আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিটবিবাহ মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ১৪ পর্ব।
অর্জুনকে তো করতেই হত লক্ষ্যভেদ। এই ক্ষমতা, এই শাণিত দৃষ্টি আর কারই বা ছিল! এক কর্ণ পারতেন হয়ত। তবে তিনি তো সুযোগই পেলেন না! কিন্তু উপস্থিত রাজাদের ইগোতে বড্ড লাগল! এ কী ব্যাপার! অ্যাঁ!!! এতগুলো রাজা রাজপুত্তুর। সব ছেড়ে কি না এক ব্যাটা ব্রাহ্মণ মুখের ওপর দিয়ে নিয়ে চলল দ্রৌপদীকে!!! তাছাড়া স্বয়ংবর, হোক না তা শর্তসাপেক্ষ, এখানে তো একমাত্র ক্ষত্রিয়দেরই অধিকার! ব্রাহ্মণগুলো এর মধ্যেও ভাগ বসাবে কেন!!! এবার ওদের মারতে না পারলেও দ্রুপদটাকে ছাড়ব না! ওটাকেও মারব আর ওর মেয়েটা যদি আমাদের মধ্যে কাউকে বেছে নেয় তো ঠিক আছে, নয়ত ওকেও আগুনে পোড়াব!!! তারপর তো লাগল দক্ষযজ্ঞ। একদিকে সকল রাজা, আরেক দিকে অর্জুন আর ভীম! বস্তুত কর্ণ তিনবার অর্জুনের কাছে পরাজিত হয়েছেন। তৃতীয় ও শেষবার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষে, তবে তখন তিনি ছিলেন নিরস্ত্র । দ্বিতীয়বার বিরাটপর্বে, যখন গোধন হরণ করে তাঁরা পালাচ্ছিলেন। আর এই প্রথমবার, দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায়, কর্ণ একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে গেলেন। আর ভীম পেড়ে ফেললেন মহাবলী শল্যকে। একেবারে তুলে আছাড় যাকে বলে। ব্রাহ্মণেরা তো দেখে হেসেই অস্থির!!! এমন সময় কৃষ্ণ এসে রণক্লান্ত, কর্ণ আর শল্যের অবস্থা দেখে খানিক ভীতও, রাজাদের বোঝালেন । এঁরা তো ধর্ম অনুসারেই দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন। আপনারা কেন এত রাগ করছেন!!! কৃষ্ণের বোঝানোয়, আর কোনো উপায়ান্তর না থাকায় রাজারা তো বিরত হলেন এবং অর্জুনসহ দ্রৌপদীকে নিয়ে পাণ্ডবেরা কুন্তীর কাছে এলেন। আর এই মহাস্বয়ংবরসভা খ্যাত হয়ে গেল “ব্রাহ্মণপ্রধান স্বয়ংবরসভা ” নামে!
একে তো দ্রৌপদীকে পাওয়া, তার ওপরে এতগুলো রাজাকে হারানো; মনে অপার আনন্দ, বিশেষ করে ভীমার্জুনের। মায়ের কাছে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে তাঁরা জানালেন ভিক্ষা এনেছেন। কি ভিক্ষা, তা মা বাইরে এসে দেখুন, এই ভেবেছিলেন আর কী। surprise দিতে কার না ভালো লাগে!!! কিন্তু surprise দিতে গিয়ে এমন shoked আর ক’জন হন!!! কুন্তী বাইরে না এসে রোজকার মতোই বললেন, যা এনেছ, বাছা, পাঁচজনে ভাগ করে নাও।
এর পরে বাইরে এসে সেদিনের ‘ভিক্ষা’ দেখে তো তাঁর চক্ষু স্থির!!! কী হবে এবার!!! তিনি তো জানেন না, স্বয়ংবর সভায় দ্রৌপদীকে দেখামাত্র সবার মত পাঁচ ভাইয়েরও অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেছিল!!! পাঁচ ভাইয়ের মনেই জেগেছিল একই কামনা! দ্রৌপদীকে একান্তভাবে পাওয়ার ইচ্ছা! আর এখন!! ভাবতে ভাবতে যুধিষ্ঠির দেখলেন দ্রৌপদী নিজেও সব ভাইকে দেখছেন। তাঁদের অবস্থা তো এমনিতেই খারাপ ছিল, এখন দ্রৌপদীর তাকানো দেখে একেবারে যাকে বলে ইয়ে!!!! তখন যুধিষ্ঠির স্মরণ করলেন ব্যাসদেবের কথা। তিনি আগেই বলেছিলেন এই মেয়েকে তোমরা পাঁচজনেই বিয়ে কোরো, কারণ তাই এই মেয়ের ভবিষ্যত্ ।
রাজা দ্রুপদকেও যুধিষ্ঠির এই যুক্তিই দিলেন। সঙ্গে দিলেন দুটি উদাহরণ । জটিলা নামে গৌতমবংশীয়া কোনো রমণীর সাত জন পতি ছিলেন। আর বার্ক্ষী নামে এক মুনিকন্যা প্রচেতা-নামের দশভাইকে বিয়ে করেন। অর্থাৎ দুই ক্ষেত্রেই পাঁচের থেকে সংখ্যাটা বেশি । এর পর ব্যাসদেব এসেও বোঝালেন নানা ভাবে এবং দ্রুপদ এই আশ্চর্য বিবাহপ্রস্তাবে রাজী হলেন। আর বিয়ে শুরু হল। পাঁচ দিন ধরে। পর পর। প্রথমে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করলেন। তারপর ভীম। তারপর অর্জুন, নকুল এবং সহদেব।
এ কথা সত্য, যে দ্রৌপদী নিজেও পাঁচ জনের প্রতিই আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন। তা নয়ত তাঁর মত তেজস্বিনী মেয়েকে জোর করে কেউ বিয়ে দিতে পারতেন না। কিন্তু এও তো ঠিক, অর্জুন ছিলেন তাঁর প্রথম মুগ্ধতা। প্রথম প্রেম । সেই অর্জুনকে তিনি কতটুকুই বা পেলেন! ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করা শুরু করতে না করতে অর্জুনকে যেতে হল বারো বছরের জন্য বনবাসে । সেখানে উলূপী আর চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে তিনি মিলিত হলেও তাঁরা দুজনেই ছিলেন অস্থায়ী সাথী । কিন্তু সুভদ্রাকে নিয়ে ফিরলেন অর্জুন বনবাসশেষে। বারো বছরের বিরহের পর দয়িত ফিরলেন আরেক সঙ্গীনীকে সঙ্গে নিয়ে!!! কী বিপুল বেদনা!!! যুগে যুগে মেয়েদের এইভাবেই ভাগ করে নিতে হয়েছে নিজের ভালোবাসা। ভাবলে হৃদয় নিংড়ানো যন্ত্রণা উঠে আসে!! অর্জুনকে দ্রৌপদী সবচেয়ে কম পেয়েছেন। যাঁকে দেখে স্বয়ংবর সভায় তাঁর মন উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল, আশা-নিরাশার দোলায় কেঁপে উঠেছিল দেহ-মন, যখন সেই মানুষটি লক্ষ্য ভেদ করলেন, তখন আনন্দে উত্তেজনায় বেপথু হয়ে দাঁড়িয়ে পর্যন্ত থাকতে পারছিলেন না স্থির হয়ে; সেই অর্জুনকে সবথেকে কম পেলেন জীবনে । তাই সমস্ত অপমান লড়াই বঞ্চনা ছাপিয়ে তাঁর মন চিরকাল ধেয়ে গেছে সেই অর্জুনের দিকেই। সচেতনে না হলেও অবচেতনে সেই না পাওয়ার শূন্যতা তাঁকে ঘিরে থাকত সর্বক্ষণ । তাই তো জীবনের অন্তিম ক্ষণে, লুটিয়ে পড়ার পর সেই সত্যটি উদ্ভাসিত হল যুধিষ্ঠিরের কথায়, দ্রৌপদী অর্জুনকে সবার থেকে অনেক, অনেক বেশি ভালোবাসতেন।
অথচ দ্রৌপদীকে আবার সবথেকে বেশি ভালো বাসতেন মেজ ভাইটি। স্বয়ংবর সভায় অর্জুনের পাশাপাশি তিনিও তো লড়াই করেছিলেন। যুধিষ্ঠির তাই বলেইছিলেন যে অর্জুন ছাড়া আর কেউ যদি দ্রৌপদীর সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, তো তিনি ভীম। দ্রৌপদীর সমস্ত ছোটবড় ইচ্ছে পালন করেছেন কে? দ্রৌপদীকে সর্ব অর্থে রক্ষা করেছেন কে? কে পাশাখেলার পর দ্রৌপদীর অপমানে গর্জে উঠে দাদার হাত পুড়িয়ে দিতে চেয়েছেন? কে দ্রৌপদীকে সভামধ্যে বেশ্যা বলে নিজের কোলে বসার বিশ্রী ইঙ্গিত করার জন্য দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা করেছেন? বস্ত্রহরণের প্রতিশোধ নিতে দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত খাওয়ার মত ভীষণ শপথ নিয়েছেন? অজ্ঞাতবাসপর্বে কীচক যখন বিরাট রাজার সভার সৈরিন্ধ্রীকে হিঁচড়ে টেনে আনল, কে তাকে মেরে হাতপা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে বীভৎস ভাবে মারলেন?
শুধুই নীরেট মারপিট নয় কিন্তু। দ্রৌপদীর পছন্দের ফুলটি আনার জন্য কি না কাণ্ড করেছিলেন ভীম। এই একটা মানুষের জন্যই দ্রৌপদী নাথবতী অনাথবৎ হয়েও হন নি। তবুও ভীম দ্রৌপদীর হৃদয়ে সেই জায়গাটি পেলেন না, যা পেলেন অর্জুন । শুধু love at first sight নয়। আসলে বিরহই বোধহয় আসল প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখে। বিচ্ছেদ আর দূরত্ব প্রেমকে অভ্যাসে পরিণত হতে দেয় না। মনে করুন, মেঘদূতম্ এর সেই যক্ষকে। তার সেই মেঘকে বাহক কল্পনা করে প্রিয়ার কাছে পাঠানোর সেই চরম Romanticism কি বিরহব্যথা না থাকলে তৈরি হত? কৃষ্ণের সঙ্গে রুক্মিণী, সত্যভামার নাম উচ্চারিত হয় কি? হয় সেই বিরহিণী রাধার নাম। যার মান ভাঙাতে কিশোর কৃষ্ণ তার পদপল্লব তুলে মাথায় রেখেছিল, বলেছিল ” স্মর-গরল-খণ্ডণম্ মম শিরসি মণ্ডণং, দেহি পদ-পল্লবমুদারম্”; যে মেয়েটি যা কিছু কালো তার মধ্যেই তার প্রেমাস্পদকে খুঁজে পেত! এই আকুলতার মধ্যেই প্রেমের জয়। তাই ভীমের এতখানি ভালোবাসা অর্জুনের কাছে হেরে গেছিল।
অধ্যাপিকা, শিক্ষা বিজ্ঞান বিভাগ, রামকৃষ্ণ সারদা মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন ।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহী, লেখালেখি করার বদভ্যাস আছে। পৌরোহিত্য করেন, মূলত পুরোনতুন বৈদিক পদ্ধতিতে বিবাহ দেন এবং রবিগান কঠোপনিষদ ও ঋক্ মন্ত্রসহ অন্যরকমভাবে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
Related