পদসঞ্চার (পর্ব-২)
২২ মার্চ। রবিবার।
আলো ক্রমে আসিতেছে কমে।
ভয়াবহ হচ্ছে পরিস্থিতি। করোনার এপি সেন্টার সরে এসেছে চিন থেকে ইউরোপে। বিশেষ করে ইতালি, স্পেনে। ইতালিতে আক্রান্ত ৫৩৫৭৮, মৃত্যু ৪৮২৫। মৃত্যুতে চিনকে ছাপিয়ে গেল ইতালি। তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে স্পেন । সেখানে আক্রান্ত ২১০০০, মৃত্যু ১০০০। জার্মানিতে আক্রান্ত ১৩৯৫৭, মৃত্যু ১০০২। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে বিশ্বে আক্রান্ত ৩১১০০০, মৃত্যু ১৩০০০।
এখনও আমাদের দেশে করোনার থাবা প্রকট হয় নি।
আক্রান্তের সংখ্যা ৩০০এর মধ্যে। প্রায় সব রাজ্যকে ছুঁয়ে গেলেও শীর্ষে আছে মহারাষ্ট্র [ ১১৬], কেরল [১১২], তেলেঙ্গানা [৩৯], উত্তরপ্রদেশ [৩৮], গুজরাট [৩৮], দিল্লি [ ৩০], পাঞ্জাব [২৯] । আমাদের
এই রাজ্যে আক্রান্ত মাত্র ১০। ভারতে মৃত্যু মাত্র ১৩, এর মধ্যে এ রাজ্যের ১ জন আছে।
গতকাল সোদপুর থেকে মামনি এসেছিল। আমার জন্য নতুন একটা স্মার্টফোন আর মায়ের জন্য কিছু উপহার এনেছিল। দুষ্টু আর মামনি মিলে আগে একটা স্মার্ট ফোন দিয়েছিল। সেটা চুরি হয়ে গেছে। তাই এবারে জন্মদিনে মামনি নিজেই কিনে দিল।
মামনি বলল গতকাল সে রবীন্দ্রনাথ টেগোর হাসপাতালে গিয়েছিল। সন্দীপনের রক্তের একটা রুটিন চেক-আপ হয়। তার জন্য। কিন্তু গিয়ে দেখে আউটডোর বন্ধ। এখানেও করোনার ছায়া। আজ আবার প্রধানমন্ত্রীর জনতা কার্ফুর ডাক। পরবর্তী পদক্ষেপ লকডাউন। দুষ্টুদের চলে আসতে বলেছিলাম। মানস বলেছিল ওদের দুজনকে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু ওরা এল না।
ভাগ্যিস বৃহস্পতিবার ব্যাঙ্ক থেকে কিছু টাকা তুলে এনেছি। সামনের মাসের জন্য। শনিবার আমাদের কাঁথি যাবার কথা ছিল। বিশেষ করে বলে দিয়েছিল ময়না। দীপকের বউ। তার ছেলে শুভর মানসিক, কালীপূজো হবে । রবিবার গাড়িঘোড়া চলবে না, তাই আমরা যাই নি। ময়না একটু রাগ করেছে। আসলে সে গুরুত্বটা অনুভব করতে পারছে না। কাল যদি যেতাম, আজ ফিরতে পারতাম না। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি রাজ্যে লকডাউন হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্ফু শেষ হল বিকেল পাঁচটায়। তারপরে এক অভিনব দৃশ্যের অবতারণা। আরতি ছাদের বাগান পরিচর্যা করছিল। কাঁসর-ঘন্টা-শাঁখের আওয়াজে সে হতচকিত। এ দুদিন বাড়িতে খবরের কাগজ আসেনি। টিভিও অচল। প্রধানমন্ত্রীর উদাত্ত আহ্বানের কথা সে জানত না। মাননীয় প্রধান জরুরি পরিষেবায় নিযুক্ত কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য জনগণকে বিকেল পাঁচটায় শঙ্খ-কাঁসর-ঘন্টাধ্বনি করতে বলেছিলেন। শহরে কাঁসর-ঘন্টা নেই, তাই উৎসাহী জনতা থালা-বাটি বাজাতে থাকল। নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। আমাদের সামনের ফ্ল্যাটে থাকেন রেলের এক বড় অফিসার। খুব প্রতাপ তাঁর। তাঁর সুযোগ্য পুত্র আমেরিকা থেকে ফিরে এখানে কাজে যোগ দিয়েছে। দেখলাম তিনি তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে ছাদে উঠে থালা বাজাচ্ছেন। অনেকে আবার রাস্তায় বেরিয়ে থালাবাদনে রত হয়েছেন। কি উচ্ছ্বাস! তারপরে শুরু হল বাজি ফাটানোর ধূম। পৃথিবী দূষণমুক্ত হয়ে হাঁফ ছেড়ে জিরিয়ে নিচ্ছিল। সেই সময়ে থালা-বাটি-শাঁখ-বাজি তাকে জানিয়ে দিল তাদের জোরের কথা।
সন্ধ্যের দিকে ফোন এল অনিমেষের। কোন্নগরে থাকে অনিমেষ। নানা পত্র-পত্রিকা থেকে উদ্ভট খবর সংগ্রহ করা তার কাজ। গতকাল সে আমাকে বলেছিল, জানিস, করোনা শীতের সন্তান আর পুরুষপ্রেমিক।
সবসময় এইরকম ধাঁধায় কথা বলে অনিমেষ। কাল তার ধাঁধার ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম কিন্তু কার জরুরি ডাক আসায় ফোন কেটে দিয়েছিল অনিমেষ।
আজ সে ফোন করাতে সুযোগ পেলাম।
জানতে চাইলাম করোনা শীতের সন্তান কেমন করে। অনিমেষ বলল, নভেম্বর থেকে জানুয়ারি চিন বা ইউরোপীয় দেশগুলিতে প্রচণ্ড ঠান্ডা। এই সময়ে সেসব দেশে ফ্লু, নিউমোনিয়া হয়। আর করোনা হল নিউমোনিয়ার বাপ বা জ্যেঠা। তাঁই শীতের সময় বেশ শেকড় বিছিয়ে আসতে পেরেছে। পেনসিলভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির এক গবেষকের কথা বলতে পারি।
-নাম কি গবেষকের?
-এলিজাবেথ ম্যাকগ্র। তিনি বলেছেন শীতে লোকে শরীরে গরমের কাপড় চাপায়, রুদ্ধঘরে থাকে, তাই সংক্রমণ বেশি হয়। বাতাস ঠান্ডা আর শুকনো হলে ভাইরাস আটকে থাকে। গরমে মাটিতে পড়ে যায়। তুই কে কে আগরওয়ালের নাম শুনেছিস?
-না, শুনিনি তাঁর নাম।
অনিমেষ বলল, উনি হার্ট কেয়ার ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি। তিনি বলেছেন ভারতের একটা সহজাত রক্ষাকবচ আছে। সেটা হল তার উষ্ণ আবহাওয়া। এই আবহাওয়ার জন্যই ইবোলা, ইয়েলো ফিভার, সার্স, মার্স ভারতে খুব প্রভাব ফেলতে পারে নি।
আশান্বিত হয়ে বলি, তাহলে আমাদের তেমনটা আতঙ্কিত হবার কারণ নেই বলছিস?
-না, আমি সে কথা বলছি না।
-তাহলে?
-ভাইরাসের মিউটেশন হয়, বদলে যায় তার চরিত্র । হয়তো দেখা গেল যে ছিল শীতের সন্তান, সে আর শীত-গ্রীষ্ম মানছে না।
একটু থেমে অনিমেষ আবার বলল, মেলবোর্নের আ্যলফ্রেড হাসপাতালের রেসপিরেটরি ফিজিসিয়ান ডাঃ টম কোটসিমবস বলেছেন শীতে ভাইরাসের বৃদ্ধির সাধারণ নিয়ম কোভিদ-১৯এর ক্ষেত্রে না খাটতেও পারে। দেখা যাচ্ছে উত্তর-দক্ষিণ সর্বত্র এর গতি। ডাঃ তাই বলেছেন : ‘This suggested either the new virous was not dependent on temperature or that this dependency was not as important as the lack of immunity in the population that was helping it to spread . ‘’
এমন উল্টো-পাল্টা কথা বলেন বিজ্ঞানীরা!
যাক গে যাক, এবার অনিমেষের কাছে জানতে চাই কেন সে করোনাকে পুরুষপ্রেমিক বলেছে। অনিমেষ বলে, হোয়াইট হাউসের কোভিদ-১৯এর টাস্ক ফোর্সের ডাইরেক্টর ড. ডেবোরা বিরস্ক বলেছেন এ কথা পরিসংখ্যান দেখে। ইতালিতে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত ১৩৮৮২ জন। এঁদের মধ্যে ৫৮% পুরুষ। মৃত্যুর হারও পুরুষের বেশি, ৭৫%। চাইনিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল আ্যন্ড প্রিভেনশন বলছে চিনে পুরুষের মৃত্যুর হার ৬৫%, স্পেনে এই হার ৬০%। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর হার নির্ধারণ করেছে এইভাবে : পুরুষ =২.৮% , নারী = ১,৭%।
পুরুষ ও নারীর হারের এই তারতম্য কেন?
অনিমেষ বলল, সিগারেট, মদ ইত্যাদি খেয়ে পুরুষরা তাদের ফুসফুসের বারোটা বাজিয়ে রাখে, তাই সংক্রমণের প্রতিরোধ করতে পারে না। তাছাড়া-
-তাছাড়া কি!
-ওকলাহোমা মেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের মাইক্রোবায়োলজিস্ট সুজান কোভেট নারী-পুরুযের ইমিউন সিস্টেমের পার্থক্যের কথা বলেছেন।
– কি রকম!
-কিছু ভাইরাসের ক্ষেত্রে নারীর শরীরের কোষ ইন্টারফেরন নামে প্রোটিন বেশি তৈরি করে। এই ইন্টারফেরনকে উদ্দীপিত করে এস্ট্রোজেন। আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজির এক অধ্যাপক স্ত্রী ইঁদুরের শরীর থেকে এস্ট্রোজেন বের করে নিয়ে দেখেছেন তারা সহজে সংক্রমণের শিকার হয়।
অনিমেষের সঙ্গে আলোচনায় আমার ভয় কাটলো না। বরং বেড়ে গেল। আমাদের এখানে গরম পড়েছে। ৩৬ ডিগ্রি চলছে। ভেবেছিলাম পাজি ভাইরাসগুলো ফটাফট মরে-হেজে যাবে। এখন দেখছি তার সম্ভাবনা নেই। তবে সে পুরুষপ্রেমিক রয়ে গেছে। পেত্নির মতো সে পুরুষের ঘাড় মটকে দেবে। আমিও তো পুরুষ। তাহলে!
[ক্রমশ]
গবেষক