বৃষ্টিথামা সোমবারের সকালটা বেশ উষ্ণ ছিল।খুব ভোরে ওঠার অভ্যেসগুলা ডিগ্রীবিহীন। হাতুড়ে দাঁতের ডাক্তার অরেলিও এস্কোভার তার অফিস খুললো ঠিক ছটায়। তখনো প্লাস্টিকের ছাঁচে রাখা কতগুলো নকল দাঁত নিয়ে, তার মাপ অনুযায়ী একগাদা যন্ত্রভর্তি টেবিলের উপরেই যন্ত্রগুলোর পাশেই সাজিয়ে রাখলো। এমনভাবে রাখলো যেন দোকানের শো কেস-এ রাখছে। সে একটা কলার ছাড়া স্ট্রাইপড শার্ট পড়েছিলো যেটার গলাটা মোটা পেরেকের মতন দেখতে সোনালী গলাবন্ধে আটকানো। সাস্পেন্ডর দিয়ে প্যান্টটার কোমর থেকে নীচে নেমে যাওয়া কোনোরকমে ঠেকানো আছে। চামড়া সর্বস্ব, ঢ্যাঙা এস্কোভারের তাকানোটা সব সময়েই কালাদের শুনতে না পেয়ে তাকানোর মতন, যা পরিস্থিতির সঙ্গে কখনোই খাপ খায় না।
সব টেবিলে সাজানো-গোছানো হয়ে গেলে ডেন্টিস্টের চেয়ারে সে বসে পড়লো হাতে ড্রিলটাকে নিয়ে। দাঁতগুলো পালিশ করতে শুরু করলো। অভ্যাসেই সব করে চলেছিলো, এমনকি ড্রিলটাকে দরকার ছাড়াই পা দিয়ে পাম্পও করে চলেছিলো। কিন্তু যা করছিলো তার সবটাই খুব স্বচ্ছন্দেই করছিলো।
আটটার পরে একটু থামলো সে। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলো পাশের বাড়ির চালে দুটো শিকারী বুজার্ড, ডানা দুটো বন্ধ করে সন্ন্যাসীর মতন ধ্যানমগ্ন। বসে আছে ঠিক চালের টং-এ। শুকোচ্ছে নিজেদের। আবার দুপুরের খাবারের সময় হওয়ার আগেই বৃষ্টি নামবে বুঝে নিয়ে আবার কাজ শুরু করলো। এমন সময় তার এগারো বছরের ছেলের চিৎকার তার মনোঃসংযোগে চিড় ধরলো একটু।
-বাবা।
-কি?
-মেয়র জানতে চাইছেন তুমি ওঁর দাঁত তুলে দেবে কিনা?
-বলে দে আমি এখানে নেই।
এস্কোভার একটা সোনার দাঁত পালিশ করছিল। একটা চোখ বন্ধ করে দাঁতটাকে প্রায় এক হাত দূরত্বে রেখে দেখছিল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। তার ছেলে আবার পাশের ছোট্ট ওয়েটিং রুমটা থেকে চেঁচালো।
-উনি বলছেন তুমি আছ, কারণ তোমার গলা শুনতে পাচ্ছে।
দাঁতটা সে পরীক্ষা করেই চলছিল। তারপরে সন্তুষ্ট হয়ে আগের হয়ে যাওয়া দাঁতগুলোর সঙ্গে ওটাকে রেখে তবেই সে কথা বললো।
-তো ভালই হয়েছে।
বলে ড্রিলটা আবার চালু করলো। কার্ডবোর্ডের বাক্স থেকে কয়েকটুকরো হাড় বের করে যেগুলোর কাজ এখনো হয়নি সেখানে রাখলো। তারপরে আবার সোনাটা পালিশ করতে শুরু করলো।
-বাবা।
-কি?
এখনো ওর চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই।
-উনি বলছেন যদি তুমি দাঁত না বার করে দাও তাহলে তোমাকে গুলি করবেন!
কোনো তাড়াহুড়ো না করে, ভীষণ শান্ত ভাবে ড্রিলটার জন্য প্যাডল করা বন্ধ করলো, ঠেলে চেয়ার থেকে সরিয়ে দিয়ে টেবিলের নীচের ড্রয়ারটা পুরো খুলে ফেললো। ওখানে একটা রিভলভার আছে।”বেশ”, সে বললো এবারে, ” ওনাকে এবারে ভেতরে এসে আমাকে গুলি করতে বল”।
চেয়ারটা ঘুরিয়ে সে উল্টো দিকের দরজার কাছে ঠেলে দিল, হাতটা ড্রয়ারের উপরে আলগোছে রাখা। মেয়র দরজায় এসে দাঁড়ালো। একগাল কামানো, ফুলে ওঠা আর ব্যাথা ভরা অন্য গালে পাঁচ দিনের না কামানো দাড়ি। লোকটার ভোঁতা চোখে অনেকগুলো রাতের জমা তীব্র হতাশা ডেন্টিস্ট খেয়াল করলো। আলগোছে আঙুলের গোড়া দিয়ে ড্রয়ারটাকে ঠেলে বন্ধ করে দিয়ে নরম করে বললো,
-বসুন।
মেয়র বললো,
-সুপ্রভাত।
-সুপ্রভাত।
সেও বললো।
সে যখন যন্ত্রগুলোকে গরম জলের বেসিনে ধুচ্ছিল ভাল করে, তখন মেয়র মুন্ডুটা চেয়ারের মাথা রাখার জায়গায় হেলিয়ে একটু ভাল বোধ করতে লাগলো। মেয়রের নিঃশ্বাস একদম বরফের মতন। তার চোখে পড়লো বেশ গরিব অফিসটা। কাঠের চেয়ার, পুরোনো ধাঁচের প্যাডেল দেওয়া ড্রিল,সেরামিক বোতল ভর্তি কাঁচের কেস। তার চেয়ারের ঠিক উলটো দিকে একটা জানলা কাঁধ অব্দি উঁচু কাপড়ের পর্দাতে ঢাকা। যখন সে বুঝলো ডেন্টিস্ট তার দিকে এগোচ্ছে তখন সে তার জুতো পরা পা দুটো শক্ত করে মুখটা খুললো নিজের।
অরেলিও এস্কোভার আলোর দিকে নিজের মুখটা ঘোরালো। ভাল করে মেয়রের সংক্রমিত দাঁতটা দেখে, সাবধানে নিজের আঙুল দিয়ে তার চোয়ালটাকে বন্ধ করে দিল।
-অসাড় না করেই এটা তুলতে হবে।
-কেন?
-কারণ আপনার একটা ফোড়া হয়েছে।
মেয়র ওর চোখের দিকে তাকালো। “ঠিক আছে” বলে একটু হাসার চেষ্টা করলো। ডেন্টিস্ট হাসলো না। কোনো তাড়াহুড়ো না করে গরমজলের বেসিনটাকে কাজের টেবিলে এনে একজোড়া সন্না দিয়ে নির্বিজীত করা যন্ত্রহুলোকে এক এক করে তুলতে লাগলো। তারপরে পিকদানিটা পায়ের ডগা দিয়ে ঠেলে দিয়ে গেল বেসিনে হাত ধুতে। সে এত সব কিছু করলো মেয়রের দিকে না তাকিয়েই। কিন্তু মেয়র তার চোখ ওর ওপর থেকে সরালো না।
ওটা নীচের দিকের আক্কেল দাঁত ছিল। ডেন্টিস্ট নিজের পা দুটোকে ছড়িয়ে গরম সাঁড়াশি দিয়ে দাঁতটাকে ধরে দাঁড়ালো। মেয়র চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরে,পা দুটোতে যত শক্তি আছে সবটা জড় করলো, এবং কিডনিগুলোতে একটা বরফ শীতল শূন্যতা টের পেল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ করলো না। ডেন্টিস্ট তার হাতের কব্জীটা শুধু ঘোরালো। কোনো হিংসা্র রেশ ছাড়াই, খুব তেতো একটা কোমলতার সঙ্গে বলে উঠলোঃ
-এবারে আপনাকে, আমাদের কুড়িটা মৃত মানুষের দাম দিতে হবে।
মেয়রের চোয়ালের মধ্যের হাড়ও কড়কড় করে উঠলো, চোখদুটোতে জল ভরে এল। কিন্তু যতক্ষণ না দাঁতটা বেরিয়ে এল ততক্ষণ সে নিশ্বাস নিল না। তারপরে সে জল ভরা চোখ নিয়ে দেখলো ওটাকে। এত অচেনা ঠেকছিল ওটাকে তখন, তখন বিগত পাঁচ রাতের অত্যাচারও তার মনে পড়ছিল না যন্ত্রণায়।
নীচু হয়ে পিকদানির উপরে ঝুঁকে হাঁফাতে হাঁফাতে,ঘামতে ঘামতে, থুতু ফেলতে ফেলতে টিউনিকটার বোতাম খুলে প্যান্টের পকেটের রুমালের দিকে হাত বাড়ালো সে। ডেন্টিস্ট তাকে একটা পরিস্কার কাপড় দিল।
-এটাতে চোখের জলটা মুছে নিন।
সে বললো।
মেয়র তাই করলো। সে কাঁপছিল তখন। যখন ডেন্টিস্ট হাত ধুচ্ছিল তখন সে ঝুলে প্রায় ভেঙে পড়া সিলিং-এ ধুলো ধুসর মাকড়সার জাল, জালে মাকড়সার ডিম আর মরা পোকামাকড় এসব দেখছিল। ডেন্টিস্ট হাত ধুয়ে মুছতে মুছতে ফিরে এল।”শুতে যান এবারে”,বললো,”আর গার্গেল করবেন নুন জল দিয়ে”। মেয়র উঠে দাঁড়িয়ে, বিদায় জানিয়ে, একটা দায়সারা মিলিটারি স্যালুট করে, টিউনিকটার বোতাম না আটকে্ লম্বা পা ফেলতে ফেলতে দরজার দিকে হাঁটা দিল।
-বিলটা পাঠিয়ে দেবেন।
-আপনার নামে না শহরের নামে হবে?
মেয়র তার দিকে ফিরে তাকালো না। দরজা বন্ধ করে দিল। পর্দার ওপার থেকে কর্কশ গলায় বললোঃ
– দুটোই একই বিষয়।
সেই সব দিনগুলোর একটা ।। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
আজ ৬ মার্চ নোবেল জয়ী জাদু বাস্তবতার মহাধিরাজ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের জন্মদিন। এই পূণ্যলগ্নে ইরাবতী পরিবার তাঁকে স্মরণ করে পাঠকদের প্রতি তুলে ধরছে “শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষের” অনুবাদ করা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের একটি গল্প।
বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বসাহিত্যে ঢেউতোলা হাতেগোনা কয়েকজন সাহিত্য সাধকের একজন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালের ৬ মার্চ কলম্বিয়ার আরকাতারায়।
কিংবদন্তির এই লেখকের শৈশব-কৈশোর কেটেছে দিদার সাথে। দিদার কাছ থেকে তিনি বহু কেচ্ছাকাহিনী শুনে বড় হয়েছেন। তার দিদা ছিলেন স্বপ্নে পাওয়া বাণীর আলোকে পারিবারিক সংহতি বজায় রাখতে সদাসতর্ক। তিনি মার্কেজকে শোনাতেন তাদের পরিবারের এমন সব কিংবদন্তির কেচ্ছা, রূপকথা যার জন্য বাস্তবতাকে বুঝে নেয়ার সূক্ষ্মতা যা কুসংস্কারাচ্ছন্ন অতিপ্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি বলে চিহ্নিত।
১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয়ী লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বিশ্বসাহিত্যে নতুন ধারা সংযোজন করে ইহলোক ত্যাগ করেছেন ২০১৪-এর ১৭ এপ্রিল (৮৭ বছর বয়সে)। তিনি কুহুক আর বাস্তবের রহস্যময়তায় কাহিনীকে সাজাবার বিস্ময়কর উদ্ভাবনী নৈপুণ্যতায় আর ভাষার অপ্রত্যাশিত কৃতকৌশলে ইতিহাসের দিকে তাকাবার নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জনক।
আইন পেশা ছেড়ে গ্যাব্রিয়েল ১৯৪৮-এর ২১ মে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এখানেই তিনি শিখে নেন উপাখ্যান রচনার মূলমন্ত্র; অর্থাৎ কী করে বাস্তবতার ভেতর কল্পনার অনুপ্রবেশ ঘটানো সম্ভব। কার্তাহেনার দৈনিকটিতে তিনি দেড় বছর কাজ করেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে তিনি যোগ দেন ‘এল হেরালদো’ নামের একটি দৈনিকে। এই পত্রিকায় তিনি ‘সেপ্তিমুস’ নামের উদ্ভট ছদ্মনামে শ্লেষ-পরিহাস আর রসিকতায় ভরা একটি লেখা লিখতেন নিয়মিত। লেখাটি ‘জিরাফ’ শিরোনামে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ওই লেখাগুলোতে ছিল মাকান্দো নামের একটি গ্রামের বর্ণনা। পরে এই গ্রামের কাহিনীই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের কলমে ‘পাতার ঝড়’ এবং ‘নিঃসঙ্গতার এক শ’ বছর’ উপন্যাসে স্থান পায়।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তাকে অন্যত্র বদলি করলে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন এবং মেহিকোতে আস্তানা গাড়েন। এখানে তিনি চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন। এখান থেকেই তিনি কোন্ খেয়ালে বেড়াতে যান আকাপুলকো নামক একটি স্থানে। সেখানেই তিনি পেয়ে যান ‘ নিঃসঙ্গতার এক শ’ বছরের উপখ্যানটির প্লট। তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে ঘরে প্রবেশ করেন আঠারো মাসের জন্য। দরজা বন্ধ করে বা হুড়কোটা এঁটে আঠারো মাস এক নাগাড়ে বইটি লেখেন। পান্ডুলিপিটি হাতে নিয়ে যেদিন ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সেদিন তার স্ত্রীর কাছে জমা হয়েছে দশ হাজার ডলারের দেনা। ‘হান্ড্রেডস ইয়ার অব সলিচ্যুউট’ (নিঃসঙ্গতার এক শ’ বছর) উপন্যাসটি প্রকাশ হয় ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে। বইটির অভাবিত সাফল্য ও খ্যাতি রাতারাতি জগতটাকে এমন হকচকিয়ে দেয়, ঝাঁকুনি দেয় যেন শুধু ল্যাটিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের ধরনটাই এমন ভিন্ন নয়; বরং একটা নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করার মতোই রোমাঞ্চকর উত্তেজনায় ভরা।
‘নিঃসঙ্গতার একশ’ বছর’ উপন্যাসের জন্য ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে নোবেল জয় করেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। তার আর যে উপন্যাসটি চরম সাফল্য আর খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয় সেটি হলো ‘কুলপতির হেমন্ত’। তার লেখা ‘একটি মৃত্যুর পূর্বঘোষিত দিনপঞ্জি’ এবং ‘কলেরার মহামারীতে প্রেম’ অসাধারণ উপন্যাস। ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ (কলেরার মহামারীতে প্রেম) ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ হয়। এটি শুধু একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসই নয়, এটি বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ক্ল্যাসিক সাহিত্য।
সেই সব দিনগুলোর একটা
