ভারতীয় নারী-ইতিহাস আলোচনায়, দেবদাসী একটি বহুশ্রুত ও বহুআলোচিত শব্দ।দেবদাসী হচ্ছেন সেই নারী, যাঁদের “বিয়ে” হতো মন্দিরের দেবতার সাথে, যাঁদের মন্দিরেই বাস করতে হতো এবং পুরোহিত,রাজা বা অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে শরীর সমর্পন ছিল যাঁদের অবধারিত নিয়তি।এই নিপীড়নের শিকার হয়েও,তাঁরা যেভাবে ভারতীয় সংস্কৃতিতে তথা performing art এ তাঁদের উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন,সেটাই বিস্ময়কর। আমাদের আজকের বিষয়, তাঁদের এই প্রতিভার অনুসন্ধান, মূলত দক্ষিণ ভারতের প্রেক্ষাপটে।
দেবদাসী প্রথার সূচনা ঠিক কবে,তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও,খৃ.পূ. প্রথম শতকে, দক্ষিণ ভারত এই প্রথার সাথে পরিচিত ছিলো।সঙ্গম সাহিত্যে যে “কবিদল”(bardic curpos)এর প্রদর্শনের (performance)এর উল্লেখ পাই,তাতে দেবদাসী প্রথার সরাসরি উল্লেখ না পেলেও,ভিরালি দের উল্লেখ আছে। এদেরকে অনেকে দেবদাসীর পূর্বসূরি বলেন।S.C.Kersenboom দেখিয়েছেন যে,ভিরালি রা রাজাদের বিলাসজীবনের অঙ্গ ছিলেন।”ভিরাল্লিয়াডুপ্পাতই”শীর্ষক বিবরণ থেকে জানা যায়,কবিদল(সম্ভবত এরা চারণকবি ধরনের ছিল)এক রাজার সভা থেকে যখন অন্য রাজার সভায় যশগাথা বা পুরম গাইতে যেত,তখন দলস্থ ভিরালি রা রান্না,মদ তৈরি, বাদ্যযন্ত্রের যত্ন নেবার পাশাপাশি, নৃত্য গীতের চর্চা করতেন।সে সব প্রদর্শনের পুরষ্কার স্বরূপ, সাম্মানিক মূল্যবান উপহারও পেতেন।
ক্রমশ, ধর্ম স্থানে ভূমিদান প্রথা ব্যপক রূপ নিতে থাকে। সেই সঙ্গে মন্দির নির্মাণও বাড়ে। মন্দিরের আর্থিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধির সাথে সাথে, মন্দিরের কাজে, নারীর নিযুক্তিকরণ ও বাড়ে।এই পথ ধরেই, দেবদাসী প্রথা রূপ পেতে থাকে।
খৃষ্টীয় তৃতীয় শতকে পল্লব পূর্ববর্তী এক রাজা নিজ প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে, নৃত্য গীতের প্রচলন করেন বলে জানা যায়।তবে এই সংক্রান্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান আমরা পাই, পঞ্চম শতকের পর,যখন দক্ষিণ ভারতে আরো মন্দির প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। তাছাড়া,ঐ সময়ের শৈব ও বৈষ্ণব সাধকদের লেখায় পরোক্ষভাবে, দেবদাসীর উল্লেখ আছে।অপ্পার উল্লেখ করেছেন,তিরুবরুরে,তিরুবদিয়াই(শিবের জন্মোৎসব) উৎসবে, শোভাযাত্রায় নৃত্যরতা নারীরা থাকতেন।। তিনি কুম্ভকোনমের গায়িকাদের তেনারমলিয়ার বা মধুকন্ঠী বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন,তিরুপ্পিরামাপুরমের মন্দিরে,যখন স্বর্ণালঙ্কার ভূষিতা নর্তকীগণ গীতবাদ্য সহযোগে নৃত্য প্রদর্শন করতেন,তখন মনে হতো, মন্দিরে যেন বৈদিক মন্ত্র প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।এ থেকে মনে হয়,আলোচ্য সময়ে মন্দিরবাসী দেবদাসীগণ সম্মানীয়া ছিলেন।
নবম শতকে, ব্রাহ্মণ্য মতাদর্শ ও তামিল কবিসংস্কৃতির(bardic culture)মেলবন্ধন ঘটে। এবার, দেবদাসী প্রথার যে বৈশিষ্ট্য গুলি প্রকট হয়,তা হলো এঁরা একাধারে হয়ে দাঁড়ান কবি,বারনারী ও ধর্মীয় আচার পালন কারিনী,সেই সঙ্গে নৃত্য গীত পটিয়সী।
তাঞ্জোরের বৃহদিশ্বর মন্দির (১০০৯খৃ), প্রথম রাজেন্দ্রর গঙ্গাইকোন্ডচোলপুরমের মন্দির ইত্যাদির গাত্রে বহুসংখ্যক লেখ খোদিত হয়েছিল। এগুলি থেকে জানা যায় যে রাজারা দেবদাসী দের পৃষ্টপোষকতা করতেন।বৃহদিশ্বর মন্দিরের লেখতে বলা হয়েছে,চারশো জন নৃত্যপরাঙ্গমাকে, পঞ্চাশ টি মন্দির থেকে সংগ্রহ করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল।বারো জন নৃত্য শিক্ষকের উল্লেখ ও আছে। মন্দিরে পাঁচ ধরনের গায়ক গায়িকা থাকতেন, যাদের বলা হতো গন্ধর্ব ও গন্ধর্বী। এদের সাথে সঙ্গতকারি গণ (বাঁশী,বীণা, উডুক্কু)থাকতেন।এই বিপুল আয়োজন,মন্দিরকে সংস্কৃতির কেন্দ্র করে তুলেছিল।এই প্রেক্ষাপটে, দেবদাসী ছিলেন এমন এক নারী,নিজস্ব সম্পদে যাঁর অধিকার থাকতো এবং যিনি এই কলাবিদ্যার চর্চায়,নিয়ত রত থাকতে পারতেন। উৎকর্ষতা প্রদর্শনের ভিত্তিতে এঁরা সাম্মানিক উপাধিও পেতেন।(শিবজন সম্বন্দর তালাইকোলি)।
চোল রাজাদের পর, দেবদাসী ঐতিহ্যের ধারক হয়ে ওঠেন বিজয়নগরের রাজাগণ। এদিকে, প্রাচীন ও আদিমধ্য যুগের সমাপ্তিও ঘনিয়ে আসে।শুরু হতে থাকে মুসলিম শাসন। হিন্দু ধর্ম ভাবনা পুরনো ঐতিহ্য কে আঁকড়ে ধরতে উদগ্ৰীব হয়। হিন্দু সংস্কৃতির বিলোপের ভয়জনিত কারণ থেকে জন্ম নেয় এমনএক self consciousness যা ক্রমশ মুক্ত বাতাবরণের পরিপন্থী হয়ে ওঠে।সমাজ সংস্কৃতির এই অশান্ত পরিবেশেও,আমরা দেখি বিষ্ণুদাসীরা শোভাযাত্রার পুরোভাগে নৃত্য পরিবেশন করছেন,বা পবিত্র জলপাত্র (কুট্টমুরাই)বহন করছেন।
কিন্তু আরো যতো দিন যেতে থাকলো, দেবদাসী প্রথার অবক্ষয় ততোই গভীর হলো। ব্রিটিশ শাসনের মধ্যপর্বে,এই প্রথার সাথে, বেশি বেশি করে যুক্ত হলো,দারিদ্র,দাসত্ব, চূড়ান্ত যৌননিগ্ৰহ এমনকি, human trafficking.মন্দিরকেন্দ্রিক এই ভ্রষ্টাচার সচেতন করে তুললো, মানবাধিকার রক্ষাকারী ও নারীস্বার্থ রক্ষাকারী মানুষদের।মুথুলক্ষী রেড্ডি,১৯৩০ সালে যে প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা করলেন,বহু লড়াইয়ের পর,তা সফল হলো ১৯৪৭এ। মন্দিরে কন্যাদান প্রথারূপ অভিশাপের সমাপ্তি ঘটলো।
ভারতীয় কলা ঐতিহ্যের নিরন্তর অনুশীলন কারিনী, ভরতনাট্যম ও ওড়িশি নৃত্য শৈলীর জন্মদায়িনী,এই দেবদাসী গণ, আমাদের প্রণম্যা।
তথ্যসূত্র:
Perceptions of Prostitution,The Devadasi system in India by Ishita Gupta
Nityasumangali by S.C. Kersenboom
পেশায় শিক্ষক। ভালোবাসেন ইতিহাসকে গল্পের ছলে লিখতে।