| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সময়ের ডায়েরি

পদসঞ্চার (পর্ব-৪)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

২৬ মার্চ । বৃহস্পতিবার

লকডাউন চলছে । ব্যস্ত কলকাতা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে । পর্ণশ্রী বাজারের কাছে কিছু মানুষ কেনাকাটার জন্য ঘুরছেন । হাতেগোনা মানুষ । রাস্তার দুপাশের গুমটিগুলো বন্ধ । যেন কার্ফু হয়েছে । আরও অনেকদিন কাটাতে হবে এভাবে । কাল রাত আটটা নাগাদ বেরিয়েছিলাম ওষুধ কেনার জন্য । রাস্তায় আলো আছে কিন্তু লোক নেই । ভুতুড়ে শহর যেন ।

আরতি মেতে আছে ছাদের বাগান নিয়ে । খুবই আশাবাদী, প্রত্যয়দীপ্ত মানুষ । সংকটের কল্পনাতে ম্রিয়মান হতে নিষেধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । রবীন্দ্রনাথ না পড়েও আরতি সেই বাণীতে উদ্বুদ্ধ । দুপুরে কথা হচ্ছিল দুষ্টুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে । ওদের গারমেন্ট ফ্যাক্টরি বন্ধ । ১৫/২০ লক্ষ টাকার পোশাক তৈরি করেছিল । পয়লা বৈশাখের জন্য । উঠেওছিল বাজার । করোনা থামিয়ে দিল । নোটবন্দি আর জি এস টিতে মার খেয়েও মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছিল । করোনা নামিয়ে দিল মাথা । কি করবে এখন ! দু-চার মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও খাদ্যবস্তু না কিনে লোকে কাপড় কিনবে কেন ! এদিকে বাড়িভাড়া দিতে হবে, দিতে হবে ব্যাঙ্কের ই এম আই ।

আরতি বলল, ‘সংকট তো শুধু আমাদের ছেলে-মেয়ের নয় । তবু তো ওদের মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে, যাদের তা নেই ভাবো তো তাদের কথা ! আবার না হয় নতুন করে বাঁচার লড়াই শুরু করব আমরা, হতাশ হয়ে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না ।’

হতাশ না হয়ে, ঘরের কোণে মুখ লুকিয়ে বসে না থেকে আরতি মেতে আছে তার গাছ নিয়ে । লেবু, বেগুন, সিম, কারিপাতা, নানা ধরনের শাক তুলে আনছে ছাদের বাগান থেকে । বেগরখালের বাগান থেকে নিয়ে আসছে কলা, পেয়ারা, খামালু- এসব । বেশ চলে যাচ্ছে আমাদের । মাঝে মাঝে তনুদের, নবদের দিয়েও আসছে । ছেলে-মেয়ে এসব রাসায়নিক সারহীন টাটকা জিনিস খেতে পারছে না, এই তার আপশোশ।

আজ ভোরে ছাদে গিয়েছিল আরতি । সেখান থেকে ডাকল আমাকে । দেখলাম টি্য়াপাখি এসেছে, উড়ছে কয়েকটা শালিখ । নির্মল নীল আকাশের তলায় গাছপালার আসল রূপ খুলেছে । পাতায় একটুকু ধুলোর আস্তরণ নেই । গাঢ় সবুজ । পৃথিবী যেন তার বহুকালের আগের জীবনে ফিরে গেছে । করোনা মানুষের জন্য আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে বটে, কিন্তু প্রকৃতিকে দূষণমুক্ত করে দিয়ে গেছে ।

অদৃশ্য করোনা ভাইরাসকে আজ দৃশ্যমান করেছেন আমাদের পুনের বিজ্ঞানীরা । ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি ইমেজিং পদ্ধতির সাহায্যে করোনার ছবি তুলেছেন তাঁরা । এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিকেল রিসার্চ’এ ।

গত ৩০ জানুয়ারি চিনের উহান থেকে কেরলে ফিরে এসেছিল এক মেডিকেল পড়ুয়া । সে ছোকরা স্থান পেল ইতিহাসে । কেননা সে ভারতে প্রথম করোনা আক্রান্ত মানুষ । সেই পড়ুয়ার লালারসে পাওয়া ভাইরাসের ছবি তুলেছেন বিজ্ঞানীরা । তাঁরা বলেছেন এই নোভেল করোনাভাইরাস বা সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সঙ্গে মিল রয়েছে আগের দুটি ভাইরাসের । প্রথমটি হল সার্স-কোভ ভাইরাস ; ২০০২সালে সিভিয়ার রেসপিরেটরি সিড্রোমের জন্য যে দায়ী । আর দ্বিতীয়টি হল মার্স-কোভ ভাইরাস ; এটি ২০১২ সালে পশ্চিম এশিয়ায় মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা মার্সের জন্য দায়ী । কিন্তু শুধু ছবি তুলে তো হবে না । বুঝতে হবে তার চরিত্র । তা না হলে প্রতিষেধক আবিষ্কারও হবে না ।

দেখতে দেখতে সারা পৃথিবীতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৬ লক্ষ ছাপিয়ে গেল । মৃত্যুর সংখ্যা ২৭ হাজার। আমেরিকায় হাওয়ার গতিতে ছুটছে করোনা । আক্রান্তের সংখ্যা ১ লক্ষ ২৪ হাজার, মৃত্যু ২ হাজার ; স্পেনে একদিনেই ৮৩৮ জন আক্রান্ত ; ইতালিতে মৃত্যু ছাড়ি্যেছে ১০ হাজার । আজ একদিনে ভারতে মৃত্যু হল ৭ জনের । বৃটিশ অর্থনীতিবিদ জিম ওনেইল বলেছেন, ‘ভগবানকে ধন্যবাদ, করোনা ভারতের মতো কোন দেশে প্রথম দেখা দেয় নি । চিন যে সামাল দিতে পেরেছে, ভারত বা তার প্রতিবেশী দেশ সেরকম সামাল দিতে পারত না ।’ এ কথায় আমাদের কর্তাদের গোঁসা হলেও কিছু করার নেই । নানা দিক থেকে চিন এখন দারুণ সমৃদ্ধ । আমারিকার প্রতিস্পর্ধী । প্রথমে ঠাট্টা-মশকরা করলেও ডোনাল্ড ট্র্যাম্প এখন চিনের সাহায্যপ্রত্যাশী । করোনার বিরুদ্ধে চিনের লড়াইএর অভিজ্ঞতা তিনি কাজে লাগাতে ইচ্ছুক ।

আমাদের ঘরে টিভি স্তব্ধ । কেবল লাইনের ছেলেটি টাকা-পয়সা নিয়ে গণ্ডগোল করছিল । আরতি রেগে কানেকশন কাটিয়ে দিতে বলেছে । খুব যে টিভি আমরা দেখতাম তা নয় । তবু এ সময় খবর-টবর দেখা যেত । সিরিয়ালের মতো খবরও অবশ্য একঘঁয়ে । ইন্টারনেট আর ফোন না থাকলে অবশ্য খুব অসুবিধে হত । স্মার্টফোনে ভিডিও কল করা যায় । ছেলে-মেয়ে, জামাই-বৌমাকে ভিডিও কল করে দেখতে পাই। আরতির মা স্বর্ণময়ীর বয়েস ৯০ ছাড়িয়ে গেছে । লকডাউন ব্যাপারটা প্রথমে বুঝতে পারে নি । বাদলপুরের মতো  গ্রামেও লকডাউন মেনেছে মানুষ । রাস্তা-ঘাটে লোকজন নেই । অল্পবয়েসী দুচারজন ছেলে একজায়গায় জড়ো হলে পুলিশ তাড়া করছে । দোকানপাট সকালের দিকে ঘন্টা দুয়েক খোলা থাকে মাত্র । এসব দেখে সন্দেহ হল স্বর্ণময়ীর । জানতে চাইল ছেলের কাছে । লকডাউন ব্যাপারটা বুঝতে পারবে না বলে সুবল জানাল দেশে একরকম অসুখ এসেছে । এক মানুষ থেকে আর এক মানুষের অসুখ হচ্ছে । শুনে স্বর্ণময়ীর ভয় হল । মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনীর সঙ্গে আর বোধহয় দেখা হবে । তাই কান্নাকাটি শুরু করল । তখন সুবল ডেকে আনল গোরা বা অংশুমানকে । স্মার্টফোন আছে তার । ভিডিও কল করে আমাদের ছবি দেখল স্বর্ণময়ী । কানে শুনতে পায় না । কিন্তু ছবি দেখে আশ্বস্ত হল । বিজ্ঞানের অবদান এই ফোন, এই ইন্টারনেট । কিন্তু মারণাস্ত্রও যে বিজ্ঞানের অবদান ! সেই অবদানের জোরে ধেড়ে খোকারা দেশ ও মানুষকে ভেঙে টুকরো করছে ।

এপর্যন্ত লেখার পরে একটা মেসেজ এল ফোনে । ফরওয়ার্ড করেছেন অনুপ ধর । অনুপবাবু ‘নিউজ বাংলা’ ও ‘সংবাদনজর’ নামক দুটি পত্রিকার  সম্পাদক ছিলেন । আমার অনেক লেখা প্রকাশ করেছেন । আমার

খুব ভালো বন্ধু । মেসেজটা দেখে চমকে গেলাম । মেসেজে বলা হয়েছে করোনার প্রভাবে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কথা ।  হোটেল, রেস্তোরাঁ বন্ধ,  বন্ধ ফাস্ট ফুডের দোকান । খেতে হচ্ছে ঘরের রান্না । সবজি প্রচুর পাওয়া যাচ্ছে । কিন্তু তেল-ঘি বাড়ন্ত । তাই রান্না-বান্না তেলে-ঝালে হচ্ছে না । এরকম খাদ্যে শরীর খারাপ হবার উপায় নেই । হচ্ছেও না শরীর খারাপ । হাসপাতালে করোনার ভিড় হলেও সাধারণ শরীর খারাপ নিয়ে কেউ যাচ্ছে না ডাক্তারের কাছে । শ্মশানঘাটের সমীক্ষা করে মেসেজপ্রেরক বলেছেন সেখানে মৃতদেহের ভিড় তুলনামূলকভাবে অনেক কম । মানুষের চিকিৎসার ভার নিয়েছে প্রকৃতি । সেই প্রকৃতি, সভ্যতার গর্বে আমরা যার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি ।

মেসেজে বলা হয়েছে গান্ধিজির কথা । ‘হিন্দ স্বরাজ’ বইতে তিনি বলেছিলেন হাসপাতাল বাড়ছে বলেই বাড়ছে রোগ । আপাতদৃষ্টিতে এই বক্তব্যকে বিজ্ঞানবিরোধী বলে মনে হবে । কিন্তু একথা তো সত্যি যে অর্থের প্রলোভনে অনেক ডাক্তার সাধারণ ব্যাধিকে অসাধারণ করে তোলেন । পেনকিলার আর আ্যন্টিবায়োটিক আমরা মুড়ি-মুড়কির মতো গলাধঃকরণ করি । এভাবে নষ্ট করি শরীরে সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতা । সেই প্রতিরোধক্ষমতাকে গলা টিপে শেষ করে দেয় ফাস্ট ফুড আর হোটেলের স্পাইসি খাবার ।

করোনা আমাদের সেই খাদ্যাভ্যাসকে আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে । এটা তার আশীর্বাদের দিক । কিন্তু খাদ্যাভ্যাসের এই পরির্বন কি বজায় থাকবে ?

দেবিকা চক্রবর্তী বলেছেন করোনা আমাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন আনবে পাঁচরকমভাবে :

ক. আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ৩২% ভাগ হোটেলে- রেস্টুর‍্যান্টে খেতে ভালোবাসে । করোনার আবির্ভাবে বন্ধ হবে সে অভ্যাস । বাধ্য হবে ঘরে তৈরি খাবার খেতে । এতে হোটেল ব্যবসার উপর অবশ্য দারুণ আঘাত আসবে ।ন্যাশনাল রেস্টুর‍্যান্ট আ্যসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া বলছে, ‘ One  of  the  sectors  worst  affected  by  covid-19  will be   food   services,  estimated   at   Rs.  4,23, 865 crore  in  India,  and  employing  more  than  700,000 people . ‘

খ. মানুষ স্বাস্থ্যগুণসম্পন্ন  খাবার খাবে ।

গ.  অস্বাস্থ্যকর খাবার কেনা ও খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হবে মানুষ ।

ঘ.  ভয় পাবে  বিদেশি খাবার খেতে ।

ঙ. দেশজ খাবার খেতে বাধ্য হবে । এক এক দেশের ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু অনুসারে গড়ে ওঠে খাদ্যাভ্যাস, কিন্তু আমরা সেটা ভুলে বিশ্বনাগরিক হবার কিংবা ময়ূরপুচ্ছধারী কাক হবার চেষ্টা করি ।

আমাদের দেশের এমন কিছু  ফল-পাকড় আছে যাদের ভাইরাসকে প্রতিহত করার কিছু শক্তি আছে । করোনার

প্রভাবে সেদিকে দৃষ্টি পড়বে মানুষের । যেমন :

ক. রসুন—এর মধ্যে আ্যালিসিন আছে, তা ভাইরাসকে প্রতিহত করে ।

খ. দারচিনি—এটি রক্তচাপ যেমন কমায়, তেমনি ভাইরাসকে প্রতিহত করে ।

গ.  লস্সি—এতে যে প্রোবিওটিক আছে তাতে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ কমে ।

ঘ. যষ্ঠিমধু—প্রাচীনকাল থেকে চিনে ভাইরাসপ্রতিরোধক হিসেবে এর ব্যবহার হয়ে আসছে ।

 

 

[ক্রমশ]

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত