পদসঞ্চার (পর্ব-৮)
২৯ মার্চ । রবিবার
সকালে মামনি চলে গেল। হাঁটতে হাঁটতে যাবে। মামনির সাহস আর দৃঢ়তা এক লাফে অনেকটা বেড়ে গেছে। সন্দীপনের আকস্মিক অসুখ যেন আমূল বদলে দিয়েছে তাকে। হাসপাতালে তার লড়াই দেখেছি। মুখ বুজে বণ্ডের পর বণ্ড সই করে যাচ্ছে, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছে, ঝিলিকের পরামর্শ নিচ্ছে, শ্বশুর-শাশুড়িকে সামলাচ্ছে। আশা দিতে পারেননি ডাক্তার, তবু সে ভেঙে পড়েনি। বুঝতে দেয়নি আমাদের। একেবারে আক্ষরিক অর্থে যমের সঙ্গে যুদ্ধ। জিতেছে শেয পর্যন্ত। তার ফলে বেড়ে গেছে আত্মবিশ্বাস।
তা না হলে করোনার আতঙ্কে সে সন্ত্রস্ত থাকতো। এতটা পথ একা একা হেঁটে হেঁটে আসতে সাহস করত না। যে কোন বিপদে মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখাটাই আসল কথা। আমার কেন জানি মনে হয়, করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলি ঠিক ভূমিকা পালন করছে না। আজই দেখলাম একটি সংবাদপত্রে শিরোনাম ‘সাবধান’। বড় বড় করে লেখা। এই শিরোনাম কি বার্তা দেবে সাধারণ মানুষকে? অভয় দেবে,না, আরও সন্ত্রস্ত করে তুলবে!
মামনি চলে যাবার পরে আরতি রান্না ঘরে ঢুকল। আমি বসলাম কম্পিউটারে।
করোনা ভাইরাসের গতিবিধির ছবিটা দেখে নেব।
আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে ছবি। এতদিন করোনার ভরকেন্দ্র ছিল চিন। সঠিক বললে চিনের হুবেই প্রদেশের উহান ও সংলগ্ন অঞ্চল। আজ করোনার ভরকেন্দ্র কিন্তু ইউরোপ আর আমেরিকা। আজকের হিসেবে চিনে আক্রান্ত ৮২৩৪১+১২৩ আর মৃত্যু ৩৩০৬ +৫। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলি যেমন রিপাবলিক অফ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, ফিলিপিনসে করোনা ঢুকেছে বটে, এখনও তেমন সুবিধে করতে পারে নি।
ইউরোপের অবস্থা কিন্তু ভয়াবহ। আক্রান্ত + নতুন আক্রান্ত এবং মৃত্যু + নতুন মৃত্যুর সংখ্যা এই রকম :
ইতালি = ৯২৪৭২ + ৫৯৭৪ । ১০০২৩ + ৮৮৭
স্পেন = ৭২২৪৮ + ৮১৮৯ । ৫৬৯০ + ৮৩২
জার্মানি = ৫২৫৪৭ + ৩৯৬৫ । ৩৮৯ + ৬৪
ফ্রান্স = ৩৭১৪৫ + ৪৬০৩ । ২৩১১ + ৩১৯
ইংল্যান্ড = ১৭০৯৩ + ২৫৪৬ । ১০১৯ + ২৬০
সুইজারল্যান্ড = ১৩১৫২ + ১০৪৮ । ২৩৫ + ৩৮
এইসব দেশের সঙ্গে আছে নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, পর্তুগাল, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, রোমানিয়া প্রভৃতি দেশ। করোনা সেসব দেশে ঢুকেছে, তবে গতি তার এখনও মন্থর।
করোনার ভরকেন্দ্র আমেরিকাও। গতি দেখে মনে হচ্ছে অনতিবিলম্বে সে ইউরোপকে ছাড়িয়ে যাবে। আমেরিকায় আক্রান্ত ১০৩৩২১, নতুন আক্রান্ত ১৮০৯৩। মৃত্যু ১৬৬৮ +৪২৫। এর পরে আছে :
কানাডা = ৪৭৪৫ + ৭৩৯ । ৫৫ + ১৬
ব্রাজিল = ৩৪১৭ + ৫০২ । ৯২ + ১৫
চিলি = ১৯০৯ + ২৯৯ । ৬ + ১
ইকোয়েডর = ১৮১৩ + ২২৮ । ৪৮ + ১২
পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ইরানে সংক্রমণ তীব্র। সেখানে আক্রান্ত ৩৫৪০৮, নতুন আক্রান্ত ৩০৭৬ , মৃত্যু ২৫১৭ + ১৩৯। পাকিস্তানে আক্রান্ত ১৫২৬, মৃত্যু ১৩ +৪। সৌদি আরবে আক্রান্ত ১২০৩ + ৯৯, মৃত্যু ৪ +১।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যে চারটি দেশে করোনা পা রেখে দাঁড়াতে পেরেছে :
থাইল্যান্ড = ১৩৮৮ + ২৫২ । ৭ + ২
