গাছে জল দিচ্ছে গদাধর। ওর গা থেকে মাটির গন্ধ আসছে। কাদার গন্ধ আসছে। বাকা বহালে উগাল জাবট দিলে এরকম হত। স্মৃতিপথে সেই পুরোনো দিনের হাওয়া ফিরে আসছে নাকে। কেমন সুন্দর অদ্ভুত মাদক সৌরভ। সোঁদা সোঁদা গন্ধে ভরে যাচ্ছে চারপাশ। বাতাসে উৎসব। একটা নীল প্রজাপতি উড়ছে। ডানায় আকাশের ছবি। একমনে জল দিয়ে যাচ্ছে গদাধর। নিজের খেয়ালে। ভালোবাসা মাখিয়ে দিচ্ছে গাছপালায়।মুখার্জি সাহেব ডাকলেন -গদাধর।
-আজ্ঞে বলুন।
-তোমার গা থেকে একটা সুন্দর গন্ধ আসছে, মাটি মাটি। গ্রামের গন্ধ।
-কি যে বলেন সাব, গায়ে ঘাম ঘাম গন্ধ। জামাটা কাচা হয় নাই চারদিন। শরমে মরে যায় গদাধর।
-অবিকল মাটির গন্ধ।
-ফুলের মহক হবেক।
-না তো। ফুলের গন্ধ আমি চিনি। তোমার গা থেকেই গন্ধ আসছে।
গদাধর উত্তর দেয়না। নীরবতার আবর্তে ভরে নেয় নিজেকে। কাজে মন দেয়। মগ্ন হয়ে পড়ে তৃষাতুর গাছগুলির প্রতি মমতায়। সুবীর মুখার্জী দেখেন কী অসম্ভব মায়া লোকটার মধ্যে । গাছ নয় যেন সন্তান পালন করছে সে।
-তোমার গ্রাম কোথায়?
-সি আপনি চিনবেন নাই।
-বল-ই না।
-ছিরুগড়্যা।
-ছিরুগড়্যা, আরে তুমি তো আমার গাঁয়ের লোক গদাধর। গদাধর হাঁ করে তাকায়। তার চোখে বিস্ময় ভরা আকাশ।
-তুমি মদনডির নাম শুনেছ? আমার গ্রাম। ছিরুগড়্যার পাশেই। মাথা নাড়ে গদাধর। মদন ডি। লাল মাটির রাস্তা চলে গেছে। খেজুর আর তালবনের সারি পেরিয়ে এক ছোট নদী। চোত বোশেখে হাঁটু জলের ও আকাল। হেঁটে গেলে তিন বিড়ির পথ। গদাধর হিসেব করে।
সুবীর মুখার্জী মনে মনে ভাবেন, “নিজের এলাকার নিজের জেলার নিজের মাটির বোধ হয় এক রকম আলাদা গন্ধ থাকে। নইলে আমি গদাধর কে চিনলাম কি করে।’’
-তুমি ঘরবাড়ি করেছ গাঁয়ে? যেতে ইচ্ছে করে না?
খুব ইচ্ছা করে কিন্তুক উপায় নাই। দিনকাল খারাপ।
-কেন?
কাগজে পড়েন নাই গাঁয়ে ইখন বদ লকজনদের কাজ কারবার।
-পড়ি। কিন্তু কাগজে পড়া আর মুখ থেকে শোনা তো এক নয়।
-গাঁ মানে মা। তা কে ছাইড়্যে কি থাকা যায়। ঘর যাই কিন্তুক রাইত থাইকতে লারি। বম পিস্তলের আওয়াজ। পুলিশের ভয়ে ডরে লিশট হইয়ে দিন কাটে। কখন কাকে পুলিশে ধইরবেক ঠিক নাই। পাটির জুলুম, চাঁদা। তোলা বাজি। এই যে পইসা জমাই জমি জিরেত কিনি, গরু বাছুর কিনি। আমার উপরে জুলুম কি কম?
গদাধরের গল্প মন দিয়ে শুনতে থাকেন মুখার্জি সাহেব। তাঁর বাগানে মালির কাজ করে গদাধর। মাটি খুঁড়ে সুন্দর সুন্দর সব ফুলের গাছ লাগায়। আর তখন ই অদ্ভুত মনকেমন গ্রাম্য চেনা গন্ধে ভরে যায় বাগান। পরিচিত গন্ধ, মাটির মহক। সুবীর মুখার্জী এবং স্বাতী মুখার্জী। স্বামী স্ত্রী দুজনই ব্যস্ত । অবসরের পর মুখার্জী সাহেব নিজে একটি কনসালটেন্সি ফার্ম চালান। মুখার্জী অ্যাসোসিয়েটস। স্বাতী মুখার্জী ব্যস্ত আইনজীবী। বিকেলের এই সময়টি তাদের গল্পের জন্য নির্দিষ্ট। একটিই মাত্র ছেলে। সায়ন। ব্যস্ত ইঞ্জিনিয়ার। কর্পোরেট জগতের সাফল্যের এস্কালেটার বেয়ে তর তর করে উপরে ওঠার স্বপ্নে মশগুল। মাটি থেকে সে এখন অনেক অনেক উপরে। যেখান থেকে দুনিয়া কে ছোট দেখায়। মানুষ গুলো কে বামনের মত মনে হয়। অহংকারী ডানায় শকুন উড়তে থাকে আকাশে। ছোটবেলায় হোস্টেল থেকে পড়াশোনা করতে করতে বাড়ি নিয়ে আবেগ কম। বাবা মা অসুস্থ হলেও দেখতে আসার সময় হয় না। একমাত্র নাতির ছবি ফেসবুকের দৌলতে দেখেছেন কয়েকবার। অন্নপ্রাশনের সময় ও যাওয়া হয়নি। ক্যালিফোর্নিয়া কোথায় মানচিত্র হাতড়ে খুঁজতে থাকেন মুখার্জি সাহেব।
তাঁদের ব্যস্তজীবনের মাঝে গদাধর এক নতুন গন্ধ বয়ে নিয়ে আসে। এক আলাদা ছবি। সবুজ প্রান্তর।নীল আকাশ। শান্ত পুকুর আর মেঠো রাস্তার ছবি। যেখানে মাছরাঙা ঝুপ করে এসে বসে জলের উপর। চিল উড়ে যায়। দু একটা চড়াই কিচ কিচ শব্দ তুলে লাফিয়ে পালায়। তোমার বউকে একদিন নিয়ে এসো গদাধর। দেশের মানুষ দেখলে প্রান জুড়োয়।
আইনব সাব। গদাধর বউ নিয়ে একদিন আসে। ওর গায়েও মাটির গন্ধ। শালুকফুল ফুটে থাকা দিঘির মত সুন্দর চোখ, আনত, নম্র। ঝর্নাজলের স্রোত। প্রণাম করে মুখার্জী সাহেব কে। মেমসাহেবকে। মিসেস মুখার্জি খুব খুশি হয়ে ওঠেন তাকে দেখে
-তোমার নাম কী?
-আলতা ।
-বাঃ! দারুণ সুন্দর নাম। এক রক্তিমাভা ছড়িয়ে যায় ওর মুখে। গদাধর দেখে।
-কি করো তুমি?
-আগে খেতিবাড়ির কাজ কইরতম খুব। ইখন ত গাঁ ঘরে যাত্যে লারি। বুড়ার বাপই মঝে মধে যায়। ইখেনে দশঘরের রান্না করি। যা পাই ছিলার লিখাপড়ার খরচা বাদে হাতে আর কিছুই থাকেনা। ছিলা একদিন বড় হবেক, ঢের বড়। তখন আর দুখ থাইকবেক নাই বাবু। এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে যায় আলতা।
মুখার্জী সাহেব দেখেন বাগান ঘিরে এক বেলাশেষের অন্ধকার নেমে আসছে। তার ভাবনায় হানা দেয় অতীত। না খেয়ে কেমন ক্যাকলাশের পারা চেহারা করেছিস। মা চেঁচিয়ে উঠত হোস্টেল থেকে ফিরলেই। তারপর শুরু হত যত্ন আত্তি। কালো রঙের দুধেলা গাইটা দুয়ে দুধ আনত প্রায় এক সের। গরম করে সন্ধ্যেয় বলত- পুরোটা খা।
-এত কি খাওয়া যায়?
-কেন যাবে না, এই তো খাবার সময়। ঘরে এত এত খাবার। ধান চাল, পুকুরের মাছ। কত ফল সবজি। ছেলে কি না ক্যাকলাশ ছা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন।
-পড়ার খুব চাপ মা? রাত জাগতে হয়।
-কি করবি অত পড়ে? অত রাত জেগে? তোর ঘরে কি খাবার অভাব?
-মায়ের এই কথার কোন উত্তর হয় না। আলতার দিকে তাকিয়ে থাকেন মুখার্জী সাহেব, অবিকল মায়ের মত! চোখ আর মুখে মায়ের সেই অমলিন অভিব্যক্তি।
২
বাড়িতে উৎসব এখন। সায়ন আসবে রবিবার। মুখার্জী সাহেব বলেন, কদিন কাজ বন্ধ থাকুক গদাধর। সায়নের এই মাটি মাটি গন্ধটা ঠিক পছন্দ নয়। ওর বমি পায়। তোমাকে এই কদিনের জন্য আমি ছুটি দিলাম। পারলে ছেলের থেকে ঘুরে এসো। তোমার ভাল লাগবে।
-আমি ছিলার কাছে নাই যাব সাব।
-তবে?
-গাঁও যাব।
-সেখানে তো দস্যুর ভয়।
-হোক। তবু মাটির মহক তো বুকের ভিতরে খেইলবেক। ডাকাইতের ডরে গাঁ ছাইড়তে লাইরব। শিকড় উপড়াইতে লাইরব্য।
অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে গধাধর। তার চোখের পাতা বন্ধ হয় না। এই গরমে গাছ গুলো জল বেঘোরে মরে যাবে। সবুজ ভাবটা হলুদ আস্তরনে মলিন হয়ে পড়বে। সে গাছের পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ফুলের কুঁড়ি গুলো আলতো স্পর্শ করে। এক অব্যক্ত কান্নায় ভরে ওঠে তার ঠোঁট। সে জলে ভরিয়ে দেয় গাছগুলোকে। তরা দমতক খাইয়ে লে আইজ। গাছেদের ফুলে ও পাতায় বিষাদময়তা। ফুলের সমারোহের ভেতর এক নিস্তেজ অবসন্নতা।
এই টাকাগুলো রাখ, গদাধর। তোমার কাজে লাগবে।
গদাধর হাত বাড়ায় না। চুপ করে থাকে। তার কান্না পায়। সে তার নিজের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত মোচড় অনুভব করে। তার মন ভিজে সুটরু। চোখে রো পড়ে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা, চুপি চুপি পালিয়ে যায়। সায়নের আসার খবরে তোলপাড় বাড়িতে। ঘরের ময়লা পরিস্কার করে সুন্দর সাজানো হয়েছে বাড়িটা। নতুন রঙের বর্নময়তায় অদ্ভুত আকর্সনিয় লাগছে চারপাশে। মাটি মাটি গন্ধটা মুছে গেছে। এক সংজ্ঞাতীত আর্বান ফ্লেভারে তোলপাড় চারদিক। মিসেস মুখার্জী উতসাহ নিয়ে বসে আছেন। ছেলে আসবে কাল। জন্মের পর থেকে নাতিকে দেখাই হয়নি কতকাল। কত বড় হয়েছে বাচ্চাটা। বাংলা বলতে পারেনা। ঠাম্মা বলে কি ডাকতে পারবে? মা-বাবা বলতে শিখেছে কি? প্রশ্নের পর প্রশ্ন সাজিয়ে তৈরি হয় তার সকাল।
বাগানের দিকে আর আসার সময় হয়না মুখার্জী সাহেবের। ঘরের মধ্যে বিদেশি টাচ আনার আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জানলার দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারেন বেলা অনেকটাই হয়েছে। বাইরের রোদ্দুর আজ বেশ চড়া। দূরের আমগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। একটা টুনটুনি পাখির বাসা দুলছে হাওয়ায়। বাচ্চা দুটোকে খাবার খাওয়াচ্ছে তার মা। বেশ মজা লাগে এই দৃশ্যের মধ্যে। মনে হয় মা যেন খাবার খাওয়াচ্ছে তাদের দু ভাইবোনকে।
-ওগো, শুনছো।
স্বাতীর কাতরতায় এই ভাবনার ভেতর দৃশ্যটি ভেঙ্গে যায়। এলোমেলো বিপন্ন চিন্তার মধ্যে ছেঁড়া বাস্তব
-বল।
-সায়ন অনলাইন আছে। তুমি কথা বলবে?
-আ তুমিই বল না।
-সায়ন বলছে ও রবিবার দিন আসতে পারছে না। খুব কাজের চাপ। পূজাতে সবাইকে নিয়ে আসবে।
-ওকে বল , আমরা ভাল আছি।
মিস্টার মুখার্জী তাকিয়ে থাকেন পাখিটার দিকে। বড় অদ্ভুত এই দৃশ্যবলয়। মা ঠিক এভাবেই খাইয়ে দিত। ঠিক এইভাবে। বাচ্চাটা একদিন আকাশে উড়ে যাবে। উড়তে উড়তে অনেকদূর। তখন আর এই বাসার কথা মনে পড়বে না তার। এই খড়কুটো আর মায়ের মমতানির্মিত এই ছোট্ট ঘর। একটুও মাটির গন্ধ কি লেগে নেই ঐ স্নেহ নীড়ে? সুবীর মুখার্জী কিছুই বুঝতে পারেন না।
-আমার ভালো লাগছে না স্বাতী। তুমিই কথা বল। একটু বাগানে বসি। স্বাতী ল্যাপটপ বন্ধ করেন। চল দুজনেই বসি। কতদিন কথা বলা হয়নি প্রাণ ভরে।
হ্যাঁ। চল।
বাগানের মাটি মাটি গন্ধটা আজ আর নাকে আসছে না। জোরে শ্বাস নিলেন সুবীর মুখার্জী। কেমন এক অদ্ভুত কৃত্রিম গন্ধ। স্বাতী বলল, তোমাকে অনেকদিন ধরে বলব বলব ভাবছি। বলা হয়নি।
সংকোচ কিসের?
-বলই না।
-মদনডি যাবে একদিন। খুব মন কেমন করে।
-আমার গোপন কথা তুমি জানলে কি করে?
এতদিন সংসার করছি, তোমার মনের কথা জানব না! হো হো করে ফুসফুস ভরা হাসি হেসে ওঠেন সুবীর মুখার্জী। কতদিন তিনি এভাবে হাসেন নি।
মদনডি!
এক মাটির গন্ধ নিয়ে ফিরে আসে। সেই কাদামাখা আলপথের ভেতর এক বৃষ্টি মুখর স্মৃতির রাস্তা। গন্ধটা ফিরে আসছে আবার – স্বাতী তোমার গায়েও আমি কাদার গন্ধ পাচ্ছি এবার, তুমি পাচ্ছো না? স্বাতী জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকেন। এক অভূতপূর্ব গন্ধ। মন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এর নাম মাটির মহক। এই গন্ধ ছাড়া মানুষের বাঁধন খুব আলগা।
কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
জন্ম ১৯৭২, পুরুলিয়ায়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ এক ডজন। পেয়েছেন ত্রিবৃত্ত পুরস্কার মালীবুড়ো সন্মান সহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সন্মাননা। কেতকী পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত।