| 19 মার্চ 2024
Categories
চিত্রকলা বিনোদন

চিত্রশিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

।। ইন্দ্রায়ুধ সেনগুপ্ত ।।

বাংলা সংস্কৃতির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের ক্ষেত্রে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অপরিসীম ভূমিকার কথা আমাদের বারেবারেই স্মরণ করতে হয়। ভারতীয় চিত্রকলায় আধুনিকতার বিষয়েও একথা সমানভাবে সত্যি। এক্ষেত্রে যার কথা আমাদের স্মরণ করতেই হবে তিনি শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর জন্ম ১৮৬৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ – তিন ভাই, রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে একই সঙ্গে তাঁদের বেড়ে ওঠা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় ভাই গিরীন্দ্রনাথ। গিরীন্দ্রনাথের ছোট ছেলে গুণেন্দ্রনাথ। গুণেন্দ্রনাথ ছিলেন শিল্প সাহিত্যের রসগ্রাহী বোদ্ধা ও শিল্প সংগ্রাহক। গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন গুণেন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান। তাঁর যখন ১৪ বছর বয়স, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়।
বিংশ শতকের প্রথম দুই দশকে আমাদের চিত্রধারায় দুটি ঘরানার প্রাধান্য ছিল। একটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার চাপিয়ে দেওয়া অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতা। আর একটি এরই প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যগত ভারতীয় আত্মপরিচয়ের সন্ধান। একে সাধারণভাবে বলা হয় নব্য-বঙ্গীয় (বেঙ্গল স্কুল) ঘরানা। এর প্রথম ও প্রধান পথিকৃৎ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১)। অবনীন্দ্রনাথ গগনেন্দ্রনাথের ছোট ভাই। কিন্তু গগনেন্দ্রনাথ ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথের অন্তত দশ বছর পরে।

কিন্তু শুরু থেকেই গগনেন্দ্রনাথের ছবি ছিল বেঙ্গল স্কুল ঘরানার একেবারে বাইরের। গগনেন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম শিল্পী যিনি একদিকে জাপানি ঐতিহ্য, আরেক দিকে পাশ্চাত্য আধুনিকতার উদ্ভাবনকে আমাদের ঐতিহ্যগত রূপরীতির সঙ্গে মিলিয়ে চিত্রকলায় নতুন উজ্জীবন এনেছিলেন। আমাদের আধুনিকতার অন্বেষণকে আন্তর্জাতিকতায় অভিষিক্ত করেছিলেন। ভারতের চিত্রকলার আধুনিকতায় এটাই ছিল তাঁর প্রধান অবদান।
গগন ঠাকুরের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা ছিল না। ছেলেবেলায় সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়ার সময় কিছুটা ছবি আঁকা শিখতে হয়েছিল। আর পরে ১৮৯৯-১৯০০ সালে তিনি কিছুদিন ছবি আঁকা শেখেন হরিনারায়ণ বসুর কাছে। হরিনারায়ণ গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, স্বাভাবিকতাবাদী আঙ্গিকে দক্ষ ছিলেন। গগনেন্দ্রনাথও সেটাই শিখেছিলেন।
এরপর গগনেন্দ্রনাথ উদ্বুদ্ধ হন জাপানি শিল্পীদের সংস্পর্শে এসে। ১৯০২ সালে জাপানের শিল্পবেত্তা ও মনীষী ওকাকুরা কলকাতায় আসেন। তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন আরো তিনজন জাপানি শিল্পী – তাইককান, কাৎসুতা ও হিশিদার শুনসো। তাঁরা জোড়াসাঁকোতে গগনেন্দ্রনাথের আতিথ্যেই থেকেছেন। তাঁদের ছবি আঁকা দেখে অনুপ্রাণিত হন গগনেন্দ্রনাথ। এছাড়াও এক দুঃখের অভিঘাত তাঁকে ছবির মধ্যে এনে ফেলে। ১৯০৫ সাল নাগাদ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র গেহেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় মাত্র ১৭ বছর বয়সে। সেই শোকে একেবারে ভেঙে পড়েন গগনেন্দ্রনাথ। তাঁকে সান্তনা দিতে ক্ষেত্র চূড়ামণি নামে এক কথককে নিয়ে আসা হয়। পরে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে শিলাইদহ থেকে নিয়ে আসা হয় শিবু সাহা নামে এক কীর্তনীয়াকে। এইসব কাহিনি বা কীর্তন শুনতে শুনতে গগনেন্দ্রনাথ নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন কথক বা কীর্তনীয়ার বিভিন্ন ভঙ্গির ছবি আঁকাতে। সেই তাঁর ছবি আঁকার সূচনা। তাঁর বয়স তখন ৩৮। সেই থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত মাত্র ২৫ বছর তাঁর সৃষ্টিশীল জীবন। ১৯৩০-এ তিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। পরের আট বছর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি আর কাজ করতে পারেন নি। এই স্বল্প পরিসরের শিল্পী জীবনে গগনেন্দ্রনাথ ভারতের আধুনিক চিত্রকলায় নতুন পথ নির্দেশ দিয়ে গেছেন।

এবার একটু দেখে নেওয়া যাক তাঁর নিজস্ব যাত্রাপথটি। প্রারম্ভিক সময়ে কাগজের ওপর পেনসিল ও কালিতে করা স্কেচগুলিতে আমরা দেখতে পাই তাঁর প্রত্যয়ী রেখার চলন। ধুতি পরে উন্মুক্ত দেহে গান গাইতে গাইতে নৃত্য করছেন শিবু কীর্তনীয়া। স্বাভাবিকতাবাদী রীতির সুষ্ঠু প্রকাশ সত্ত্বেও অবয়বের যথার্থতা থেকে চরিত্রের জঙ্গমতার ওপর জোর দিয়েছেন বেশি। ১৯০৫ থেকে ১৯১০-এর মধ্যে চাইনিজ ইঙ্কে তিনি কিছু কাকের ছবি আঁকেন। বাঁশের পাতার কিছু ছবিও তিনি এঁকেছিলেন এই সময়। জাপানি কালি-তুলি ছবির আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন এই ছবিগুলিতে। অবন ঠাকুরের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে আমরা বুঝতে পারি গগনেন্দ্রনাথের বিশিষ্টতা। তিনি উন্মীলিত করতে চাইছেন একান্ত আত্মমগ্ন বিষণ্ণ এক সৌন্দর্যের আবহ, যেখানে সমকালীন বিশ্ব তাঁর নিজস্ব ঐতিহ্যে প্রতীয়মান। ১৯১১ সাল নাগাদ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ বইয়ের জন্য ছবি আঁকতে অনুরোধ করেন গগনেন্দ্রনাথকে। ২৪টি ছবি এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। এই ছবিগুলি তাঁর শিল্পীজীবনে যেমন, তেমনি আধুনিকতার উত্তরণেও গৌরবময় পাদপীঠ স্বরূপ। কলকাতার ও ঠাকুরবাড়ির আবহ তাঁর আগে আর কেউ এত সফলভাবে আঁকেন নি। জাপানি প্রকরণের সঙ্গে ইম্প্রেশনিস্ট আঙ্গিকের সকল সমন্বয়ে এই ছবিগুলি অনবদ্য। জোড়াসাঁকোতে দোতলার বারান্দায় আরামকেদারায় পা ছড়িয়ে বসে আছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। পাশে আর একটি চেয়ারে বসে আছে শিশু-রবি। দুজনেরই কালির ছোপে আঁকা পোশাকের মধ্যভাগে শূন্য পরিসর ছেড়ে গড়ে তোলা আলোর ব্যঞ্জনা, অবয়বে এনেছে আত্মমগ্ন রহস্যের ছোঁয়া। রেলিংয়ের পাশে বড় দুটি স্তম্ভ। তার মাঝখান দিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে ঝোপের ভেতর থেকে মাথা তুলেছে নারকেল গাছ। যেন হাওয়ায় নড়ছে পাতাগুলি। তখনকার কলকাতার প্রকৃতির সামান্য আভাস ধরা আছে এখানে। চারপাশে অন্ধকারের মাঝে উদ্ভাসিত প্রদীপের আলো।

তাতে গোল হয়ে বসে রামায়ণ পড়ছে ভৃত্যেরা। আলো-আঁধারের এই মরমি মায়া শিল্পীর নিজস্ব মগ্ন অন্তর্মুখীনতার পরিচয় বহন করে। প্রবল বৃষ্টিতে ঝাপসা ধূসর আবহ। এরই মধ্যে ইংরেজি শিক্ষক ছাতা মাথায় দিয়ে কিশোর রবিকে পড়াতে আসছেন। দুটি পাখি শূন্যে উড়তে উড়তে পরস্পরের সঙ্গে খেলা করছে। এরকম সব ছবিতে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ি ও কলকাতার পরিবেশকে চিত্রায়িত করেছেন আত্মমগ্ন নিবিড় কাব্যময়তায়। এই কবিতার অনুষঙ্গই হয়ে উঠবে ছবিতে তাঁর স্বাতন্ত্র্যের একটি বিশেষ দিক। এখানেই গগনেন্দ্রনাথের অনন্যতা ও স্বকীয়তা।
তাঁর পরবর্তী কাজগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রাঁচি, পুরি ও গ্রাম বাংলার নিসর্গমূলক জলরঙের ছবি, হিমালয়ের চিত্রমালা, চৈতন্য চিত্রমালা, কার্টুনধর্মী সমাজ-সমালোচনামূলক ছবি, আলোছায়ার জ্যামিতিতে গড়া তথাকথিত কিউবিস্ট আঙ্গিকের পরীক্ষামূলক ছবি, লোককথাভিত্তিক চিত্রমালা ও মৃত্যু পরপারের জীবনের প্রতীকী চিত্রাবলী। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় গগনেন্দ্রনাথের ছবি সম্পর্কে বলেছেন যে, ১৯১০-২০ সালের তাঁর কাজগুলি দেখলে মনে হয়, বিষয়ের চেয়ে বস্তু ও তার আকার এই সময় যেন গগনেন্দ্রনাথকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল।স্ট্রাকচারের ওপর জোর পড়েছিল তাঁর কিউবিস্ট আঙ্গিকের ছবিতে। কিন্তু নিসর্গের ছবিগুলিতে আবার অন্তর্ভাবই প্রধান হয়ে উঠেছে। নিসর্গকে প্রায়-বিমূর্ততার দিকে নিয়ে গেছেন তিনি, ইম্প্রেশনিজমের ধারণার প্রয়োগ সেখানে নজরে পড়ে।
এরকম কয়েকটি নিসর্গমূলক ছবির দিকে আমরা একটু দৃষ্টিপাতের চেষ্টা করতে পারি। ‘সমুদ্রের উপর চাঁদ’ নামে একটি ছবি আছে তাঁর। এঁকেছেন জলরং, ওয়াশ ও টেম্পারা মাধ্যমে। বিষয় জ্যোৎস্নালোকিত সমুদ্র। কিন্তু সমুদ্র বা ঢেউয়ের স্পষ্ট কোনো উপস্থিতি নেই। হালকা স্বর্ণাভ আলোয় সবটাই আচ্ছন্ন। চিত্রপটের মধ্যভাগে পূর্ণচাঁদের উপস্থিতি দেখা যায়। তাও খুব সোচ্চার নয়। বেলাভূমিতে একজন মানুষের উপস্থিতি। কিন্তু সেই মানুষ একটি ঘন ছায়াময় কম্পমান রেখায় পর্যবসিত। চাঁদের আলোয় তার ছায়া পড়েছে ভূমির ওপর। নিসর্গের এই অমূর্ত উদাত্ততার অনুষঙ্গ পরে আমরা অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের ছবিতেও দেখতে পাই। গগনেন্দ্রনাথকেই এখানে বলা যেতে পারে পূর্বসূরি। এই পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ নিসর্গরচনাগুলির মধ্যে রয়েছে পানিহাটির বাগান থেকে দেখা গঙ্গার ছবি, রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতা অবলম্বনে আঁকা নদী তীরে বৃষ্টির দৃশ্য, পদ্মা নদীতে ঝড়ের দৃশ্য, কলকাতার পথ বেয়ে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনে যাচ্ছে – জলরঙে আঁকা এরকম একটি নাগরিক নিসর্গের ছবি।
‘চৈতন্য চিত্রমালা’ বিষয়ের দিক থেকে পুরাণঘেঁষা, এখানে গগনেন্দ্রনাথের আঙ্গিক অনেকটা নব্য-ভারতীয় ঘরানার কাছাকাছি। এরপর গগনেন্দ্রনাথের ছবিতে দুটি বৈশিষ্ট্যের উন্মোচন ঘটে, যা তাঁকে আধুনিকতাবাদী মূল্যবোধের দিকে নিয়ে যায়। এর একটি তাঁর কার্টুন চিত্রমালা। দ্বিতীয়টি কিউবিস্ট আঙ্গিকের আত্তীকরণ। ১৯১৫-তে তৈরি বিচিত্রা ক্লাবের অন্যতম উদ্যোক্তা ও সংগঠক ছিলেন তিনি। এখানে নাটক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অভিনয় ও মঞ্চ পরিকল্পনায় তাঁর আগ্রহ জন্মে। তা থেকেই কৌতুক রূপায়ণের দিকে তিনি উদ্বুদ্ধ হন। তখনকার সমাজের, ঔপনিবেশিক শাসনের নানা অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠে এসেছে তাঁর কার্টুনে। যেমন, ‘মিলস্টোন অব কাস্ট’, যেখানে ব্রাহ্মণ ও এক কঙ্কাল ওপরে বসে চাকতি ঘোরাচ্ছে, আর তাতে পিষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসছে অজস্র নিম্ন প্রজাতির মানুষ। উচ্ছৃত জলস্রোতে ভেসে যাচ্ছে তারা। আজকে জাতপাত দলিত সংখ্যালঘু নিয়ে সামাজিক রাজনৈতিক সংকটের সময়ে ছবিটি সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর অজস্র কার্টুনের মধ্যে নির্বাচিত কিছু ছবি নিয়ে তিনটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল, ১৯১৭-তে ‘বিরূপ বজ্র’ ও ‘অদ্ভুতলোক’ এবং ১৯২১-এ ‘নবহুল্লোড়’। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের ছবিতে উন্মীলিত হবে যে প্রতিবাদী চেতনার নানা দিক, তারও প্রথম পথিকৃৎ ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ।
১৯২০র পর থেকে গগনেন্দ্রনাথের ছবি কিউবিজমের দিকে গেছে ক্রমশ। এখানেও আলোছায়ার দ্বৈতের মধ্য দিয়ে এক রহস্যময়তাকেই উন্মীলিত করেছেন তিনি। এই যে জ্যামিতি, এর স্বরূপ কী? অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৮ সালে এক লেখায় বলেছিলেন যে, গগনেন্দ্রনাথ তাঁর কিউবিজম অনুসারী ছবিতে চিত্রক্ষেত্রে যেভাবে আলো ও ছায়া বা সাদা ও কালোর জ্যামিতিকতায় ব্যবহার করেছিলেন, ব্রাক ছাড়া আর কোনো কিউবিজমের শিল্পী সেভাবে করেন নি। কিউবিজমের পরিপ্রেক্ষিতে এটা গগনেন্দ্রনাথের বিশেষ অবদান। কিউবিজম গগনেন্দ্রনাথকে ভাবিয়েছিল বা অনুপ্রাণিত করেছিল ঠিকই। কিন্তু ব্রাক, পিকাসো প্রমুখ কিউবিস্ট-শিল্পীর থেকে গগনেন্দ্রনাথের ছবি ছিল একেবারেই আলাদা। জীবনের ও প্রকৃতির অন্তর্লীন এক রহস্যময়তা তাঁকে সবসময়ই আকর্ষণ করত। সেই রহস্যকে পরিস্ফুট করতেই তিনি আলোছায়ার জ্যামিতি নিয়ে খেলা করেছেন। একদিকে যেমন এইধরণের ছবি, আর একদিকে নাটকের মঞ্চের সেট। ‘স্টেজ ডেকরেশন’ নামে একটি ছবি আছে। আলো-আঁধারে পরিসরের জ্যামিতি নিয়ে খেলেছেন সেখানে। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ বা ‘রক্তকরবী’ নাটকের মঞ্চের ছবিতেও এই জ্যামিতিকতা আমরা দেখতে পাই। এই রূপারোপই যেন সর্বনাশের বিরুদ্ধে শিল্পীর প্রতিবাদী ভাষ্য হয়ে ওঠে।
এর পরের পর্যায়ে গগনেন্দ্রনাথের ছবিতে কিউবিজমের জ্যামিতিকতা অনেক সংবৃত হয়ে এসেছে। তা মিশে গেছে মগ্ন অধ্যাত্মবোধের সঙ্গে। বিখ্যাত ‘নটীর পূজা’ ছবিটিতে এর প্রকাশ দেখতে পাই, ‘সিঁড়িতে সাক্ষ্য’ শীর্ষক ছবিতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে একটি চাতালে দাঁড়িয়ে থাকে দুই নারী। বাইরে উজ্জ্বল আলো। ভেতরে সংহত ছায়া। এরই মধ্যবর্তী অঞ্চলে মুখোমুখি দুই মানবী। গাঠনিকতাকে শিল্পী নিয়ে গেছেন আলোছায়াময় রহস্যলোকের দিকে। আঙ্গিক নিয়ে এত যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সারাজীবন করেছেন গগনেন্দ্রনাথ, তার সমকালীন তুলনা খুব বেশি নেই।
গগনেন্দ্রনাথের সাংগঠনিক প্রতিভার কথাও আমাদের ভুললে চলবে না। ১৯২২ সালে কলকাতায় এসেছিল যে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের ছবি, তা্র প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। এই প্রদর্শনী তৎকালীন ভারতীয় চিত্রকলায় পাশ্চাত্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে আত্মস্থ করতে সাহায্য করেছিল। এছাড়াও মন দিয়েছেন মঞ্চ ও পোশাক পরিকল্পনায়; বুটিক ও সুচিশিল্পের নানা দিক, কাঠের পুতুল, আসবাব ও গৃহসজ্জার নানা দিক নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।
তাঁর সাহিত্যচেতনার স্বাক্ষর রয়েছে ‘ভোঁদড় বাহাদুর’ নামে প্রকাশিত হয়েছে বইটিতে। পড়লে মনে হয়, তিনি যদি লেখালিখিতেও একটু মন দিতেন, আমাদের শিশুসাহিত্য আরও কত সমৃদ্ধ হতে পারত।
দুঃখের কথা আমাদের প্রথাগত শিল্প-ইতিহাসে তাঁর স্বীকৃতি অনেকটাই উপেক্ষিত। অসামান্য বহুমুখী প্রতিভাদীপ্ত এই শিল্পীকে আজ আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত