অদ্ভুত একটা কিনকিন কিরকির আওয়াজ করতে করতে দেয়াল ঘড়িতে ভোর চারটে বাজল। অনেকক্ষণ আগেই জেগে গিয়েছিলেন অনিকেত রায়মহাশয়। তিনটে বাজাও শুনেছেন জেগে জেগে। অনিদ্রার রাতে এইসব ঘড়ির আওয়াজ যে কী গা-শিরশিরে হতে পারে অনিকেতবাবুর চেয়ে ভালো তা কেউ জানে না। তবু কী একটা মায়ার বশে ঘড়িটাকে তিনি অবসর দিতে পারেননি। তাঁর দাদামশায়ের ঘড়ি। চমৎকার চলে এসেছে চিরকাল। ঘড়ির এইরকম চলে আসাটাকে কোনো ব্র্যান্ড-নেমের গৌরব মনে করার কোনো কারণ নেই। কত সুইস, কত জার্মানই তো এল গেল। কে ফাস্ট যাচ্ছে, কে স্লো, কার টাইম বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ প্রলাপ বকছে। কিন্তু অনিকেতবাবুর দাদামশায়ের ঘড়ি টিকটাক ঠিকঠাক চলছে। সাত জার্মান জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে। এ কৃতিত্ব জগাইয়েরই। আসল কথা কোনো কোনো ঘড়ি যন্ত্র হলেও ঠিক যান্ত্রিক থাকে না শেষ পর্যন্ত। প্রাণটান গোছের কিছু একটা পেয়ে যায়। জগাই পেয়েছে। এটাকে একটা মির্যাকল বলা যায়। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অনিকেতবাবু খসখসে গলায় বললেন, তুই যদি পারিস জগাই তো আমিই বা পারব না কেন? পেরে যাব ঠিক। কী বল!
টিক টক জগাই বলল।
টিক টক? ঠিক কথা বলছিস? … অনিকেতবাবু বললেন, তা হলে পারি? পেরে যাই? বলতে বলতে সজোরে কম্বলটা সরিয়ে বিছানার বাইরে এক লাফ মারলেন অনিকেতবাবু। পা দুটো ঝনঝন করে উঠল। কিন্তু ওইটুকুই। ফাটা, ভাঙা এসব কিছু হল না। হৃষ্ট মুখে কনকনে ঠান্ডা মেঝের ওপর সোজা পায়ে ল্যান্ড করলেন অনিকেতবাবু।
ডাক্তারেরা কিন্তু বলে থাকে ঘুম থেকে উঠে হুটোপাটি করবেন না। ধীরে সুস্থে কয়েকটি আড়মোড়া ভাঙবেন। ডান কাতে শোবেন, বাঁ কাতে শোবেন, তারপর হাতের ওপর ভর দিয়ে আস্তে উঠে বসবেন, পা ছড়াবেন। এক পা এক পা করে মাটিতে নামবেন। ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে আরও একটি পেল্লাই আড়মোড়া ভাঙবেন। তারপর…
কে বলছে? কে বলছে কথাগুলো?
অনিকেতবাবু চারদিকে তাকিয়ে হদিস করতে পারলেন না। চিপচিপে বুকে অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে বুঝলেন এই এস, সি, ডি বা সুপার কমপ্যাক্ট ডিসক বাইরে কোথাও নয়, তাঁর নিজের বুকের ভেতরেই বাজছে।
বছর চারেক আগে স্ত্রী গায়ত্রী যখন খুব অসুস্থ, হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে এসেছেন জোর করে, সেই সময়ে গায়ত্রীর নাম করে নিজেও একবার ভালো করে ডাক্তারি চেক আপ করিয়ে নিয়েছিলেন। সেই ডাক্তারই বলেছিলেন, আরে দাদা, আপনার হাইপারটেনশন নেই, রক্তে চিনি নেই, ব্ল্যাড কোলেস্টেরলও ধর্তব্যের মধ্যে নয়। হার্ট চলছে চমৎকার ল্যাবডুব ঝাঁপডুব ছন্দে। জোয়ানের মতো আপনি বাঁচবেন না তো বাঁচবে কে? তবে হ্যাঁ…।
ডাক্তার এক ঝুড়ি কর্তব্য ও অকর্তব্যের কথা বলেছিলেন। সেগুলো সযত্নে মুখস্থ করে রেখে দেন অনিকেতবাবু। কষ্ট করে মুখস্থ করতে হয়নি। কানের ভেতর দিয়ে একবার ঢুকতেই মরমে পশেছে। তাই তাঁর শরীর মনে না রাখলেও মন সেগুলো মনে রাখে, মনে করিয়ে দেয়।
বিছানা গোছাতে লাগলেন অনিকেতবাবু। সবাই-ই হয়তো নিজের কাজ নিজে করে কিন্তু করে দায়ে পড়ে, দায়সারা করে। অনিকেত করেন যত্ন করে মেথডিক্যালি। বালিশটা থুপে থুপে ঠিক জায়গায় রাখলেন। কম্বলটা দু-হাতে তুলে নিলেন। খুব ভারী লাগল। ভালো করে দেখতে গিয়ে রায়মহাশয়ের বুক হিম হয়ে গেল। এ কী? দুটো কম্বল কেন? জানালা বন্ধ। পায়ে মোজা। গায়ে উলিকট। একটা কম্বলই তো যথেষ্ট? দুটো কেন? এ কি দার্জিলিং নাকি? কিংবা নিদেনপক্ষে বর্ধমান, চাতরা, নবাবগঞ্জ? আরে বাবা এ যে শহর কলকাতার গাদাগাদি মধ্যিখান? কম্বলটা দিলে কে? কে এমন ষড়যন্ত্রনিপুণ, নিষ্ঠুর অন্তরালবর্তী বিভীষণ আছে যে মাঝরাতে তার ঘরে ঢুকেছে এবং গায়ে দিয়ে দিয়েছে দ্বিতীয় কম্বল? নাঃ সুপ্রতীকের কথা তিনি আর শুনবেন না। এবার থেকে দরজা বন্ধ করে শোবেন। তিনি নিশ্চয়ই রাতে কুঁই কুঁই করেছেন। বেশ সশব্দে। বলা যায় না হয়তো কেঁদেছেন, অচেতনের ওপর তো হাত নেই! ছি ছি! সেই কান্নার শব্দে আকৃষ্ট হয়ে সুপ্রতীক অথবা আরও ভয়াবহ। রুমিই হয়তো। কী ভাবল।
চটপট করে বাথরুম সেরে মাথা গলা কান-ঢাকা টুপিটা মাথায় গলিয়ে নিলেন তিনি। গায়ে চাপালেন ওভারকোট। পায়ে উলের মোজা। এ সবই সিমলাতে কেনা হয়েছিল অন্তত বিশ বছর আগে। সিমলায় সে বছর ভালো বরফ পড়েছিল। এখন সেই সিমলাই আয়োজন কলকাতিয়া জানুয়ারিতে গায়ে চাপাচ্ছেন তিনি। আয়নার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, অ্যাবমিনেবল স্নোম্যান! বলেই চমকে উঠলেন কারণ কে যেন সঙ্গে সঙ্গেই বলল, অ্যাবমিনেবল ওল্ড ম্যান। চারদিকে চকিতে একবার তাকিয়ে নিলেন অনিকেত রায়মহাশয়। তাঁর দীর্ঘশ্বাসে আয়নার পরিষ্কার গায়ে একটা দলা-পাকানো বাষ্পের দাগ হল। সিনথেটিক সোলের জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে এবার নিঃশব্দে লম্বাটে সরু দালানটা পার হওয়া, দরজাটা টেনে দিয়ে নিজেই এলিভেটর নামিয়ে সদরে পৌঁছোনো, তারপর নিজের ইয়েতি সদৃশ আকারটি নামিয়ে দেওয়া। রাত-দারোয়ান গলা বাড়িয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় প্রশ্ন করল, কে যায়?
দুশো তেইশ।
কচ্ছপের মতো গলা গুটিয়ে নিল ব্যাটা।
খোলা গালের ওপরে এসে বিঁধছে মাঘের ধারালো ছুরির মতো হাওয়া। একবারটি শিউরে উঠলেন অনিকেতবাবু। তারপর হনহন করে পা চালালেন পুবের পার্কটার দিকে। দু-চারটে রাত-কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। শীতে পা টেনে ধরেছে, কিন্তু তাকে ওই রাত কুকুরগুলোর মতোই পাত্তার মধ্যে আনতে চাইছেন না তিনি। নির্ভীক পদক্ষেপে তিনি পার্কের দিকে এগিয়ে চলেছেন।
রাস্তায় এখনও দাপটের সঙ্গে জ্বলছে পরাক্রান্ত পথ-বাতিগুলো। যেন বড়ো বড়ো জ্বলজ্বলে চোখে দেখছে কে যায়, কারা যায়। খোকা না বুড়ো, বুড়োখোকা না বুড়ো-বুড়ো। দেখছে এবং হিসেব রাখছে। মাথা নীচু করে ওভারকোটের দু পকেটে হাত ভরে রাস্তাটা পার হলেন তিনি। হনহন করে হেঁটে পার্কে পৌঁছোতে পাঁচ মিনিট। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন আরও কিছু কিছু মূর্তির আবির্ভাব হয়েছে আশেপাশে। মাথা-গা-কম্বল-শাল মুড়ি দেওয়া, কেউ কোট-প্যান্টালুন হাঁকড়েছে। মাথা ঢেকে নিয়েছে মাফলারে! নানান মূর্তি। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। প্রাণপণে হাঁটছে।
হাঁটবেন, হাঁটবেন, ভোরে একবার, সন্ধেয় একবার করে হাঁটবেন। হাঁটাই এখন একমাত্র ব্যায়াম…বুকের ভেতরে এস. সি. ডি.-টা খনখনে গলায় বলে যেতে লাগল। আশপাশ দিয়ে জড়পুঁটলির মতো হন্টনকারীদের দেখে মনে হয় তাদের বুকের মধ্যেও ডিসকটা বাজছে… হাঁটবেন। হাঁটবেন…..ভোরে…..সন্ধেয়…হাঁটাই এখন একমাত্র ব্যায়াম…।
আজ নিয়ে তৃতীয় দিন হল অনিকেত এইভাবে বেরোলেন। সুপ্রতীক জানে না, রুমি জানে না। ওরা ওঠবার আগেই আবার নিঃশব্দে ফিরে যাবেন তিনি। পকেট থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলবেন। ওই সময়ে একটা দমকা কাশি আসতে চায়, সেটাকে কোনোমতে চেপে টয়লেটের মধ্যে গিয়ে মুক্ত করে দেন তিনি। বালতির ওপর কলটাকে পুরো প্যাঁচ ঘুরিয়ে খুলে দেন। ছড়ছড় করে জল পড়তে থাকে। খক খক ঘঙঘঙ ঘঙ আখা আখা আখ খা আখা, অনিকেত মনের সুখে কাশতে থাকেন। ঘরে গিয়ে এক চামচ ওষুধ খাবেন ড্রয়ার চাবি দিয়ে খুলে, একটা থ্রোট লজেন্স মুখে রাখবেন তারপরে।
রুমি যখন ঘুমচোখে বসবার ঘরে এসে কাগজ খুঁজবে তখন সে কাগজ পড়ে ভাঁজ করে টেবিলে রাখা, বিজয়ীর ভঙ্গিতে অনিকেতবাবু বাঁ পায়ের ওপর ডান পা রেখে তাকে মৃদুমন্দ নাচাতে নাচাতে সিগারেট খাচ্ছেন। রুমি যদি ভালো করে লক্ষ করত তো দেখতে পেত অনিকেতবাবুর সিগারেট থেকে বিশেষ ধোঁয়া উঠছে না। ঠোঁটে ওটা আলতো করে ধরে রেখেছেন তিনি। রুমি কাগজের মোটা খবরগুলোতে চোখ বুলোবে : ইকোয়েডরে আবার ভূমিকম্প, কিয়োটোতে জলপ্লাবন। না ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ কিছু হয়নি। সুপ্রতীক আসবে, চেঁচিয়ে খবরগুলো পড়বে তখন রুমি।
সে কি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি? আশ্চর্য!
হলেই বা এখানে কী! রুমি আলগা গলায় বলবে, আমাদের আছে সাইক্লোন আর পথ দুর্ঘটনা।
রুমি এবার উঠে যাবে। সুপ্রতীক বাবার সিগারেট থেকে নিজেরটা জ্বালিয়ে নিতে চাইবে, সেই সময়টার জন্যে সামান্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নেন অনিকেতবাবু। তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে সিগারেটের মুখ। ধোঁয়াটা পুরো ছেড়ে দিয়ে দু-আঙুলের ফাঁকে সেটাকে সন্তর্পণে ধরে রেখে কোনো একটা হাজারবার পড়া জার্নাল আবার পড়বেন অনিকেতবাবু। সুপ্রতীকের মুখচোখ কাগজে আড়াল। সে কিছুই বুঝতে পারবে না।
টি-মেশিন থেকে প্রত্যেকে এক এক কাপ চা নিয়ে মুখোমুখি বসবেন এবার। মৌজ করে। চমৎকার শান্তিময় আবহাওয়া। পারিবারিক প্রভাত।
রুমি আজকাল প্রায়ই জিজ্ঞেস করছে, রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো বাবা? গতকাল এ প্রশ্ন শুনে বড়ো বড়ো সরল চোখে তাকিয়ে ছিলেন অনিকেতবাবু, ঘুম? মানে? ঘুম হবে না কেন?
না তাই বলছিলাম।
জিজ্ঞেস করার সময়ে রুমির চোখ দুটো চায়ের কাপের ওপর থেকে আধখোলা হয়ে ভেসেছিল। ঝিনুক-ঝিনুক চোখ। দেখেও যেন দেখলেন না সেই ঝিনুকের পেটের মতো দৃষ্টি।
সুপ্রতীক পরশু বলল, তুমি এবার সকালের দিকে চা-টা বন্ধ করে দাও বাবা। একটু গরম দুধ খেলে শরীরটা ঠিক থাকবে।
অনিকেতবাবু আকাশ থেকে পড়ে বলেছিলেন, দুধ? দুধ মানে? ও দুধ! দুধ কথাটা জীবনে প্রথম শুনলেন অনিকেতবাবু।
অন্ততপক্ষে চায়ে চিনিটা খেয়ো না—সুপ্রতীক তাঁর দিকে চেয়ে বলেছিল।
চিনি দুধ না হলে তাকে আর চা বলে না মাই চাইল্ড? বেপরোয়া সাহসের সঙ্গে সুপ্রতীকের চোখে চোখ রাখলেন তিনি। মাই চাইল্ড বলতে পেরে একটা অদ্ভুত আত্মপ্রসাদ। সুপ্রতীক তাঁর ছেলে যদি চাইল্ড হয়, তা হলে তিনি কী? আর যাই হোন, নিশ্চয়ই দুগ্ধমাত্রসার দ্বিতীয় শৈশবগ্রস্ত নন।
চা-টা শেষ করে স্প্রিং-এর মতো উঠে দাঁড়ান অনিকেত।
চলি রুমি, চলি রে সুপ্রতীক। আমাকে আবার লেখা-টেখাগুলো নিয়ে বসতে হবে। কেউ কোনো সাড়া শব্দ করে না। এই নীরবতা এক হিসেবে স্বস্তির। মাথা খুঁড়ে কোনো আইডিয়া-টিয়া বার করতে হয় না তাঁকে। আবার অস্বস্তিরও। তবে কি ওরা তাঁর লেখা-টেখাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না? নাকি বিশ্বাসই করছে না! ভেতরে ভেতরে দমে গেলেও তিনি চেহারার ওপর সেটা ফুটতে দ্যান না। স্প্রিং এর মতো চলনভঙ্গিটা বজায় রেখে তিনি ওদের সামনে দিয়ে চলে এলেন। ওরা আড়াল হতে একটু আলগা দিলেন। নিজের ঘরে এসে পর্দাটা টেনে দিয়ে সোয়াস্তি।
জানলার পাশে আরামকেদারা। এই আরেকটা দাদুর আমলের জিনিস। ভাঙে না, মচকায়ও না। কুচকুচে আবলুশ কাঠের জিনিস। নরম গদি দেওয়া। সেই গদির গায়ে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে জানলার বাইরে চোখ রাখলেন তিনি। তাঁদের পনেরো তলা, পাশের ব্লকটা সতেরো তলা। সতেরো তলা টপকে আকাশরেখা দেখতে পেলেন অনিকেত। দেখতেই থাকলেন। দেখতেই থাকলেন। কী সুন্দর। কী অপূর্ব সুন্দর! কী চমৎকার এই জীবন ব্যাপারটা। আর কিছু না। শুধু সুস্থ সবল হয়ে বেঁচে থাকাটাই একটা…কী দুর্লভ সৌভাগ্য?
পাশের ব্লকটাতে ওরা ছাদ-বাগান করেছে। একটা করবী গাছ। সরু সরু বাঁকা কুকরির মতো পাতার মধ্যে থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল ফুটে থাকে। সবুজে লালে নবীন। এখন, এই শীতেও সবুজ জাগিয়ে রেখেছে গাছটা। একটু খুঁজলে দেখা যাবে দুটো ব্লকের মাঝখানের জমিতে গজিয়ে ওঠা তিনটে বটল পাম। দুধ সাদা গা। ওপর থেকে সেসব দেখা যায় না। কিন্তু স্মৃতিতে ভাসে মাথায় সবুজ পালক। গাছেরা কখনও বুড়ো হয় না। ওরা যতদিন খুশি আকাশ দেখে, মাটি থেকে খাদ্য নেয়, বাতাস থেকে শ্বাস নেয়, এবং অতি মূল্যবান অক্সিজেন পৃথিবীকে দিতে থাকে। দেয় বলেই না গাছপালার এতো দাম, এতো আদর। এই যে সব গগনচুম্বী বাড়ি। তাদের প্রতি গুচ্ছে নির্দিষ্ট সংখ্যক বৃক্ষ আছে। আছে ঝোপ জাতীয় গাছ। ঝকঝকে তকতকে। ছোটো চারা যখন পোঁতা হয় তখন চারদিকে বেড়া দেওয়া হয় ভক্তিভরে। গাছ সবসময়ে জীবন দিচ্ছে, তাই গাছ দেবতা। দিতে হবে সবসময়ে কিছু-না-কিছু দিয়ে যেতে হবে। বি প্রোডাকটিভ, অনিকেত! বি প্রোডাকটিভ। বুকের ভেতরে ব্যাটাচ্ছেলে এস, সি, ডি-টা আবার বলছে। চমকে প্রায় আরামকেদারার আশ্রয় থেকেও পড়ে যাচ্ছিলেন অনিকেতবাবু।
তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। মোটা নোটবই। লাইব্রেরি থেকে আনা রেফারেন্স। বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা। ভেতরে মার্কার দিয়ে সব ওলটানো আছে। বিশ্ব রাজনীতির ওপর জনসংখ্যার প্রভাব নিয়ে একটা তথ্যবহুল প্রবন্ধ লিখছেন তিনি। লিখছেন মানে ছেলে-বউয়ের কাছে বলেছেন যে লিখবেন। আসলে কলম চিবোচ্ছেন। ভালো লাগছে না মোটেই।
পঞ্চান্ন বছর বয়সে অবসর নেবার পর ঠিক পনেরোটা বছর কেটে গেছে। গোড়ায় গোড়ায় অনিকেতবাবু খুব উৎসাহের সঙ্গে লেখাজোকা ধরেছিলেন। বিজ্ঞাপনসংস্থার সঙ্গে কাজ কারবার করতে হত, তাই চেনাশোনা ছিল কিছু কিছু। লেখার অভ্যেস। আইডিয়া নিয়ে নাড়াচাড়া করার অভ্যেস এগুলোও ছিল। নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। ছাপত। রোজগারও হত। আত্মতৃপ্তিও হত। পেনশন তো পাঁচ বছর অন্তর শতকরা দশভাগ করে কমে যায়, কাজেই এই উপরি আরে নাতির জন্য দামি খেলনা, রুমির জন্য একটা ভালো পারফিউম কি সুপ্রতীকের জন্য একটা শৌখিন সিগারেট লাইটার—এই জাতীয় উপহার কিনে বাড়ির হাওয়ায় খুশির ঝলক এনে দেওয়া হত। এমন ছোটাছুটি করে দোকান বাজার করতেন, হইহই করে আড্ডা মারতেন ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে, দুপুরবেলাও কাজে-কর্মে বেরিয়ে থাকতেন যে, ছেলে-বউ-নাতি প্রতিবেশীরা কেউই বুঝতে পারত না তাঁর বয়স হচ্ছে। মাঝে মাঝে সুপ্রতীকের বন্ধু অবুদ বলত, কাকাবাবু আপনার চুলগুলো কাঁচাপাকা না হলে কেউ বুঝতেই পারত না আপনি অবসর নিয়েছেন। আপনি আমাদের থেকেও জোয়ান।
তা সে যাই বলুক, বললেই তো আর তিনি জোয়ান হয়ে যাচ্ছেন না। কঠিন সত্য হল এই: তিনি অবসরপ্রাপ্ত, দেশের সাম্প্রতিকতম নিয়ম অনুযায়ী পঞ্চান্ন বছরেই। তাঁর রাজনৈতিক অধিকার নেই, অর্থাৎ তিনি ভোট দিতে পারেন না, কোনো আদালতে বিচারও চাইতে পারেন না। তিনি ঠিক নাগরিক যাকে বলে তা নন পুরোপুরি। যেটুকুও বা নাগরিকত্ব আছে ক্রমশই খোয়াচ্ছেন, খোয়াতে থাকবেন। এখন যে-কোনোদিন, বুড়ো অকর্মণ্য বলে বোঝা গেলেই সরকারি বৃদ্ধনিবাসের টিকিটটি তাঁকে কেউ ধরিয়ে দেবে। ছেলে বউই দেবে, ওরা যেমন প্র্যাকটিক্যাল! আর ওরা না দিলেও প্রতিবেশী আছে, বন্ধুবান্ধবের ছেলেপুলে আছে, পুলিশ আছে। নেই কে?
কিন্তু আজকাল অনিকেতবাবুর এই দৌড়ঝাঁপ আর ভালো লাগছে না। রাতুলটা যতদিন ছোটো ছিল, ভালো জমত। কিন্তু দেখতে দেখতে সেও এখন সতেরো আঠারো বছরের হয়ে গেল। তারও বাইরের জগৎ হয়েছে, গোপনীয়তা হয়েছে। তার নিজের জগতের মধ্যে আর চট করে প্রবেশ করা যায় না। করার চেষ্টা করলেই বুঝতে পারেন সুর বাজছে না।
কী রে রাতু, কী পড়বি ঠিক করলি? মেডিসিন?
কোন মেডিসিন?–রাতুল মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে। ছোট্ট রাতুল তাঁর চিকিৎসা করতে খুব ভালোবাসত। ড্রপার দিয়ে ইঞ্জেকশন দিত। পিপারমিন্টের ট্যাবলেট খেতে দিত। অকেজো প্লায়ার্স বুকে পিঠে বসিয়ে হার্ট বিট দেখত।
কোন মেডিসিন মানে?–অনিকেতবাবু ওর কথা বুঝতে পারেন না।
মিলিটারি না সিভল না পুলিশ?
আজকাল এইসব আলাদা বিভাগ হয়েছে বুঝি?।
ততক্ষণে রাতুল তাঁর চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। যাবার সময়ে ছুড়ে দিয়ে গেছে সে কমটেক পড়বে।
কিংবা!
কী রে দাদু আজকাল কার সঙ্গে স্টেডি যাচ্ছিস? খুব মাই-ডিয়ার দাদু হতে চেষ্টা করেন তিনি।
দিয়া, চই আর দাভিনা।
তিনজনের সঙ্গে?—অনিকেত কেমন ভোম্বল মতো হয়ে যান।
হ্যাঁ!–রাতুলের অবাক উত্তর। ওসব তুমি বুঝবে না দাদু।
ইদানীং অনিকেতবাবু দুপুরবেলা আর লাইব্রেরি যান না। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে লেখা লেখা খেলা করেন। রুমিরা জানে তিনি একটা বিশাল বই লিখবেন। প্রবন্ধ-ট্রবন্ধ ছাড়াও। বিশাল বই যা নাকি সমাজতত্ত্বের কাজে লাগবে। এ রকম বই লিখতে পারলে আলাদা করে গ্র্যান্ট পাবেন লেখক। প্রোডাকটিভ কিছু করলে সরকার নানারকম সাহায্য দিয়ে থাকে। সন্দীপন দেশাই বলে এক ভদ্রলোক পরের পর বই লিখে যাচ্ছেন। অর্থনীতির ইতিহাস। এদেশীয় অর্থনীতি, বিশ্ব অর্থনীতি। আশির কাছে বয়স হল ভদ্রলোকের। এঁর সঙ্গে অনিকেতবাবুর একসময়ে খুব আলাপ ছিল। খুব সম্প্রতি এঁকে এঁর শেষ বইটির জন্য অভিনন্দন জানিয়ে ফ্যাক্স করেছিলেন তিনি। দেশাই তার জবাব দিলেন খুব ছোট্ট এবং অপ্রাসঙ্গিক। হোপ আইল ডাই ইন মাই ওন বেড।
কিন্তু অনিকেতবাবু দরজাটা বন্ধ করে দেন দুপুরে। সন্তর্পণে জানলার পর্দাটা টেনে দ্যান। পাশের ব্লকের যে ভদ্রলোকের জানলাটা তাঁর মুখোমুখি? মনস্বী না কী যেন? বড্ড ইয়ে। কদিন আগেই গায়ে পড়ে বলেছিল, কাকাবাবু আপনার যেন কত হল? দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনার রিটায়ারমেন্টের ইয়ারটা……
অনিকেতবাবু ভীষণ উৎসাহের সঙ্গে হাত ঝাঁকিয়ে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, সিনেমা যাবে নাকি মনস্বী। বেশ ভালো একটা অ্যাডভেঞ্চারের ছবি এসেছে। লুনার পার্ক। বলো তো টিকিট কাটি। তুমি আমি আয় রাতুল।
জানালার পর্দা টেনে দিয়ে একটা ভীষণ গর্হিত কাজ করতে থাকেন তিনি। দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকেন : ধবধবে চুলের এক বৃদ্ধ। বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সময়টা ফাল্গুন চৈত হবে। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে, তার বাইরেটা গরম ভেতরটা ঠান্ডা হাওয়ার বৃদ্ধের এলোমেলো চুল আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হাফ পাঞ্জাবি হাওয়ায় ফুলে ঢোল। বৃদ্ধবয়সের পাতলা চামড়ার ওপর বসন্তের হাওয়ার স্পর্শ, বড়ো সুন্দর! ছোট্ট একটি ছেলে বল লাফাতে লাফাতে এল।
দাদু তুমি বল খেলতে পারবে?
না ভাই।
তাহলে কুইজ? কুইজ করব?
পারব না ভাই।
আচ্ছা তাহলে বসে আঁকো।
তাও পারব না।
তবে তুমি পারবেটা কী?
মৃদু হেসে বৃদ্ধ বলেন, মনে মনে পারি। এখনও এসবই মনে মনে পারি। চোখ বুজে ঘুম ঘুম এসে যায়। স্মৃতির ওপর এক পর্দা কাপড়। ক্ষীণভাবে অনিকেতবাবুর মনে হয়, কে? কে এই বৃদ্ধ?—তাঁর দাদু বোধহয়। আর গুন্ডা ছেলেটা? তিনি, তিনিই নিশ্চয়। একাশি বছর বয়সে তাঁর এগারো বছর বয়সের সময়ে খুব সম্ভব মারা গিয়েছিলেন দাদু। এই আরামচেয়ার, ওই ঘড়ি তাঁর। অন্য এক পল্লির অন্য এক বহুতলের তিনতলায় থাকতেন তাঁরা। আবার ঘোর এসে যায় অনিকেতবাবুর।
রুমি, সুপ্রতীক, গায়ত্রী আর তিনি। রাতুলকে নিয়ে লম্বা পাড়ি দিয়েছেন। মোটরে। সুপ্রতীক চালাচ্ছে, রুমি তার পাশে। পেছনে বাকিরা। দু-পাশে পাহাড়ি গাছ। সরল, দেওদার…এটা কোন জায়গা…দার্জিলিং? শিলং? মুসৌরি? হঠাৎ গাড়িটা ঘ্যাচ ঘ্যাচাং করে থেমে গেল। সুপ্রতীক নেমে পড়ে অনেকরকম চেষ্টা চরিত্তির করল। এমন কি রাতুলও। কিন্তু কিস্যু হল না। গাড়ি যেমন নট নড়ন চড়ন তেমনি হয়ে আছে। তখন অনিকেতবাবু নামলেন। জাস্ট পাঁচ মিনিট। হাতের সাদা রুমালটা কুচকুচে কালো হয়ে গেল অবশ্য কিন্তু গাড়ি সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল। রাতুল বলছে, তোমার হাতে জাদু লিভার আছে নাকি দাদু। রুমি বলছে, বাবা না থাকলে এই বিশ্রী জায়গায় রাত হয়ে আসছে…কী ঠান্ডা।
ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দিচ্ছে রুমি। এটা বড়ো প্রিয় দিবাস্বপ্ন অনিকেতবাবুর। কখনও ঘটেনি। কিন্তু যদি ঘটে! এমন কেন সত্যি হয় না আহা! এ ছাড়াও আরও কত ভালো ভালো দিবাস্বপ্ন আছে অনিকেতবাবুর। কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন? দেখতে দেখতে জমাট দুপুর ঘুম এসে যায়। ফুরফুর ফুরফুর করে নাক ডাকতে থাকে। হঠাৎ নাকে ফৎ করে একটা বেয়াড়া মতো আওয়াজ হতেই তিরবেগে উঠে বসলেন অনিকেতবাবু। বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করছে। জানালার পর্দা টানা আছে তো ঠিক? দরজাটা বন্ধ? হ্যাঁ। আছে। আছে।
অর্থনীতির ওপর প্রবন্ধ! হু। রাজনীতির ওপর লোকসংখ্যার প্রভাব। মাথার মধ্যেটা রাগে চিড়বিড়িয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। লিখতেই যদি হয় তিনি রম্যরচনা লিখবেন। আবার ফর্মের দিক থেকে রম্য হলেও তা হবে রুদ্র রচনা। মনের যাবতীয় ক্ষোভ, জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা সব প্রকাশিত হবার জন্যে তাঁর মাথার মধ্যে ফাটাফাটি হুটোপাটি করে চলেছে। কিন্তু এরকম কিছু লেখা মানে নাহক নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। ঠিক আছে না-ই বা প্রকাশ করলেন, শুধু নিজের তৃপ্তির জন্যেই তিনি লিখবেন। এই সংকল্প মনের মধ্যে উঁকি দেবামাত্র রায়মহাশয় তাঁর কম্পিউটারে কাগজ ভরলেন। একটু ভাবলেন, তারপর লিখলেন
জীবন সুন্দর, পৃথিবী সুন্দর, কিন্তু মানুষ কুৎসিত, সমাজ কুৎসিততর, শাসনযন্ত্র কুৎসিততম। যৌবনও কুৎসিত। যত বয়স হইতেছে, বুঝিতেছি যৌবনও কুৎসিত। কারণ, হ্যান্ডসাম ইজ দ্যাট হ্যান্ডসাম ডাজ। যে যৌবন বৃদ্ধের আত্মত্যাগের মূল্যে ফুর্তি কিনিয়া বাঁচিয়া থাকে তাহাকে ধিক। যে যৌবন বৃদ্ধের জীবন হইতে বসন্তের অধিকার ছিনাইয়া লয় তাহাকে ধিক। যে সকল বৈজ্ঞানিক উন্নতি, প্রাযুক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিবার সামাজিক পরিকাঠামো তোমরা প্রস্তুত করিতে পার নাই, সে সকলের সঙ্গে তাল মিলাইবার চেষ্টা তোমাদের হাস্যকর। কারণ তাহা করিতে গিয়া মানুষের স্বাভাবিক অধিকারগুলি তোমরা ছিনাইয়া লইতেছ। এগুলি তোমাদের বেতালা বেসুরো আসুরিক কাণ্ড। জনসংখ্যা হু হু করিয়া বাড়িতেছে। তো আমরা কী করিব? আমাদের কাহার ঘরে একটি দুটির বেশি সন্তান আসে না। কোথায় বাড়িতেছে, কেন বাড়িতেছে খোঁজ আর লইবে কি! ভালো করিয়াই জানো সব। দারিদ্র্য, অপরাধ, অধিকার, কুশিক্ষা, প্রজাবৃদ্ধি সকলই তো পুষিতেছ? আর খাঁড়াটি তাক করিয়াছ সিনিয়র সিটিজেনের গলদেশ তাক করিয়া? যে নাকি সারাজীবন ধরিয়া তিল তিল করিয়া দিয়াছে?
ছাপা কাগজটার দিকে চেয়ে রইলেন অনিকেতবাবু। ভাষাটা যে দাদামশায়ের বেরোল। দাদামশায় কেন কে জানে এই ভাষায় চিঠিপত্র লিখতেন। তাঁর কাছে রয়েছে কয়েকটা। ভাষাটার কেমন একটা বুড়ো বুড়ো বিজ্ঞ বিজ্ঞ গন্ধ। তাঁর মধ্যে কি দাদামশায়ের ভূত ঢুকল? ঢুকুক, তাই ঢুকুক। রাজনীতির ভূত ঢোকার চেয়ে তা শতগুণে ভালো।
অস্থির হয়ে পায়চারি করতে শুরু করে দিলেন তিনি। গত পঞ্চাশ বছরে মৃত্যুর হার লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে। শেষ এপিডেমিক এসেছিল এডসের। এ শহরের সমস্ত হাসপাতাল, নার্সিংহোমের ব্লাড-ব্যাংক, ইনজেকশনের ভূঁচ এডসের ভাইরাসে ভরে গিয়েছিল। সেসময়ে ইউ, এন. ও.-র শাখা ডাবলু. এইচ. ও হাসপাতালগুলো অধিগ্রহণ না করলে কয়েক কোটি মানুষ মরে যেত। কিন্তু ডাবলু, এইচ, ও, তখন থেকে শক্ত হাতে হাসপাতালগুলো পরিচালনা করে চলেছে। সংক্রামক ব্যাধি এখন প্রায় নেই-ই বলতে গেলে। দেহযন্ত্র বিকল হলে চোখ থেকে শুরু করে হার্ট, কিডনি লাং সবই পাওয়া যাচ্ছে। চোখ থেকে মজ্জা পর্যন্ত সব কিছু ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। মৃত্যুর হার তাই কমে গেছে। এদিকে জন্মের হার কমছে না। তা-ও আবার বিশেষ বিশেষ পকেটে বাড়ছে। কতকগুলি পল্লি থেকে কজন মানুষ বেরোয় হাতে গোনা যায়, আবার কতকগুলি পল্লি থেকে পিলপিল করে মানুষ বেরোয়। দারুণ সস্তা হয়ে গেছে টেলিযন্ত্র। বেশির ভাগ মানুষের সাংস্কৃতিক খাদ্য এখন হিংস্র, কামোত্তেজক এন চ্যানেল। স্কুলকলেজে ড্রপ-আউটের সংখ্যা বাড়ছে। বেকারভাতা এসে গেছে। ভোটাধিকারের বয়স ক্রমেই কমছে। আঠারো থেকে যোলো হল, এখন পনেরো।
বেলা তিনটের সময়ে অনিকেতবাবুর খিদে পেল। তিনি আভেনের হটচেম্বার থেকে বিরিয়ানি বার করে খেলেন। এই এক টং হয়েছে, সব কিছু নিউট্রিশন একত্র করে পনেরো মিনিটে স্বাস্থ্যপ্রদ এক পদ রান্না। চাইনিজ খিচুড়ি, থাই পোলাও, বিরিয়ানি আলা ফ্রাঁস। কোল্ড চেম্বার থেকে কাঁচা সালাড বার করলেন তিনি। আজকাল আর একদম কাঁচা খেতে পারছেন না। সালাড-ড্রেসিংটা মেয়নেজ মনে হচ্ছে। সেটুকু চেঁছে পুঁছে খেয়ে তিনি হাজার স্কোয়্যার ফুটের ফ্ল্যাটটা পায়চারি করে বেড়াতে লাগলেন।
রাত্রে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন দেখে রুমি জিজ্ঞেস করল, বাবার কি শরীরটা ভালো নেই!
আজ অনেক বেলায় খেয়েছি, খিদে নেই।
তোমাকে কতবার বলেছি টাইমটা মেনটেইন করো। রেগুলারিটিই হল গিয়ে আসল-সুপ্রতীক থমথমে গলায় বলল।
গ্রাহ্য করলেন না, অনিকেতবাবু। গম্ভীরভাবে বললেন, লিখতে লিখতে খেয়াল ছিল না। এ কথায় কেমন হৃষ্ট হয়ে উঠল দুজনেই। রুমি এবং সুপ্রতীক।
রুমি বলল, খেতে ভালো না লাগে নাই খেলেন। একগ্লাস ট্রাংকুইলেট খেয়ে নেবেন শোবার আগে…
ওসব তোমরা খাও—বলে অনিকেতবাবু বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, অন্যমনস্ক হয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। আজ যেন কাউকেই গেরাহ্যি করছেন না তিনি।
এরা দুজনে অর্থপূর্ণভাবে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল শুধু।
অনেক রাত অবধি ঘুমোতে পারলেন না অনিকেতবাবু। কিন্তু জেদ করে কোনো ওষুধ বিধুষও খেলেন না। ট্রাংকুইলেট নামে পানীয়টাও না। মাঝরাত পার করে দু এক ঘন্টার জন্যে ঘুমটা এসেছিল, তারপরই তাঁর দাদামশায় তাঁকে জানিয়ে দিলেন টং টং টং টং।
অনিকেতবাবু উঠে মুখ ধুলেন, ধড়াচূড়া চাপালেন। একটা আলোয়ান মুড়ি দিলেন সবার ওপর। তারপর নিঃশব্দে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে, এলিভেটর চালিয়ে নীচে নেমে এলেন। রাত-দারোয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে। শুনসান মাঘের রাস্তায় একেবারে হিমমণ্ডলে ডুব দিলেন অনিকেতবাবু। শীতে আড়ষ্ট হরে থাকা পা বাড়ালেন পার্কের দিকে।
কোণটা সবে ঘুরেছেন, নিঃশব্দে একটা ঢাকা ভ্যানমতো এসে দাঁড়াল তাঁর পেছনে, নিঃশব্দে লাফিয়ে নামল দুজন আপাদমস্তক য়ুনিফর্ম-পরা লোক। একজন ডান দিকে, একজন বাঁ দিকে অনিকেতবাবুর। তিনি ভালো করে কিছু বোঝার আগেই ভ্যানের ভেতরে চালান হয়ে গেলেন। তাঁর মাথার ওপর দিয়ে একটা ঘেরাটোপ গলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কে তোমরা? কী চাও? কী চাও? তিনি বৃথাই চেঁচাতে লাগলেন। কেউ কোনো উত্তর দিল না। সামান্য পরে তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর মুখে যে ঘেরাটোপটা দেওয়া হয়েছে সেটা সাউন্ড প্রুফ। এবং তিনি ধীরে ধীরে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। এইভাবেই তাহলে ওরা অনিচ্ছুক বৃদ্ধদের বৃদ্ধাবাসে নিয়ে যায়!
যখন জ্ঞান হল, অনিকেতবাবু দেখলেন তিনি একটি চমৎকার আলোকিত ঘরে শুয়ে। তাঁর শয্যাটি মাথার দিকে এমন করে তোলা যেন তিনি আরামকেদারাতেই বসে আছেন। তাঁর চারপাশে বেশ কিছু ভদ্র ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। দেখলে যেন মনে হয় ডাক্তার। সকলেরই হাসিমুখ। ঠিক এমন পরিবেশ অনিকেতবাবু আশা করেননি।
এখন কেমন বোধ করছেন?
ভালো—অনিকেতবাবু ক্ষীণস্বরে বললেন।
খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।
কেন?
রাস্তার মাঝখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন।
তাই?–অবাক হয়ে অনিকেতবাবু বললেন—আমি তো…আমাকে তো…
হ্যাঁ আমাদের হেলথ স্কোয়াডের ভ্যান ভাগ্যে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল!
তাই? অনিকেতবাবু দুর্বলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তো ভাবলুম…আচ্ছা আমার ছেলে বউ সপ্রতীক আর রুমি রায়মহাশয় তেত্রিশের বি,…
আহা হা ওঁদের খবর দেওয়ার তো আর দরকার হবে না।–একজন স্মিতমুখে বললেন, আপনি তো ভালোই হয়ে গেছেন। জাস্ট একটা ব্ল্যাক আউট হয়েছিল। আমরা সব চেক-আপ করে নিয়েছি। আপনি বাড়ি যেতে পারেন।
একলা একলা মানে একটা গাড়ি…
সব ব্যবস্থা আছে, আমাদের ভ্যানই যাবে।
একটা প্রেসক্রিপশন মানে ব্ল্যাক-আউটটা…
ভদ্রলোকেরা স্নেহের হাসি হাসলেন, পৌঁছে যাবে, ভ্যানে আপনার সঙ্গেই পৌঁছে যাবে।
কোমরের কাছে চওড়া বেল্ট দিয়ে শয্যার সঙ্গে বাঁধা ছিলেন অনিকেতবাবু। তার থেকে অনেক তার বেরিয়েছে।
হ্যাঁ একটা কথা, হাসিমুখে একজন বললেন, আপনি যদি কাইন্ডলি একটা কাগজে সই করে দ্যান।
সামনে মেলে ধরা কাগজটার অনিকেতবাবু দেখলেন তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর কিডনি, হার্ট এসব দান করেছেন। আপত্তি কী? চোখদুটো তো আগেই দান করে রেখেছেন।
তিনি হেসে বললেন, জ্যান্ত থাকতে থাকতে আবার খুবলে নেবেন না যেন।
কথা শুনে ভদ্রলোকেরা সবাই হাসতে লাগলেন। একটা রসিকতা করেছেন বুঝে অনিকেতবাবুও হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতেই সই করে দিলেন।
ব্যস আপনি মুক্ত। বেল্টটা ধীরে ধীরে খুলতে লাগলেন একজন।
উঠতে গিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন অনিকেতবাবু। তিনি তো আর জানতেন না তাঁর হার্ট, কিডনি, সব আগেই বার করে নেওয়া হয়ে গেছে। এসব এখন কাজে লাগবে কোনো অসুস্থ কিন্তু ভোটপ্রদানক্ষম তরুণের। এতক্ষণ তাঁকে যা বাঁচিয়ে রেখেছিল তা হল তাঁর মাথার কাছে রাখা যান্ত্রিক হার্ট, যান্ত্রিক কিডনি। তাঁর মুক্তির মুহূর্তেই সেগুলোর সুইচ অফ করে দেওয়া হয়েছে। এরা নিতে পারেনি শুধু তাঁর বৃদ্ধ, অভিজ্ঞ ব্রেইনটা। নেবার কৌশল এখনও আয়ত্ত করে উঠতে পারেনি, পারবে কি না তা-ও বলা যাচ্ছে না। এমন কি পারলেও নেবে কি?
জীবনের শেষ ধবনি অনিকেতবাবু শুনতে পেলেন সন্দীপন দেশাইয়ের গলায়। সহ্যের অতীত ডেসিবেলে আওয়াজ তুলে বলছেন, হোপ আইল ডাই ইন মাই ওন বেড।
লেখিকা, জন্ম ২৬ ফাল্গুন, ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে। বাণী বসু উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা লেখেন, অনুবাদও করেন। একাধিক সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিতা বাণি বসু আশির দশক থেকেই সাড়া জাগানো জনপ্রিয়তার অধিকরিণী। তিনি বিজয় কৃষ্ণ গার্লস কলেজের অধ্যাপিকা।