| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি

নারী পুরুষের মিলন কাহিনী (পর্ব-১২)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বিবাহ  মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ১২ পর্ব।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

সত্যি বলতে কি রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে কোথাও মণিপুর রাজ্যের ঠিকানা দেওয়া নেই। শুরুই হচ্ছে মণিপুরের রাজার ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে বর দিয়েছিলেন যে তাঁর বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে, এই বরদানের কাহিনী দিয়ে। কিন্তু শিবের যেমন স্বভাব আর কী, কখন কাকে কি বর দেন, নিজেই ভুলে যান বোধহয়! তো পুত্রের বদলে জন্মালো এক কন্যা। এই দিয়ে আখ্যানটি আরম্ভ। তা আমরাই বোধহয় সব ভেবে নিলাম এই মণিপুর পূর্ব ভারতের মণিপুর। ওই যাকে মনস্তত্ত্বে  association বলে। রবি ঠাকুর বললেই শান্তিনিকেতন মনে পড়ে, হাওড়া বললেই হাওড়া ব্রিজ; তেমন মণিপুর শুনেই মণিপুরী নাচ আর সেই পাহাড়ে জঙ্গলে ঘেরা রাজ্যটি মনে পড়ে যায়। আর নাটক শুরুও হচ্ছে শিকার দিয়েই যে। সেই গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে পর্বত শিখরে অরণ্যে তমশ্ছায়া! কিন্তু মহাভারতের মণিপুর যে এক অন্য রাজ্যের কথা বলে। মহাভারতে উলূপীকে ছেড়ে অর্জুন গেলেন হিমালয়ে। সেখানে গেলেন অগস্ত্যবট বশিষ্ঠপর্বত ও তুঙ্গনাথে। সেখান থেকে পূবদিক হয়ে নামতে লাগলেন। অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ। সেইখান থেকে সমুদ্রের ধারের স্থানগুলিতে। আহা! ভাবতেই কেমন লাগছে। উড়িষ্যার সেই সুবিশাল জলধি, উদ্বাহু  চৈতন্যদেবের  কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে ছুটে যাওয়া যেখান দিয়ে, সেখানেই কয়েক হাজার বছর আগে এক কবি এনে ফেলেছিলেন সেই কৃষ্ণেরই পরম বন্ধু অর্জুনকে।
এই পথেই যেতে যেতে পড়ল মহেন্দ্র পর্বত । তারপর সমুদ্রের তীর ধরেই তিনি ঢুকে পড়লেন মণিপুরে। এই যাত্রাপথের ম্যাপের ছবিটি দিলাম শুধু মাত্র বোঝাতে, যে এ এক অন্য রাজ্য। সমুদ্রের ধারে। অদূরেই মহেন্দ্র পর্বত। মণিপুরের সমস্ত তীর্থ দেখে অর্জুন গেলেন রাজা চিত্রবাহনের প্রাসাদে। সেখানেই দেখলেন রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে। পরমাসুন্দরী সেই কন্যা বাড়ির মধ্যেই ঘোরাফেরা করছিলেন, শিকারে যান নি মোটেও। আর চিত্রাঙ্গদা অর্জুনকে পেতে তপস্যা করেন নি, বরং অর্জুনই চিত্রাঙ্গদাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন। ওইটে পুরোটাই কবিকল্পনা। এমন কল্পনা, যে কল্পনাতেই ডুবে থাকতে মন চায়। কিন্তু কী করব! আসল গল্পে যে ঢুকতেই হবে!
চিত্রাঙ্গদাকে দেখেই অর্জুনের অভিলাষ এমন জাগল, যে তিনি সোজা রাজার কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে কন্যাটিকে চাইলেন। সত্যি বলতে কি, অর্জুনের এই একটি বিয়েই এখনকার মত, যেখানে পাত্র বা পাত্রপক্ষ গিয়ে সরাসরি কন্যার সঙ্গে বিয়ের অনুমতি চাইছে। তবে মহাভারত বলে কথা, সহজে তো সহজ ব্যাপার হওয়ার নয়। দেখা গেল, এখানেও রাজা একটি শর্তে বিয়ে দিতে রাজী হলেন। কি সেই শর্ত?
শর্ত হল এই, যেহেতু চিত্রবাহনের কোনো পুত্র নেই, তাই চিত্রাঙ্গদার গর্ভে যে সন্তান জন্মাবে, সেই হবে এই রাজ্যের ভবিষ্যত উত্তরাধিকার। অর্থাৎ অর্জুন তার বাবা হবেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর সেই অর্থে কোনো অধিকার থাকবে না। না, স্ত্রীর ওপরেও না। স্ত্রী সন্তানকে রেখেই তাঁকে বিদায় নিতে হবে।
দেখুন তাহলে, আজীবনের জন্য না হলেও ঘরজামাইয়ের একটা concept দিব্যি ছিল তখন। আসলে শেষ পর্যন্ত তো সবটাই প্রয়োজন। এটা তো ঘরজামাই হওয়ার প্রস্তাবই। কোনোটাকেই তাচ্ছিল্য করা তাই উচিত নয় । অর্জুন তো টুঁ শব্দটি করলেন না। কারণ প্রথম এবং শেষ কথা তো আপাতত চিত্রাঙ্গদাকে পেতে হবে। বেশ তো ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়ে বেরিয়েছিলেন। উলূপী সেই যে ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে সেটি ভাঙলেন, তো সে এমন ভাঙা ভাঙল, আর জুড়লই না! চিত্রাঙ্গদার পরেই আবার সুভদ্রাকে দেখেও একই অভিলাষ জাগল কিনা, তাই বলছি!
যাক্,  আর দ্বিতীয় কারণ হল,  এখনও তো বারো বছর শেষ হতে অ-নে-ক বাকি। কাঁহাতক আর স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে ঘুরবেন! বরং এইই ভালো। সুতরাং স তথেতি প্রতিজ্ঞায় তাং কন্যাং প্রতিগৃহ্য চ! কী সহজ সংস্কৃত দেখুন। তাই হবে, একথা বললেন (অর্জুন)এবং সেই কন্যাকে গ্রহণ করলেন। দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেল। চিত্রাঙ্গদা অন্তঃসত্ত্বা হলেন। সেই অবস্থায় চিত্রাঙ্গদাকে রেখে অর্জুন আবার দেশভ্রমণে বেরোলেন। এই অবস্থায় কেন আবার দূরে গেলেন, কে জানে! হয়ত এই সময়ে কাছে থাকলে মায়া তৈরি হবে, ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে, তাই। কিছু দিন এদিক ওদিক ঘুরে আবার মণিপুরে ফিরে দেখলেন চিত্রাঙ্গদা এক পুত্রকে জন্ম দিয়েছেন, নাম রেখেছেন বভ্রুবাহন।
এইবার সেই শর্ত পূরণের পালা। শর্ত করার সময় চিত্রবাহন একটা শব্দ বলেছিলেন, সেটি হল শুল্ক। চিত্রাঙ্গদার গর্ভে জাত সন্তান হবে চিত্রাঙ্গদার বংশের ধারক, এই ছিল বিয়ের শুল্ক। অর্থাৎ ছেলেটিকে মেয়ের বাড়িতে শুধু থাকতে হচ্ছে আর সন্তানকে মাসহ দাদুদিদার কাছেই রেখে যেতে হচ্ছে, তাই নয়; সন্তানটি মায়ের বংশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, বাবার বংশকে নয়। বুঝতে পারছেন কথাটা! ছেলে ছেলে করে তো সবাই পাগল, ছেলে হবে আর সে বংশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে! স্বামী স্ত্রীতে সদ্ভাব নেই, বাড়ির সেই বউটিকে কারণে হোক বা অকারণে, শ্বশুরবাড়ির কেউ সহ্য করতে পারে না, নিন্দায় মুখর; কিন্তু তার সন্তান হলে, বিশেষ করে পুত্র সন্তান হলে সে কিন্তু সেই বংশের কুলপ্রদীপ! যে মা ধারণ করল, অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে জন্ম দিলো, সে যাক্ ভাড়মে! ভালো রে ভালো! অথচ  অর্জুনকে দেখুন, পুরুষের মত এক পুরুষ, শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর, চাইলেই জোর করতে পারতেন। বিশেষ করে পুত্র সন্তান দেখে। আগেও, যখন চিত্রাঙ্গদাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের জন্য বলতে এসেছিলেন, তখনই  এমন কথা নাও দিতে পারতেন। জোর করে হরণ করলেই বা এক সামান্য ছোট রাজ্যের রাজা কিই বা করতে পারতেন! ভীষ্ম যেমন একের পর এক প্রত্যক্ষে, পরোক্ষে জোর করেছিলেন। আসব সে সব কথায়, আগে অর্জুনকে দেখে নিন।  অর্জুন কিন্তু জোরাজুরির ধার দিয়েই গেলেন না। বরং, বিদায় নিতে চাইলেন চিত্রাঙ্গদার কাছে। তাঁকে বললেন, এই বভ্রুবাহনকে বড় করে তোলো, তোমার বংশের উপযুক্ত করে। আর মহারাজ  যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয় যজ্ঞ করবেন, তখন বাবার সঙ্গে এস। সবাই খুব খুশি হবেন তোমাদের দেখে। আর বিপ্রয়োগেণ সন্তাপং মা কৃথাস্ত্বম্ অনিন্দিতে!! হে অনিন্দিতা, আমার বিরহে কষ্ট পেয়ো না। এই বলে অর্জুন বেরিয়ে পড়লেন। আবার খানিক দেশভ্রমণ সাঙ্গ করে গেলেন প্রভাসতীর্থে। যেখানে আছেন মামাতো ভাই আর পরম সুহৃদ কৃষ্ণ আর মামাতো বোন, সুভদ্রা; যদিও তখনও পর্যন্ত তাঁর এই মামাতো বোনটি সম্পর্কে তিনি একেবারেই অজ্ঞ।
আগের সবকটি পর্ব পড়তে ও ড. রোহিণী ধর্মপালের অন্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত