আমাদের ছোটবেলাতেও কালগুলো সব নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে ঝকঝকে তকতকে হয়ে সেজেগুজে আসত! কাল মানে এই শীত হেমন্ত বসন্ত এদের কথা বলছি। বেচারা হেমন্ত ! গরম তাকে ঠেলতে ঠেলতে শীতের ওপর ফেলে দিয়েছে, তাকে খুঁজেই পাওয়া যায় না আর! এখন তো সারা বছরের অধিকাংশটাই গরম। হালকা গরম, গ্যালগ্যালে ঘামা গরম, ভেপসে পচে ওঠা গরম, তাতে পুড়ে ওঠা গরম, শুকনো গরম। এই পাঁচ ঋতু, সঙ্গে ওই দয়াদাক্ষিণ্যের মত করে কিছুটা শীত। ব্যস, ছয় ঋতু শেষ। ওই চিকেন পক্স নিমপাতা সজনে ফুল দিয়ে বসন্ত এসেছিল গোছের একটা ভাব মনে আসে শুধু!!!
তা মহাভারতের যুগ তো আমাদের ছোটবেলারও অনেক অনেক অনেক আগে, সেই সময়ের বসন্তর স্বাদের তারই আলাদা! রাজা উপরিচর বেচারা কামার্ত অবস্থায় শিকার করছেন, ওদিকে বসন্ত তার পসরা নিয়ে বনেও হাজির। সেখানে অশোক গাছে লাল ফুলের বাহার, চাঁপা গাছে চাঁপা ফুটে মনোহর সুবাসটি ছড়িয়ে দিয়েছে, আমের বউলের হাল্কা গোলাপী আভা আর চাপা সৌরভে মৌমাছিরা মত্ত হয়ে গুনগুন করছে, কোকিলের কুহুরবে কান পাতা দায়! মানে কামোত্তেজনা বাড়ানোর প্রেক্ষাপটটি একেবারে তুখোড় সাজে সাজানো। রাজা তো আর পারছেন না সহ্য করতে সেই চাপ! একটি ফুলে ছাওয়া অশোক গাছের তলাটিতে বসে পড়লেন তিনি, শিকার করা রইল পড়ে, তখন কি আর হাত-পা চলে! চারপাশের ফুলের আর মধুর গন্ধ মেশানো হাওয়া তাঁর সারা গায়ে যেন আদরের হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। তিনি মনে মনেই স্ত্রীকে ভেবে সম্ভোগ করতে লাগলেন । কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই গভীর বনে অশোক গাছের তলায় তাঁর বীর্য পাত হয়ে গেল ।
ভাববেন না এইসব আমার কল্পনা, ব্যাসদেব নিজে বিয়ে না করলে কি হবে, অতি বাস্তববাদী হলেও কি হবে ; দিব্যি রোমান্টিক ছিলেন! এই সমস্ত কথা একটু সাধু ভাষায় তিনিই লিখে গেছেন। সত্যি বলতে কি মহাভারতের নারী পুরুষের মিলন আর তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে লিখলেই ছোটোখাটো আরেকটা মহাভারত হয়ে যায়!
যাক্, বীর্যটি তো বেরোল। রাজামশাই আবার খুব সাবধানী মানুষ । তাই নিজের বেরিয়ে আসা বীর্যটি যাতে নষ্ট না হয়, তাই আঙুল দিয়ে সেই বীর্যটির নির্গত হওয়াকে সংযত করলেন, অর্থাৎ যাতে একটুও এদিক ওদিক না পড়ে, তা নিশ্চিত করলেন। তারপরে সেটিকে অশোকের লালচে কচি পাতায় সুন্দর করে মুড়লেন। করে একটি বাজপাখিকে ডেকে তাকে বললেন এই মোড়কস্থ বীর্যটি যেন তাঁর স্ত্রী গিরিকাকে গিয়ে দেওয়া হয়।
এতক্ষণ বেশ বাস্তবসম্মত বর্ণনা চলছিল। এইবার শুরু হল কল্পনার জাল বিস্তার । এইভাবে পুরুষের বীর্য নানা ভাবে বাহিত হয়ে সন্তান তৈরি হওয়ার গল্প কিন্তু আমাদের মহাকাব্যে পুরাণে আছে। সেইসব গল্পে আসব এক এক করে। এখন এই কল্পনার পরাকাষ্ঠা আবার কৃত্রিমভাবে বীর্যস্থাপনের কথা মনে করায়, যা এই সময়ের একেবারে আধুনিকতম বিজ্ঞান । এই বিতর্কে একেবারেই যাচ্ছি না যে তখন এমন পদ্ধতি ছিল সত্যি সত্যি; তবে কল্পনায় যে ছিল, তা দেখাই যাচ্ছে ।
তা সেই বাজপাখি তো ভালমানুষের পো-র মত সেই মোড়কটি নিয়ে চলল। কিন্তু পথে দেখা হল আরেক বাজপাখির সঙ্গে, যে আবার আমাদের বাহকটিকে আক্রমণ করে বসল। বাহকটিই বা কম কীসে! সুতরাং শুরু হল যুদ্ধ । এ ওকে ঠোঁট দিয়ে মারে, তো ও ওকে নখ দিয়ে আঁচড়ায়। এই করতে করতে মোড়কটি কখন খসে গেছে, টুপ করে পড়ে গেছে তলায় বইতে থাকা যমুনার জলে, সে কি আর হুঁশ থাকে!!!!
তা অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা, কোনো এক ব্রাহ্মণের অভিশাপে— বামুনগুলো যখন তখন বড্ড অভিশাপ দিত বাপু, বলতেই হবে— মাছ হয়ে সেই যমুনার জলে ভুসকুড়ি কেটে বেড়াচ্ছিল, আকাশ থেকে টুপ করে কি পড়েছে দেখে সাঁ করে সাঁতার দিয়ে এসে সেটি খেয়ে ফেলল! ব্যস!!! বেচারি জানলোও না, কি হল!! উপরিচরের সেই জোরালো বীর্যটি গিরিকার বদলে অদ্রিকার মৎস্যজরায়ুতে গিয়ে সক্রিয় হয়ে গেল।
সেই গর্ভযুক্ত মৎসরূপী অদ্রিকা দশ মাস পর ধরা পড়ল জেলেদের জালে। তার পেটটি কাটার পর দুটি মানুষ পাওয়া গেল। একটি পুত্র আরেকটি কন্যা! রাজা পুত্রটিকে গ্রহণ করলেন। সেই পুত্র পরে মৎস্য নাম নিয়েই বড় হয় এবং ধার্মিক রাজা হিসেবে খ্যাতিমান হয়। মাছকে বাপু অবজ্ঞা কোরো না এবার থেকে। এই যে কখনো মাছের কখনো গাছের কখনো পাখির কখনো বাতাসের এইসব কাজকর্ম দেখানোর একটা উদ্দেশ্য আমার মনে হয় এই যে কাউকেই অবহেলা করতে না শেখানো, সবকিছুরই অসীম গুরুত্ব আমাদের জীবনে, এই কথাই কি পরোক্ষভাবে বলা হচ্ছে না! সবটাই হাস্যকর, বলার আগে এই যুক্তিটাও ভাবা দরকার বইকী। প্রকৃতিকে কিন্তু আমাদের বেদ-উপনিষদ মহাকাব্য পুরাণ একেবারে মানুষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী করে জড়িয়ে দিয়েছিল। আর আধুনিক মানুষ প্রকৃতিকে প্রথমে আলাদা করে নষ্ট করতে শুরু করল, এখন বিপদ বুঝে কোথাও কোথাও বাঁচানোর মরীয়া চেষ্টা শুরু হয়েছে; আসলে নিজের স্বার্থেই।
আর কন্যাটি? তার কি হল?