| 20 এপ্রিল 2024
Categories
সময়ের ডায়েরি

স্বয়ং ব্রহ্মা জানতেন না। এবার জানুন দয়া করে।

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট


হ্যাঁ, প্রজাপিতা ব্রহ্মাও জানেন মেয়েদের চেপে রাখা, চেপে দেওয়ার গোপন তত্বটি। আবহমানকাল ধরে সেটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের লেগাসি মশাই। পান থেকে চুন খসে যাবে তবুও ব্রহ্মা অনড়।

আমাদের আড়িয়াদহের বাড়ি ছিল রক্ষণশীল। দাদুর গঙ্গাস্নানে গিয়ে বারেবারে পায়ে ঠেকতে থাকা শিবলিঙ্গ মাথায় করে এনে নিত্য ফুল-বেলপাতা-জল আর বাতাসা দিয়ে পুজো এখনো হয় দুবেলা। ঐ সার্ধশতবছরের ধাতব শিব এখন আমার বাবা-মায়ের কাছে। সেই সূত্র ধরেই ছোটোবেলা থেকেই আমাদের বাড়ির মেয়েরা শিবপুজো ও অন্যান্য পুজোয় সামিল হয়েছি সেই ছোট্টবেলা থেকেই। এ আমার সংস্কার। এ আমার অহংকার। একে আমার লালন করতেও মন্দ লাগেনা। দক্ষিণ কলকতার শ্বশুরবাড়িতে পুজোআচ্চা বড় একটা দেখিনি। ষষ্ঠী, বারব্রত তে গায়ে উপোস আর পয়সা তুলে রাখা ছাড়া। “ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মোটি” দেখতে দেখতে এসব খুব মনে পড়ছে কাল থেকে। পৈতে কেন পরব না, আমারো মনে হত বৈকি । পরে জেনেছি নবদুর্গার ব্রাহ্মণী রূপে আর সরস্বতী পুজোয় দেবীরাও উপবীত পরেন বৈকি। বাড়িতে মা অনেক ট্যাবু ভেঙেছিলেন। রোজ আমি বা মা কেবল সন্ধ্যে জ্বেলে শাঁখ বাজাব কেন? তাই ভাই আর বাবাও প্রক্সি দিত। বাড়ির প্রথম মেয়ে আমার জাঠতুতো দিদির প্রথম অসবর্ণ বিয়ে হল। বিয়ের পরে অষ্টমঙ্গলায় এসে দিদি বলেছিল আমি তো শিবঠাকুর ছোঁবনা, আমার তো ব্রাহ্মণত্ব ঘুচেছে। মা বলেছিল, আলবাত জল দিয়ে ছুঁয়ে পুজো করবি তুই। বাড়িতে সরস্বতী পুজো বা শিবরাত্রির পুজো বাবার সঙ্গে সমান তালে মাকে করতে দেখেছি। মন্ত্র বলে আমাদেরো পুজো করাতে শিখিয়েছে মা। শাঁখা-পলা আমাদের ঘটিবাড়িতে ঠাকুমাও পরতেন না। সিঁদুরও অতি সামান্য। তবে কেউ পরলে বাধা দেয়নি। এই যেমন আমার ভালো লাগে লোহা পরে থাকতে, একটু সিঁদুর ছোঁয়াতে সেটা আমার বিশ্বাস। সেটাও আমার সংস্কারের মধ্যেই পড়ে। তাই বলে কেউ না পরলে আমিও জোর করে চাপাতে রাজী ন‌ই। আমার আশেপাশের মানুষকে খুশি করাই নয়, আমারো ভালো লাগে। তবে আমি অত আড়ম্বরে পুজোআচ্চা করিনি কোনোদিনো। যতটুকুনি না হলে নয়। আর ঐ পাঁজির পুরুত? তাদের মৌলবাদ বা ফতোয়া জারি করা, এটা হবে না, ওটা করতে নেই, এসবকে আমিও এক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দি চিরকাল। সেইসঙ্গে বিজ্ঞান আমাকে অনেক যুক্তি দেয় এবং দিয়ে চলে। এই যেমন বাসিকাপড় ছেড়ে রান্না ঘরে ঢোকা। সেটার একটা হাইজিনের অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি। তাই বলে ভোরবেলায় স্নান করেই ঠাকুরঘরে বা রান্নাঘরে ঢুকতে হবে, তাই আবার একজন মেয়েকে সেটা আমার নাপসন্দ। গায়ত্রী মন্ত্র বা ওম্‌ কেন মেয়েরা উচ্চারণ করবেনা? সেটা নিয়েও আমার সঙ্গে তুমুল হয়েছে বাবার সঙ্গে এক আধবার। সত্যি‌ই তো পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এসব ক্ষমতা নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত করে রেখে দেবে আজন্মকাল? মেয়েরাই আজন্মকাল পুজো গোছাবে, ভোগ রাঁধবে, বাড়বে অথচ প্রধান পুজোটা করবে একজন পুরুষ পুরোহিত? সেই সঙ্গে বিয়ের সময় পিঁড়ি করে মেয়ে কে ঘোরানো বা কন্যা সম্প্রদান কে বড়োই অহেতুক বলে মনে হয়েছে আমারো।
গতবছর আমর ঋতুমতী পুত্রবধূকে কালীমন্দিরে প্রবেশ করিয়েছি আমি ও আমার কর্তা দুজনে মিলে। সে নিজে অবাক হয়েছে। সে নিজে মানেনা কিন্তু সোজা একেবারে মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকতে আপত্তি করছিল, ভাবছিল হয়ত তার নতুন শ্বশুর শাশুড়ি কি ভাববে। কিন্তু আমরাই বলেছি, আয় তুই। তখন তার চোখ চিকচিক করে উঠেছে। এত লিবারাল তার আধুনিক শ্বশুর শাশুড়ি?
আমিও বলেছি সেদিন তাকে, এই পুরুত গুলোই তো অম্বুবাচীতে কামাখ্যায় যজ্ঞ করে আসে না? যত্ত জ্বালা তাদের রক্তমাংসের মেয়েদের নিয়ে? তাই বলে শবরীমালা প্রসঙ্গ কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য। খ্রিষ্টানদের হাত থেকে একটা হিন্দু মন্দির কে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় এত সরব তারা। এমনিতেই দক্ষিণে পুজোটুজোয়, আচার বিচারে আমাদের এক কাঠি ওপরে সেখানে আর এক শ্রেণীর মানুষরা সেই পিরিয়ডস নিয়েই এত সোচ্চার ।সেখানে আবার রাজনৈতিক কারণও আছে অতএব সিনেমায় এই প্রসঙ্গটি না এলেও পারত। আরেকটা ছোট্ট ভুল। ঊমা কে হোয়াটস্যাপ পাঠিয়েছিল শবরী। কিন্তু ঊমা এসে বলল, এসেমেস পেয়েছে। এছাড়া সুপার ফ্ল পেলুম না। সত্যি বলছি ভালো লেগেছে ছবিটি। আমাদের সবার প্রিয় কবি সম্রাজ্ঞীর সংলাপ, ঋতাভরীর চমৎকার অভিনয় এর জন্যই ১০০ তে ৮০ দিলাম। অতিকথনে দুষ্ট নয়, প্যানপ্যানে প্রেম নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হল মেয়েদের উত্তরণের গল্পটি। বাঙালিদের জীবনে মেয়েদের তুলে আনার জন্য যিনি এই কাজটির পুরোধায় সেই গৌরী ধর্মপাল কে আবারো শ্রদ্ধা। খুঁটিনাটি সব বলে দিয়েছে ছবির চিত্রনাট্য। সবাইকে দেখে আসার অনুরোধ জানাই। মেয়েদের পৌরোহিত্য এর জয়জয়াকার হোক। কন্যা সম্প্রদান, লগ্নভ্রষ্টা, পুজোর তিথি এসবের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে এগিয়ে চলুক তাদের ধ্বজা উড়িয়ে।
সব শত্রুমুখে ছাই দিয়ে ব্রহ্মাদের আবহমানকালের লেগাসি কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিন মেয়েরা, মায়েরা, ঘরের ঝি বৌরা। ধর্ম ভীরু হবেন না দোহাই। ধর্ম প্রাণ হয়ে উঠুন। মানবিকতাই হোক আসল ধর্ম। সবার ওপরে মানুষ সত্য। অতএব লিঙ্গ বৈষম্য আর নয়!
স্বয়ং ব্রহ্মা জানতেন না। এবার জানুন দয়া করে। দিন আগত ঐ!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত