| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি

নারী পুরুষের মিলন কাহিনী (পর্ব-১৯)

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

বিবাহ  মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ১৯পর্ব।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
রাম যখন sweet sixteen এ পা দেব দেব করছেন, তখন একদিন অযোধ্যার রাজসভাতে এলেন বিশ্বামিত্র মুনি আর রাজা দশরথের থেকে রাম-লক্ষ্মণকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন, কারণ তিনি এক মহাযজ্ঞ করছেন আর মারীচ আর সুবাহু নামে দুই রাক্ষস সেই যজ্ঞের আগুনে মাংস আর রক্ত ছুঁড়ে বাধা দিয়েই চলেছে, তাদের আটকাতে রামকে তাঁর চাই। বিশ্বামিত্রের ইচ্ছে অনুযায়ী রাম চললেন তাঁর সঙ্গে আর তাঁর সঙ্গী হয়ে ছায়ার মত চললেন ভাই লক্ষ্মণ । বিশ্বামিত্রের যজ্ঞ নির্বিঘ্নে শেষ হল। তারপর দুই ভাইকে নিয়ে মুনি গেলেন জনক রাজার রাজ্যে। জনককে অনুরোধ করলেন শিবের ধনুটি, হরকার্মুকটি রামকে দেখাতে। এইখানে প্রথম সীতার উল্লেখ এল। ব্রহ্মর্ষি রাজা জনক বললেন তাঁর অযোনিসম্ভূতা কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ের কথা, তাও কখন, না যখন রাজা ক্ষেত চষছিলেন, সেই সময় ! ভাবা যায়!! রাজামশাই হাল চালাচ্ছেন, ক্ষেত চষছেন; এমন না হলে রাজা কীসের! আর সেই রাজা, এক অজ্ঞাতকূলশীল ফেলে যাওয়া মেয়েকে আপন মেয়ের মত করে তুলে নিলেন! Adopt করা, তাও আবার কন্যাসন্তানকে, তাও এমন একজনকে, যার নাকি মা-বাপের ঠিক নেই!!! কতটা নিজের করে নিয়েছিলেন সেই কন্যাকে, তা টের পাই যখন নিজের ঔরসজাত কন্যা ঊর্মিলার পরিচয় দিচ্ছেন ছোট মেয়ে বলে। বড় মেয়ে সীতা যে!
সেই ধনু তো এল। বিরাট এক আট চাকার গাড়িতে করে, লোহার তৈরি সিন্দুকে শোওয়ানো, পাঁচ পাঁচটি হাজার লোক সেই গাড়িকে ঠেলতে ঠেলতে কোনোরকমে নিয়ে এল। সেই বিশাল আর ভারী ধনুটিকে রাম অবলীলায় তুলে গুণ পরাতে গিয়ে ভেঙে ফেললেন! এমন আওয়াজ হল যে রাম লক্ষ্মণ বিশ্বামিত্র আর জনক ছাড়া সব একেবারে পপাত চ মূর্ছিত চ!!!! 
এবার জনক তো আগেই বলেছিলেন, এই ধনুতে যিনি গুণ পরাবেন, সীতা হবে তাঁর। ঠিক দ্রৌপদীর মত, বীর্যশুক্লা বলা হত এমন কন্যাকে, যাঁকে অর্জন করতে হয় বীরত্ব দেখিয়ে। আমন্ত্রণ পেয়ে দশরথও উপস্থিত হলেন। ঠিক হল রামের সঙ্গে সীতার, লক্ষ্মণের সঙ্গে ঊর্মিলার; আর জনকের ভাই কুশধ্বজের দুই মেয়ে মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তির সঙ্গে ভরত ও শত্রুঘ্নের বিয়ে হবে। 
এক দিনেই চারজনের বিয়ে স্থির হল।
বিয়ের দিন, দশরথ রাজার কুলপুরোহিত বশিষ্ঠমুনি, রাম-লক্ষ্মণকে নিয়ে আসা বিশ্বামিত্র মুনি আর রাজা জনকের পুরোহিত শতানন্দ মিলে যজ্ঞবেদী রচনা করলেন। সঙ্গে গুছিয়ে রাখলেন সুগন্ধী ফুল, যবের শীষভরা ছবিআঁকা ঘট, ধূপদানী, শঙ্খ, লাজ বা খই রাখার পাত্র। তারপর যজ্ঞাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হল আর জনক এসে রামকে বললেন, তুমি এই মেয়ের হাতটি তোমার হাতেতে নাও, তোমাদের মঙ্গল হোক । এই বলে রামের হাতে জল দিলেন। রাম-সীতা তিনবার অগ্নি প্রদক্ষিণ করলেন। এইভাবে পর পর বিয়ে হল চার রাজপুত্র রাজকন্যার। এখানে উল্লেখ্য, সম্প্রদান শব্দটি থাকলেও যেভাবে কন্যাসম্প্রদান পরবর্তীতে প্রচলিত হয়েছিল, এখানে তা একেবারেই অনুপস্থিত । বরং বৈদিক বিবাহের পাণিপীড়নের সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে, যেখানে কন্যার হাতটিকে বরের হাতে প্রদান করা হয়। যেখানে বর বলেন,
পতি ও পত্নী একই সঙ্গে 
দুজনে বৃদ্ধ হব,
সে-ভাগ্য চেয়ে তোমার হাতটি আমার হাতে নিলাম।
পুরন্ধি ভগ অর্যমা আর
সবিতা দেবতা তোমাকে আমার
গার্হস্থ্যের সঙ্গিনী করে দিলেন সম্প্রদান।
এই অপরূপ বাংলা অনুবাদটি পেয়েছি আমরা গৌরী ধর্মপালের থেকে। কী অপূর্ব প্রেমময় উক্তি বলুন! জানি না, জনক এই মন্ত্রই রামকে বলিয়েছিলেন কিনা, তবে এইভাবেই চার রাজকন্যার হাত দেওয়া হল চার রাজপুত্রের হাতে। পর দিন সকালে এই চার নববিবাহিত দম্পতিকে নিয়ে দশরথ রওনা হলেন অযোধ্যার পথে।
সেখানে কৌশল্যা সুমিত্রা কৈকেয়ী আর সব রাণীরা মিলে সাদরে বরণ করলেন তাঁদের। তারপর সে এক সুখের কাল! নিভৃত নির্জন চারিধার জগতে কেহ যেন নাহি আর! প্রাসাদের মধ্যেই সুমধুর মধুচন্দ্রিমা! বারো বছর ধরে চলল এই পরস্পরে মত্ত সময়। আদরে ভালোবাসায় বন্ধুত্বে একেবারে হৃদয় ভরে উঠল সবার, বিশেষ করে রাম-সীতার!

 এর কিছুদিন পর ভরত শত্রুঘ্নকে নিয়ে গেলেন মামারবাড়ি আর অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের সুখশান্তি  তছনছ হয়ে গেল! তাই নিয়ে আগেও বলেছি। আর পুনরাবৃত্তি করছি না। শুধু রাম বনবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে গেলেন প্রথমেই গেলেন মা কৌশল্যার কাছে, সেখান থেকে এলেন সীতার কাছে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সীতা রামকে দেখামাত্র বুঝলেন নির্ঘাত বড়সড় কোনো গোলমাল ঘটেছে। রামের মলিন মুখটি দেখে তাঁর মন উদ্বেলিত হয়ে উঠল আশঙ্কায়। রাম সব কিছু খুলে বলে সীতাকে বললেন, আমি তো বনবাসে চললাম । দীর্ঘ চোদ্দ বছর তোমাকে আর দেখতে পাব না, আজই শেষ রাত। তাই দেখা করতে এলাম।
সীতা তো অবাক। তিনি উত্তর দিলেন, তোমার কথা শুনে তো হাসি চাপতে পারছি না! তুমি কী সব উল্টো পাল্টা বলছ! এই নাকি তুমি লেখাপড়া শিখেছ, এই নাকি তুমি মহাবীর! শোন, আমি আগেও তোমার সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যেতে চেয়েছি, এই ফাঁকতালে তাই তো দিব্যি হয়ে যাবে। কী মজাই না হবে! কতদিন ধরে কল্পনা করেছি যে এমন এক জায়গায় যাব যেখানে পশুপাখি ছাড়া আর কেউ থাকবে না, নাম-না-জানা সব ফুলের গন্ধে ভরে থাকব আমরা, পুকুরে পুকুরে পদ্ম ফুটে আলো হয়ে থাকবে, হাঁস আর কারণ্ডবের কলরব ভেসে আসবে, সেই পুকুরে ডুব দিয়ে দিয়ে স্নান করব! আহা! এ আমার কত দিনের স্বপ্ন পূরণ যেন। তুমি আর আমি, শুধু তুমি আর আমি!
রাম অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন। জলাশয়ে পদ্ম আর হাঁসের বদলে পাঁক আর কুমীর ভর্তি থাকতে পারে, জঙ্গল মানেই হিংস্র প্রাণীর ভয়, পা ফেললেই কাঁটা ফোটার যন্ত্রণা এমন যতরকম বিপদ হতে পারে সবব বললেন। সীতার এক কথা। শেষে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমাকে দেখে যেমন শক্তিশালী পুরুষ মনে হয়, তা তো তুমি নও দেখছি! মেয়েদের মত ভয় পাচ্ছ যে! সোজা কথা হল আমি যাব এবং যাব এবং যাব! আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছ, এখন ফেলে পালানোর মতলব! ওসব হবে না। তাছাড়া এই বনবাসে কোনো অসুবিধা তো দেখতে পাচ্ছিই না, বরং আমি মহানন্দে থাকব তোমার সঙ্গে, তোমার বুকের কাছটিতে।
তখন রাম সীতাকে একেবারে জড়িয়ে ধরলেন! আসলে নিজে থেকে তো বলতে পারছিলেন না স্ত্রীকে, যাঁর পরদিন যুবরাণী হওয়ার কথা, তাঁকে কোন মুখে বলবেন বনে চলো সব ছেড়ে! সীতার আকুল ভালোবাসায় ভরা কথা শুনে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। তবে রাম কিন্তু একবারও বলেন নি যে মেয়েদের বনে যাওয়া উচিত নয় বা পথি নারী বিবর্জিতা জাতীয় কথা। হ্যাঁ, বনজঙ্গল বিপদে ভরা, সবার জন্যই সেই যাত্রা কষ্টকর, একথা বলেছেন বইকী! আর বাড়িয়ে বাড়িয়েই বলেছেন। জোর করে সীতাকে নিয়ে গেলে রামকে আরোও না জানি কত গালি হজম করতে হত! 
পর দিন রাম সীতা ও লক্ষ্মণ, একসঙ্গে হাজির হলেন রাজসভায়। কৈকেয়ীর এনে দেওয়া চীর বস্ত্র পরলেন। সীতা কিভাবে তা পরবেন বুঝতে না পেরে দুটি চীরের টুকরো হাতে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে রাম সযতনে তা সীতার কৌষেয় পরিধানের ওপরেই তা জড়িয়ে দিলেন। দেখুন, এখানে অনেকটা সেই বাহুবলী দেবসেনার মত লাগছে না! ভরা সভায় সীতাকে ভালোবেসে নিজের হাতে কাপড় পরিয়ে দিচ্ছেন রাম! এই টুকরা গুলিও মনে রাখতে হবে। একটা রাগের মধ্যে মধ্যে করা টুকরাগুলি অনেক সময় অসাধারণ এক  একটি সৃষ্টি হয়ে ওঠে, সবটা নিয়েই একটা রাগের সৌন্দর্য্য! বস্তুত যে কোনো সার্থক উপন্যাসের চরিত্রের মতোই রামায়ণ মহাভারতের চরিত্রগুলির কোনোটাই পুরো সাদা পুরো কালো নয়! আর কয়েক হাজার বছর ধরে সমান জনপ্রিয়, শত্রু মিত্র সবাইকে সমানভাবে উদ্দীপ্ত করা এমন লেখা পৃথিবীতে ক’টি আছে বলুন তো!
যদিও এ নারী পুরুষের মিলন কাহিনী, তবু মিলন কাহিনীই তো! তাই একটু দুই পুরুষের মিলন, দুই বন্ধুর মিলন নিয়েও বলাই যায়, তাই না? বলি, কারণ কতগুলো কথা বলতে লোভ হচ্ছে ।
 রামের জীবনের কয়েকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় আছে। তার অন্যতম শম্বুক বধ। এক তাপস, শূদ্র, সে ঘোর তপস্যা করছিল সশরীরে দেবত্বলাভ করার জন্য । এই পাপেই নাকি এক ব্রাহ্মণের পুত্র অল্প বয়সে মারা যায়; অথচ সে সময় অকালে কারুর মৃত্যু হত না! ব্রাহ্মণদের অভিযোগ পেয়ে রাম সেই তাপসকে খুঁজে বার করে হত্যা করেন।
 এই কাহিনীটি আমরা সবাই জানি এবং রামের নিন্দায় মুখর হই। একটি বিশেষ রাজনৈতিক পন্থা এই ঘটনাটি দিয়ে রামকে শরশয্যায় শুইয়ে দেয় এবং স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই যে অত্যন্ত নৃশংস হত্যা এটি। কিন্তু এর মাধ্যমেই যদি রামকে চিহ্নিত করা হয় শূদ্রের শত্রু রূপে, তাহলে গুহ আর রামের বন্ধুত্ব নিয়ে কী বলবেন! গুহ ছিলেন নিষাদ রাজা, রামের প্রাণসম প্রিয় বন্ধু । রাম বনবাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে গুহের রাজ্যের সীমায় এসেছেন শুনে ছুটে এলেন বন্ধু গুহ। রামকে জড়িয়ে ধরে, চণ্ডাল রাজা গুহ জড়িয়ে ধরছেন ইক্ষ্বাকু বংশের রামকে–আমন্ত্রণ জানালেন নিজের রাজ্যে। রামও বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে সব কথা বললেন এবং তাঁরা সারারাত এক সঙ্গে কাটালেন। রাম সীতা লক্ষ্মণ এবং গুহ।
 আরেকটা গল্প বলি এই প্রসঙ্গেই। যা আছে উত্তরকাণ্ডে। অবশ্য এই গল্পটিকে আপনারা প্রক্ষিপ্ত বলতেই পারেন, কারণ উত্তরকাণ্ডকে প্রক্ষিপ্ত অংশই বলা হয়ে থাকে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সীতার নির্বাসন ইত্যাদিকেও প্রক্ষিপ্ত ধরতে হবে! 
গল্পটি এরূপ, এক সকালে রামের কাছে বিচারপ্রার্থী হয়ে এল একটি কুকুর । হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। একটি কুকুর। তার অভিযোগ একটি ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে। সেই ব্রাহ্মণ তাকে অকারণে লাঠি দিয়ে  মেরেছেন। রাম সেই ব্রাহ্মণকে ডেকে পাঠালেন। সে নিজ অপরাধ স্বীকার করল এবং সেই কুকুরটির ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে শাস্তি দেওয়া হল! একটি মনুষ্যেতর প্রাণী, তার কথায় বর্ণশ্রেষ্ঠের শাস্তি হল! যে কাণ্ডে শম্বুকবধ, সেই কাণ্ডেই এই গল্প! তাই এক কথায় রাম শূদ্রবিরোধী চূড়ান্ত খারাপ লোক ছিলেন, তা কী বলা যায়! তাহলে গুহ কি রামের এমন বন্ধু হতেন!
 বনবাসে এগোই এবার। গুহর রাজ্য পেরিয়ে রাম এলেন ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে। এইখান থেকেই সীতার মধুর স্বপ্নপূরণ শুরু হল বলা যায়। ভেলায় করে রাম লক্ষ্মণের সঙ্গে যেতে যেতে অচেনা গাছ আর ফুল চিনতে চিনতে স্রোতের অনুকূলে এগিয়ে যেতে লাগলেন তিনজনে। মাঝে মাঝে আবার লক্ষ্মণ সীতার ইচ্ছে মতো ফুল পেড়ে এনে দিলেন। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর যমুনানদীর ধারে, নানান পশু শিকার করে মহানন্দে মাংস খেলেন। তারপর ময়ূরের কেকা, হাতীর বৃংহন, আর বাঁদরদের কিচিরমিচির শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লেন। 
পর দিন সকালে চিত্রকূট পাহাড়ের কাছে, বাল্মীকির আশ্রমে পৌঁছে গেলেন তাঁরা। আর তার কাছেই পর্ণকুটির বাঁধলেন লক্ষ্মণ। নিয়ে এলেন কৃষ্ণমৃগ। সেটিকে রীতিমতো তন্দুর করা হল! শুরু হল রাম সীতা লক্ষ্মণের বনবাসে বনভোজনের আনন্দ! সামনেই পাহাড়, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মাল্যবান নদী ( পরে আবার ভরতের মুখে আছে মন্দাকিনী নদী), চারিদিকে শুধু পাখির ডাক; নির্বাসন-টনের দুঃখ ভুলে মহানন্দে থাকতে আরম্ভ করলেন তাঁরা।
 এইখানে কিছুদিন থাকার পর বনে বনান্তরে ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা এলেন অগস্ত্য মুনির আশ্রমে। তাঁরই নির্দেশে নতুন করে ঘর বাঁধলেন গোদাবরী নদীর কাছে, পঞ্চবটী বনে ( নিজাম রাজ্যের কাছে, মতান্তরে নাসিকের কাছে: রাঃবসু, পৃঃ ১৫৮)।
 সীতা দেখলেন এ যে একেবারে তাঁর কল্পনার রাজ্য! রাম যেখানে কুটির বাঁধলেন, একটি সমতল প্রশস্ত স্থান, চারিদিকে জঙ্গল ঘন জমাট সবুজ, শাল তাল তমাল আম অশোক পনস পুন্নাগ চাঁপা চন্দন খেজুর গাছ, খানিক দূরে কুলুকুলু গোদাবরী, আর কাছেই সেই পদ্মফুলে ভরা এক দীঘি। তাতে হাঁস আর কারণ্ডব চক্রবাক পাখি খেলে বেড়াচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে নানা পশু-পাখিতে পরিপূর্ণ, অর্থাৎ মাংসের যোগানও অঢেল।
এইখানে বলি রামেরা মাংস ছাড়া বেশিদিন থাকতে পারতেন না। অর্থাৎ আদ্যন্ত ননভেজ ছিলেন তিনজনেই। মানে ক্ষত্রিয়রা তাইই খেতেন। মাছমাংসমদ, সঙ্গে ফলমূলও। রামকে নিরামিষ ভাববেন না মোটেই। এবং সেই মাংস খাওয়ার অভ্যাস এতোই প্রিয় ছিল যে  এখানে, পঞ্চবটীতে আসার আগে সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রমে তিনি চাইলেও রাম বেশি দিন থাকতে চাননি। বলেছিলেন এই কথাই, “আমি যদি তীক্ষ্ম শরে সেই সকল মৃগ বধ করি তবে আপনি কষ্ট পাবেন, তা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হবে। এই আশ্রমে আমি দীর্ঘকাল বাস করতে পারব না (রাঃ বসু, পৃঃ ১৫৩)”।
এই পঞ্চবটীতেই রাম-লক্ষ্মণের দোষেই তাঁদের ওপর নেমে এল মহা বিপদ।
আগের সবকটি পর্ব পড়তে ও ড. রোহিণী ধর্মপালের অন্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত