| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক লোকসংস্কৃতি

নারী পুরুষের মিলন কাহিনী (পর্ব-২৪)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বিবাহ  মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ২৪পর্ব।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
এই পর্বটি উৎসর্গ করতে চাই “না” বলতে পারা সমস্ত মেয়েদের। যে মেয়েটি জীবনের সব স্বপ্ন বলি দিয়েও চেষ্টা করে গেছে স্বামীকে, শ্বশুরবাড়িকে খুশি করার, তার পরেও মার খেয়ে কালশিটে পড়ে গেছে যখন, তারপরে আবার হাত উঠলে  প্রাণপণ শক্তি দিয়ে নিজেও মেরে বসেছে; যে মেয়েটা রক্তাক্ত অবস্থাতেও স্বামীর যৌন চাহিদা মেটাতে বাধ্য হয়েছে মাসের পর মাস, তারপর একদিন চিৎকার করে না বলে উঠেছে; যে মেয়েটার স্বামীর যৌনতাই নেই, প্রজনন ক্ষমতাই নেই, অথচ স্ত্রীরই দোষ, এই শুনতে শুনতে ক্লান্ত একদিন সবার সামনে সমস্ত সত্যি গলা ফাটিয়ে বলে দিয়েছে; হীনমন্যতায় ভোগা স্বামীর প্রতি মূহুর্তের তীক্ষ্ম তীব্র অভিযোগের তীর সইতে সইতে একদিন উদাসীন হয়ে গেছে যে মেয়েটি; মদ্যপ স্বামীর লাথি আর গালিগালাজ পেতে পেতে যে মেয়েটি একদিন আরেকটি পুরুষের হাত ধরেছে, তারপর সেখানেও স্বপ্ন ভঙ্গ হলে আরেকটির, শুনতে হয়েছে বেশ্যা আখ্যা; সেই প্রতিটি মেয়ের জন্য এই পর্বটি।
আমি মনে করি, বিশ্বাস করি যে সীতা প্রথম সেই মেয়ে, যে স্বামীকে দেবতার মতো ভক্তি করে, উন্মত্তের মতো ভালোবেসেও শেষ পর্যন্ত নিজের সম্মান বজায় রেখেছিলেন। প্রত্যাখ্যান করেছিলেন রামকে। চিরদিনের মতো। সীতার পাতালপ্রবেশ রামকে প্রত্যাখ্যান ছাড়া আর কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারি না। সীতা আত্মহত্যা করেন নি। সীতা দ্বিতীয় বার অগ্নি পরীক্ষা দেন নি। কিন্তু আর কারুর দিকে ফিরে তাকান নি। রামকে ছেড়ে, অযোধ্যা ছেড়ে, প্রেম বাৎসল্য ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। আমরা মেয়েরা, শত প্রতিকূলতাতেও ছেড়ে দিতে পারি না। বড্ড আঁকড়ে থাকা স্বভাব আমাদের। আর খালি ভাবতে থাকি, এই বার; এইবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ভালোবাসা দিয়ে, আমার স্নেহ আর সেবা দিয়ে, আমার শরীর দিয়ে আমি সব ঠিক করে দেব। অদ্ভুত বিশ্বাস অদ্ভুত ভরসা নিজের প্রেমের ওপর। মেয়েরা ভুলে যায়, অধিকাংশ পুরুষের কাছে শেষ প্রেম হল তার কর্ম। তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা । আর কিছু না থাকলেও নিজের জেদ। অহম্। সবার উপরে ইহাই সত্য। প্রেম? মাথা নত করা তার কাছে? সে তো দুর্বলতার পরিচয়! হায় রে! প্রেমের কাছে হার মানতে যে কত বড় হৃদয় লাগে, কতখানি ঔদার্য লাগে, কতখানি শক্ত হতে হয়, তা তোমরা আজোও জানো না।
এইখানে বলি, আমি পুরুষবিরোধিতা করছি না। কিন্তু “স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম্ দেবা ন জানন্তি”র বিরোধিতা করছি। মেয়েদের বোঝা বড়ই সহজ। সামান্য কথায় যারা অভিমানী হয়ে ঠোঁট ফোলায়, একটু আদুরে গলা পেলে যে আনন্দে ভরে ওঠে; তার চরিত্র বুঝতে এত অসুবিধা হে প্রেমিক হে স্বামী? তাহলে তো তোমার বুদ্ধিসুদ্ধির গোড়াতেই গলদ হে! আর বিরোধিতা করছি পুরুষতান্ত্রিকতার। পুরুষের সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে গুলিয়ে ফেলবেন না। বলছিলাম না, রামের কাজের প্রতিবাদ কেউ করবে না? করেছেন। এখনকার মেয়েদের কথা বলছি না। অনেক দিন আগে। করেছেন এক কবি। এক পুরুষ। ভবভূতি। তাঁর রচনার মধ্যে দিয়ে। উত্তররামচরিতে। আমার জানার এ কথা নয়। আমি জেনেছি গৌরী ধর্মপালের থেকে। তাঁর অনবদ্য এক প্রবন্ধ “কবি ভবভূতি” থেকে। উত্তরকাণ্ডেও রাম শোক করেছেন, কিন্তু উত্তররামচরিতে রামকে কবি কাঁদিয়ে ছেড়েছেন। সীতা বিসর্জনের পর সীতাশূন্য পঞ্চবটীতে এসে রাম বিলাপ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন,
হা হা দেবি স্ফূটতি হৃদয়ং ধ্বংসতে দেহবন্ধঃ
শূন্যং মন্যে জগদবিরলজ্বলমন্তর্জ্বলামি।
সীদন্নন্ধে তমসি বিধুরো মজ্জতীবান্তরাত্বা বিষ্বঙ্মোহঃ স্থগয়তি কথং মন্দভাগ্যঃ করোমি!! তৃতীয় অঙ্ক |৩৮
 “বুক ফেটে যায় রাণী 
দেহবন্ধ যায় টুটে
পৃথিবী যেন শূন্য লাগে মোহে।
অন্তরে জ্বলে দহন তীব্র 
অত্মরাত্মা পুড়ছে নিত্য 
অন্ধকারে ডুবছি যেন
কপাল এতোই মন্দ মম।”
পঞ্চবটীবনে ঢুকেই রাম হাহাকার করে বলছেন, 
“প্রিয়ার সঙ্গে থেকেছি যেখানে কতদিন…কতদিন
যেখানে গাছের পশুরা আমার মিতা।
গিরিতট…কত ঝরণা ঝরছে…গুহা…
এই সেই গোদাবরী উপত্যকা।” উ:রা:চ ৩|৮(অনুঃ গৌরী ধর্মপাল )
সীতার সখী বাসন্তীর মুখে কেমন অনুযোগ বসিয়েছেন ভবভূতি, দেখুন, 
“তুমি মম প্রাণ, দ্বিতীয় হৃদয়, 
অঙ্গে অমৃত, তুমি কৌমুদী নয়নে-
এই সব আরো কত শত প্রিয়বচনে
সেই সরলাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে অবশেষে কিনা
থাক-” উ:রা:চ:৩|২৬ (অনুঃ গৌরী ধর্মপাল )
ছলাকলা নাকি মেয়েরাই পারে! ছেলেরা কম যায় নাকি!
ভবভূতি দুর্মুখ নামে এক চর চরিত্র সৃষ্টি করেছেন এখানে, যে রামকে সীতার অপবাদ রটেছে কেমনভাবে, সেই সংবাদ দেয়; কিন্তু রাম যখন সীতা বিসর্জনের সিদ্ধান্ত নেন, সেই বলে, 
“যিনি অগ্নিশুদ্ধা
যিনি অন্তঃসত্ত্বা 
কুলোকের কথা শুনে
তাঁকে দিচ্ছেন বিসর্জনে”? উ:রা:চ:, প্রথম অঙ্ক
রামও কিন্তু বলছেন, 
“দুঃখই পেতে কেবল কি রামে দিয়েছিলে মাগো চেতনা
মর্মঘাতী এ বজ্র-গজাল বুকে বিঁধে আছে প্রাণ-
যায় না, কেন মা যায় না”? উ:রা:চ: ১|৪৭ (অনুঃ গৌরী ধর্মপাল )
নাটকের চতুর্থ অঙ্ক কবি এনেছেন জনককে। কৌশল্যাকে দেখে দূর থেকেই জনক বলছেন,
“আমার কাছে যিনি ছিলেন মহোৎসবের আনন্দ 
আজ তিনিই কাটা ঘায়ে নুনের মতো অসহ্য”! ৪|৭
অরুন্ধতীকে জিজ্ঞাসা করছেন চূড়ান্ত ব্যঙ্গ ভরে,”(শুধু ) প্রজার পালক যে রাজা,  তার মা কেমন আছেন”? আর তার পরেই বলছেন, “হুঁ, কে ব্যাটা এই অগ্নি, যে আমার সীতা শুদ্ধ না অশুদ্ধ পরীক্ষা করবে”!
এ কথার উত্তরে অরুন্ধতী কি বলছেন? না,  সীতা ইতি এবং পর্যপ্তম্ । অর্থাৎ কিনা “সীতা, এই নামটিই যথেষ্ট সে শুদ্ধ কিনা জানতে”। রামকে কেমন হ্যাটা করা হয়েছে দেখুন! একের পর এক আক্রমণ! রামজননী কৌশল্যা চলে এসেছেন বাল্মীকির আশ্রমে, আর সীতাকে খুঁজছেন আর বলছেন, 
 “সীতাকে সবাই বলতেন
রাঘববংশের পুত্রবধূ 
দশরথ বলতেন, না
এ তো মেয়ে আমাদের, নয় তো বধূ”!
উত্তররামচরিতে কবি শেষে মিলন দেখিয়েছেন। সবাই ছেড়ে চলে যাওয়া সীতা আবার ফিরে এসেছেন। বাল্মীকির আশ্রমে রামসীতার নাটক দেখানো হচ্ছে সবাইকে, সেই নাটকের সীতাকে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে হাহাকার করে উঠছেন দর্শক রাম। লক্ষ্মণ বলছেন, “এ কী, দাদা! এতো বিচলিত হচ্ছেন! এ তো নাটক মাত্র!” নাটকেই সীতা পৃথিবীমায়ের কাছে চলে যাচ্ছেন, রাম চেতনা হারাচ্ছেন! শেষে স্বয়ং সীতাকে এসে হাত বুলিয়ে রামের জ্ঞান ফেরাতে হচ্ছে!!! আর সবাই একত্র হচ্ছেন।
এইভাবে বাল্মীকির উত্তরকাণ্ডের সমুচিত উত্তর দিয়েছেন কবি ভবভূতি।    মেরুদণ্ডহীন রামকে, দুর্বিনীত প্রজাদের, অগ্নিকে সপাটে থাপ্পড় মেরেছেন আর শেষে মিলিয়ে দিয়েচেন নায়ক- নায়িকাকে।
 তাই সীতার চলে যাওয়ার বেদনাকে, রামের ভয়ানক অন্যায়কে এইভাবে পরিশুদ্ধ করেছেন ভবভূতি। রামায়ণকে ধরে রাম সীতার বিচ্ছেদকেই চিরস্থায়ী না করে বরং উত্তররামচরিতকেই ঠাঁই দিই মনে? যেখানে চার ভাই, তাদের চার বউ আর সবার দুটি করে পুত্র মিলে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ভবিষ্যতের দিকে?
এর পরের পর্বে আবার ফিরব মহাভারতের মহারণ্যে। ভেবেছিলাম রামায়ণ দ্রুত শেষ হবে, রাম-সীতার গল্পে কি আর নতুন বলার আছে! ভুল ভেবেছিলাম। হয়ত ভেতরে ভেতরে আরোও কিছু রয়ে গেছে। অন্য কাহিনী বলার সময় টুক করে ঢুকে পড়বে! আপাতত দেখি, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু আর বিদুর কত বড়টি হলো! তাদের জীবনে কোনো মেয়ের আগমন হলো কিনা!
[চলবে]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত