বিবাহ মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ১১ পর্ব।
অর্জুন। কৃষ্ণের পরেই প্রেম-সংক্রান্ত বিষয়ে মহাভারতের সবচেয়ে বর্ণময় পুরুষ চরিত্র। কৃষ্ণের মতোই গাত্রবর্ণ, আজানুলম্বিত হাত, রমণীমনোহর দেহপট, যাকে আমাদের কিশোরীবেলায় আমরা বলতাম tall dark and handsome। তার উপর বীর। মুখেন মারিতং নয়, সত্যি বীর। এমন পুরুষকে দেখলে তো কাম জাগবেই। তাই হয়েছিল উলূপীরও, সঙ্গে ছিল সন্তানকামনাও। এবার উলূপীর সঙ্গে অর্জুনের কি করে দেখা হল, সেই গল্পে যাই।
দ্রৌপদীর সঙ্গে পঞ্চ পাণ্ডবের বিয়ের পর নারদকে সামনে রেখে পাঁচ ভাই একটা অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, যে দ্রৌপদী এক এক বছর এক এক জন ভাইয়ের স্ত্রী হয়ে থাকবেন। এক ভাইয়ের সঙ্গে সময় কাটানোর সময় অন্য ভাই কোনো কারণেই সেখানে হঠাৎ করে এসে পড়বেন না । এলে তাঁকে বারো বছরের জন্য বনে চলে যেতে হবে।
এই নিয়ম না করলে তো চলত না, কারণ দ্রৌপদীকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত! আর ভাইয়েদের মধ্যে তিক্ততা তৈরি হতোই। চলে আসে সেই কথা, কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করো। সাধনার পথে এ বড় অন্তরায়! পৃথ্বীরাজকে কি সংযুক্তা বলেছিলেন রাজ্যপাট ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে বসে থাকো!!!! সীতা কি রাবণকে ডেকে এনেছিলেন, এস আমাকে হরণ করে নিয়ে যাও!! হেলেনকে দেখে প্যারিস মুগ্ধ হয়েছিলেন আর হেলেনের কাছেও প্যারিস কেন অনেক বেশি কাম্য হবেন না! মেনেলাসের তুলনায় প্যারিস সৌন্দর্য্যে প্রেমে সবেতেই অতুলনীয় । অথচ ট্রয়ের যুদ্ধ, ট্রয়ের ধ্বংসের জন্য হেলেনকেই দায়ী করা হয়! রামায়ণে সীতা, মহাভারতে দ্রৌপদী! মেয়েদের দিকে আঙুল তোলা বড় সহজ। ওরা নরম, ওরা জোরালো প্রতিবাদ করবে না! সুতরাং পুরুষ নিজের মনকে, প্রবৃত্তিকে সংযত করতে পারে না, মেয়েদের প্রতি পুরুষের আকর্ষণ অদম্য, সামাজিক প্রতিষ্ঠা আর ধনবান হওয়ার জন্য একজন পুরুষ প্রয়োজনে অসামাজিক কাজেও পিছ-পা হয় না; এসব গেল জলে! তৈরি হল কামিনীকাঞ্চন থেকে সাবধান, তৈরি হল পথি নারী বিবর্জিতা, তৈরি হল নারী নরকের দ্বার! একের পর এক বিশ্রী অপমানজনক প্রবাদ, পুরুষের অসংযমিতা লুকিয়ে রাখার শক্তপোক্ত ঢাল!!! তবে পঞ্চ পাণ্ডব জানতেন যে কীভাবে নিজেদের জন্যই এমনভাবে নিজেদের আটকে রাখতে হবে। মহাভারতকার জানতেন লোভটা লুকিয়ে বিশেষ করে পুরুষের মধ্যেই, আর ঈর্ষাও তাদেরই বেশি; তাই এমন নিয়মের পরিকল্পনা করিয়েছেন পাণ্ডবদের দিয়ে । যাই হোক, এই নিয়ম মেনে পঞ্চ পাণ্ডব আর দ্রৌপদী সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন।
