উপমারে কবিতা ভাবতে পারেননি আহসান হাবীব (১৯১৭ – ১৯৮৫), কাহিনি’রে যতোটা ভাবতে পেরেছেন। এই জিনিসটা ইনিশিয়াল স্টেইজে উনাকে ফররুখ আহমেদের চাইতে আলাদা করেনি কেবল পরে কলকাতা বেইজড বাংলা-কবিতার ধারণা থেকেও বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শেষমেশ বাংলা-কবিতারে বুকশেলফে তুলে রাখার মতো সফিশটিকেশনই দিতে চেয়েছেন আহসান হাবীব। কমন পিপলের কথাই বলেছেন আন-কমন, শুদ্ধ/আপোষী বাংলায়।
দোতলার ল্যন্ডিং মুখোমুখি ফ্ল্যাট। একজন সিঁড়িতে, একজন দরোজায়
:আপনারা যাচ্ছেন বুঝি?
: চলে যাচ্ছি, মালপত্র উঠে গেছে সব।
: বছর দু’য়েক হলো, তাই নয়?
: তারো বেশি। আপনার ডাকনাম শানু, ভালো নাম?
: শাহানা, আপনার?
: মাবু।
: জানি।
: মাহবুব হোসেন। আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন।
: কে বলেছে। আপনার তো অনার্স ফাইনাল, তাই নয়?
: এবার ফাইনাল
: ফিজিক্স-এ অনার্স।
: কি আশ্বর্য। আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ?
: মা চান না। মানে ছেলেদের সঙ্গে ব’সে…
: সে যাক গে, পা সেরেছে?
: কি ক’রে জানলেন?
: এই আর কি। সেরে গেছে?
: ও কিছু না, প্যাসেজটা পিছল ছিলো মানে…
: সত্যি নয়। উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে…
: ধ্যাৎ। খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো?
: মা বলেছে?
: শুনতে পাই? বছর দুয়েক হ’লো, তাই নয়?
: তারো বেশি। আপনার টবের গাছে ফুল এসেছে?
: নেবেন? না থাক। রিকসা এলো, মা এলেন, যাই।
: যাই। আপনি সন্ধেবেলা ওভাবে পড়বেন না,
চোখ যাবে, যাই।
: হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই।
: যান, আপনার মা আসছেন। মা ডাকছেন, যাই।
রূপকথা
খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে,
স্বপ্নের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে।
এখানে রাতের ছায়া ঘুমের নগর,
চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর।
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের,
আকাশের নীল রং ছাউনিতে এর।
পরীদের ডানা দিয়ে তৈরি দেয়াল,
প্রজাপতি রং মাখা জানালার জাল।
তারা ঝিকিমিকি পথ ঘুমের দেশের,
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের।
ছোট বোন পারুলের হাতে রেখে হাত,
সাতভাই চম্পার কেটে যায় রাত।
কখনও ঘোড়ায় চড়ে হাতে নিয়ে তীর,
ঘুরে আসি সেই দেশ চম্পাবতীর।
এই খানে আমাদের মানা কিছু নাই,
নিজেদের খুশি মত কাহিনী বানাই।
আমি কোনো আগন্তুক নই
আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পালেস্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা–
সারা দেশে।
আমি কোনো আগন্তুক নই।
এই খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে
তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই।
কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী
সাক্ষী তার চিরোল পাতার
টলমল শিশির, সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা
নিশিন্দার ছায়া
অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী
তার ক্লান্ত চোখের আঁধার
আমি চিনি, আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন। আমি
জমিলার মা’র শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি
সে আমাকে চেনে
হাত রাখো বৈঠায় লাঙ্গলে, দেখো
আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর। দেখো
মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে
লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস।
আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই।
দু’পাশে ধানের ক্ষেত
সরু পথ
সামনে ধু ধু নদীর কিনার
আমার অস্তিত্বে গাঁথা। আমি এই উধাও নদীর
মুগ্ধ এক অবোধ বালক।
স্বদেশ
এই যে নদী
নদীর জোয়ার
নৌকা সারে সারে,
একলা বসে আপন মনে
বসে নদীর ধারে
এই ছবিটি চেনা।
মনের মধ্যে যখন খুশি
এই ছবিটি আঁকি
এক পাশে তার জারুল গাছে
দু’টি হলুদ পাখি,এমনি পাওয়া এই ছবিটি
কড়িতে নয় কেনা।
মাঠের পরে মাঠ চলেছে
নেই যেন এর শেষ
নানা কাজের মানুষগুলো
আছে নানান বেশ,
মাঠের মানুষ যায় মাঠে আর
হাটের মানূষ হাটে,
দেখে দেখে একটি ছেলের
সারাটাদিন কাটে।
এই ছেলেটির মুখ
সারাদেশের সব ছেলেদের
মুখেতে টুকটুক।
কে তুমি ভাই,
প্রশ্ন করি যখন,
ভালবাসার শিল্পী আমি,
বলবে হেসে তখন।
এই যে ছবি এমনি আঁকা
ছবির মত দেশ,
দেশের মাটি দেশের মানুষ
নানান রকম বেশ,
বাড়ি বাগান পাখ-পাখালি
সব মিলে এক ছবি,
নেই তুলি নেই রং তবুও
আঁকতে পারি সবই।
ছড়া
ঝাউয়ের শাখায় শন শন শন
মাটিতে লাটিম বন বন বন
বাদলার নদী থৈ থৈ থৈ
মাছের বাজার হৈ হৈ হৈ।
ঢাকিদের ঢাক ডুমডুমাডুম
মেঘে আর মেঘে গুড়ুমগুড়ুম
দুধকলাভাত সড়াত সড়াত
আকাশে বাজে চড়াৎ চড়াৎ।
ঘাস বনে সাপ হিস হিস হিস
কানে কানে কথা ফিস ফিস ফিস
কড়কড়ে চটি চটাস চটাস
রেগেমেগে চড় ঠাস ঠাস ঠাস।
খোপের পায়রা বকম বকম
বিয়েমজলিশ গম গম গম
ঘাটের কলসি বুট বুট বুট
আঁধাঁরে ইঁদুর কুট কুট কুট।
বেড়ালের ছানা ম্যাও ম্যাও ম্যাও
দু দিনের খুকু ওঁয়াও ওঁয়াও।
ইচ্ছা
মনারে মনা কোথায় যাস?
বিলের ধারে কাটব ঘাস।
ঘাস কি হবে?
বেচব কাল,
চিকন সুতোর কিনব জাল।
জাল কি হবে?
নদীর বাঁকে
মাছ ধরব ঝাঁকে ঝাঁকে।
মাছ কি হবে?
বেচব হাটে,
কিনব শাড়ি পাটে পাটে।
বোনকে দেব পাটের শাড়ি,
মাকে দেব রঙ্গিন হাঁড়ি।
শরতে
ফুল ফুল তুল তুল গা ভেজা শিশিরে,
বুল বুল মশগুল, কার গান গাহিরে?
তর বর উঠে পর রাত ভোর দেখ না?
হাত তুলে প্রাণ খুলে স্রষ্টারে ডাক না..
ঝিক মিক দশ দিক নাই পিক পাপিয়া..
সাদা বক চক চক উড়ে যায় ডাকিয়া..
বিল ঝিল খিল খিল লাল নীল বরণে,
গাছে গাছে ফিঙ্গে নাচে চঞ্জল চরনে।
ভেজা ভেজা তাজা তাজা শেফালির সুবাসে,
শিশুদল কোলাহল করে নানা হরষে।
টিদার জরিপার শ্যাম শাড়ী অঙ্গে
এ্যলো কেশে এলো হেসে শরত এ বঙ্গে…
মেঘনা পাড়ের ছেলে
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকা বেয়ে
আমি বেড়াই হেসে খেলে-
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে।
মেঘনা নদীর নেয়ে আমি মেঘনা পাড়ে বাড়ি
ইচ্ছে হ’লেই এপার থেকে ওপারে দেই পাড়ি।
তালে তালে তালের নৌকা
দু’হাতে যাই বেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
পাহাড় সমান ঢেউয়ের বুকে নৌকো আমার ভাসে
মেঘমুলুকের পাহাড় থেকে ঝড়ের ঝাপটা আসে-
মাথার ওপর মুচকি হাসে
বিজলি নামের মেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
আমার ঢেউয়ের সঙ্গে গলাগলি ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা
ঝড়ের সঙ্গে লড়াই ক’রে কাটাই সারাবেলা।
দেশ থেকে যাই দেশান্তরে
মনের নৌকা বেয়ে-
আমি মেঘনা নদীর ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
কাশ্মিরী মেয়েটি
কাশ্মিরী মেয়েটির কালো চোখ।
ফরিদের ছোট ছেলে সে-চোখের কিছুটা আলো
চেয়েছিলো!
সাহস অসীম নয়
কেননা মেয়ের
অবিরাম হাতপাখা আঁখিজল ঢের
দেখেছে সে।
এমন কি মাঝে মাঝে দু’একটা ফুটো তামা
সেই হাতে রেখেছে সে।
কাশ্মিরী মেয়েটির ঘাগরাটি লাল,
কাশ্মিরী মেয়েটির তনু গোলগাল।
ফরিদের ছোট ছেলে নাম আমজাদ
তার ছিলো সাধ,
খেলবে ম্যাজিক সেই ঘাগরাটি নিয়ে
কাশ্মিরী মেয়েটিকে
পুরো এক পয়সার সিগারেট দিয়ে
কাশ্মিরী মেয়েটির চোখ দুটি সাপের মতন,
কাশ্মিরী মেয়েটির দাঁতগুলি ভীষণ ধারালো:
নখে তার বিষ –
মুখে বুলি নরম নরম:
বেইমান কুত্তা হায় তোম্।
পথের মোটর এক হোলো বানচাল!
ফিরে গেলো দিন;
কাশ্মিরী মেয়েটার ঘাগরা বিলীন,
হাসে তার চোখ।
আমজাদ চেয়েছিলো কিছুটা আলোক!
(রাত্রিশেষ, ১৯৪৭)
কোনো বাদশা’যাদীর প্রতি
নীল আকাশ,
রঙিন ঊষা
আর সবুজ তৃণে গড়ের মাঠ।
-আজ আমাদের ঈদ!
বাদশা’যাদী,
তুমি আসবে তো?
কার্জন পার্কের মোড়ে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো;
মাঠ থেকে ফিরে এসে
তোমায় লিফট করবো।
উহু গাড়ি কোথায়!
লিফট ক’রব-মানে
ওটা একটা কথার কথা।
আমরা হেঁটেই যাবো।
আমার পরনে থাকবে পা’জামা
গায়ে একটা সবুজ ডোরাকাটা শার্ট।
মাথার টুপিটা কালো,
তাতে পাঁচ সাতটা হলুদ বরণ ফুল।
পায়ে বাটা কোম্পানীর ক্যানভাস্।
লাল রঙের সিল্কের রুমাল
টাই করে গলায় বাঁধা।
আর তুমি?
তুমি পরেছ লাল টকটকে একটা শাড়ি।
যেটা কিনেছিলাম
ফেরিওলার কাছে,
এক টাকা চৌদ্দ আনায়।
গলায় হাঁসুলী, পায়ে মল,
গায়ের কোর্তাটা অনেক দামী –
মল্লিক বাজারে কেনা।
পায়ে তোমার নাগরাই সু
খোঁপায় চিরুণী আর অনেক কাঁটা,
তার ওপরে
একছড়া বেলফুলের মালা জড়ানো।
পথের লোকগুলো
হা ক’রে চেয়ে থাকবে তোমার দিকে।
তুমি যেন কিছু মনে করো না।
আমরা যখন হেঁটে যাবো-
আমরা বাহুটা জড়িয়ে থেকো
মেম সাহেবরা ঐ রকম চলে কিনা!
ফারপোতে আমরা যাব না।
খোদার দিন।
আজ নাছারা খানা খেতে নেই।
আমরা যাব ছকু মিয়ার হোটেলে।
বালুসাই, ছমুচা, খেজুর
যত তোমার খুশী খেয়ো।
ভাবনা নেই পয়সা আছে অনেক।
বাপ দিয়েছে ছ’আনা
দুই রাত বিড়ি বেঁধে পেয়েছি এক টাকা দু-আনা।
রাস্তায় বেরিয়ে
আরো কতক্ষণ ঘুরে বেড়াবো
নিরুদ্দেশে।
তারপর যখন বাজবে আড়াইটে
মনে পড়বে বায়স্কোপের কথা।
কোথায় যাব?
কেন ‘তসবির মহল’
না হয় ‘পার্ক শো হাউস’-
‘বাকে সেপাহীরা’ খেল আছে একটাতে
আর একটাতে ‘বাপকা বেটা’।
তখন আমরা রিকশতেই যাব।
তোমার একটা মান আছে তো!
আর তুমি যখন সাথে থাকবে
তখন টিকেটটাও না হয় চড়া দামেই নেব।
দু’খানা ন’আনাতে।
যদি ঘুমিয়ে যাও-
একটা জর্দা দেয়া পান
তোমাকে খাওয়াব।
তোমার ঘুম যাবে টুটে,
তোমার বুকের মধ্যে ধড়ফড় ক’রে উঠবে,
তুমি তখন আমার বুকে
মাথা রেখে খেল্ দেখবে।
আর তখন আমি পড়বো ঘুমিয়ে।
অনেক রাতে আমরা বেরুবো।
আবার রিকশ্।
তোমায় নামিয়ে দেব,
যে কোনো একখানে-
তুমি যাবে তোমার ঝরোকায়!
আর আমি?
আমি যাবো তিন নম্বর হারু মিয়ার বস্তি
সেখানেই আমি থাকি।
(রাত্রিশেষ, ১৯৪৭)
তামসিক একটি মুর্হূত
একদা হঠাৎ এক অপরাহ্নে মনে হলো
মৃত্যুও কঠিন হতে পারে।
যেহেতু অনন্তকাল বাঁচবে না জানি
মৃত্যুর দর্শনে বহু কবিতার শরীরে স্বাস্থ্যের
অতীন্দ্রীয় উজ্জ্বলতা রেখেছি; ভেবেছি
জীবন এবং এই জগৎকে দুদিনের পান্থশালা;
সহজে পেয়েছি
নির্মল আনন্দ যার ব্যাখ্যা নেই পৃথিবীর ফুলের পাপড়িতে
কিম্বা হীরকে পান্নায়।
আহারে-বিহারে শুধু কালক্ষেপ
প্রতীক্ষায় হৃদয় রেখেছি উন্মুখ, কখন হবে
অনাদি অনন্তকাল সমুদ্রের ঢেউ হয়ে
বয়ে যাবে জীবন, এবং
জায়াপুত্রপরিবার যথারীতি একদা দু’চোখ
মুছে নিয়ে মন দেবে উত্তরাধিকারসূত্রে কবে-
আমি হবো চৈতন্যের লীলার আশ্রয়ে
সদানন্দ শিশুর মহিমা;
লোভের ক্ষোভের আর ক্ষুদ্রতার কালি মুছে নিয়ে
জ্বালিয়ে আত্মার শিখা ব্যাপ্ত হবো অনন্তে
ভেবেছি।
ভেবেছি এবং নিত্য যথারীতি জমিয়েছি কড়ি
পাড়ের, এবং কিছু অনিত্য কড়িও
রেখেছি সঞ্চয় ক’রে ভবিষ্যৎ পথিকের প্রয়োজন ভেবে,
যেহেতু তারাও কিছু আশা করে। অতএব কোনো
অনুতাপ কিম্বা কোনো মনোবেদনার
কারণ ছিলো না কিছু।
অথচ একদা
অপরাহ্ণে যখন-
(যেমন প্রত্যহ যাই)
দক্ষিণের আমের বাগানে
বেরিয়ে, দু’একটি কঁড়ি হাতে নিয়ে ফিরেছি
হঠাৎ
পাতার আড়ালে ডাক শোনা গেলো
এবং অক্লান্ত স্বরে ডেকে গেলো একটি ঘুঘু নিজের মনেই।
মনে হলো এ পৃথিবী আরো
অনেক অনেক দিন বেঁচে রবে
মৃত্যু হবে আমার এবং
যদিও অক্লান্ত স্বরে অপরাহ্ণে ঘুঘুদের ডাক
শোনা যাবে
আমি তা শুনবো না। ঘরে ফিরে এখন যেমন
দেখা গেলো একটি মেয়ে বিকেলের ছায়ায় মিশিয়ে
শরীর, আপন মনে ব’সে আছে জানালার র’কে
ভাবছে কিছু
অথবা কিছুই ভাবছে না সে-
তার সঙ্গে এখানে এমন ক’রে আর কোনোদিন
আমার হবে না দেখা।
আর এই সামান্য কারণে
হঠাৎ সেদিন এক অপরাহ্নে মনে হলো
মৃত্যুও কঠিন হতে পারে
এবং নির্মম।
(ছায়াহরিণ, ১৯৬২)
যত দূরে যাই
যত দূরে যাই তুমি অপার
তোমাকে দেখার অন্ত নাই
ভোরের নদীর নীল বিথার
নদী নিরবধি আজকে তাই।
অপরাহ্নের ক্লান্ত পায়
পথের প্রান্ত ভোলায় চোখ
পলাশে বকুলে চোখ ফেরায়
হঠাৎ তোমার ব্যাপ্তলোক।
ভোরের নদীর মোহনা শেষ
আরেক নদীতে নতুন ভোর,
যতদূরে যাই তুমি অশেষ
পালে উদ্দাম নতুন জোর।
তুমি চিত্রল শিশু হরিণ
লালন করেছো বুকে তোমার
চোখে নাচে তার রাত্রি দিন
কি যে অস্থির চপলতার।
পুরনো পথের প্রান্তে যাই
দেখি ফুটে আছে নতুন ফুল
শুকনো নদীর ঘাটে দাঁড়াই
নতুন পানিতে ভরেছে কূল
দেখি বন্দরে নতুন সাজ
চেনা মানুষের নতুন মুখ
সারা বুকে তুমি কি কারুকাজ
রেখেছো, ভরেছো আমার বুক।
(মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, ১৯৭৬)
গিলগামেশ কাহিনী
ভালোবাসা ভালোবাসা বলে আমি গেলুম এগিয়ে
তাকে কোথাও দেখি না। আমি
যতই সামনের দিকে চলে যাই
একে একে সব
সঙ্গীরা হারিয়ে যায় একা পড়ে থাকি।
দক্ষিণে প্রাসাদ থাকে উত্তরে বাগিচা
জলসাঘরে নূপুরে উদ্দাম
তার সামনে নীল জলরেখা
তাকে বাঁয়ে রেখে
তোরণ পেরিয়ে গেলে বিধ্বস্ত খামার। মরা
ফুলের মলিন রেণু পুবের বাতাসে। এই
খামার মলিন রেণু
এইসব পার হয়ে গেলে
আরো সামনে কিছুই থাকে না।
প্রাসাদ জলসাঘর সরোবর এইসব ছেড়ে
বিধ্বস্ত খামার আর মলিন ফুলের রেণু
পার হয়ে আমিও একজন গিলগামেশ। আমি
অমরতা অমরতা বলে
হন্তারক সাপের কবলে যাই,
তারো আগে বিশাল বনানী
কাঁপিয়ে বেরিয়ে আসে ধূসর প্রান্তরে
একটা ঘোড়া জোয়ান অথচ তার এক পা নেই, তবু
প্রবল বিক্রমে যায় ছুটে যায়
যেতে যেতে বলে
ফিরে যাও, ফেরার পথেই
ভালোবাসা অপেক্ষায় আছে।
(দু’হাতে দুই আদিম পাথর, ১৯৮০)
আমি তখন
তুমি বলো কামিনী কামিনী!
পুরনো বাগানটাগান তুলে দিয়েছি। তুমি তবু
কেবলই বলো বকুল বকুল!
আমি নতুন কেনা আরশি তুলে ধরি
চোখের সামনে
তুমি তারস্বরে চীৎকার করে বলো, ‘তুমি নও তুমি নও!’
আমার মুখের রেখা কাঁপতে থাকে।
‘একদা এই পথই রাজপথ ছিলো…
এই বলে তোমার গল্প শুরু। আমি শুনতে চাই না
তুমি বলো, ‘তিনি করতলে স্থাপন করছিলেন নক্ষত্রলোক।’
আমি চমকে উঠি।
আমি নদী দেখি
শালবন দেখি
ব্যাঘ্রনিনাদ পিঠে তুলে একদল হরিণকে ছুটে যেতে দেখি।
তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
আমি আবার অনেক দূরে সরে যেতে থাকি।
গোধূলির সমস্ত সিঁদুর যখন ধূসর হয়ে আসে আর
বনভূমি কাঁপিয়ে
বিশালাকায় কালো ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে
ভয়াবহ নিরবতা যখন গর্জে ওঠে
আমি ভয় পাই।
ভয় পেয়ে আমি তোমার দিকে ছুটতে থাকি
নক্ষত্রে ছাওয়া তোমার খ’ড়ো ঘরের দাওয়ার দিকে
তোমার গল্পের দিকে।
আমি কামিনী কামিনী বলে ছুটতে থাকি
আমি বকুল বকুল বলে ছুটতে থাকি।
(দু’হাতে দুই আদিম পাথর, ১৯৮০)
বসবাস নিবাস
পাখির উড়াল দেখতে দেখতে প্রশ্ন করেছি।
কোথায় নিবাস?
পথের বাতাস উড়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করেছি
কোথায় নিবাস?
কি নিঃসঙ্গ নদী বয়ে যায একা একা নদী
কোথায় যে যায়
কতদিন তাকে প্রশ্ন করেছি নিবাস কোথায়
নিবাস কোথায়?
কোথায় যে কার নিবাস, আহা রে ঝড়ে বৃষ্টিতে
কোথায় যে রয়
আমার নিজের ঘর আছে, আমি নিজের ঘরেই
থাকি নির্ভয়।
শেলফে সাজানো মননের সঙ্গে স্বজন
সুখে বসবাস
হঠাৎ কখনো দর্পণে মুখ হঠাৎ প্রশ্ন
কোথায় নিবাস?
(বিদীর্ণ দর্পণে মুখ, ১৯৮৫)
জোনাকিরা
অসুখ
স্বদেশ আমার
একবার বলেছি তোমাকে
এই খানে নিরঞ্জনা
ঘুমের আগে
আমার সন্তান
একজন খ্যাতিমান কবি ও সাহিত্যিক। দীর্ঘ দিন দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদের দায়িত্ব পালন সূত্রে তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে অভিভাবকের ভূমিকা রেখেছেন। তিনি চল্লিশের দশকের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি হিসেবে পরিগণিত। বাংলা ভাষা সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।