পদসঞ্চার (পর্ব-৯)
আজ মামনির জন্মদিন। ফোনে-ফোনে শুভেচ্ছা জানানো হল। দুষ্টু-স্মিতাও শুভেচ্ছা জানালো। করোনা আমাদের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। তবু বায়না ধরেছিল মামনি। এখানে আসবার। আমরা নিষেধ করেছি। আনন্দ এখানে থাকলে তার রিক্সায় যাবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু দেশে গিয়ে আটকে পড়েছে আনন্দ। সেদিন ফোন করে আফসোস করছিল। এখানে থাকলে তবু দু-পয়সা আয় হত।
মামনি ফোনে বলল, ‘বাবা, সেদিন তোমাকে করোনা ভাইরাস নিয়ে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের কথা বলছিলাম না! আসলে ব্যাপারটা জীবাণু যুদ্ধের প্রস্তুতি কিনা সেটাই প্রশ্ন। জীবাণু যুদ্ধের একটা বিবরণ লেখো না! তাহলে তোমারও সময় কাটবে, আর সেটাই আমার জন্মদিনের উপহার হবে।’
আমি বললাম, ‘তোর সঙ্গে সেদিন আলোচনার পরে আমি বইপত্র আর নেট ঘেঁটে অনেক তথ্য জোগাড় করেছি। কিন্তু আমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র নই, তাই কোথায় কি ভুল হয়ে যাবে বলে সংকোচ আছে।’
মামনি ফোনের অপর প্রান্তে হেসে উঠল। বলল, ‘লিখবে তো আমার জন্য। আমিও বিজ্ঞানে বিজ্ঞ নই এমন কিছু। মোটামুটিভাবে জীবাণুযুদ্ধের একটা পরিচিতি দরকার। সে তুমি পারবে।’
তাই আজ রাতে আমি জীবাণুযুদ্ধের ছোট একটা ইতিহাস লিখছি। লিখতে লিখতে শিউরেও উঠছি। লুই পাস্তুরের ছবিটা বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। মানুষের মঙ্গলের জন্য যিনি জীবাণু বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করলেন, গড়ে তুললেন মাইক্রোবায়োলজির ভিত্তিভূমি; সেই জীবাণু বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো হল মানব ধ্বংসের অস্ত্র হিসেবে। তার নাম হল বায়ো ওয়্যার বা জীবাণুযুদ্ধ।
তবে জীবাণু বিজ্ঞানের জন্মের অনেক আগে থেকেই জীবাণুকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে মানুষ। তবে তখন সে অস্ত্র ছিল স্থূল। খ্রিস্ট পুর্ব ৪০৪ সাল। গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস লিখেছেন তাঁর নাটক ‘ফিলোসিটেটস’। সে নাটকের নায়ক ফিলোসিটেটস ট্রোজান যুদ্ধে যাবার পথে আহত হলেন বিষাক্ত তিরের আঘাতে। এ কাহিনির নিশ্চয়ই একটা বাস্তব ভিত্তি আছে। শত্রুকে জব্দ করার জন্য সেকালে তিরে মাখানো হত বিষ। গ্রিক toxikon থেকে এসেছে ইংরেজি শব্দ poison বা বিষ। গ্রিক toxon শব্দের অর্থ হল তির। toxon থেকে এসেছে toxikon .
গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডটাস ( খ্রিঃ পূঃ ৫ম শতক) বলেন ব্ল্যাক সি-র সাইথিয়ানরা বিষ মাখানো তিরের ব্যবহার জানত। তারা বিষধর সাপের পচাগলা দেহের সঙ্গে মানুষের রক্ত ওমল মিশিয়ে একটা পাত্রে ভরে রেখে দিত মাটির তলায়। এতে জন্মাত গ্যাংগ্রিন ও টিটেনাসের ব্যাক্টিরিয়া। এই বিষ মানুষের শরীরে ঢুকে তার রক্তের কোষ, স্নায়ু ও শ্বাসযন্ত্রকে আক্রমণ করত।
পিলোপনেশিয়ান যুদ্ধের সময় স্পার্টানরা এথেন্সের নগর রাষ্ট্র অবরোধ করে। ঐতিহাসিক থুসিডাইডিস (খ্রিঃ পূঃ ৪৩১) লিখেছিলেন স্পার্টানরা এথেন্সের জলাধারে একধরনের বিষ মেশায়। ফলে প্লেগের মহামারী দেখা দেয়। এই প্লেগকে বর্তমানের কোন কোন বিশেষজ্ঞ ইবোলা প্লেগ বলেছেন, যার ভাইরাস আফ্রিকার সবুজ বাঁদর থেকে এসেছিল।
হ্যানিবল ছিলেন কার্থেজীয় সৈন্যবাহিনীর নায়ক। তাঁর জাহাজে থাকত বিষধর সাপে পূর্ণ কাচের জার। শত্রুদের জাহাজ কাছাকাছি এলে সেই জার তাদের জাহাজে ছুঁড়ে দেওয়া হত। জার ভেঙে যাওয়ায় বেরিয়ে পড়ত সাপ। তাদের কামড়ে প্রাণ যেত শত্রুদের। তাঁর যুদ্ধের হাতিগুলোও শত্রুদের সন্ত্রস্ত করত। যেমন ৫৪৮ খ্রিঃ পূর্বে পার্সিয়ার রাজা উট ব্যবহার করে রাজা ক্রোয়েসাসকে পরাজিত করেছিলেন। ক্রোয়েসাসের ঘোড়াগুলো অপরিচিত উটের গন্ধে ও দৃশ্যে সন্ত্রস্ত হয়েছিল।
১১৫৫ সালে ইতালির টরটোনার জলাধারে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন শত্রুদের জব্দ করার জন্য। আজকের ইউক্রেনের ফিওদোশিয়া হল সেকালের কাফা। সেই কাফার নগর প্রাচীরের উপর প্লেগ আক্রান্তদের মৃতদেহ রেখে দিয়েছিল তাতাররা।১৩৪৬ সালে। ফলে কাফার অধিবাসীরা আক্রান্ত হল প্লেগে। জেনোয়ার যে সব ব্যবসায়ী ক্রিমিয়া বন্দরে বাণিজ্য করতে আসত, তারা এই রোগ বহন করে নিয়ে যায় ইউরোপে। ১৩৪৭সালে ইতালি থেকে প্লেগ গেল স্পেন ও ফ্রান্সে। ১৩৫০ সালে সেখান থেকে স্ক্যান্ডিনেভিয়া, প্যারিস, লন্ডন। জনসাধারণের মনে এই মহামারীর কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা জানলে চমৎকৃত হতে হয়। বর্তমানের করোনা আক্রান্ত মানুষের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে তার প্রতিক্রিয়ার কিছুটা মিল পাওয়া যাবে। প্রথমত, কিছু মানুষ মনে করে মরতে যখন হবে, তখন হৈ-হুল্লোড় করে, জীবনকে ভোগ করে মরাই ভালো। দ্বিতীয়ত, কিছু মানুষ মনে করে এটা মানুষের পাপের জন্য ঈশ্বরের শাস্তি। তৃতীয়ত, বহু মানুষ মনে করে এর জন্য দায়ী ইহুদিরা, তাই তাদের ধ্বংস করা ভালো।
১৪৯৫ সাল। স্পেনের শত্রু ছিল ফ্রান্স, ইতালি, নেপলস। শত্রদের জব্দ করার জন্য মদের সঙ্গে কুষ্ঠরোগীর রক্ত মিশিয়ে সরবরাহ করা হয়। ১৬৫০ সালে দেখা যায় পোল্যান্ডের লোকেরা শত্রুদের জব্দ করার জন্য তাদের দিকে পাগলা কুকুরের থুতু ছিটিয়ে দিত। ফলে তাদের মধ্যে জলাতঙ্ক রোগ দেখা দিত। প্লেগ রোগীর মৃতদেহ সুইডিশদের মধ্যে কৌশলে বিতরণ করে রাশিয়ানরা। ১৭৬৩ সালে বৃটেনে স্মল পক্স দেখা দেয়। তারা রোগীদের কম্বল না পুড়িয়ে জমা করে। ওহিও-র নেটিভ আমেরিকানদের সেই কম্বল বিতরণ করেন ক্যাপ্টেন ইকুয়ার। যে ইংরেজ মানবধ্বংসের আয়োজন করেছিল, সেই ইংরেজদের একজন চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার ১৭৯৬ সালে আবিষ্কার করলেন স্মল পক্সের টিকা। অস্ত্র হিসেবে রোগজীবাণুকে প্রয়োগ করার এরকম আরও দৃষ্টান্ত মধ্যযুগে আছে। তবে সেগুলি ছিল খুব স্থূল প্রয়োগ।
এরপরে এল উনিশ শতক। জীবাণু বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হল দৃঢ় ভিত্তির উপরে। জীববিদ্যার সাফল্য এল ফসলনাশক কীট ও শিল্প-রসায়নের চর্চা থেকে। এলেন লুই পাস্তুর। বীয়র বা ভিনিগার কেন নষ্ট হয়, তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাস্তুর দেখলেন এর জন্য দায়ী একধরনের অণুজীব। তিনি বুঝলেন এইসব অণুজীবকে সরিয়ে দিতে পারলে প্রাণী ও উদ্ভিদের পচনকে রোধ করা যায়। গুটিপোকার অসুখের ব্যাপার অনুসন্ধান করতে গিয়েও পাস্তুর রোগজীবাণুকে দেখতে পেলেন। তাহলে তো মানুষের বিভিন্ন রোগের জন্যও দায়ী হল রোগজীবাণু। সেকালের চিকিৎসকদের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে পাস্তুর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার (immunization) সুফল প্রমাণিত করে দিলেন।
মহামারী প্রতিরোধে এগিয়ে এল জীবাণুবিদ্যা।
শুরু হয়ে গেল ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে গবেষণা। যখন বিশেষ রোগের জন্য বিশেষ জীবাণুকে চিহ্নিত করা সম্ভব হল, তখন তা প্রতিরোধের জন্য সিরাম আবিষ্কারও সম্ভব হল। আর যেখানে রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা গেল না, সেখানে সতর্কতা অবলম্বনের উপর জোর দিলেন বিজ্ঞানীরা। উন্নত স্বাস্থ্যবিধান বা sanitation-এর উপর গুরুত্ব দেওয়া হল।
এভাবে টাইফয়েড, কলেরা, ডিপথিরিয়া প্রভৃতি রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হল।
তারপরে জীববিদ্যার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণিত, ইনজিয়ারিং, রসায়ন, কোয়ান্টাম মেকানিকস, কম্পিউটার সায়েন্স, ইনফরমেশন থিয়োরী। জীবাণু বিজ্ঞান প্রস্তুত করে দিয়েছে জীবাণু যুদ্ধের পথ। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি সংগোপনে তার চর্চা করে যাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদীরাও তাকে হাতিয়ার করছে। গড়ে উঠছে অনেক বেসরকারি গবেষণাগার। আর. পুর্ভার তাঁর ‘Chemical and Biological Terrorism : the Threat according to the open literature’ (2002) বইতে তার বিবরণ দিয়েছেন।
জীবাণু অস্ত্রের উৎপাদন ব্যয় যেমন কম, তেমনি তার প্রভাবও ব্যাপক। ১ গ্রাম টক্সিন হত্যা করতে পারে ১ কোটি মানুষকে। Sarin নামক রাসায়নিক নার্ভ এজেন্টের চেয়ে অনেক শক্তিশালী botulinam. স্কাড মিশাইল থেকে বটুলিনাম টক্সিন নিক্ষেপ করা হলে তা ৩৭০০ স্কোয়ার কিলোমিটার এলাকা প্রভাবিত করবে। এবং সে প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। অত্যন্ত নীরবে প্রয়োগ করা যায় জৈব অস্ত্র। শত্রুদেশ বা রাষ্ট্র আঁচ করতেও পারে না। তারা যখন দেখে ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রামক রোগ তখন আর করার কিছুই থাকে না মানুষের। ভাগ্যের পরিহাস, মহামারী প্রতিরোধে যে জীবাণু বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা, সেই জীবাণু বিজ্ঞানকে কৃত্রিম মহামারী সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে এ যুগে।
এই পর্যন্ত লেখার পরে ক্লান্তি এল।
ফেসবুক খুলে অবসর বিনোদন করতে গিয়ে রাজন গুহের পাঠানো একটা লিঙ্ক চোখে পড়ল। আমেরিকার Spectator পত্রিকার এক প্রতিবেদন। বলা হচ্ছে যেসব দেশে নেতৃত্বে আছেন নারীরা, তাঁরাই ভালোভাবে মোকাবিলা করছেন করোনার। যেমন জার্মানি, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, তাইওয়ান। বলা হচ্ছে মহামারী বা অতিমারীর সময় নারীরাই ভালো নেতৃত্ব দিতে পারেন। [“The leaders of Germany, Iceland, Belgium, New Zealand, Finland and Denmark are arranged into a gird accompanied by this caption ‘COVID-19 is everywhere but countries with heads of the state managing the crisis better seem to have something in common’ . Those six countries are among the fewer than 30 in world that are led by women .” ]
এর আগে আমি পরিহাস করে বলেছিলাম যে করোনা পুরুষপ্রেমিক। তার মানে তার শত্রু নারী। সেই নারীদের নেতৃত্বে করোনা জব্দ ।
[ক্রমশ ]
গবেষক