একদিন হল কি, এক ব্রাহ্মণের গো-ধন দস্যুরা কেড়ে নিয়ে গেল। ব্রাহ্মণ বেচারা ছুটে এলেন রাজপ্রাসাদে। চিৎকার করে অভিযোগ জানাতে লাগলেন । অভিযোগ শুনে বেরিয়ে এলেন অর্জুন, ব্রাহ্মণকে অভয় দিয়ে অস্ত্র আনতে চললেন। এদিকে অস্ত্রের ঘরে অবস্থান করছিলেন যুধিষ্ঠির। বিধিমতে, সেই সময় দ্রৌপদী তাঁর স্ত্রী । কিন্তু কিছু করার নেই। শরণাগতকে রক্ষা করা ক্ষত্রিয়রাজার পরম ধর্ম । সুতরাং কোনো কিছুর পরোয়া না করে অর্জুন সেই ঘরে ঢুকে অস্ত্র নিয়ে প্রথমে ব্রাহ্মণের হৃত গো-ধন উদ্ধার করলেন এবং বনবাসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন।
যুধিষ্ঠির অবশ্য যথাসাধ্য যুক্তি সহ অর্জুনকে আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। বলেছিলেন তুমি তো আর্তকে সাহায্য করতে কাজটা করেছ। তাছাড়া আমি মোটেই অসন্তুষ্ট হই নি। সর্বোপরি, কনিষ্ঠের ঘরে বিশেষ অবস্থায় জ্যেষ্ঠ প্রবেশ করলে তা নিয়মলঙ্ঘন হয়, কিন্তু জ্যেষ্ঠের ঘরে কনিষ্ঠ প্রবেশ করলে তা হয় না । কিন্তু “ধর্মাচরণে কোনো ছলনার আশ্রয় নিতে নেই”, যুধিষ্ঠিরেরই শেখানো এই নীতি অর্জুনের রক্তে। তাই অর্জুনকে কিছুতেই ধরে রাখা গেল না । তিনি বেরিয়ে পড়লেন । একা না অবশ্য । সঙ্গে গেলেন বহু বেদবিৎ ব্রহ্মজ্ঞ বৈষ্ণব প্রভৃতি মানুষ ও মিষ্টি কথা বলতে পারা সহচরবৃন্দ। নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে অর্জুন এসে পড়লেন গঙ্গাদ্বারে। এখন এই গঙ্গাদ্বার স্থানটি কোনটি, তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। তবে মহাভারত অনুযায়ী আমরা দেখি, এর পরেই অর্জুন হিমালয়ে যান। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে গঙ্গাদ্বার স্থানটি হিমালয়ের কাছাকাছিই ছিল। এবং স্থানটির মাহাত্ম্য এমনই ছিল যে অর্জুন সেখানে একটি আশ্রম নির্মাণ করে ফেললেন, যেখানে ব্রাহ্মণেরা বহুতর অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠানও আরম্ভ করে দিলেন।
এইরকমই একটি দিনে, অর্জুন গেলেন গঙ্গায় স্নান সারতে। মনে ইচ্ছে, একেবারে তর্পণ সেরে উঠবেন। মনের সে ইচ্ছে মনেই রয়ে গেল, কারণ?
অবকৃষ্টো মহাবাহুর্নাগরাজস্য কন্যয়া ।
অন্তর্জলে মহারাজ! উলূপ্যা কাময়ানয়া!!!
কামার্তা উলূপী এসে সেই মহাবাহু অর্জুনকে জলের ভেতর টেনে নিয়ে গেলেন।
সেখানে প্রথমে অর্জুনকে হোম করার ব্যবস্থা করে দিলেন উলূপী । মেয়েরা কখনো তাড়াহুড়ো করে না! তারপর অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে আগে নিজের পরিচয় দিলেন। তারপর বললেন, দৃষ্ট্বৈব পুরুষব্যাঘ্র! কন্দর্পেণাস্মি পীড়িতা।। আপনার মত ব্যাঘ্রসম পুরুষকে দেখে আমি কামবাণে আহত! তাই আপনাকে আমার চাই।
কিছু কিছু লেখায় দেখেছি উলূপীকে বলা হয়েছে বিধবা, তাঁর স্বামী গরুড়ের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন । কিন্তু মহাভারতে এমন কোনো কথা নেই। উলূপী পরিষ্কার বলছেন, আপনাকে দেখেই আমার কাম জেগে উঠেছে, অন্য কোন পতিও আমার নেই; অর্থাৎ অন্য কোনোভাবে আমি এই কাম মেটাতে পারব না। সুতরাং আপনি আত্মসমর্পণ করুন আমার কাছে আর আমাকে আনন্দিত করুন। কথাগুলো লক্ষ্য করুন, মেয়েটি পুরুষটিকে বলছে আত্মসমর্পণ করতে, তাকে আনন্দ দিতে!!! এমন সোজাসাপ্টা কথা এখনকার ক’জন মেয়ে বলতে পারবে? বললেও সমাজ তাকে কি চোখে দেখবে? অবিবাহিতা মেয়ে কিন্তু! এবং বুঝতেই পারছেন, বালিকা নয়। রামায়ণ মহাভারতে বাল্যবিবাহ কোথায়!!! শুধু এই কথা নয়, আরোও যুক্তি দেখিয়ে অর্জুনের সমস্ত আপত্তি তিনি ভাসিয়ে দিলেন। বললেন, আপনার ব্রহ্মচর্যের নিয়ম দ্রৌপদীর জন্যই নির্দিষ্ট । অন্য কোনো নারীর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। তাই আমার সঙ্গে রমণ করলে মোটেও নিয়মের লঙ্ঘন হবে না। তাছাড়া, আমি পীড়িত। ন করিষ্যসি চেদেবং মৃতাং মামুপধারয়! এই মিলন না হলে আমি মরে যাব! তাই আমার প্রাণ বাঁচাতেও এই কাজ আপনাকে করতেই হবে। আমি অত্যন্ত কামাতুর হয়ে আপনাকে চাইছি। নিজেকে তুলে দিন আমার কাছে।
অর্জুনের বাধা দেওয়ার আর কোন জোর রইল না। আর এমন আত্মসমর্পণ করতে অর্জুনের খুব বেশি আপত্তিও ছিল বলে মনে হয় না! সুতরাং তিনি উলূপীর সঙ্গে “সর্বপ্রকার” রমণ করলেন । এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন ব্যাসদেব। একটিমাত্র রাত তো। উলূপী তো কামে অস্থির ছিলেনই। অর্জুনও বহু দিন দ্রৌপদীর থেকে দূরে। বারো বছর পুরতে অনেক দেরি । তাই সাধ মিটিয়ে যৌন ইচ্ছে পূরণ করে নিলেন দুজনে। সেই রাত কাটিয়ে পরের দিনই হিমালয়ের পথে যাত্রা করলেন অর্জুন আর কালক্রমে উলূপী জন্ম দিলেন দুজনের মিলনের ফল, ইরাবানকে।
এই মিলনকে কি নাম দেবেন? ব্যভিচার? এই সন্তানকেই বা কি বলবেন? জারজ? বিশেষ করে মেয়েটি যেখানে অবিবাহিতা, তার এত যৌন আকাঙ্ক্ষা কীসের, যে একজন পুরুষকে দেখে এমন হল, যে তাকে টেনে নিয়ে যেতে হবে!!! মনে রাখবেন, উলূপী ওই এক রাতের মিলনকে ভোলেন নি। শুধু তাই নয়, ইরাবানকে জন্ম দিয়েছেন। তাকে রণকৌশল শিখিয়েছেন এবং কুরুক্ষেত্রের মহারণ শুরু হলে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বাবার পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে ।
একজন নারী আর একজন পুরুষ । পরস্পরকে পছন্দ করেছেন। একজন অবিবাহিতা, কিন্তু যৌবনে পা দিয়েছেন, কামনা তৈরি হয়েছে। অন্যজন স্ত্রীর থেকে অনেক দূরে । বহু বছরের দূরত্ব । সেই প্রেক্ষাপটে ব্যাসদেব বা তৎকালীন সমাজ এই মিলনকে অবৈধ বলে লাঞ্ছিত করে নি। বরং স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখিয়েছেন। এই স্বাভাবিক ভাবে দেখতে শেখাটাকেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি ।
এরপর অর্জুন ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লেন মণিপুর রাজ্যে । এই মণিপুর কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মণিপুর নয়। এই মণিপুর কিন্তু পূর্ব ভারতের মণিপুর নয়!
অধ্যাপিকা, শিক্ষা বিজ্ঞান বিভাগ, রামকৃষ্ণ সারদা মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন ।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহী, লেখালেখি করার বদভ্যাস আছে। পৌরোহিত্য করেন, মূলত পুরোনতুন বৈদিক পদ্ধতিতে বিবাহ দেন এবং রবিগান কঠোপনিষদ ও ঋক্ মন্ত্রসহ অন্যরকমভাবে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।