চোখে। দৈত্যপুরীর মন্ত্রে মরা রাজপুতেরা যেন। পশ্চিমের ভাঙা অলিন্দের ওপারে বন শিউলির বনে রোদ খেলা করে। রাংচিতের ঝাড়ে লাগে ধরি ধরি নাচ। রংপাখা মেলে ওড়ে ফড়িং-এর ঝাঁক। দূর আকাশের হাসকুটে মুখখানি অলিন্দের ধারে এসে ভিড়ে যায় এই তিন জনের সঙ্গে। তিন জন হয় চার জন।
পারুল বলে ফিসফিস করে, জানিস ভাই, যে লোকটা কালকে আমার স্বামীর পার্ট করছিল, সে লোকটা কী পাজি! হাত দুটো টিপে টিপে মাইরি ব্যথা করে দিয়েছে।
জুঁই বলে ঠোঁট বেঁকিয়ে, বোধ হয় সত্যি স্বামী হতে চেয়েছিল।
পারুল চিমটি কেটে বলে, তোর মুখপুড়ি।
তারপর ছোট্ট মেয়েটির মতো বলে গাল ফুলিয়ে, যা হাবলা চেহারা।
সেতারের প্রথম আলাপের মতো হাসি শুরু হতে থাকে। এদিকে ওদিকে ছোট ছোট ভাই বোনগুলি শুরু করে উঁকিঝুঁকি মারতে। বেলার লজ্জা করে।
বড় কিনা! তবু বলে থেমে থেমে, কেন, যে লোকটা আমার বাবুর পার্ট করলে? সে ব্যাটা তো দু দুবার গায়ের উড়নিই ফেলে দিল আমার গায়ে। আবার বলে কিনা, বলে বেলা দেখায় নকল করে—মাইরি, এরপরে কারও সঙ্গে আর নাটক করতে পারব না জানেন বেলাদি।
জুঁই টেনে টেনে চোখ ঘুরিয়ে বলে, মা-ই-রি?
তারপরেই হাসি। আলাপের পরে হাসি ওঠে গমকে। এ শুধু হাসি নয়। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে হাসির চেয়েও তীব্র কান্না, তাদের মেয়েজীবনের অপমানের।
তারপর জুঁই বলে, আর সেই পাঁচ টাকার নোট?
কোন পাঁচ টাকা?
বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সিরাজদ্দৌলা নাটকে? বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর, দাড়ি নেড়ে পাঁচটাকার নোট ফেলে দিয়ে গেল আমার পায়ের কাছে। দিয়ে আবার দূর থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল, আলেয়া নোট তোলে কি না তোলে।
তারপর?
আমি অমনি গ্রিনরুমের একজায়গায় লুকিয়ে দেখতে লাগলাম, মিরজাফরের কীর্তি। আর নোটটা মাইরি, চোখে পড় তো পড় পেন্টারের চোখে। সে বেচারি কুড়োতে যাবে, মিরজাফর লাফিয়ে হাজির, আমার, আমার, পড়ে গেছে, হেঁ হেঁ…
ভাঙা রাজবাড়িতে হাসি মাতাল হয়ে ওঠে। দৈত্যের ছমছমে মায়াপুরীতে এক মানুষিক মোহের রং ছড়ায়। হাসি শুনে রান্নাঘরে বসে, গায়ে কাঁটা দেয় স্নেহলতার। যেন ঘাড় মটকাবার উল্লাসে হাসে সর্বনাশী প্রেতিনীরা।
এমনি সময়, চকিতে আবির্ভাব হয় হরিদাসের। ফিরে দেখে না মেয়েদের দিকে, কথাও বলে না। যেন হঠাৎ এসে পড়েছে। পোকা খাওয়া নিশাচর চোখে তাকায় দক্ষিণের উঠোনে, নয়তো পশ্চিমের বনে। হঠাৎ হাসি বন্ধ। যেন কোন মুখখোলা পাতালের নির্ঝরের কলকল শব্দ উঠেছিল সপ্তমে। পাথর চাপা পড়ে সে শব্দ হঠাৎ হারায়। রুদ্ধশ্বাস বাতাস আবর্তিত হয় নড়বড়ে ঘরের কোণে কোণে। কিম্ভুতাকৃতি মাকড়সার ঝুলগুলি মাথা নাড়ে জুলজুল চোখে।
ছত্রাকারে ছড়ানো পার্ট চটপট কুড়োয় আবার তিন জনে। ব্যস্ত হয়ে বলে বেলা, হে পুত্র, দাসীপুত্র নহে শুধু তোর পরিচয়। বেলাকে আড়চোখে দেখে জুঁই বলে, কী আশ্চর্য দুখানি নয়ন সেই মৌর্য রাজপুত্রের।
পারুল বলে গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে, সখী, গ্রীক নন্দিনীর নীলচক্ষু যে হৃদয় করেছে জয়, সে হৃদয় কালোচক্ষু দেখিতে না পায়।
হরিদাস হেঁড়ে গলায় স্নেহ ঢেলে বলে, বাঃ! আজ নির্ঘাত তিন বোনের তিন মেডেল!
তারপর আসে আধবুড়ো রামকানাই আর বুড়ো হলধর। রামকানাইয়ের ডিগডিগে ঝাঁকড়া চুল, দন্ত নিয়ত বিকশিত। কোনকালে ছিল সে এক যাত্রাদলের ম্যানেজার। লোকে বলে রামকানাই অধিকারী। আর অপুরদন্তী মাজাভাঙা বুড়ো হলধর ছিল তার ড্যান্স মাস্টার। লোকে বলে নাটুয়া হলধর। রামকানাই লিকলিকে হাতে ধরে হারমনিয়ম। নাটুয়া হলধর কোমর ঘুরিয়ে এবড়ো খেবড়ো মেঝেয় গুনে গুনে পা ফেলে বলে, এক-দুই-তিন, এক-দুই-তি-চার…
শুরু হয় নাচ ও গানের রিহার্সেল। নাচের চেয়েও তিন বোনের শরীর কেঁপে থরো থরো, আধা কান্না আধা হাসিতে। ঢিলে স্ক্রু নড়বড়ে মাজা হলধরের যে পরিমাণে দোলে, চারবার পা ফেলতে তার অনেক বেশি সময় লাগে। আর তিন মেয়ের শরীরের কাঁপুনি দেখে সে ভাবে, এরা খাঁটি নৃত্য-পটীয়সী। নইলে এমন করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাঁপায় কী করে।
তা ছাড়া চোখও ধাঁধায় একটু। তিন মেয়ের লুটনো আঁচল আর শিথিল জামার সুডোল বাঁকের দোলায় তার শীর্ণ নালীকণ্ঠে শ্বাসরুদ্ধ হতে চায়। রামকানাই বলে ওঠে, ঐ হুঁ হুঁ হল না। চোখে একটু ঝিলিক হানতে হবে।
বেলা বলে, কেমন করে?
পারুল বলে, এমনি করে। বলে চোখ ঘুরিয়ে হাসে।
জুঁই বলে, হল না। এই দ্যাখ, বলে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে, বুকে এক বিচিত্র কাঁপন দিয়ে, বাঁকিয়ে ছোট চোখে চায়।
রামকানাই ও হলধর যুগপৎ বলে ওঠে, এ্যাই, এ্যাই ঠিক। আর কোনওক্রমে যদি হরিদাস কাছ ছাড়া হয়, তবে তো কথাই নেই। তিন বোন ঘিরে বসে দু জনকে।
পারুল বলে, রামকানাইদা
রামকানাই সন্ত্রস্ত হয়ে বলে, উঁহু, দাদা নয়। তোমার বাবা বারণ করেছে। কাকা বলো।
জুঁইবলে, রামকানাই কাকা
বলো।
বেলা বলে বল বললেন কেন? বলুন, বলো মা!
হাসতে গিয়ে হাসি আটকায় রামকানাইয়ের গলায়, বোকা বোকা হেসে বলল, হেঁ হেঁ, নিজের মাকে ছাড়া, মানে, কখনও কাউকে মানে
মানের মানে সব চাপা পড়ে যায় হঠাৎ তিন মেয়ের গলার উচ্ছ্বসিত খিলখিল হাসিতে! আবার আবির্ভাব হরিদাসের। কী ষড়যন্ত্রে মাতল তিন মায়াবিনী।
তারপর আসে শিবু। অমনি বাকি তিনটি পুরুষের মুখে নামে অন্ধকার। দেখা দেয় বিরক্তি, বিকৃতি। মনে মনে ফোঁসে হরিদাস। মনে মনে সুতীক্ষ্ণ নখে নখ ঘসে আর বলে, শুয়োরের বাচ্চা! আর তিন মেয়ে এবার সত্যি সত্যি চোখে হানে ঝিলিক। তিন বোনের নয়নজুলিতে, নিঃসৃত ঢল খাওয়া দেহ সরোবরে, লাগে ঢেউ টাবুটুবু পূর্ণ অষ্টাদশীর। এতক্ষণের বিদ্রূপ বেহায়াপনার পরে লজ্জা এসে ভারী করে ছয়টি চোখের পাতা। গালে ফোটে বিচিত্র রং, ঠোঁটে বিচিত্র রং, হাসি নাম-না-জানা। আড়ে আড়ে দেখে শিবুকে আর চোখোচোখি করে পরস্পর তিন বোনে। শিবু যেন নেশার ঘোরে মাতাল। না এসে পারে না একবার। সে এলে হাওয়া বহে অন্যদিকে। পশ্চিমের বনশিউলি মেঘলাভাঙা রোদের টোপর পরে যেন মুখ বাড়িয়ে ধরে অলিন্দে।
দক্ষিণের উঠোনে, ছাতিমের আয়তচোখের পাতা নড়ে রহস্যময়ীর মতো। শিবুর কথা শুনেই পরিবেশ যায় পালটে। বলে, পড়তা খারাপ এ বছরের, বুঝলেন কাকাবাবু। মাত্তর দুটো বায়না মিলেছে, পৃথ্বিরাজ সংযুক্তার পৃথ্বিরাজ আর অর্জুন, তাও অনেক কুতিয়ে কাতিয়ে। তবে পৃথ্বিরাজটা নতুন, সংযুক্তা হরণের সিল্টা যদি মাত করতে পারি, জোর বায়না জুটবে।
তিন বোন নিঃশব্দ হাসিতে গড়িয়ে পড়ে গায়ে গায়ে। দাঁতে দাঁত ঘষে হাসে। বলে, তা ঠিক।
প্রতিধ্বনি করে দুই মাস্টার, হেঁ হেঁ!
শিবু বলে, নইলে মাইরি, মনমোহিনী অপেরার সঙ্গে চলে যাব, পাড়াগাঁয়ে।
বেলা বলে উদ্বেগচাপা গলায়, পাড়াগাঁয়ে?
শিবু বলে, হ্যাঁ। কী করব, বেকার তত থাকতে হবে না। আর পাড়াগাঁয়ের লোকগুলি ভাল লেগে গেলে, একটু খেতে টেতে দেয় ভাল।
অমনি তিন বোনের চোখে নামে অসময়ের মেঘ-অন্ধকার। হরিদাস বলে, সেই ভাল।
তবুও জুঁইবলে ঠোঁট উলটে, আমরা বোধহয় চান্স পাব পাবলিক স্টেজে।
পারুল বলে, নয়তো ফিলমে।
পরমুহূর্তেই বারুদের প্রথম জ্বালা নীল ঝিলিকের মতো তীব্র বিদ্রূপ হাসি ফোটে তিন বোনের ঠোঁটে। হরিদাসের রক্তজ্বলন্ত চোখ শাসায় নিঃশব্দে। যেন আরও কোণ ঘেঁষে ওত পাতে, শাণায় নখর।
কিন্তু অবাক ব্যাপার! জ্বলন্ত চোখের শাসন, মেয়ে তিনটে দেখেও দেখে না এখন। টেরে টেরে দেখে শিবুকে। হরিদাসের বুক কাঁপানো হাসি দেখে কেন যে হাসে ওরা থেকে থেকে। যেন ওদের নিজেদের মধ্যে কী একটা জানাজানি আছে। দৈত্যের প্রাণভোমরার খবরটা বলাবলি করে নাকি ওরা।
আরও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে হরিদাস। শিবু তখন বলে, আজ কী? চাণক্য? বলে বেলার সঙ্গে চাণক্যের অভিনয় করে। বেলা করে মুরা। তখন কেমন একটা চাপা-চাপা ব্যথা ও জ্বালা দেখা দেয় জুঁই ও পারুলের চোখে। সে খুবই ক্ষণিক। তারপরেই শিবু চন্দ্রগুপ্ত হয়ে প্রেম করে হেলেনের সঙ্গে। কর্তব্যরত প্রেমিক চন্দ্রগুপ্তের মতো কাঁদায় ছায়াকে। পারুলের চোখে তখন সত্যি জল দেখা দেয়। এই সময়ে বোঝা যায়, অভিনয়ে দক্ষ কতখানি তিন বোনে। কিন্তু শিবুর মতো বোধহয় কেউ পারে না সেই সোনারকাঠি ছোঁয়াতে। তারপরেও শিবু বলে, কাল কী? কিছু নয়? পরশু? তারপরে? দেবলাদেবী? মিরকাশিম? অদ্ভুত মুখস্ত তার। খিজির, কাফুর, আলাউদ্দীন, নয়তো মিরকাশিম, পি, মিরজাফর, তিন বোনের সঙ্গে সবগুলি প্রকসি সে একা একা দেয়। প্রসি দেওয়ার জন্য কিনা কে জানে। কৃতজ্ঞতা ফোটে তিন বোনের চোখে, কৃতজ্ঞতা যেন অনেকখানি অনুরাগে ভরা। তার ফাঁকে ফাঁকে ওই বনশিউলির বনের রোদে ছায়ার মতো ব্যথার আনাগোনা। হঠাৎ মনে পড়ে, বোম খোলাবুকের। আঁচল অগোছাল। সাবান ঘষা মুখটা রয়েছে খসখসে।
বেলা সন্তর্পণে চুল ওঠা কপাল ঢাকে। জুঁই লুকিয়ে দেখে তার বুকের অন্তর্বাস। দেখে পারুলও।
শিবু দেখে একে একে তিন জনকে। হঠাৎ নিশ্বাস ফেলে বলে, বাবা বলেছে, আমি নাকি আইবুড়ো বোনটার চেয়েও বড় কাঁটা। ঘাড় ধরে বার করে দেবে।
তারও চোখে ব্যথার ছায়া।
রান্নাঘরে বসে, শ্রীনগরের মুখুটিবাড়ির বড় বউয়ের ভয়ে হাত পা কাঁপে থরথর করে। শুধু ডাল পোড়ে উনুনে।
তারপর, বেলা না গড়াতেই সাজো সাজো রব। তাড়া দেয় হরিদাস। ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় বায়নার টাকা। কখনও পঁচিশ মাইল, কুড়ি মাইল, দশ মাইল দূরে। পাড়ার পাশের পাড়াতেও কখনও বা। সে এক বিচিত্র জগৎ। মানুষ যে কতরকম! কেউ গায়ে পড়ে চেহারা দেখায়। লোভ, বেষারেষি, অতি ভদ্রতার নাটুকেপনা। কোথাওবা অমুক জায়গার বিখ্যাত অ্যামেচার সামন্দেশ মদ না খেয়ে পারে না পার্ট করতে, শুধু ঢলে ঢলে পড়েন ভাড়াটে অভিনেত্রীর ঘাড়ে।
হরিদাস এ সব দেখে অন্য চোখে। তার যে এক ভয়। তাই সে মেয়েদের প্রতিই মনে মনে। রোষে। টাকা নেয় হেসে।
রং মেখে ঢুলতে ঢুলতে রাত্রিশেষে ফিরে আসে তিন বোন। রাত্রিসন্ধ্যার গলায় সাজানো সতেজ, শেষ রাত্রির পিষ্ট তিনটি মালা। ভাবে, যদি চিরদিন থাকত শুধু এই টুলুনি। এমনি নেশা নেশা ভাব। তবে তরে যাওয়া যেত। কিন্তু হয় না তা। সব পেরিয়েও সময় আসে। যখন হাসতে গিয়েও হঠাৎ থেমে যায় তিন জনে। হঠাৎ যেন অন্ধকার কোথা থেকে আসে ঘনিয়ে, বাতাস হয় রুদ্ধ একেবারে।
হয়তো চুল বাঁধতে বসে হঠাৎ চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠে বেলার। ঠোঁটে চেপে ধরে চিরুনি। জল দেখা দেয় চোখের কোণে। হঠাৎ কী যে হয়। হাতের মো মুখে না মেখেই, রুদ্ধগলায় ফিসফিস করে বলে জুঁই, তোর পায়ে পড়ি বড়দি, চোখ মুছে ফেল। বলে সে নিজে গো ভরা হাত চাপা দেয় চোখে।
আলতার বাটি থেকে আলতা পড়ে ছলকে। বেলার পায়ের কাছে মুখ চেপে ফুলে ফুলে ওঠে পারুল। বলে, কেন যে কাঁদিস তোরা। কী যে হয়। কেন যে হয়!
অনেক সন্তর্পণে পা টিপে টিপে চলতে চলতেও এড়াতে পারে না এটুকু। অকস্মাৎ শক্ত শিলায় কখন চিড় খেয়ে যায়। এ ওকে সামলাতে গিয়ে ফুটিফাটা হয় তিনজনার।
পশ্চিমের শিউলি বনটা তখন রৌদ্রহারা, ঘনছায়া বিষণ্ণ বাতাসে হু-হুঁ করে। দক্ষিণের গোলাকৃতি ছাতিম সরে গিয়ে পুরানো রাজবাড়ির কোণে মুখ গোঁজে।
নিশ্বাস ঝরে বেলায়। বলে, কী যে হয়।
জুঁইবলে, পোড়ে মনের মধ্যে।
পারুল বলে আলুথালু বেশে, আমার সারা গায়ের মধ্যে যেন কী পাক দিয়ে ওঠে।
বেলা বলে, কিছু যেন মনে পড়ে?
কী? কাকে মনে পড়ে? তিন জনে তাকায় তিন জনের চোখের দিকে। কাকে যেন খোঁজে পরস্পরের চোখে।
তবু আবার হাসে তিন বোনে। ভাসে নিত্য জীবনে। ধনুকের ছিলার মতো বেঁকে ওঠে ঠেটি। চোখের বিদ্যুতে, হাসির বজ্রে জ্বালাতে চায় সংসারটাকে। কখনও কখনও জ্বলে ওঠে নির্দয়ভাবে। হয়তো অন্ধরাত্রে, বিছানায় পাশাপাশি দেহলগ্ন হয়ে ফুঁসে ফুঁসে ওঠে। নেমে আসে নড়বড়ে ছাদটা। অন্ধকারকে পেষে অন্ধকার। দম বন্ধ হয়ে আসে। এই দেহ যেন পিন ফোঁটা শির। রক্ত ঝরে অহর্নিশ। প্রাণ-স্রোত গলে গলে অবসাদে হয় শীর্ণ শব। নিত্য জোয়ারে প্লাবিত গঙ্গায় ও সুদীর্ঘ সময়ে নামে ভাঁটা। পাতালবাসিনীর মতো হয়তো চাপা গলায় গর্জে ওঠে বেলা, কেন, কীসের। জন্য? আর কিছু কি নেই, আর কোনও সুখদুঃখ বুঝি নেই সংসারে? শুধু এই রংমাখা মুখে?
নিজেদেরই মনের ভাষাকে আরও শাণিত করতে, পালটা যুক্তি দেয় জুঁই, এই দুর্দিন। বাবা, মা, ভাই, বোন…
বেলা বলে, এই কি রীতি সংসারের? চিরদিন সেই জন্য রং মাখতে হবে মুখে। শুধু ভাই বোন মা? মেয়েমানুষের আর কিছু থাকে না সংসারে? থাকে না আর কিছু?
পারুল বলে, আমরা বুঝি মেয়ে নই বাবা মায়ের? শুধু তারাই বাপ-মা? আমাদের দেবে না কিছুই?
কিছু কী? জুঁই অন্ধকারে চেয়ে থাকে নির্বাক হয়ে। তারও মন জ্বলে। তারপর তিনজনেই চুপ হয়ে যায়। চোখ জ্বলে আর ভিজে ভিজে ওঠে। দক্ষিণের ছাতিমের ঝাড়ে ঝি ঝি টেনে টেনে কাঁদে। অন্ধকার মনে মনে বলে, রিক্ত মাঠের বুকে অসহ্য বেদনা জাগে সৃষ্টিহীন অপমানে। আরও কত মানুষ সংসারে! কত দূর ব্যাপ্ত ছোটখাটো সুখে দুঃখে, মহান হাসি ও কান্নায় সম্পূর্ণ সংসারটি ছড়ানো স্তরে স্তরে। কে না চায় নিজেকে ছড়াতে, ছাড়াতে? অবহেলিত বনলতাও সর্বশক্তিমান মানুষের বেড়া টপকে বাড়ে অবিরত। এই তো নিয়ম।
নেমে আসে ছাদ। চাপা দেয়, পিষ্ট করে। বুকে মুখে পড়ে থাকে তিন জনে।
সকালে হরিদাস গোনে, এক, দুই, তিন…। পোকা খাওয়া চোখে দেখে দক্ষিণে পশ্চিমে। মরশুম। মরশুম।
স্নেহলতা রাগে ভয়ে পোড়ে।
মরশুম! মরশুম! বহু রাত্রি ভোর হয়। আবার রাত্রি ভোর হয়।
.
দরজা ঠেলে হরিদাস। দরজা ককিয়ে ওঠে, ব্যাথা জাগা গর্ভিণী মাজারীর মতো। হরিদাস গোনে, এক, দুই, তিন
অভ্যাসে গুনেছে। হঠাৎ থেমে গোনে আবার, এক দুই… দুটি রং মাখা মুখ। অসাড় নিদ্রায় মগ্ন।
নিশাচর রক্তচোখ ঘষে হরিদাস দেখে, একজন নেই। কে? জুঁই। কোথায় গেল? দেখে এদিক ওদিক। পশ্চিমে বনশিউলিবনে থোকো থোকো তাজা ফুল হাসছে রোদ ঠোঁটে নিয়ে। মাথা চাড়া দেওয়া রাংচিতে উঠেছে আকাশে। জুঁইকোথায়? উপরে নীচে নেই, আশেপাশে নেই। হরিদাস ডেকে তোলে দু জনকে। জুঁইকোথায়?
রং ওঠা-ওঠা দুটি মুখ, ভাবলেশহীন। কাজলঅন্ধ রাতজাগা চোখে তাকায় বিছানার দিকে। যেখানে শুয়েছিল আর এক জন, ছিল তিন জন দেহলগ্ন হয়ে। হঠাৎ যেন মাটি আর বিচুলি বেরিয়ে পড়ে রংমাখা পুতুলের মুখে। চোখ নেই, দেওয়ালের গর্তের মতো শুধু কালো কালো ফুটো চারটে চোখ। বিস্মিত কান্নায় তারা দু জনেই পালটা জিজ্ঞেস করে, কোথায়, কোথায়?
আচমকা টনক নড়ে দৈত্যের। ডানা-খসা প্রাণভোমরা গোঙায় রাগে ও ভয়ে। কঠিন শিকলে বাঁধা অনায়াস জীবনে ধরেছে ফাটল। ওপড়ানো শিকড় বৃদ্ধ বট টলমল করে। আতঙ্কে ও ঘৃণায় চিৎকার করে ওঠে হরিদাস, কোথায়? কোথায়?
পলাতকার পদচিহ্নের মতো, একটুকরো কাগজ বেরোয় বালিশের তলা থেকে। বিস্মিত-আক্রোশ-জ্বলন্ত চোখে কাগজটি পড়ে বেলা। পড়ে দেয় পারুলের হাতে। আচমকা আগুন লাগে পারুলের গায়ে কাগজটি পড়ে। অভিশাপের আগুনে চিরকুটটি পুড়িয়ে দেয় হরিদাসের হাতে। হরিদাস পড়ে, অকারণ খুঁজো না। চলে গেলাম শিবুর সঙ্গে।
ঘরটা যেন টাল খেয়ে গেল। নীরবতা কয়েক মুহূর্ত। চায়ের গেলাস কেতলি হাতে দরজার কাছে যোবা ছবি স্নেহলতা। বাদবাকি ছেলেমেয়েগুলি উঁকি দেয় নানান ঘুলঘুলি দিয়ে। ৮৭৪
হরিদাসের রক্তচোখ সাঁড়াশির মতো নেমে আসে বাকি দুটি মুখের উপর।
সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, ফিরে তাকায় বেলা। চোখ জ্বলে তার। গলায় অজস্র ঘৃণা ঢেলে বলে, জানো বাবা, আরও কী বলত জুঁই?
ছিন্নসূত্র খুঁজে পাওয়া চকিত সন্ধানী গলায় বলে হরিদাস, কী?
কী? সত্যি আরও কী বলত জুঁই, বেলা কী জানে? সে কি মিথ্যা কথা বলছে? হয়তো আপন মনে তৈরি করা, তবু অসহ্য ঘৃণাভরে বলে, জানো বাবা, বলত চিরদিন কি রং মাখব মুখে? যদি বা মাখি, আর কি নেই কিছু আমার প্রাণে?
হরিদাস রুদ্ধগলায় বলে, আর? আর কী?
আর? হঠাৎ যেন ভুলে যায় সব কথা। অমনি মনে হয়, জুঁইযেন তার কানে কানে কথা বলছে। যেন জুঁইয়ের সেই শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলিই বলে, আর? আর বলত, না হয় খাব দুঃখের ভাত, পরব ছেড়া কাপড়, তবু সে তো আমারি দুঃখের ঘরে।
পারুলও বলে ওঠে তিক্ত ঝাঁজ গলায়, আরও কী বলত, জানো মেসোমশাই?
হরিদাসের চোখ ফেটে পড়ে। শির ছেঁড়া গলায় বলে, কী, কী?
পারুলের মনে হয় না একটুও বানিয়ে বলছে। বলে, বলত, আমার ঘর হবে, স্বামী হবে, ছেলে হবে। রাতভর নাটক করে ফিরে এসে, রাঁধব, খাওয়াব ওকে, ঘুম পাড়াব…
কন্ঠরুদ্ধ হয় পারুলের। তবু বলে, আর বলত, বাবা যদি চায়, বাবাকেও দেব। তবু এখানে আর পারিনে। এবার চলে যাব।
বেলা পারুল দু জনেই ঘাড় নাড়ে, হ্যাঁ, বলত।
হরিদাস বলে, তোরা কী বলতিস?
আমরা? হঠাৎ দুর্জয় জ্বলন্ত চোখ ফেটে জল আসে দু জনেরই। রং ধুয়ে যায় গালের। দু জনেই বলে, আমরা? আমরা বলতাম, না না, কখনও না।
হরিদাস চিৎকার করে প্রতিধ্বনি করে, না না, কখনও না।
ছোট হয়ে আসে ঘরটা, ভারী হয়ে আসে অন্ধকার। ঝুলগুলি নেমে আসে কড়িকাঠ থেকে মেঝেয়।
তবু বনশিউলি বনে ফোটা দৃপ্ত সতেজ ফুলগুলি রোদে হাসে, মাথা দোলায় বাতাসে। রাংচিতের নরম ডাঁটা আকাশকে ছাড়াতে চায় তরতর করে।
তারপর নজর ফেরে হরিদাসের স্নেহলতার দিকে। ভয় ঘৃণা কান্না, কিছুই ছিল না তার চোখে। ভাবলেশহীন চোখ দুটি তার। যেন চেয়েছিল নিজের হাতের পঁচিশ বছরের পুরনো, জললাগা, ধুলো লাগা, তেল লাগা, শাঁখার দিকে। হরিদাস দেখে তার সিঁদুর লেপা মধ্যসিঁথি।
দেখে, তার কুদ্ধচোখ হঠাৎ চমকায়। যেন চোখ দুটি অন্ধ হয়ে যায়। ফিরে চায় নতুন সন্দেহে। মনে হয়, সামনে দাঁড়িয়ে ওটা জুঁই। স্নেহলতা নয়। পালাবার ছলনা যার চোখের ছায়ায় অনেক, অনেক আগে হরিদাস দেখতে পেয়েছিল।
সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রখ্যাত লেখক, ঔপন্যাসিক। কালকূট ও ভ্রমর তাঁর ছদ্মনাম। তাঁর রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে ওঠে। ১৯৮০ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
তাঁর শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে কলকাতার উপকণ্ঠে নৈহাটিতে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তাঁর জীবন ছিল পরিপূর্ণ। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন।
বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের গান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির এক জন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাঁকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়। তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন জেলখানায়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
‘কালকূট ’ছদ্মনামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি তাঁর ছদ্মনাম। ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘কোথায় পাব তারে’ সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন।
তাঁর লেখা ছোট গল্পের সংখ্যা ২০০ এবং উপন্যাসের সংখ্যা ১০০।