সিঙ্গুর থেকে সিংহল বিজয় কাহিনী
সুমিত বর্ধন
।।১।।
আমাদের এ কাহিনীর নায়কের নাম বিজয় । পুরো নাম বিজয় সিংহ। আদি বাড়ী পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চল।
কাহিনীর খানিকটা পৌরাণিক গল্প আর খানিকটা ইতিহাস। আগে গল্পটুকু বলে নিই, তারপরে তার প্রেক্ষাপটে ইতিহাসকে হাজির করাব ।
যে দেশটাকে আমরা এখন শ্রীলঙ্কা বলে জানি, প্রায় ১৯৭২ সাল অবধি পর্যন্ত তার নাম ছিল সিলোন বা সিংহল ।
এই শ্রীলঙ্কা বা সিংহলের অনুরাধাপুরমের বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষুরা সেই খৃষ্ট পূর্বাব্দ তৃতীয় শতাব্দী থেকে একটি গ্রন্থে শ্রীলঙ্কার রাজবংশের সমস্ত ইতিহাস ক্রমাগত লিপিবদ্ধ করে গেছেন ।
পালি ভাষায় রচিত সেই গ্রন্থের নাম মহাবংশ ।
আমাদের বিজয়ের কাহিনীর উপাদান মূলতঃ এই মহাবংশ থেকেই পাওয়া । কিছু উপাদান পাওয়া দ্বীপবংশ নামে মহাবংশের পূর্বসূরি আর একটি পুঁথি থেকে ।
কাহিনীর সূত্রপাত বেশ কিছুদিন আগে । তা ধরুন আন্দাজ ওই খৃষ্ট পূর্বাব্দ সপ্তম শতাব্দী হবে । মানে আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও আগে । বৈদিক যুগ পার হয়ে উত্তর ভারত তখন কাশী, কোশল, মগধ, বৃজি ইত্যাদি নানা জনপদে বিভক্ত । তথাগত বুদ্ধ তখনও ধরাতলে অবতীর্ণ হননি ।
সেই সময়ে বঙ্গের রাজার এক কন্যা ছিলেন, নাম তাঁর সুসিমা । তা রাজকন্যা হলে কি হবে, সুসিমা সেই সময়ের তুলনায় বেশ স্বাধীনচেতা এবং উচ্ছৃংখল ছিলেন । ফলে বাড়িতে তাঁর কপালে গালমন্দ বেশ ভালোরকমই জুটত ।
গালাগাল সহ্য করতে না পেরে সুসিমা একবার বাড়ি ছেড়ে পালালেন । যাবেন কোথায় ? তা একদল বণিক মগধ যাচ্ছিল, তো তাদের দলেই ভিড়ে গেলেন ।
এবার যেতে যেতে রাঢ় অঞ্চলে বণিকেরা পড়ল এক সিংহের পাল্লায়।
সিংহ বলতে অবশ্য বোধহয় সত্যিকারের সিংহ নয়, খুব সম্ভবতঃ সিংহ নামধারী কোন ডাকাত সর্দার-টর্দার হবে।
তা সে যাই হোক, সিংহের তাড়া খেয়ে বণিকেরা প্রাণের ভয়ে সব এদিক সেদিক উর্দ্ধশ্বাসে পালাল । রাজকন্যা সুসিমা কিন্তু একেবারে সিংহের প্রেমে ফ্ল্যাট হয়ে গেলেন । আর সিংহমশাইও এমন রাজ-হংসী পেয়ে হিংসা-টিংসা ভুলে গেলেন, তাকে পিঠে চড়িয়ে সটান নিয়ে গেলেন নিজের গুহায় ।
কালক্রমে সিংহ আর সুসিমার দুটি সন্তান জন্মাল । তার মধ্যে ছেলেটির নাম সিংহবাহু আর মেয়েটির সিংহসিবলী।
বছর ষোল সিংহের সাথে কাটানোর পর সুসিমা ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তাকে ছেড়ে পালালেন । এসে হাজির হলেন বঙ্গের সীমানায় । সেখানে তখন বঙ্গের রাজার এক ভাইপো রাজপ্রতিনিধি হয়ে শাসন করছিলেন, তিনি সুসিমার এই কাহিনী শুনে চমৎকৃত হয়ে তাকে সঙ্গে করে রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে একেবারে বিয়েই করে ফেললেন।
এদিকে সিংহও নিখোঁজ পরিবারের সন্ধানে বঙ্গসীমান্তে এসে তাদের না পেয়ে নানা উপদ্রব আরম্ভ করে দিল। রাজার পক্ষ থেকে সিংহকে মারার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করা হল।
পুরস্কারের লোভে সিংহবাহু সিংহকে হত্যা করলেন। কিন্তু তার অল্প কয়েকদিন আগেই রাজার মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং উত্তরাধিকার সূত্রে বঙ্গের সিংহাসনও সিংহবাহুর হস্তগত হল।
সিংহবাহু কিন্তু সিংহাসনে বসলেন না, দাদামশায়ের রাজ্য মায়ের দ্বিতীয় স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে, ছোটবেলায় যেখানে বড় হয়েছিলেন, সেই রাঢ় অঞ্চলে সিংহপুর নামে রাজ্য স্থাপন করলেন।
এই সিংহপুর কোথায় ঠিক তা বলা মুস্কিল, এক এক জন ঐতিহাসিক এর এক জায়গায় দিক-নির্দেশ করেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন কলিঙ্গে, মন্মথ দাস বলেছেন ছোট নাগপুরে ।
তবে দীনেশচন্দ্র সেন আর হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী কিন্তু সিংহপুরের স্থান নির্দেশ করেছেন একবারে আমাদের ঘরের পাশে।
সে জায়গার আজকের নাম আমাদের অতি পরিচিত।
সিঙ্গুর।
।।২।।
তা সিংহবাহু তো সিংহপুরে রাজ্য স্থাপন করে প্রায় চারশো ক্রোশ জঙ্গল সাফ করে গ্রাম বসিয়ে রাজা হয়ে বসলেন । রাজা হল, তার রাজ্যি হল , তা রাণী থাকবে না ?
থাকবে না কেন ! নিশ্চই ছিল ! কিন্তু রানীর নামটা বলতে গিয়ে একটু হোঁচট খেতে হল । কারণ মহাবংশ বলছে রাণীর নাম সিংহসিবলী ।
সেকি ! খানিক আগে যে পড়লাম সিংহসিবলী সিংহবাহুর বোন !
এর ব্যাখা দেওয়া মুস্কিল । হতে পারে মহাবংশের তথ্য ভুল, অথবা এও হতে পারে সে সময়ের সমাজটাই অন্যরকমের ছিল । বঙ্গদেশটা আর্য সংস্কৃতির দখলে তখনো পুরোপুরি আসেনি । সুসিমার স্বাধীন ব্যবহার, পুনর্বিবাহ, অন্তত সেরকমই খানিকটা ইঙ্গিত দেয় । মিশরের ফ্যারাওদের মধ্যে ভাই-বোনে বিবাহের রেওয়াজ ছিল, এদেশেও সেওরকম কোন প্রথা ছিল কিনা সে হয়ত ভব্যিষতের গবেষণাই বলতে পারবে। আপাততঃ এই খটকাটুকু পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া যাক।
সিংহসিবলীর অনেকগুলি ছেলে হয়, এদের মধ্যে সবার বড়টির নাম বিজয়। এই বিজয় অত্যন্ত অত্যাচারী ছিলেন। শুধু নিজে একা নন, তাঁর অনেক অনুচর ছিল, তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে প্রজাদের ওপর ভয়ানক অত্যাচার করতেন।
প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে রাজা সিংহবাহুর কাছে এসে নালিশ জানালে রাজা ছেলেকে তীব্র ভর্ৎসনা করলেন । কিন্তু ভবি ভোলার নয় , বিজয়ের ব্যবহার কিছুমাত্র পাল্টালো না। এইভাবে তিন-তিনবার নালিশ আর শাসনের পরেও যখন বিজয়ের চরিত্র পাল্টানোর কোন লক্ষণ দেখা গেল না, ক্রুদ্ধ প্রজারা তখন রাজাকে বলল ‘একে মেরে ফেলুন।‘
প্রাণে না মেরে রাজা পুত্রকে নির্বাসন দিলেন। বিজয় আর তার সাতশো অনুচরের মাথা অর্ধেক মুড়িয়ে তাদের স্ত্রী ছেলেমেয়ে সমেত জাহাজে তুলে দিলেন। শুনেছি নকশাল আমলে পুলিশ মাঝে মধ্যে অনেক উঠতি বামপন্থীকে হাওড়া থেকে টিকিট কেটে বম্বের ট্রেনে তুলে দিত । এটা যে একটা বেশ প্রাচীন ট্র্যাডিশন এই বিজয়ের লাইফ হিস্ট্রি থেকে সেটা বেশ বোঝা যায়।
বিজয় জাহাজে চড়ে তো রওনা হলেন । কিন্তু সমুদ্রযাত্রার সময় ঝড়ে শিশুরা যে জাহাজে ছিল সেটা পথ হারিয়ে অন্য দিকে ছিটকে গেল, যেখানে গিয়ে পৌঁছল তার নাম নগ্গদ্বীপ । মেয়েরা অন্য একটা জাহাজে ছিল, সেটাও ঝড়ে দিকভ্রষ্ট হয়ে হাজির হল মহিলাদ্বীপে । ঝড়ে বিজয়ের জাহাজের অনেক ক্ষতি হয়েছিল, কোনমতে বিজয় জাহাজ নিয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলের সুপ্পারকে পৌঁছলেন ।
এই সুপ্পারককে চিনতে অসুবিধে হয় না । এটি সোপারা বা সোরপারক নামেও পরিচিত, একেবারে মুম্বইয়ের লাগোয়া একটি প্রাচীন বন্দর।
কিন্তু নগ্গদ্বীপ? সেটা কোথায়। দীনেশচন্দ্র একে পূর্ব উপকূলের নেগাপত্তম বলে চিহ্ণিত করলেও আর একটা ব্যাখা হতে পারে। নগ্গদ্বীপ অর্থে নগ্নের দ্বীপ বোঝায়। খুব সম্ভবতঃ এমন এক জায়গা যেখানে বস্ত্রহীন আদিম কোন জনজাতির বাস ছিল। এই বর্ণনার সাথে একমাত্র মিলতে পারে ভারতের পূর্ব সমুদ্রের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। কারণ বিজয়ের সমুদ্রযাত্রা্র বহু পরে, চোলেরাও এই দ্বীপের তামিড় নাম রেখেছিল নক্কাবরম – উলঙ্গের দেশ।
আর মহিলাদ্বীপ? খুব সম্ভবতঃ এটা আজকের মালদ্বীপ বা মাল্ডিভস।
শিশুরা আর মহিলারা আলাদা আলাদা জাহাজে যাত্রা করবে এটা খুব একটা সম্ভব বলে মনে হয় না। সুতরাং সামারি করলে যা দাঁড়ায় তা হল বিজয় বাবাজী বাপের ঘাড় ধাক্কা খেয়ে সঙ্গী সাথী নিয়ে সমুদ্র পথে ভারতের উপকূল ধরে যাত্রা আরম্ভ করলেন। মাঝপথে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য যে কোন কারণেই হোক, অভিযাত্রীদের একটা দল আরও পূবদিক যাত্রা করে এসে পৌঁছল নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে । বিজয় বাকিদের নিয়ে উপকূল বরাবর যেত যেতে কন্যাকুমারী একটা বেড় দিয়ে এবার উত্তর দিকে যেতে থাকলেন। মাঝখানে আরো একদল বিজয়কে ছেড়ে চলে গেল আরও পশ্চিমে মালদ্বীপে। বাকিদের নিয়ে উত্তরে পাড়ি দিয়ে বিজয় শেষ পর্যন্ত এসে ভিড়লেন মুম্বইয়ের কাছাকাছি সোপারার বন্দরে।
সুপ্পারকের বাসিন্দারা গোড়ার দিকে বিজয়দের ভালই খাতির যত্ন করেছিল। কিন্তু ওই যে বলে না স্বভাব যায় না ম’লে? তা বিজয়ের সাঙ্গপাঙ্গোদের সুখ কপালে সইল না। তারা মাল টেনে লোকাল পাবলিদের সঙ্গে এমন মারপিট লাগিয়ে দিল, যে তারা বলল, ‘ এ শালাদের মেরে তাড়া’।
অতএব বিজয় আবার সমুদ্রে জাহাজ ভাসালেন, যাত্রা শুরু করলেন দক্ষিণ দিকে।
।।৩।।
দক্ষিণদিকে যাত্রা করে ঝড় ঠেলে বিজয়ের জাহাজ এসে ভিড়ল শ্রীলঙ্কার উপকূলে তাম্রপর্ণীতে। বাংলার বিজয় যেদিন প্রথম শ্রীলঙ্কার মাটিতে পদার্পণ করলেন সেটি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ভারতবর্ষের অন্য এক প্রান্তে দুটি শালতরুর মাঝখানে শাক্যচূঢ়ামণি তথাগত বুদ্ধ সেদিন তাঁর নির্ব্বাণ শয্যায় শায়িত।
এর পরে অনেকটা উপকথা। বিজয়ের অনুচরেরা কুবন্না নামে এক মায়াবী যক্ষীর খপ্পরে পড়লে বিজয় তাকে হারিয়ে নিজের সঙ্গীদের মুক্ত করলেন। তারপরে তার সাহায্যে আবার যক্ষরাজ কালসেনকে তার কন্যার বিবাহের সময়ে বধ করে তার পোষাক গায়ে দিলেন।
অর্থাৎ স্থানীয় যে আদি জনগোষ্ঠী ছিল বোধহয় তাদেরই একাংশের সাহায্যে তাদের রাজাকে সমূলে ধ্বংস করে বিজয় রাজা হয়ে বসলেন। কুবন্না বিজয়ের ঘরণী হয়েছিলেন, তদের দুটি সন্তানও হয়েছিল। কিন্তু জাতে ওঠার লোভে এদেরকে খেদিয়ে দিয়ে বিজয় পাণ্ডুরাজের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন । এ ব্যাপারে সিংহ ফ্যামিলির ট্র্যাক রেকর্ড যে ভাল নয় সে আমরা আগেই দেখেছি।
বিজয়ের পিতা সিংহবাহু সিংহকে বধ করেছিলেন বলে তাঁর উপাধি হয়েছিল সিংহল। তাঁর আত্মীয়স্বজন আর অনুচরদেরও লোকে সেই নামেই ডাকত। সুতরাং বিজয়ের নতুন রাজ্যের নামও সিংহল হল।
এই বিজয়ই সিংহল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ।
মহাবংশেও এর পরেও অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে । কিন্তু কাহিনী এই পর্যন্তই থাক । এবার এ গল্পের ঐতিহাসিক সত্যতা কিছু আছে কিনা খানিক দেখি ।
সিঙ্গুর থেকে সিংহল অবধি বিজয়ের বিজয়যাত্রার উপাখ্যান বাঙালি মানসে চিরকালের জন্যে কেমন একটা দাগ রেখে গেছে । বাংলা কাব্যের কোন বণিক সমুদ্র যাত্রা করলে তাকে একবার সিংহল যেতেই হবে । তা সে চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতি সওদাগরই হোক বা তার পুত্র শ্রীমন্ত ।
আর আধুনিক কালে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যদি স্বোচ্ছাসে বলেন, ‘আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়, সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্য্যের পরিচয়’ তো দ্বিজেন্দ্রলাল বলছেন ‘একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়, একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত সাগরময়’ । এমনকি জীবনানন্দের কবিতাও ‘সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে’ ঘুরে আসতে ভোলে নি ।
আর ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে ? শ্রীলঙ্কায় ? সেখানেও বাংলার প্রতি একটা টান রয়ে গেছে । শ্রীলঙ্কায় প্রাচীন কালে ছককাটা বোর্ডের এক ধরণের খেলা ছিল, তার নাম ওলিন্দা কেলিয়া । রাজদরবারের অমাত্যরা এই খেলাতে আদিতে ঘুঁটি হিসেবে মুক্তো ব্যবহার করলেও , গ্রামের মানুষ তার জায়গায় একধরণের লাল কালো গাছের বীজ ব্যবহার করা শুরু করেন। কালক্রমে সেই গাছের নামও ওলিন্দা হয়ে দাঁড়ায় । এ গাছের ল্যাটিন নাম আব্রুস প্রেকাটোরিয়াস, আর তার লাল কালো বীজকে আমার বাংলায় চিনি কুঁচফল নামে । আর এই কুঁচ-ফল নিয়ে মধ্যযুগের সিংহলী ছড়ার গানে ছোটরা গায়,
ওলিন্দা থিবেন্নে … কোই কোইদেসে — কোথায়, কোথায় পাওয়া যায় ওলিন্দা গাছ ?
ওলিন্দা থিবেন্নে … বাঙ্গালী দেসে — ওলিন্দা গাছ পাওয়া যায় বাংলা দেশে ।
গেনাথ সাদান্নে … কোই কোইদেসে — কোথায়, কোথায় নিয়ে এসে লালন করা হয় ওলিন্দা গাছ ?
গেনাথ সাদান্নে … সিংহল দেসে – সিংহল দেশে নিয়ে এসে লালন করা হয় ওলিন্দা গাছ।
সেই বহুযুগ আগের বাংলা আর শ্রীলঙ্কার মধ্যেকার যোগসূত্রের প্রতিধ্বনি যেন এই গান।
গানের লিঙ্ক একটা দিলাম, শুনে দেখতে পারেন
অবশ্য শুধুমাত্র কুঁচফলের গান দিয়ে প্রমাণ হয় না যে বহুকাল আগে বাংলা থেকে একদল মানুষ শ্রীলঙ্কায় বসতি স্থাপন করেছিলেন । তার জন্যে দরকার আরো তথ্য ।
।।৪।।
বিজয় সিংহের কাহিনী সংক্ষেপে একদল ভাগ্যাণ্বেষীর উপনিবেশ স্থাপনের গল্প । কিন্তু এ গল্প যে সত্যি তার প্রমাণ কি ? পৌরাণিক কাহিনীতে যতই ঐতিহাসিক ঘটনার বা জায়গার উল্লেখ থাকুক , তার ওপরে সম্পূর্ণ রূপে ভরসা করা যায় না ।
সুতরাং বঙ্গদেশ থেকে এক সময়ে যে একদল মানুষ সিংহলে বসতি স্থাপন করেছিল তার সপক্ষে দু-ধরণের প্রমাণ হাজির করতে হল ।
প্রথম হল ভাষা । এক জায়গার মানুষ যদি আর এক জায়গায় গিয়ে বসবাস শুরু করে তাহলে এই দুই প্রান্তের মানুষের ভাষার মধ্যে কিছু মিল থাকা উচিৎ । দীনেশচন্দ্র বাংলা আর সিংহলী ভাষার তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে মোহম্মদ শহিদুল্লার একটি চিঠির উদ্ধৃতি দিয়েছেন । সেখানে ড: সহিদুল্লা বলছেন ‘সিংহলী ভাষার সঙ্গে অশোকের পূর্বভারতের লিপি ব্যবহৃত ভাষার ঘনিষ্ঠতম সমন্ধ দৃষ্ট হয় । ঐ ভাষা নিশ্চই রাঢ় দেশের প্রাচীন ভাষা হইতে উদ্ভূত হইয়াছে।‘
উদাহরণস্বরূপ দীনেশ্চন্দ্র সিংহলী ও বাংলা শব্দের একটি দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন । তার মধ্যে থেকে বেছে বেছে কয়েকটা দিলাম –
বাংলা – মাটি / সিংহলী – ম্যাটি
বাংলা – তেল / সিংহলী – তেল
বাংলা – লোম / সিংহলী – লোম
বাংলা – সুখ / সিংহলী – সুক
বাংলা – গাছ / সিংহলী – গাস
বাংলা – মাকড়সা / সিংহলী – মাকুলুষা
কিন্তু কিছু শব্দ এক মানেই যে বাংলার মানুষ সিংহলে গিয়েছিল তা একশোভাগ প্রমাণ হয় না । এর বিপক্ষে বলা যেতে পারে যে বাংলা আর সিংহলী দুইই হয়ত কোন পূর্বতন ভাষা থেকে তাদের শব্দভাণ্ডার ধার করেছে তাই দুটোতে একই রকমের শব্দ দেখা যাচ্ছে ।
অতএব আর একটি পূর্ণমাত্রায় বৈজ্ঞানিক প্রমাণ উপস্থিত করতে হল ।
জেনেটিক রিসার্চ ।
১৯৯৫ সালে গৌতম ক্ষত্রিয় একটি রিসার্চ পেপারে দাবি করেন যে সিংহলীদের ওপর দক্ষিণ ভারতীয় তামিলদের জিনগত প্রভাব প্রায় ৭০%, কিন্তু বাঙালীদের ২৫%।
কিন্তু ১১৯৬ সালে এস এস পাপিহা, সর্বজিত মস্তানা এবং আরো কয়েকজন মিলে তাদের রিসার্চ পেপারে এর বিরুদ্ধ মত পোষণ করে জানান, সিংহলীদের ওপর বাঙ্গালীদের জিনগত প্রভাব ৭২% । এরপর সর্বজিত মস্তানা ২০০৭ আর একটি পেপারে প্রমাণ করেন যে জিনগত ভাবে বাঙালীরা সিংহলীদের নিকটতম জাতি ।
বিতর্ক হয়ত এখানেই শেষ নয় । কিন্তু বিজয় সিংহের কাহিনীর সবকটা চরিত্রই তো বিতর্কিত । বঙ্গদেশে জন্মালেও তাদের মানসিকতা বাঙালীর মতন নয় ।
সত্যি বলতে কি প্রাচীন ভারতের চেনা চরিত্রগুলোর সাথে সুসিমা, সিংহবাহু, বিজয়, এদের ব্যাক্তিকেন্দ্রিকতা, নৈতিক চ্যুতি, ঝুঁকি নেবার দুঃসাহসিক প্রবণতা, কিছুই মেলে না। মেলে বরঞ্চ খানিকটা গ্রীক পুরাণের নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে ।
তার নানা ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে সমুদ্র বিজয়ী বিজয় সিংহ যেন বাঙালীর ইউলিসিস ।
সূত্র : দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ / The Mahavamsa, tr. Wilhelm Geiger / Somasiri Devendra, Mariners, Merchants, Monks : Sri Lanka and the Eastern Seas/ Wikipedia /