| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সময়ের ডায়েরি

পদসঞ্চার (পর্ব-১০)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

১ এপ্রিল । বুধবার । রাত ১ টা ৩০

অনেক রাত। চারদিক নিস্তব্ধ। আগের লেখাটা ১২-৪৫ এ শেষ করেছি। আরতি বলছিল শুয়ে পড়তে। কিন্তু ঘুম আসছে না। এমনিতে আমি নিশাচর। স্বাস্থ্যের সাধারণ নিয়ম নাকি এটা নয়। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া, আর ভোর ভোর ওঠাই নাকি নিয়ম। কিন্তু ডাঃ অশোক ঘোষ একটা বই খুলে একবার আমাকে সেটা দেখিয়ে বলেছিলেন প্রচলিত কথাটা ঠিক নয়। শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়। অশোকবাবুও অনেক রাতে ঘুমোন, বেশ বেলা করে ওঠেন।

রাত একটা বেজে গেল, আমার কোন ক্লান্তি বোধ হচ্ছে না। ঘুমে ঢুলেও আসছে না চোখ। আসলে মানুষের মারণযজ্ঞের ইতিহাসটা আমাকে বড় উত্তেজিত করে তুলেছে। বিংশ শতাব্দী থেকে জীবাণু অস্ত্র নিয়ে কয়েকটি দেশ যে রকম খেলা শুরু করেছে, তার বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। লেখার একটা খসড়াও করে ফেলেছি। আজ না লিখলে পরে এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। আমি পানাসক্ত। আরতিকে লুকিয়ে বাটা থেকে একটা পান নিয়ে তাতে চার কুচো সুপুরি আর একটু দোক্তা দিয়ে মুখে পুরলাম। পিক না ফেলে ঘিটে ফেলতে একটা ঘোরমতো লাগল। চেয়ারে বসে সামনের রাস্তার দিকে তাকালাম। হঠাৎ মনে হল অসংখ্য করোনা ভাইরাস যেন নাচছে, আর বলছে : কেমন দিলাম, কেমন দিচ্ছি, হাঃ হাঃ হাঃ….।

দোক্তা মদ নয়। তার নেশা বেশিক্ষণ থাকে না। ধাতস্থ হতে নিজের বোকামিতে খুব হাসি পেল। করোনা ভাইরাসকে চোখে দেখব কি করে! তাছাড়া সে তো জীবন্ত কোন সত্তা নয়। ভাইরাস সত্যি বড় বিচিত্র। জীবিত না হয়েও তারা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে টিকে থাকার কৌশল আয়ত্ত করেছে। করোনা স্পাইকি প্রোটিন শেল দিয়ে আবৃত কিছু জেনেটিক পদার্থ মাত্র। আমাদের নাক বা মুখ দিয়ে অলক্ষিতে ঢুকে পড়ে সে আমাদের কোন অতিথিপরায়ণ কোষকে আশ্রয় করে। তারপরে শুরু হয় তার লীলাখেলা।

মানুষও তো খেলতে চেয়েছে  এইসব ভাইরাস নিয়ে। এদের নিয়ে সে তৈরি করেছে মারাত্মক সব জৈব অস্ত্র, শত্রুকে জব্দ করার জন্য। জৈব অস্ত্র আর রাসায়নিক অস্ত্র। ১৯১৪ সালে ফরাসিরা ২৬ এম এম ইথেল ব্রোমোসিটেট-এর গ্রেনেড ব্যবহার করে। এটি তীব্র গন্ধযুক্ত মারাত্মক গ্যাস। জার্মানি ব্যবহার করে ১৯ সি এমের ইথেল ব্রোমোসিটেট। ব্যবহৃত হয় ব্রোমাইন নাম টিয়ার গ্যাস।

প্রথম যে মারাত্মক জৈব অস্ত্র ব্যবহৃত হয় তার নাম ক্লোরাইন। এর স্বল্প প্রয়োগে চোখজ্বালা, কাশি, বমি হয় ; অধিক প্রয়োগে মৃত্যু অনিবার্য । জার্মানি এর প্রয়োগ করে প্রথম, তবে ব্যুমেরাং হয়ে তাদের নিজেদেরই মৃত্যু ঘটায়। এরপরে ব্যবহৃত হয় ফসজিন ও ডিপোসজিন। ফুসফুসকে অকেজো করে দেয় এরা। ব্যবহৃত হয় মাস্টার্ড গ্যাস, যা শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করতে পারে। তবে কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি যে প্যাথোজিন ব্যবহার করেছিল তা মানব হত্যার জন্য নয় । তাদের শত্রু ছিল মিত্রশক্তি ও তাদের সাহায্যকারী আর্জেন্টিনা, রোমানিয়া, নরওয়ে, স্পেন। এদের শস্য ও প্রাণী হত্যা করে হাতে না মেরে ভাতে মারতে চেয়েছিল জার্মানি। শত্রুদেশের প্রাণী হত্যার জন্য তারা আ্যনথ্রাক্স ও  গ্ল্যান্ডার্স জীবাণু ছড়িয়ে দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে  জৈব অস্ত্র প্রয়োগে মৃত্যুর হার ছিল মাত্র ১% । কিন্তু বোঝা গিয়েছিল যে এই অস্ত্র কমখরচে তৈরি করা যায়, এবং মারাত্মক কার্যকরী।

প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ১৯২৫ সালে জেনিভা প্রোটকলে নিষিদ্ধ হয় জৈব অস্ত্রের প্রয়োগ –‘ Asphyxiating , poisonous or other gases  and  of  all  analogous  liquids,  materials,  or devices  and  bacteriological   methods  of  warfare’ .

জৈব অস্ত্র প্রয়োগের ব্যাপারটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল জাপান, জার্মানি নয়। চিন বিজয়ে কাজে লাগিয়েছিল জৈব অস্ত্র। শোনা যায় ১৯৩৯ সালে জাপান নিউইয়র্কের রকফেলার ইন্সটিটুট থেকে ইয়েলো ফিভারের ভাইরাস হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল। জাপানের জৈব অস্ত্রের গবেষণার ক্ষেত্রে শিরো ইসহির [১৮৯২-১৯৫৯]  নাম উল্লেখযোগ্য। ইনি মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ইউনিট ৭৩১ এর পরিচালক। ১৯৩০ সালে টোকিও আর্মি মেডিকেল স্কুলে ইনি শুরু করেন গবেষণা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইনি জাপানের জৈব অস্ত্র কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন। এই বিষয়ে গবেষণার জন্য ২৬ টি কেন্দ্র স্থাপিত হয়, প্রায় ৫ হাজের কর্মী কাজ করেন সেখানে। শিরো ইসহি ছিলেন মাঞ্চুকুয়োর ইউনিট ৭৩১ এর দায়িত্বে। জাপানে যেসব যুদ্ধবন্দি ছিলেন তাঁদের উপর ২৫ রকম রোগের জীবাণু নিয়ে পরীক্ষা হয়। ফলে ১০ হাজার বন্দি মারা যায়। যুদ্ধ শুরু হলে চিনের ১০০০ কুয়োতে কলেরা ও টাইফাস রোগের জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরোপ্লেন থেকে শহরে ছড়ানো হয় প্লেগ রোগের জীবাণু। ফলে চিনে মহামারী দেখা যায়। মারা যা্য হাজার হাজার লোক। জাপান ভয় দেখায় রাশিয়াকেও।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট শক্তির পরাজয় ঘটে। রাশিয়া জাপানের জৈব অস্ত্রের গবেযকদের – বিশেষ করে শিরো ইসহি ও তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী মাসাজি কিটানোকে শাস্তি দিতে চায়। আমারিকা হয়ে ওঠে ক্ষমার অবতার । জৈব অস্ত্র বিষয়ে জ্ঞান বিনিময় করবে- এই শর্তে আমেরিকা তাদের শাস্তি মকুব করে। শিরো ইসহি প্রমুখ যুদ্ধাপরাধীরা আশ্রয় গ্রহণ করেন আমেরিকায়। সেখানে সম্মানীয় নাগরিকের মর্যাদায় লালিত-পালিত হন। মানুষের উপর নানা জৈব অস্ত্রের প্রয়োগ বিষয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন মাসাজি কিটানো।

আমেরিকায় জৈব অস্ত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করেন স্যার ফ্রেডারিক ব্যান্টিং [১৮৯১-১৯৪১]। ইনি কানাডার অধিবাসী। পড়াশুনো করেন টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে । ১৯২৩ সালে ইনসুলিন আবিষ্কারের জন্য জন জেমস রিচার্ড ম্যাকলয়েডের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ব্যান্টিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির জীবাণু অস্ত্রের সম্ভাব্য প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যান্টিং বৃটিশ সরকারে কাছে এ ধরনের গবেষণাগারের অনুমতি প্রার্থনা করেন । তিনি টিটেনাস, গ্যাস গ্যাংরিন, প্যারোট ফিভার, আ্যনথ্রাক্স এসব রোগের জীবাণু তৈরি করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার প্রস্তাব দেন। ১৯৪০ সালে তিনি উত্তর আমেরিকায় চালু করেন ব্যক্তিগত গবেষণাগার । আমারিকায় সরকারিভাবে জৈব অস্ত্রের গবেষণা শুরু হয় ১৯৪১ সালে। জৈব অস্ত্র তৈরি করে মানুষ ও প্রাণীর উপর প্রয়োগ করে দেখা হয়। জাহাজ থেকে যে ব্যাক্টিরিয়া ছড়ানো হয় তা ভার্জিনিয়া ও সানফ্রান্সিকো উপকূলের ১০ লক্ষ মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। বাস স্টেশন ও বিমান বন্দরসহ ২০০টি শহরে   bacterial  aerosols ছড়ানো হয়। একটা বড় শহরে প্যাথোজেনের বিস্তৃতি পরীক্ষার জন্য ১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কে ছড়ানো হয় bacillus  globigii .ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে, জনমতের চাপে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন জৈব অস্ত্রের গবেষণা বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ১৯৭২ সালে  Biological and Toxin  Weapon Convention [BTWC] চুক্তিতে সই করেন । জেনিভা প্রোটোকলে জৈব অস্ত্রের প্রয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, আর বি টি ডব্লু শি-র কনভেনশনে জৈব অস্ত্রের গবেষণাও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল : “  The development, stockpiling, acquisition, retention and production  of—-

  1. biological agents and toxin of types and in quantities that have no justification for prophylactic, protective or other peaceful purposes.
  2. weapons, equipments and delivery vehicles designed to use such agents or toxins for hostile purposes or  in  armed  ”

জার্মানরা জৈব অস্ত্রের প্রয়োগ করতে পারে এই ভয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের চাপে আমেরিকা জৈব অস্ত্রের গবেষণা শুরু করে। কিন্তু হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক ম্যাথিউ মেসেলসনের নিরলস প্রচেষ্টায় আমেরিকায় জৈব অস্ত্রের কর্মসূচি বন্ধ হয়। তিনি জৈব অস্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার শুরু করেন, বিজ্ঞানীদের কাছে আবেদন পাঠান, আবেদন পাঠান রাজনৈতিক নেতাদের কাছে। বায়োলজিকাল উয়েপনস কনভেনশন ইমপ্লিমেন্ট সাপোর্ট ইউনিটের প্রধান ড্যানিয়েল ফিকস মেসেলসনের অবদান স্বীকার করে লিখেছেন : ‘ Through  his  work  in  the  US  and   internationally  ,  Matt.  Meselson  was  one  of  the  key  forefathers   of  the  1972  Biological  Weapons   Convention .  The  treaty  bans  biological  weapons  and  today  has  182  member  states .   He  has  continued   to  be  a guardian  of  the  BWC  ever  since .’

