বেণু দত্তরায়ের কবিতা
শীত
একদিন শীতবুড়ি এসে ডাকত, আয় আয়। উত্তরের
মাঠ দিয়ে লাঠি ঠুকে-ঠুকে হেঁটে আসত। একমাথা রুক্ষ
কুয়াশা-জড়ানো চুল। আমাদের ঠাকুরদা জানতেন
সক্কলের আগে। বলতেন, এসো এসো
ঠাকুরদা বলতেন, শীতের সুখই আলাদা! আমরা ছোটরা
খুদে-খুদে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতাম। শীতের সঙ্গে
তাঁর কী যে প্রণয় আমাদের বুঝবার ক্ষমতাই ছিল না।
আমাদের ঠাকুরদারও ছিল সাদা মাথাভর্তি চুল
খুব ভোরে উঠতেন ঠাকুরদা ব্রহ্মলগ্নে। তখন পৃথিবীর
সীমানা বদল হচ্ছে। ধুতির প্রান্ত গায়ে জড়িয়ে যেতে-যেতে
হাঁকতেন, উঠে পড়ো দাদুরা। উঠে দ্যাখো শীতে
সাতটা শেয়াল মরে গেছে
আমরা উঠতাম না। মায়ের কোলের কাছে আরও ঘন
হয়ে শুয়ে থাকতাম। ততক্ষণে সাবেক দিঘির জলে
স্নান সেরে নিচ্ছেন ঠাকুরদা। চারদিকে কুয়াশার গাঁটছড়া
গাছপালা লতা-পাতা শুনশান
শীতের সুখই আলাদা, বলতেন ঠাকুরদা। কাঠ-পালা জ্বালিয়ে
সেঁকে নাও হাত-পা আগুনে… পিঠেপুলি খাও। মাথার উপরে
দ্যাখো ঝাঁকে-ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে বালিহাঁস… কলসি নামানো
হচ্ছে খেজুরগাছের। কী যে ঠান্ডা রস!
ঠাকুরদার সঙ্গে সেই শীত গেছে কবে! শিমের মাচায়
আর বেগুনি রং ফুল ধরে না। কাঁঠালপাতার দোনা ভরে
দুধ নিয়ে পিসিরা খেলে না। খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে শীত আসে
আমাদের পাকা-ঘরে। উত্তরের জানালাটা বন্ধ করে দাও-
জানো না কি টনসিল পেকেছে এই ফ্ল্যাটবাড়িটাতে?
চাঁদনিরাতে শালবনে
শালবনের ধারে রাত্রে
দূরন্ত চৈত্র না -যাওয়াই ভালো
রংধামালি থেকে
রাত আরাইটেয়
ট্যাক্সি করে ফিরছুলুম
একটা পাতা ব্রিজের ওপরে
উঠতেই মনে হল
চাঁদে আজ আগুন লেগেছে
এইসব দূু্র্দান্ত আগুনে
চোখ বন্ধ করে রাখাই ভালো
কিংবা ঘরের দরজা – জানালার
পর্দা ঠেসে- ঠুসে
কবে যে কি পাপ করেছিলুম
জলন্ত যৌবনে সত্যভ্রষ্ট
কার কাছ থেকে পালিয়ে ফিরেছি
নিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি
সে আজ ভীষণ প্রতিশোধ
নিতে চায়
ড্রাইভারকে বললুম
চাঁদে কি আগুন জ্বলছে
এইসব চৈত্ররাত্রি খুন করতে পারে
স্পীড মোর স্পীড
সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়ে
একবার আমার দিকে-
একটা ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে
উঠেছে গাড়ি প্রবল শব্দে
রাত্রি-জাগা একটা পাখি
উইন্ড স্ক্রীনে
ডানার শব্দ ছিটকে পড়েছে
আমি চোখ বন্ধ করে ফেললুম
দুঃসহ ভয় আর আতঙ্কে
আমার কপাল ফেটে
গলগল করে রক্ত পড়ছে
২
না – যাওয়াই ভালো
পিশাচসিদ্ধ হাওয়া
হা-হা করছে শালবন
মৃত্যুযন্ত্রণার মত অপ্রকাশ্য
আতঙ্কে
সমস্ত রাত্রিকেই যেন
প্রতে পেয়েছে
রাইফেলটা বাগিয়ে ধরে
আমি পিছিয়ে এলাম
সভয়ে
দৌড়ে ছুটে এসে
সিদ্ধার্থ ধরে ফেলেছে
আমাকে-
চলে আসুন স্যার
অপদেবতার মন্ত্র বলছে
পাহাড়
উত্তরের শালবন
রাইফেল দিয়ে তার সঙ্গে
কী করবেন
ভালোবাসার জন্যেই
ভালোবাসার জন্যে আমি একশ আটত্রিশবার খুন হয়েছি
আর প্রত্যেকবার
আমার দেহ লটকে দিয়েছে
গলির মোড়ে
ল্যাম্পপোস্টের ভুতূড়ে আলোয়…
একটা পিঁপড়ে আমার ঠোঁটের কষে…একটা মাছি বসেনি
আমার জামার হাতায়
খুব কালচে রঙের দাগ দেখে
এক বন্ধু বলেছিল—খুব বাঁচা গেছে মাইরি…
ভালোবাসার জন্যে আমাকে বারবার লেলিয়ে দিয়েছে
কুকুর
সেই সুন্দরীদের ল্যাপডগগুলো
আমার জিভ কচকচিয়ে খেয়েছে…
শেষে আমার চামরার ডুগডুগি বানিয়ে
রামধুন পদাবলী…
আঃ মোলো যা, রামায়নের মধ্যেই
এই ভূতের কিচমিচি ভাল্লাগেনা—
ভালোবাসার জন্যেই আমি বারবার
ফিরে আসতে চাই, গুপ্তহত্যা হতে চাই বারবার..
মন ভাঙার খবর
ইস্কুলে যখন পড়ি
তার পাশেই ছিল
আদ্দিকালের
ইদ্রাকপুর কোর্টের মস্ত বাড়িটা
যেন ভৌতিক জাহাজ
কেউ বলতেন, ওই দুর্গটার
চুড়োয় দাঁড়িয়ে
চাঁদ রায় প্রতাপ রায় নাকি
কার্ভালোর নৌযুদ্ধ দেখতেন
কেউ বলতেন, যাঃ কেমন করে হবে
ওটা জাহাঙ্গীরের তৈরি
তার তলায়-তলায়
সুড়ং গেছে ঢাকায়
আমাদের বালককালের কথা –
(সত্যিই কি একটা বালককাল ছিল?)
দেশভাগের পর শুনেছি
এখন ওখানে এস্-ডু সাহেবের
দরবার
মস্ত সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়
ইদ্রাকপুর কোর্টের কথা
মনে থাকবার নয়
কিন্তু দেশভাগের আগে-আগে
বন্ধু জয়নালের বোন শাহানা
ওই দুর্গের পাথুরে দেয়ালের
ধার থেকে
কয়েকটা সূর্যমুখী ফুলের গোছা ছিঁড়ে
আমাকে উপহার দিয়েছিল
কী যে পাগলাটে মেয়েটি ছিল
সেই বয়সে শাড়ি ধরেছিল
হাত-ভরা নানারঙের চুড়ি
আর কাঁচের টিপ থাকত কপালে
দাদার বন্ধু আমাকে
শুধু-শুধুই সে তুই বলত –
তোদের হিঁদুদের তো আবার
এ-ফুল পুজোয় লাগে না
তোকে দিলাম পুজো করতে নয়
পড়ার টেবিলে রেখে দিবি
ও-বাংলা থেকে
সাততাড়াতাড়ি চলে আসতে গিয়ে
শাহানার কথা মনেই হয়নি
সূর্যমুখী ফুল দেখলে
এখনো বুকের মধ্যে ব্যথা হয়
দেশ তো কতই ভাঙে –
মন-ভাঙাভাঙির
খবর কেউ রাখে?
কবি