ইন্দোনেশিয়া = ১১৫৫ + ১০৯ । ১০২ + ১৫
ভারত = ৯৭৯ + ২৫৫ । ২৫ + ৮
বাংলাদেশ = ৪৮ + ০ । ৫ + ০
কবিতাদি ফোন করেছিলেন আরতিকে। একটা মর্মান্তিক ঘটনা শোনালেন। তাঁর বাড়ির উল্টোদিকে এক ভদ্রমহিলা কাল রাতে হঠাৎ মারা গেছেন। আরতি চিনতে পারল তাঁকে। কবিতাদির বাড়িতে দেখেছে সেই মহিলাকে। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। হাসিখুশি। স্বামী অন্য কোন রাজ্যে আটকে পড়েছেন। মেয়েকে নিয়ে আছেন তিনি। কাল মাঝরাতে বাথরুমে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান তিনি। মেয়ে চিৎকার করে। পাড়ার লোক জানালায় উঁকি মারলেও কেউ দরজা খুলে বাইরে আসেননি। কবিতাদি দরজা খুলে বেরিয়ে ছিলেন। সচেতন প্রতিবেশীরা তাঁকে অগ্রসর হতে দেননি। কি জানি, হয়তো সেই মহিলা করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। অরুণোদয় ক্লাবের আ্যম্বুলেন্সে তাঁর মেয়ে তাঁকে বিদ্যাসাগর হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতাল তাঁকে মৃত ঘোযণা করে। করোনা নয়, ম্যাসিভ হার্ত আ্যাটাকে মারা গেছেন ভদ্র মহিলা।
কবিতাদি দুঃখ করে বলছিলেন, ‘এই ভদ্রমহিলা পড়ার সকলের আপদে-বিপদে ছুটে যেতেন। অধচ তাঁর বিপদে কেউ এগিয়ে গেল না। হয়তো সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেলে বেঁচে যেতে পারতেন।করোনার আতঙ্কে এমন কাবু হবে আছে মানুষ!’
কেন, আতঙ্ক কেন!
আতঙ্ক কেন মানুষের! মানুষ না বিশ্বজয়ী! প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে সে বিশ্বজয় করেছে! জলে-স্থলে-আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে তার বিজয় পতাকা! একের পর এক ধ্বাস করে গেছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে প্রবলভাবে বিঘ্নিত করে গেছে।
আফ্রিকার জাম্বিয়ার রাজধানী লিসাকার দক্ষিণে মাইল সাতেক দূরে আছে চমৎকার একটি চিড়িয়াখানা। তার নাম মুণ্ডা ওয়াঙ্গা। যার অর্থ : আমার বাগান। এই চিড়িয়াখানায় ৪৫ প্রজাতির প্রাণী আর ১০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। নানা খাঁচায় নানা প্রাণী দেখতে দেখতে দর্শক শেষ খাঁচাটির কাছে এসে দেখে সে খাঁচা শূন্য। কোন প্রাণী সেখানে নেই। সেখানে আছে একটি বিরাট আয়না, তার পাশে একটি লিপি। লিপিতে লেখা ‘ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী’। আয়নাব দর্শক নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে। বুঝতে পারে লিপিটির আসল অর্থ। বুঝতে পারে, পৃথিবীর ভয়ংকর প্রাণী হল মানুষ। অন্ত্যহীন চাহিদার তাগিদে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষ মেতেছে নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলায়।
এই ধ্বংসলীলায় প্রথমে আসে গাছ ও বন। যেদিন থেকে কুড়ুল আবিষ্কার হয়েছে, সেদিন থেকে শুরু হয়েছে গাছ ও বন কাটা। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের আগে ৩ ট্রিলিয়ন গাছ ছিল। আজ আছে তার ৪৫% ভাগ মাত্র গাচ ও বন কাটার তাগিদ বেড়েছে শিল্প-বিপ্লবের পর। বিংশ শতাব্দী থেকে এ পর্যন্ত ১০০ লক্ষ স্কোয়ার কিলোমিটার বন কেটে ফেলা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের মতে ১৯৯০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ১০ লক্ষ স্কোয়ার কিলোমিটার বন কাটা হয়েছে। ‘গার্ডিয়ানে’র মতে প্রতি সেকেণ্ডে একটা ফুটবল খেলার আয়তনের সমান আয়তন বন ধ্বংস করা হয়। বহু শত প্রজাতির উদ্ভিদ নষ্ট করে দিয়েছে মানুষ।
