Categories
নারী পুরুষের মিলন কাহিনী (পর্ব-৯)
আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
বিবাহ মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। যুগে যুগে প্রতিষ্ঠানটি এর আদি রূপ থেকে বর্তমান কাঠামোয় উপনীত হয়েছে। বিবাহপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে প্রধানত ধর্ম। বিয়েসংক্রান্ত সকল নিয়মকানুন বিধিবদ্ধ হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসনে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় ধর্মীয় শাস্ত্রের বিধানই ছিল সামাজিক আইন, ধর্মীয় আইনের দ্বারাই শাসিত হতো সমাজ-সংসার। ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতিও বৈবাহিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। মনুস্মৃতি এবং অর্থশাস্ত্রে আট প্রকারের হিন্দু-বিবাহ পদ্ধতির উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্ম’, ‘দৈব’, ‘আর্য’, ‘প্রজাপত্য’, ‘অসুর’, ‘রাক্ষস’, ‘পৈশাচ’ ও ‘গান্ধর্ব’ এই আট ধরনের বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহই শুধু গ্রহণযোগ্য ছিল। দায়ভাগ গ্রন্থে জীমূতবাহন উল্লেখ করেছেন যে, ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রজাপত্য এবং গান্ধর্ব বিবাহ অনিন্দনীয়। ধর্মশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ী নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ ছিল সাধারণ নিয়ম। সবর্ণে বিবাহ উৎকৃষ্ট হলেও মনু ব্রাহ্মণ পুরুষকে নিজ বর্ণ ছাড়া নিম্নতর তিন বর্ণে বিবাহের অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, যেমন চন্ডীমঙ্গলে, মুসলমানদের নিকা বিবাহের কথা বলা হয়েছে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এমনকি বিশ শতকেও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল। উচ্চশ্রেণীর অবস্থাপন্ন মুসলমানদের একাধিক স্ত্রী থাকত। বিশ শতকের শুরুতে কুলীনদের বাইরে হিন্দু সমাজে বহুবিবাহ তেমন প্রচলিত ছিল না। বিয়ের এমন অনেক জানা অজানা বিষয়ে আলো ফেলেছেন ড. রোহিণী ধর্মপাল তাঁর এই ধারাবাহিক ‘নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী’-তে। আজ থাকছে নারী-পুরুষের মিলন কাহিনীর ৯ম পর্ব।
বলছিলাম না, দেবযানীর দুঃখ এখনও বাকি! চলুন তাহলে, দেবযানীর জীবনে তারপর কি হল দেখি।
কচকে সঞ্জীবনী বিদ্যা শেখানোতেই সন্তুষ্ট হল না দেবদল। ভাবল, এই সঙ্গে যদি শুক্রাচার্য্যের সঙ্গে অসুরদের ঝগড়া বাঁধানো যায়, তো কেমন হয়!!! দেবতাদের এই পরামর্শ ইন্দ্রের বেশ পছন্দ হল। তিনি নিজেই নিলেন ঝগড়া লাগানোর ভারটি। অসুররাজ বৃষপর্বার এক কুবেরের বাগানের মত সুন্দর মনোরম বাগানে টলটলে এক দীঘিতে স্নান করছিল কয়েকটি মেয়ে । তার মধ্যে দেবযানীও ছিলেন। ছিলেন রাজকন্যা শর্মিষ্ঠাও। পাড়ে জামাকাপড় রেখে মহানন্দে মেয়ে কয়টি জলকেলি করছিল পরস্পরে। ইন্দ্র এসে এমন এক হাওয়া বইয়ে দিলেন, যে সব কাপড়গুলি এলোমেলো হয়ে মিশে গেল। শর্মিষ্ঠা ভুল করে দেবযানীর কাপড়টি পরলেন। একেই দেবযানীর মেজাজ ভালো ছিল না। কচের প্রত্যাখ্যানের ঘাটি তখনও দগদগে। দুম করে রেগে গিয়ে তিনি শর্মিষ্ঠাকে বলে বসলেন ” অসুরের মেয়ে হয়ে কোন স্পর্ধায় তুই আমার কাপড় পরিস”!!!! রাজকন্যা শর্মিষ্ঠাও কম যান না, দেবজয়ী অসুররাজার মেয়েকে এমন অপমান!!!! তিনি দেবযানীকে আরোও ভয়ানক অপমানজনক কথা বললেন। বললেন, “তোর বাবা দিবারাত্রি আমার বাবার স্তব করে। তোষামোদি করে। তুই ভিখারিণি! তোর চিৎকারে কী হবে আমার!! আমি সশস্ত্রা আর রাজার কন্যা, তুই আমার যোগ্যই নস”। শুধু এই বলে তিনি ক্ষান্ত হলেন না, ধাক্কা মেরে দেবযানীকে একটা কূয়োর মধ্যে ফেলে রাগে গসগস করতে করতে ফিরে গেলেন। ক্ষমতার অপব্যবহারের উদাহরণ চিরন্তন। নারী পুরুষ নির্বিশেষে । এখনকার রাজনীতিতেই এমনটা হয়, ভাববেন না । এও মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ।
এদিকে মৃগয়ায় এসে ঘুরতে ঘুরতে যযাতি রাজা ঘোড়াকে জল খাওয়াতে কুয়োর কাছে এসে জলের জন্য ঝুঁকতেই দেখলেন, এ কী! জলের বদলে সেখানে এক রূপসী কন্যে যে! রাজা সেই কন্যের পরিচয় নিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিজের রাজধানীতে ফিরে গেলেন। এদিকে ঘূর্ণিকা নামে এক দাসী দেবযানীর খোঁজ করতে করতে সেখানে আসতে দেবযানী দুঃখে ভেঙে পড়ে সব বলে বাবাকে ডেকে আনতে বললেন। শুক্রাচার্য অনেক বুঝিয়েও অবশ্য দেবযানীর রাগ কমাতে পারলেন না। আর অপরাধ তো কম নয়। শুধু মুখের ঝগড়া হলে এক রকম, এ তো হত্যার চেষ্টা । তাছাড়া সত্যি বলতে কি, তাঁর নিজের আঁতেও একটু ঘা লাগল বই কী! বৃষপর্বাই তো তাঁর বিদ্যার কাছে নতজানু, তাঁর মেয়ে দেবযানীকে এই সব উল্টো কথা কি করে বলে!!! এর তো একটা বিহিত হওয়াই চাই।
তিনি সোজা অসুররাজের কাছে গিয়ে বললেন, “আমি চললাম । এখন তোমরা সমুদ্রে সেঁধোও বা বনের গভীরে গিয়ে লুকিয়ে থাকো, আমার কিছুই এসে যায় না । তোমরা আমার মেয়েকে কষ্ট দিয়েছ, সুতরাং দেবযানীকে নিয়ে আমি চললাম ।” বৃষপর্বা দেখলেন, এই রে!!! সব তো যায়!!! এই মানুষটি গেলে তো তাঁদের সব যাবে!!! দেবতাগুলো এই অপেক্ষা করেই বসে আছে!!! চর তো তাঁরও আছে!!! খবর তো তিনিও রাখেন!!! সুতরাং তিনি একেবারে পায়ে পড়ে গেলেন গুরুর আর কথা দিলেন দেবযানী যা চাইবেন, তিনি আর তাঁর মেয়ে তাইই করবে।
এখন রাজনীতির খেলায় মেয়েরা চিরকালই বলিপ্রদত্ত । শর্মিষ্ঠা অন্যায় করেছিলেন অবশ্যই, কিন্তু তাঁকে তার জন্য বড়ই মূল্য চোকাতে হল। দেবযানী দাবী করলেন শর্মিষ্ঠাকে তাঁর দাসী হয়ে থাকতে হবে। বৃষপর্বা আগেই মেয়েকে বলে রেখেছিলেন, তাঁর এবং তাঁর প্রজাদের মঙ্গলের জন্য দেবযানী যা চাইবেন, শর্মিষ্ঠাকে তাইই করতে হবে। সুতরাং শর্মিষ্ঠা বাধ্য হলেন দেবযানীর দাস্যবৃত্তি মেনে নিতে।
ভাবছেন, এই তো, এবার দেবযানীর দিকে পাশার দান পড়েছে। হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে বটে। আরোও কিছুক্ষণ মনে হবেও। কারণ আবার দেবযানীর জীবনে আসবেন যযাতি। এবং দেবযানী ও শর্মিষ্ঠাকে একসঙ্গে দেখে কথা দেবযানীর সঙ্গে বললেও মুগ্ধ হবেন শর্মিষ্ঠার সৌন্দর্য্য দেখেই। কিন্তু দেবযানী স্বয়ং যযাতিকে বিবাহ প্রস্তাব দেওয়ার পরে, খানিক অনিচ্ছুক হওয়া সত্ত্বেও দেবযানীকে বিবাহ করবেন তিনি। দেবযানীর সঙ্গে তাঁর স্বামীগৃহেও সঙ্গে যাবেন শর্মিষ্ঠা । অর্থাৎ দেবযানী নিজের দাবীতে নিজেই জড়িয়ে পড়বেন আর সমস্যা আরোও বাড়বে। আন্দাজ করতে পারছেন নিশ্চয়ই, কিরূপ সমস্যা আসতে চলেছে দেবযানীর জীবনে। যদিও শুক্রাচার্য্য নিজেও পুরুষ তো, রাজাকে ডেকে সাবধান করে দেবেন এই বলে যে বৃষপর্বার কন্যাটিকে যতই সম্মান করো, খবরদার, তাকে বিছানায় তুলো না আবার! কিন্তু তা কী সম্ভব হবে!!! এমন রূপসী, এমন আভিজাত্যপূর্ণ চেহারাটি; যা দেখে যযাতি প্রথমেই মুগ্ধ হয়েছিলেন, তা কি তিনি ভুলতে পারেন সহজে!!!
যযাতির সঙ্গে কিছু দিন পরেই আবার দেখা হয়েছিল দেবযানীর, যেখানে তিনি নিজেই যযাতিকে propose করলেন। সেই গঙ্গার মতোই । তিনি তো কচের অভিশাপ জানতেনই, জানতেন কোনো ব্রাহ্মণের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে না। এখন এই রাজা সব দিক দিয়ে তাঁর যোগ্য পাত্র। মনে মনে হয়ত কচের সঙ্গে তুলনাও করেছিলেন। আর সেই দিক থেকে যযাতি কোনো অংশেই কম ছিলেন না । তাই এঁকে বিয়ে করলে কচকেও বেশ জব্দ করা যাবে, এমন ভাবনাও হয়ত তাঁর মনে এসেছিল। কিন্তু যযাতি বিশেষ করে জানতে চেয়েছিলেন শর্মিষ্ঠার কথা। দেবযানী দুজনের পরিচয় দিতেই তিনি বললেন, এইরকম সুন্দরী তরুণী আমি পৃথিবীতে দেখিনি আগে । এমনকী এও বললেন, আপনার রূপও কোনো প্রকারেই এঁর রূপের মত নয়।
“অস্যা রূপেণ তে রূপং ন কিঞ্চিং সদৃশং ভবেৎ”। এই কথার পরেও দেবযানী বুঝলেন না। এতেই তাঁর বোঝা উচিত ছিল, যে এই পুরুষটি রূপকে প্রাধান্য দেয়! মেয়েরা বড়ই বোকা হয় সত্যি ! কী আর বলি! যাই হোক, দেবযানীর সঙ্গে যযাতির বিয়ে হল। শর্মিষ্ঠা আর সহস্র দাসীসহ দেবযানী শ্বশুরবাড়ি গেলেন । কিছুদিন মহাসুখে কাটল । তিনি এক পুত্রের মা-ও হলেন।
এদিকে শর্মিষ্ঠা, তাঁকেও অবশ্য একেবারেই দোষ দেওয়া যায় না, তাঁরও দৈহিক মিলনের ইচ্ছে জেগেছে, তিনিও যৌবনবতী হয়েছে। তিনি তখনই মনে মনে স্থির করে নিলেন তিনিও রাজাকেই বরণ করবেন। এর কিছু পরেই, ওই গিরিকার মতোই, রজঃস্বলা অবস্থার অবসানে, একদিন তিনি রাজাকে বাগানে একা পেলেন। এতটুকু দেরি না করে তিনি সরাসরি রাজার কাছে গিয়ে ঋতুরক্ষার প্রার্থনা করলেন। এখন রাজার তো ষোল আনার জায়গায় উনিশ আনা ইচ্ছে শর্মিষ্ঠার সঙ্গে মিলিত হওয়ার , অথচ মনে শুক্রাচার্য্যের ভয়! তিনি যদি সত্যিই সবার মঙ্গল চাইতেন, তাহলে শর্মিষ্ঠার বিবাহ দিতেন যোগ্য কোনো পুরুষের সঙ্গে । শর্মিষ্ঠাকে বোঝাতেন। কিন্তু তার ধারকাছ দিয়ে তিনি হাঁটলেন না। খানিক আমতা আমতা করে আপত্তির পর, শর্মিষ্ঠার বোঝানোতে তিনি সব আপত্তি বানের জলে ভাসিয়ে শর্মিষ্ঠার সঙ্গে মিলিত হলেন । মহাভারতে পাই, রাজা শর্মিষ্ঠাকে সন্তুষ্ট করে নিজেও যথেষ্ট সুখ পেলেন। আর শর্মিষ্ঠা গর্ভবতী হলেন। না, এই প্রথম আর এই শেষ নয়। দেবযানী দুইটি পুত্রের জন্ম দিলেন, এদিকে শর্মিষ্ঠা মা হলেন তিনবার! দেবযানী জানতে পর্যন্ত পারলেন না, তাঁরই স্বামীর ঔরসে শর্মিষ্ঠাও গর্ভবতী হয়ে চলেছেন এবং তাঁর থেকে বেশি আদর পাচ্ছেন!
এখানে একটা কথা বলার, শর্মিষ্ঠার সঙ্গে যযাতির বিয়ে সংক্রান্ত কোনো কথাই কিন্তু মহাভারতে নেই! শুধু শর্মিষ্ঠার যুক্তি ছিল ধর্ম অনুসারে সখীর পতি পতিই হয়! আর দেবযানীর জিজ্ঞাসার উত্তরে সমানে বলে গেছেন এক ধার্মিক ও বেদজ্ঞ ঋষি আসায় তাঁর কাছে তিনি কাম প্রার্থনা করে মা হয়েছেন। স ময়া বরদঃ কামং যাচিতো ধর্মসংহিতম্ । অর্থাৎ আমি ধর্মসঙ্গতভাবেই তাঁর কাছে কাম চেয়েছিলাম । দেখুন, মেয়েরা কতখানি স্বাধীন ও স্বাভাবিক ছিলেন সেই সময় । এখানে শর্মিষ্ঠা মিথ্যা বললেও এই কথাটা বারবার প্রমাণ হচ্ছে যে কামেচ্ছা সবার মধ্যেই চিরকাল থাকে এবং সেই সময় ছেলেদের মত মেয়েরাও তা নিয়ে খুব লুকোচুরি করত না!
যাক্, এইভাবে দেবযানীর নাকের ডগায় দেবযানীকেই প্রবঞ্চনা করতে লাগলেন তাঁর স্বামী ও শর্মিষ্ঠা । যে দিন এই ভয়ানক বিষয়টি জানতে পারলেন দেবযানী, তিনি ফিরে গেলেন বাবার কাছে। আরক্তনয়নে বাবাকে অভিযোগ জানালেন।
শুক্রাচার্য্য ক্রোধে জ্বলে উঠে মারাত্মক অভিশাপ দিলেন যযাতিকে।
অধ্যাপিকা, শিক্ষা বিজ্ঞান বিভাগ, রামকৃষ্ণ সারদা মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যাভবন ।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহী, লেখালেখি করার বদভ্যাস আছে। পৌরোহিত্য করেন, মূলত পুরোনতুন বৈদিক পদ্ধতিতে বিবাহ দেন এবং রবিগান কঠোপনিষদ ও ঋক্ মন্ত্রসহ অন্যরকমভাবে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।