গৌতম ঘোষদস্তিদারের কবিতাগুচ্ছ
আজ ০২ এপ্রিল কবি, সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক গৌতম ঘোষদস্তিদারের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
বিবাহ বিচ্ছেদ
আমার তো চিরকাল অনুস্বর নিয়ে টেনশন, টেনশন বিসর্গ নিয়ে
জঙ্গল নিয়ে টেনশন, পাহাড় নিয়ে টেনশন, টেনশন সমুদ্র নিয়েও
তোমাকে নিয়ে এতকাল কী-যে টেনশন গেছে আমার, তা বলার নয়
আজকাল গত জন্মের নৌকাটি নিয়েও আমার খুব টেনশন হয়
নৌকাটির গায়ে এত দিনে কতটা লতাগুল্ম জমে উঠেছে
তার গায়ে জমে উঠেছে কি না বল্মীকস্তূপ কিংবা তা খোলের ভিতরে
লুটেরারা লুকিয়ে রেখে গেছে কি না মণিমুক্তোমেশা অনেকটা অন্ধকার
অথবা কোনো খুনি মধ্যরাতে ফেলে রেখে গেছে কি না রক্তঅস্ত্র
সে-সব ভেবে আমার এখন চাপা-টেনশন হতেই থাকে নিত্যদিন
কিন্তু নৌকার মাস্তুলে তোমার লাল-ওড়নার গায়ে অবিচল বাতাস নিয়ে
এখন আমার আর বিন্দুমাত্র টেনশন নেই, তুমি বেশ জানো!
পদাবলি
প্রতিটি চুম্বন থেকে আলো ঠিকরায়,
দূর থেকে আলো দেখি আমি শূন্যকায়।
আমার চুম্বন ছিল মাঘ-জ্যোৎস্নায়,
মেলামাঠে রাতশেষ কলঙ্ক ছড়ায়।
কলঙ্ক নিয়েই থাকি কলঙ্ক আলোর,
তোমার বাগানে আমি চিরফুলচোর।
জলের অকূলে নৌকা লেগেছিল পাটে,
গলায় পরাই কণ্ঠি নবদ্বীপঘাটে।
তার আগে মেলাপথে গাড়ির আড়ালে,
ঝিনুকটি হাতে পাই আকাশপাতালে।
পরপারে রসাতল ঢেকে যায় ফুলে,
শেষরাতে মোহদুটি তুমি দাও খুলে।
দুপুরের গানগুলি রেখেছি গুছিয়ে,
সব গান কথকতা পেয়েছি লুকিয়ে।
আমি আজ বহুদূরে যমুনাবিহীন,
রাধা গেছে মথুরায় আমি রাইলীন।
কাহিনির পরিণতি ঘটে জ্ঞাতসারে,
কথকের সাধ্য নেই পালটাতে পারে।
প্রণয় অতীত জানি আজকের নয়,
চুম্বনের আলো আসে এইটুকু জয়।
বিনামেঘে-বাজ
শকুনি দিলেন চাল চিরসর্বনাশা,
সেই দানে ধর্মরাজ হেরেছেন পাশা।
রাজ্য যায় জায়া যায় সত্যে অবিচল,
কাহিনির পরিণতি মায়া অবিকল।
কলিকালে জৌনপুরে বিনামেঘে-বাজ,
বসেছে জুয়ার ঠেক পত্নীবাজি আজ।
স্বামী হারে সব বাজি স্ত্রীকে পায় জয়ী,
রক্ষীদল কুরুপক্ষ বুঝেছে মৃন্ময়ী।
মেয়েটি অবুঝ বড় আদালতে যায়,
সেই দোষে শকুনেরা ফের ঠোকরায়।
পরিণতি ভাবি আর হিম হয়ে যাই,
পুরুষত্বহারা আমি জ্বলেপুড়ে ছাই।
সীতাও পেলেন শেষে অতল-পাতাল,
কন্যাটি কোথায় যাবে ভাবে মহাকাল।
চারদিকে নারীভেদ অবিরত-খুন,
অগ্নিকুণ্ডে বসে চলো গাই রামধুন।
তাপসী
ফসলের জমি তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা ছিল মেপে ঈষাণ-নৈর্ঋতে,
সকালের খেতে পড়ে ছিল দেহ, তাপসী মালিক, যেন পোড়াকাঠ।
পোড়াশব ফের পুড়ে গেলে পরে সব-দেহাতীত হয়ে যায় ফিকে,
বিকাশের কালে এমনই তো হয় চিরকাল সব সহজিয়ামতে।
তাপসীর দেহ মাটিমাখা-জমি, সারা-গায়ে তার কালো-পোড়াদাগ,
শবটুকু তার ভেদ করে মাঠে উঠেছিল চূড়া জয়-পরাজয়।
তাপসীর গায়ে ঠিক-কতগুলি দাঁত ও নখের দাগ লেগে ছিল,
সবই অজানা, জেনে কী-বা হত, আমরা মেপেছি মেদিনীর ভাগ।
তাপসীর জমি স্বপ্নসুফলা, তারকাঁটা দিয়ে ঘিরেছে টাটারা,
তার পাশে আছে বর্মের মতো পার্টি ও নেতা, ফঁড়ে ও মিথ্যুক।
কবিও কম নেই, সিনেমা বানাল, ‘পিতাই ধর্ষক’, নীরব সকলে;
বিনাশের কালে এমনই হয়ে থাকে, চলে অনশন, আমরা ও তারা।
বাকিটা ইতিহাস, প্রতিবাদী জেলে, আমরাই জয়ী, ভুলি পোড়াদাগ;
তারপর মেয়ে ঘাসফুল দেখে নেমে এল মাঠে, নেই স্মৃতিভার।
ফিরে এসে দ্যাখে, চারদিক থেকে মিলিয়েছে হাত সব বলাৎকার;
পিতাও বলছে, ‘কন্যা দিয়েছি আমি, আমিও পেতে পারি লঙ্কাভাগ’।
চুম্বনের আলো
প্রতিটি চুম্বন থেকে আলো ঠিকরায়,
দূর থেকে আলো দেখি আমি শূন্যকায়।
আমার চুম্বন ছিল মাঘ-জ্যোৎস্নায়,
মেলামাঠে রাতশেষ কলঙ্ক ছড়ায়।
কলঙ্ক নিয়েই থাকি কলঙ্ক আলোর,
তোমার বিশদে আমি চিরফুলচোর।
জলের অকূলে নৌকা লেগেছিল পাটে,
গলায় পরাই কণ্ঠি নবদ্বীপঘাটে।
তার আগে সেইবার গাড়ির আড়ালে,
ঝিনুকটি হাতে পাই আকাশপাতালে।
পরপারে রসাতল ঢেকে যায় ফুলে,
সচন্দন-মোহদুটি তুমি দাও খুলে।
দুপুরের গানগুলি রেখেছি গুছিয়ে,
বাউলগানের সুর নিয়েছি লুকিয়ে।
আমি আজ বহুদূরে যমুনাবিহীন,
রাধা গেছে মথুরায় আমি রাইলীন।
কাহিনির পরিণতি ঘটে অবিচারে,
কথকের সাধ্য নেই পালটাতে পারে।
প্রণয় অতীত জানি আজকের নয়,
চুম্বনের আলো দেখি এইটুকু জয়।