নিজেকে শ্রেষ্ঠ জীব বলে মনে করে মানুষ। নিজের অধিকারের ব্যাপারে খুব সচেতন। তাই তার কাছে অন্য প্রাণীর জীবনের মূল্য নেই। এই তো কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলজাত জলসংকটের জন্য ১০ লক্ষ উট কে গুলি করে মারা হল। পৃথিবীটা যে শুধু মানুষের জন্য নয়, এ কথা জেনেও না জানার ভান করে। ‘জার্নাল সায়েন্স’ পত্রিকার এক প্রবন্ধে রচেল ফেল্টম্যান মানুষকে সবচেয়ে বড় শিকারী প্রাণী বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে অন্যান্য মাংসাশী প্রাণী যে শিকার করে, মানুষ করে তার তিন গুণ। লন্ডনের জুলজিকাল সোসাইটির বিজ্ঞানীদের মতে গত ৪০ বছর মানুষ জল ও স্থলের অর্ধেক প্রাণী হত্যা করেছে। মাংস মানুষের খাদ্য তালিকার অন্যতম উপকরণ। খাদ্যের জন্য প্রতিদিন মানুষ ২০০০লক্ষ প্রাণীকে হত্যা করে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্য বছরে ১০০০লক্ষ ইঁদুর, বেড়াল, মাছ, বাঁদর, পাখি প্রভৃতি হত্যা করা হয়। এছাড়া আছে মজা ও অবসরে বিনোদনের জন্য প্রাণী হত্যা। আগের দিনে রাজা-মহারাজারা শিকার করতান। একালে ট্রফি জেতার জন্য অয়োজন করা হয় শিকারের। এর জন্য বছরে ৭০ হাজার প্রাণীকে আত্মদান করতে হয়।
শুধু মানবেতর প্রাণী নয়, মানুষ শিকার করে মানুষকেও। স্বার্থসাধনের জন্য সভ্যতার শুরু থেকে যুদ্ধ করে আসছে মানুষ ল এই সব যুদ্ধে কত মানুষ নিহত হয়েছে, তার তালিকা নির্ণয় অসম্ভব। বিংশ শতাব্দী থেকে সে তালিকা মোটামুটি পাওয়া যায় । প্রথম বিশ্বমহাযুদ্ধে নিহত = ৮৫২৮৮৩১, আহত= ২১১৮৯১৫৪। দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধে নিহত ও আহতের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। নিহত ৭-৮ কোটি, আহত ৮-১০ কোটি। আ্যটম বোমায় হিরোসিমায় ৯০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার, নাগাসাকিতে ৬০ থেকে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। হিটলার হত্যা করেন ৬০ লক্ষ ইহুদি, স্ট্যালিনের আমলে নিহত হয় প্রায় সমান সংখ্যক মানুষ। এ ছাড়াও আছে দেশে দেশে যুদ্ধ ও বিপ্লবে নিহত হয়েছে বহু মানুষ। গ্রিসের গৃহযুদ্ধে ১ লক্ষ ৫০ হাজার, হাঙ্গেরির বিপ্লবে ৩ হাজার, কোরিয়ার যুদ্ধে ২- ৩ লক্ষ, চিনের গৃহযুদ্ধে ৩-৬ লক্ষ, গুয়াতেমালার গৃহযুদ্ধে ২ লক্ষ, কিউবার বিপ্লবে ৫ হাজার, কঙ্গোর বিদ্রোহে ১ লক্ষ, ভিয়েতনামের যুদ্ধে ৯ লক্ষ ৬০ হাজার, ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যায় ৪-৩০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে। ধর্মের জন্যও যুদ্ধ করেছে মানুষ। ম্যাথিউ হোয়াইটের মতে ক্রুশেড বা ধর্মযুদ্ধে ২০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
এর মূল্য মানুষকে চুকিয়ে দিতে হবে। তাই যাঁরা করোনা ভাইরাসকে প্রকৃতির প্রতিশোধ বলছেন, তাঁরা ভুল বলছেন না।
[ক্রমশ]
গবেষক
অনেক সুন্দর হয়েছে লেখাটি। পড়ে অনেক ভাল লাগল। এমন গল্প আরও জানতে চাই। এমন নতুন নতুন গল্প মানুষকে ইন্সপায়ার করবে।