কিন্তু বি টি ডব্লু সি-তে সই করা সত্ত্বেও রাশিয়া সংগোপনে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জৈব অস্ত্র তৈরি করে যাচ্ছিল নিরবচ্ছিন্নভাবে। সেইজন্যই তৈরি হয়েছিল ‘বায়োপ্রিপারেট’। দেশে তার ১৮ টি ইউনিট ছিল। কাজ করতেন ৬০ হাজার কর্মী। প্লেগের মতো মারাত্মক ব্যাক্টিরিয়া ও স্মল পক্সের মতো মারাত্মক ভাইরাস নিয়ে কাজ হচ্ছিল সেখানে। ১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে রাশিয়া পরিত্যাগ করে এক বৈজ্ঞানিক চলে আসেন ইংল্যান্ডে। তাঁর নাম ড. ভ্লাদিমির পাশোচিঙ্কি। তিনি বায়োপ্রিপারেটের কর্মকান্ড ফাঁস করে দেন। তিনি জানান রাশিয়া এমন জৈব অস্ত্র তৈরি করেছিল, যা প্রতিরোধ করার শক্তি পাশ্চাত্য জগতের ছিল না। তাঁর মতে রাশিয়ার ছিল :

  1. Had genetically  engineered   bacteria   and   viruses,
  2. Weaponized the  microbes  in  a powder  form,
  3. Loaded them  onto  various  munitions,
  4. Integrated BW   into  their  doctrine  and half  specific   plans  for  use  of 

১৯৯২ সালে আর একজন বিজ্ঞানী রাশিয়া ত্যাগ করে চলে আসেন ইংল্যান্ডে। তাঁর পুরো নাম জানা যায়নি। ‘টেম্পল ফরচুন’- এই সাংকেতিক নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। তিনি পাশেচিঙ্কের বক্তব্য সমর্থন করেন। প্লেগ জীবাণু নিয়ে গবেষণার কথা বলেন।

১৯৯২ সালের শেষদিকে ড. কানাজাটজান আলিবেকভ রাশিয়া ত্যাগ করেন। তিনি বায়োপ্রিপারেট-এর সহ-পরিচালক ছিলেন। তিনি বলেন ১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ জৈব অস্ত্রের কর্মচূচিকে গতিবেগ দান করার জন্য ‘এনজাইম’ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আলিবেকভ প্রথম দিকে ‘টুলারেমিয়া বোম্বলেটে’র কাজে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর মতে, ‘ By  1992  the  Russian  possessed a grand  total  of  52  different  biological  agents  or   combination  of  agents,  including   deadly   Marburg,   Ebola  and  Small  Pox  viruses,  that could  be  weaponized’ .  তারা এক ভাইরাসের জিন অন্য ভাইরাসের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে এক নতুন ভয়ংকর ভাইরাস সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। ভাইরোলজিস্ট  নিকোলাই উস্তিনভ মারবার্গ ভাইরাস নিজের শরীরে ইনজেক্ট করে মারা যান। তাঁর সহকর্মীরা জৈব অস্ত্রের অন্ধ সমর্থকদের কথায় উৎসাহিত হয়ে উস্তিনভের শরিঋ থেকে ভাইরাসটি বের করেন। তাঁরা লক্ষ্য করেন মিউটেশনের ফলে ভাইরাসটি আরও ভয়ংকর হয়ে   উঠেছে। পরবর্তীকালে রাশিয়ায় জৈব অস্ত্রের গবেষণা বন্ধ হয়েছে, কিন্তু সঞ্চিত জীবাণুগুলি কি অবস্থায় আছে কেউ জানে না।

চিন, তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইস্রায়েল, ইরাক, ইরান প্রভৃতি দেশেও গোপনে জৈব অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বলে জানা যায়। সন্ত্রাসবাদীরাও জৈব অস্ত্র ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছে।

 

 

[ক্রমশ]

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত