| 23 এপ্রিল 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

আহসান হাবীবের বিখ্যাত কয়েকটি কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

উপমারে কবিতা ভাবতে পারেননি আহসান হাবীব (১৯১৭ – ১৯৮৫), কাহিনি’রে যতোটা ভাবতে পেরেছেন। এই জিনিসটা ইনিশিয়াল স্টেইজে উনাকে ফররুখ আহমেদের চাইতে আলাদা করেনি কেবল পরে কলকাতা বেইজড বাংলা-কবিতার ধারণা থেকেও বাঁচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শেষমেশ বাংলা-কবিতারে বুকশেলফে তুলে রাখার মতো সফিশটিকেশনই দিতে চেয়েছেন আহসান হাবীব। কমন পিপলের কথাই বলেছেন আন-কমন, শুদ্ধ/আপোষী বাংলায়। 

সময়টাকে নিয়েছেন উনি, সময়ের ভিতরে নিজের কবিতারে ইনসার্ট করতে চেয়েছেন, কিন্তু এটা দিয়ে সময়টাকে ডিফাইন করার মতো সাহস উনি দেখাতে চাননি। যার ফলে বলার জিনিসগুলি খুবএকটা চেইঞ্জ না হইলেও বলার প্যার্টানটাতে কিছু সময় পরপরই চেইঞ্জ আনতে পেরেছেন। অলওয়েজ অ্যান আউটসাইডার বলেছেন তাঁর মিডল-ক্লাস রিডারদেরকে, আমি কোনো আগন্তুক নই! আগুন্তকরা মিলে একটা আগুন্তুক লাঙ্গুয়েজ বানিয়ে ওইখানে আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে আগুন্তুক না হয়ে বেঁচে থাকাই মুশকিল। এই জন্যই কি আহসান হাবীব কিছুটা শরমিন্দা থাকতেন সবসময়?

দোতলার ল্যন্ডিং মুখোমুখি ফ্ল্যাট। একজন সিঁড়িতে, একজন দরোজায়


:আপনারা যাচ্ছেন বুঝি?
: চলে যাচ্ছি, মালপত্র উঠে গেছে সব।
: বছর দু’য়েক হলো, তাই নয়?
: তারো বেশি। আপনার ডাকনাম শানু, ভালো নাম?
: শাহানা, আপনার?
: মাবু।
: জানি।
: মাহবুব হোসেন। আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন।
: কে বলেছে। আপনার তো অনার্স ফাইনাল, তাই নয়?
: এবার ফাইনাল
: ফিজিক্স-এ অনার্স।
: কি আশ্বর্য। আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ?
: মা চান না। মানে ছেলেদের সঙ্গে ব’সে…
: সে যাক গে, পা সেরেছে?
: কি ক’রে জানলেন?
: এই আর কি। সেরে গেছে?
: ও কিছু না, প্যাসেজটা পিছল ছিলো মানে…
: সত্যি নয়। উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে…
: ধ্যাৎ। খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো?
: মা বলেছে?
: শুনতে পাই? বছর দুয়েক হ’লো, তাই নয়?
: তারো বেশি। আপনার টবের গাছে ফুল এসেছে?
: নেবেন? না থাক। রিকসা এলো, মা এলেন, যাই।
: যাই। আপনি সন্ধেবেলা ওভাবে পড়বেন না,
চোখ যাবে, যাই।
: হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই।
: যান, আপনার মা আসছেন। মা ডাকছেন, যাই।

 

 


রূপকথা


খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে,
স্বপ্নের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে।
এখানে রাতের ছায়া ঘুমের নগর,
চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর।
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের,
আকাশের নীল রং ছাউনিতে এর।
পরীদের ডানা দিয়ে তৈরি দেয়াল,
প্রজাপতি রং মাখা জানালার জাল।
তারা ঝিকিমিকি পথ ঘুমের দেশের,
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের।
ছোট বোন পারুলের হাতে রেখে হাত,
সাতভাই চম্পার কেটে যায় রাত।
কখনও ঘোড়ায় চড়ে হাতে নিয়ে তীর,
ঘুরে আসি সেই দেশ চম্পাবতীর।
এই খানে আমাদের মানা কিছু নাই,
নিজেদের খুশি মত কাহিনী বানাই।

 

 


আমি কোনো আগন্তুক নই


আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পালেস্থিরদৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা–
সারা দেশে।
আমি কোনো আগন্তুক নই।
এই খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে
তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই।
কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী
সাক্ষী তার চিরোল পাতার
টলমল শিশির, সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা
নিশিন্দার ছায়া
অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী
তার ক্লান্ত চোখের আঁধার
আমি চিনি, আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন। আমি
জমিলার মা’র শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি
সে আমাকে চেনে
হাত রাখো বৈঠায় লাঙ্গলে, দেখো
আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর। দেখো
মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে
লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস।
আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই।
দু’পাশে ধানের ক্ষেত
সরু পথ
সামনে ধু ধু নদীর কিনার
আমার অস্তিত্বে গাঁথা। আমি এই উধাও নদীর
মুগ্ধ এক অবোধ বালক।

 

 

 


স্বদেশ


এই যে নদী
নদীর জোয়ার
নৌকা সারে সারে,
একলা বসে আপন মনে
বসে নদীর ধারে
এই ছবিটি চেনা।
মনের মধ্যে যখন খুশি
এই ছবিটি আঁকি
এক পাশে তার জারুল গাছে
দু’টি হলুদ পাখি,এমনি পাওয়া এই ছবিটি
কড়িতে নয় কেনা।
মাঠের পরে মাঠ চলেছে
নেই যেন এর শেষ
নানা কাজের মানুষগুলো
আছে নানান বেশ,
মাঠের মানুষ যায় মাঠে আর
হাটের মানূষ হাটে,
দেখে দেখে একটি ছেলের
সারাটাদিন কাটে।
এই ছেলেটির মুখ
সারাদেশের সব ছেলেদের
মুখেতে টুকটুক।
কে তুমি ভাই,
প্রশ্ন করি যখন,
ভালবাসার শিল্পী আমি,
বলবে হেসে তখন।
এই যে ছবি এমনি আঁকা
ছবির মত দেশ,
দেশের মাটি দেশের মানুষ
নানান রকম বেশ,
বাড়ি বাগান পাখ-পাখালি
সব মিলে এক ছবি,
নেই তুলি নেই রং তবুও
আঁকতে পারি সবই।

 

 

 


ছড়া


ঝাউয়ের শাখায় শন শন শন
মাটিতে লাটিম বন বন বন
বাদলার নদী থৈ থৈ থৈ
মাছের বাজার হৈ হৈ হৈ।
ঢাকিদের ঢাক ডুমডুমাডুম
মেঘে আর মেঘে গুড়ুমগুড়ুম
দুধকলাভাত সড়াত সড়াত
আকাশে বাজে চড়াৎ চড়াৎ।
ঘাস বনে সাপ হিস হিস হিস
কানে কানে কথা ফিস ফিস ফিস
কড়কড়ে চটি চটাস চটাস
রেগেমেগে চড় ঠাস ঠাস ঠাস।
খোপের পায়রা বকম বকম
বিয়েমজলিশ গম গম গম
ঘাটের কলসি বুট বুট বুট
আঁধাঁরে ইঁদুর কুট কুট কুট।
বেড়ালের ছানা ম্যাও ম্যাও ম্যাও
দু দিনের খুকু ওঁয়াও ওঁয়াও।

 

 

 


ইচ্ছা


মনারে মনা কোথায় যাস?
বিলের ধারে কাটব ঘাস।
ঘাস কি হবে?
বেচব কাল,
চিকন সুতোর কিনব জাল।
জাল কি হবে?
নদীর বাঁকে
মাছ ধরব ঝাঁকে ঝাঁকে।
মাছ কি হবে?
বেচব হাটে,
কিনব শাড়ি পাটে পাটে।
বোনকে দেব পাটের শাড়ি,
মাকে দেব রঙ্গিন হাঁড়ি।

 

 


শরতে


ফুল ফুল তুল তুল গা ভেজা শিশিরে,
বুল বুল মশগুল, কার গান গাহিরে?
তর বর উঠে পর রাত ভোর দেখ না?
হাত তুলে প্রাণ খুলে স্রষ্টারে ডাক না..
ঝিক মিক দশ দিক নাই পিক পাপিয়া..
সাদা বক চক চক উড়ে যায় ডাকিয়া..
বিল ঝিল খিল খিল লাল নীল বরণে,
গাছে গাছে ফিঙ্গে নাচে চঞ্জল চরনে।
ভেজা ভেজা তাজা তাজা শেফালির সুবাসে,
শিশুদল কোলাহল করে নানা হরষে।
টিদার জরিপার শ্যাম শাড়ী অঙ্গে
এ্যলো কেশে এলো হেসে শরত এ বঙ্গে…

 

 


মেঘনা পাড়ের ছেলে


আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
মেঘনা নদীর ঢেউয়ের বুকে
তালের নৌকা বেয়ে
আমি বেড়াই হেসে খেলে-
আমি মেঘনা পাড়ের ছেলে।
মেঘনা নদীর নেয়ে আমি মেঘনা পাড়ে বাড়ি
ইচ্ছে হ’লেই এপার থেকে ওপারে দেই পাড়ি।
তালে তালে তালের নৌকা
দু’হাতে যাই বেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
পাহাড় সমান ঢেউয়ের বুকে নৌকো আমার ভাসে
মেঘমুলুকের পাহাড় থেকে ঝড়ের ঝাপটা আসে-
মাথার ওপর মুচকি হাসে
বিজলি নামের মেয়ে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।
আমার ঢেউয়ের সঙ্গে গলাগলি ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা
ঝড়ের সঙ্গে লড়াই ক’রে কাটাই সারাবেলা।
দেশ থেকে যাই দেশান্তরে
মনের নৌকা বেয়ে-
আমি মেঘনা নদীর ছেলে
আমি মেঘনা নদীর নেয়ে।

 

 

 


কাশ্মিরী মেয়েটি


কাশ্মিরী মেয়েটির কালো চোখ।
ফরিদের ছোট ছেলে সে-চোখের কিছুটা আলো
চেয়েছিলো!

সাহস অসীম নয়
কেননা মেয়ের
অবিরাম হাতপাখা আঁখিজল ঢের
দেখেছে সে।

এমন কি মাঝে মাঝে দু’একটা ফুটো তামা
সেই হাতে রেখেছে সে।
কাশ্মিরী মেয়েটির ঘাগরাটি লাল,
কাশ্মিরী মেয়েটির তনু গোলগাল।
ফরিদের ছোট ছেলে নাম আমজাদ
তার ছিলো সাধ,
খেলবে ম্যাজিক সেই ঘাগরাটি নিয়ে
কাশ্মিরী মেয়েটিকে
পুরো এক পয়সার সিগারেট দিয়ে

কাশ্মিরী মেয়েটির চোখ দুটি সাপের মতন,
কাশ্মিরী মেয়েটির দাঁতগুলি ভীষণ ধারালো:
নখে তার বিষ –
মুখে বুলি নরম নরম:
বেইমান কুত্তা হায় তোম্।

পথের মোটর এক হোলো বানচাল!
ফিরে গেলো দিন;
কাশ্মিরী মেয়েটার ঘাগরা বিলীন,
হাসে তার চোখ।
আমজাদ চেয়েছিলো কিছুটা আলোক!

(রাত্রিশেষ, ১৯৪৭)

 

বইয়ের কাভার - রাত্রিশেষ

বইয়ের কাভার – রাত্রিশেষ

 


কোনো বাদশাযাদীর প্রতি


নীল আকাশ,
রঙিন ঊষা
আর সবুজ তৃণে গড়ের মাঠ।
-আজ আমাদের ঈদ!
বাদশা’যাদী,
তুমি আসবে তো?
কার্জন পার্কের মোড়ে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো;
মাঠ থেকে ফিরে এসে
তোমায় লিফট করবো।
উহু গাড়ি কোথায়!
লিফট ক’রব-মানে
ওটা একটা কথার কথা।
আমরা হেঁটেই যাবো।

আমার পরনে থাকবে পা’জামা
গায়ে একটা সবুজ ডোরাকাটা শার্ট।
মাথার টুপিটা কালো,
তাতে পাঁচ সাতটা হলুদ বরণ ফুল।
পায়ে বাটা কোম্পানীর ক্যানভাস্।
লাল রঙের সিল্কের রুমাল
টাই করে গলায় বাঁধা।

আর তুমি?
তুমি পরেছ লাল টকটকে একটা শাড়ি।
যেটা কিনেছিলাম
ফেরিওলার কাছে,
এক টাকা চৌদ্দ আনায়।

গলায় হাঁসুলী, পায়ে মল,
গায়ের কোর্তাটা অনেক দামী –
মল্লিক বাজারে কেনা।

পায়ে তোমার নাগরাই সু
খোঁপায় চিরুণী আর অনেক কাঁটা,
তার ওপরে
একছড়া বেলফুলের মালা জড়ানো।
পথের লোকগুলো
হা ক’রে চেয়ে থাকবে তোমার দিকে।
তুমি যেন কিছু মনে করো না।

আমরা যখন হেঁটে যাবো-
আমরা বাহুটা জড়িয়ে থেকো
মেম সাহেবরা ঐ রকম চলে কিনা!

ফারপোতে আমরা যাব না।
খোদার দিন।
আজ নাছারা খানা খেতে নেই।
আমরা যাব ছকু মিয়ার হোটেলে।
বালুসাই, ছমুচা, খেজুর
যত তোমার খুশী খেয়ো।
ভাবনা নেই পয়সা আছে অনেক।
বাপ দিয়েছে ছ’আনা
দুই রাত বিড়ি বেঁধে পেয়েছি এক টাকা দু-আনা।

রাস্তায় বেরিয়ে
আরো কতক্ষণ ঘুরে বেড়াবো
নিরুদ্দেশে।
তারপর যখন বাজবে আড়াইটে
মনে পড়বে বায়স্কোপের কথা।

কোথায় যাব?
কেন ‘তসবির মহল’
না হয় ‘পার্ক শো হাউস’-
‘বাকে সেপাহীরা’ খেল আছে একটাতে
আর একটাতে ‘বাপকা বেটা’।

তখন আমরা রিকশতেই যাব।
তোমার একটা মান আছে তো!
আর তুমি যখন সাথে থাকবে
তখন টিকেটটাও না হয় চড়া দামেই নেব।
দু’খানা ন’আনাতে।

যদি ঘুমিয়ে যাও-
একটা জর্দা দেয়া পান
তোমাকে খাওয়াব।
তোমার ঘুম যাবে টুটে,
তোমার বুকের মধ্যে ধড়ফড় ক’রে উঠবে,
তুমি তখন আমার বুকে
মাথা রেখে খেল্ দেখবে।
আর তখন আমি পড়বো ঘুমিয়ে।

অনেক রাতে আমরা বেরুবো।
আবার রিকশ্।
তোমায় নামিয়ে দেব,
যে কোনো একখানে-
তুমি যাবে তোমার ঝরোকায়!

আর আমি?
আমি যাবো তিন নম্বর হারু মিয়ার বস্তি
সেখানেই আমি থাকি।

(রাত্রিশেষ, ১৯৪৭)

 

 

 

 


তামসিক একটি মুর্হূত


একদা হঠাৎ এক অপরাহ্নে মনে হলো
মৃত্যুও কঠিন হতে পারে।

যেহেতু অনন্তকাল বাঁচবে না জানি
মৃত্যুর দর্শনে বহু কবিতার শরীরে স্বাস্থ্যের
অতীন্দ্রীয় উজ্জ্বলতা রেখেছি; ভেবেছি
জীবন এবং এই জগৎকে দুদিনের পান্থশালা;
সহজে পেয়েছি
নির্মল আনন্দ যার ব্যাখ্যা নেই পৃথিবীর ফুলের পাপড়িতে
কিম্বা হীরকে পান্নায়।

আহারে-বিহারে শুধু কালক্ষেপ
প্রতীক্ষায় হৃদয় রেখেছি উন্মুখ, কখন হবে
অনাদি অনন্তকাল সমুদ্রের ঢেউ হয়ে
বয়ে যাবে জীবন, এবং
জায়াপুত্রপরিবার যথারীতি একদা দু’চোখ
মুছে নিয়ে মন দেবে উত্তরাধিকারসূত্রে কবে-
আমি হবো চৈতন্যের লীলার আশ্রয়ে
সদানন্দ শিশুর মহিমা;
লোভের ক্ষোভের আর ক্ষুদ্রতার কালি মুছে নিয়ে
জ্বালিয়ে আত্মার শিখা ব্যাপ্ত হবো অনন্তে
ভেবেছি।
ভেবেছি এবং নিত্য যথারীতি জমিয়েছি কড়ি
পাড়ের, এবং কিছু অনিত্য কড়িও
রেখেছি সঞ্চয় ক’রে ভবিষ্যৎ পথিকের প্রয়োজন ভেবে,
যেহেতু তারাও কিছু আশা করে। অতএব কোনো
অনুতাপ কিম্বা কোনো মনোবেদনার
কারণ ছিলো না কিছু।

অথচ একদা
অপরাহ্ণে যখন-
(যেমন প্রত্যহ যাই)
দক্ষিণের আমের বাগানে
বেরিয়ে, দু’একটি কঁড়ি হাতে নিয়ে ফিরেছি
হঠাৎ
পাতার আড়ালে ডাক শোনা গেলো
এবং অক্লান্ত স্বরে ডেকে গেলো একটি ঘুঘু নিজের মনেই।
মনে হলো এ পৃথিবী আরো
অনেক অনেক দিন বেঁচে রবে
মৃত্যু হবে আমার এবং
যদিও অক্লান্ত স্বরে অপরাহ্ণে ঘুঘুদের ডাক
শোনা যাবে
আমি তা শুনবো না। ঘরে ফিরে এখন যেমন
দেখা গেলো একটি মেয়ে বিকেলের ছায়ায় মিশিয়ে
শরীর, আপন মনে ব’সে আছে জানালার র’কে
ভাবছে কিছু
অথবা কিছুই ভাবছে না সে-
তার সঙ্গে এখানে এমন ক’রে আর কোনোদিন
আমার হবে না দেখা।

আর এই সামান্য কারণে
হঠাৎ সেদিন এক অপরাহ্নে মনে হলো
মৃত্যুও কঠিন হতে পারে
এবং নির্মম।

(ছায়াহরিণ, ১৯৬২)

 

বইয়ের কাভার - ছায়া হরিণ।

বইয়ের কাভার – ছায়া হরিণ।

 


যত দূরে যাই


যত দূরে যাই তুমি অপার
তোমাকে দেখার অন্ত নাই
ভোরের নদীর নীল বিথার
নদী নিরবধি আজকে তাই।

অপরাহ্নের ক্লান্ত পায়
পথের প্রান্ত ভোলায় চোখ
পলাশে বকুলে চোখ ফেরায়
হঠাৎ তোমার ব্যাপ্তলোক।

ভোরের নদীর মোহনা শেষ
আরেক নদীতে নতুন ভোর,
যতদূরে যাই তুমি অশেষ
পালে উদ্দাম নতুন জোর।

তুমি চিত্রল শিশু হরিণ
লালন করেছো বুকে তোমার
চোখে নাচে তার রাত্রি দিন
কি যে অস্থির চপলতার।

পুরনো পথের প্রান্তে যাই
দেখি ফুটে আছে নতুন ফুল
শুকনো নদীর ঘাটে দাঁড়াই
নতুন পানিতে ভরেছে কূল

দেখি বন্দরে নতুন সাজ
চেনা মানুষের নতুন মুখ
সারা বুকে তুমি কি কারুকাজ
রেখেছো, ভরেছো আমার বুক।

(মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, ১৯৭৬)

 

 

 


গিলগামেশ কাহিনী


ভালোবাসা ভালোবাসা বলে আমি গেলুম এগিয়ে
তাকে কোথাও দেখি না। আমি
যতই সামনের দিকে চলে যাই
একে একে সব
সঙ্গীরা হারিয়ে যায় একা পড়ে থাকি।

দক্ষিণে প্রাসাদ থাকে উত্তরে বাগিচা
জলসাঘরে নূপুরে উদ্দাম
তার সামনে নীল জলরেখা
তাকে বাঁয়ে রেখে
তোরণ পেরিয়ে গেলে বিধ্বস্ত খামার। মরা
ফুলের মলিন রেণু পুবের বাতাসে। এই
খামার মলিন রেণু
এইসব পার হয়ে গেলে
আরো সামনে কিছুই থাকে না।

প্রাসাদ জলসাঘর সরোবর এইসব ছেড়ে
বিধ্বস্ত খামার আর মলিন ফুলের রেণু
পার হয়ে আমিও একজন গিলগামেশ। আমি
অমরতা অমরতা বলে
হন্তারক সাপের কবলে যাই,
তারো আগে বিশাল বনানী
কাঁপিয়ে বেরিয়ে আসে ধূসর প্রান্তরে
একটা ঘোড়া জোয়ান অথচ তার এক পা নেই, তবু
প্রবল বিক্রমে যায় ছুটে যায়
যেতে যেতে বলে
ফিরে যাও, ফেরার পথেই
ভালোবাসা অপেক্ষায় আছে।

(দু’হাতে দুই আদিম পাথর, ১৯৮০)

 

বইয়ের কাভার - দু'হাতে দুই আদিম পাথর

বইয়ের কাভার – দু’হাতে দুই আদিম পাথর

 

 


আমি তখন


তুমি বলো কামিনী কামিনী!
পুরনো বাগানটাগান তুলে দিয়েছি। তুমি তবু
কেবলই বলো বকুল বকুল!

আমি নতুন কেনা আরশি তুলে ধরি
চোখের সামনে
তুমি তারস্বরে চীৎকার করে বলো, ‘তুমি নও তুমি নও!’
আমার মুখের রেখা কাঁপতে থাকে।

‘একদা এই পথই রাজপথ ছিলো…
এই বলে তোমার গল্প শুরু। আমি শুনতে চাই না
তুমি বলো, ‘তিনি করতলে স্থাপন করছিলেন নক্ষত্রলোক।’

আমি চমকে উঠি।
আমি নদী দেখি
শালবন দেখি
ব্যাঘ্রনিনাদ পিঠে তুলে একদল হরিণকে ছুটে যেতে দেখি।

তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
আমি আবার অনেক দূরে সরে যেতে থাকি।

গোধূলির সমস্ত সিঁদুর যখন ধূসর হয়ে আসে আর
বনভূমি কাঁপিয়ে
বিশালাকায় কালো ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে
ভয়াবহ নিরবতা যখন গর্জে ওঠে
আমি ভয় পাই।

ভয় পেয়ে আমি তোমার দিকে ছুটতে থাকি
নক্ষত্রে ছাওয়া তোমার খ’ড়ো ঘরের দাওয়ার দিকে
তোমার গল্পের দিকে।

আমি কামিনী কামিনী বলে ছুটতে থাকি
আমি বকুল বকুল বলে ছুটতে থাকি।

(দু’হাতে দুই আদিম পাথর, ১৯৮০)

 

 

 


বসবাস নিবাস


পাখির উড়াল দেখতে দেখতে প্রশ্ন করেছি।
কোথায় নিবাস?
পথের বাতাস উড়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করেছি
কোথায় নিবাস?

কি নিঃসঙ্গ নদী বয়ে যায একা একা নদী
কোথায় যে যায়
কতদিন তাকে প্রশ্ন করেছি নিবাস কোথায়
নিবাস কোথায়?
কোথায় যে কার নিবাস, আহা রে ঝড়ে বৃষ্টিতে
কোথায় যে রয়
আমার নিজের ঘর আছে, আমি নিজের ঘরেই
থাকি নির্ভয়।

শেলফে সাজানো মননের সঙ্গে স্বজন
সুখে বসবাস
হঠাৎ কখনো দর্পণে মুখ হঠাৎ প্রশ্ন
কোথায় নিবাস?

(বিদীর্ণ দর্পণে মুখ, ১৯৮৫)

 

 


জোনাকিরা


তারা- একটি দুটি তিনটি করে এলো
তখন- বৃষ্টি-ভেজা শীতের হাওয়া
বইছে এলোমেলো,
তারা- একটি দু’টি তিনটি করে এলো।
থই থই থই অন্ধকারে
ঝাউয়ের শাখা দোলে
সেই- অন্ধকারে শন শন শন
আওয়াজ শুধু তোলে।
ভয়েতে বুক চেপে
ঝাউয়ের শাখা , পাখির পাখাউঠছে কেঁপে কেঁপে ।
তখন- একটি দু’টি তিনটি করে এসে
এক শো দু শো তিন শো করে
ঝাঁক বেঁধে যায় শেষে
তারা- বললে ও ভাই, ঝাউয়ের শাখা,
বললে, ও ভাই পাখি,
অন্ধকারে ভয় পেয়েছো নাকি ?
যখন- বললে, তখন পাতার ফাঁকে
কী যেন চমকালো।
অবাক অবাক চোখের চাওয়ায়
একটুখানি আলো।
যখন- ছড়িয়ে গেলো ডালপালাতে
সবাই দলে দলে
তখন- ঝাউয়ের শাখায়- পাখির পাখায়
হীরে-মানিক জ্বলে।
যখন- হীরে-মানিক জ্বলে
তখন- থমকে দাঁড়াঁয় শীতের হাওয়া
চমকে গিয়ে বলে-
খুশি খুশি মুখটি নিয়ে
তোমরা এলে কারা?
তোমরা কি ভাই নীল আকাশের তারা ?আলোর পাখি নাম জোনাকি
জাগি রাতের বেলা,
নিজকে জ্বেলে এই আমাদের
ভালোবাসার খেলা।
তারা নইকো- নইকো তারা
নই আকাশের চাঁদ
ছোট বুকে আছে শুধুই
ভালোবাসার সাধ।

অসুখ


আমি বড় অসুখী। আমার আজন্ম অসুখ। না না
অসুখে আমার জন্ম।
এই সব মোহন বাক্যের জাল ফেলে
পৃথিবীর বালক-স্বভাব কিছু বয়স্ক চতুর জেলে
মানব-সাগরে।
সম্প্রতি উদ্দাম হাতে নৌকো বায়। আমরা বিমূঢ়।
কয়েকটি যুবক এই অসুখ-অসুখ দর্শনের
মিহি তারে গেঁথে নিয়ে কয়েকটি যুবতী
হঠাৎ শৈশবে গেলো ফিরে
এবং উন্মুক্ত মাঠে সভ্যতার কৃত্রিম ঢাকনায়
দুঃসাহস-আগুন জ্বালিয়ে
তারস্বরে কেবল চিৎকার করে :
আমরা বড় অস্থির। কী চাই,
আমাদের কী চাই, কী চাই!
ওরা বলে : সন্ত্রাসতাড়িত আমরা সন্ত্রাসিত পৃথিবীতে তাই
আমরা কেবল ছুটি। বলে আর ঊর্ধ্বশ্বাসেছোটে।
কোথায় ছুটেছে যদি জানতে চাও ওরা অনায়াসে
জবাবে জানায়, নেই ঠিকানা,
অথবা কোনো ঠিকানার বাসনাও নেই।
নৈরাশ্যের হাওয়া থেকে ক্রোধের আগুন জ্বেলে নিয়ে
ওরা বলে : পুড়ুক পুড়ুক
দু’পাশের শ্যামশোভা, পুরনো ঘরের
পুরনো সম্ভার সব পোড়াবো এবং
শূন্যতাকে একমাত্র সত্য বলে রেখে যাবো দুয়ারে সবার।
আর এই উন্মাদ উৎসবে যদি হঠাৎ কখনো
ব্যথিত প্রবীণ কোনও পথচারী প্রশ্ন করে : শূন্যতার বোঝা
কে বয় এমন করে, কোন অর্থে, কী লাভ, কী লাভ!
ওরা বলে : অর্থ নেই। অর্থ নেই এ জীবনে এই শুধু সার
জেনেছি। জেনেছি কোনো লাভ নেই অর্থের সন্ধানে।
লাভ নেই লাভের আশায় কালক্ষেপে
অথবা শূন্যের কড়ি গুণে গুণে লাভ নেই অলিক ছায়ায়।
তার চেয়ে উদ্দাম জোয়ারে
ভেসে যাবো। এবং যেহেতু
ভেসে ভেসে ডুবে যাওয়া একমাত্র সত্য পৃথিবীতে
সত্যের সজ্জিত বৃদ্ধ গাধাটাকে ডুবিয়ে আমরাও
কিছুকাল মত্ত হাতে নৌকা বেয়ে
জোয়ারের জলে ভেসে যাবো।
এবং একদা ডুবে যাবো।

স্বদেশ আমার


জেলের সেলে বন্দী ছিলো
মৃতের স্তুপের অন্ধকারে বন্দী ছিলো
বন্দী ছিলো বন্ধ দুয়ার
ভয় থমথম ঘরের মাঝে।
শহর জুড়ে কারফ্যু তার কাফন ছড়ায়
সেই কাফনে বন্দী ছিলো।
ওরা তখন মন্ত্রপুত মশাল নিয়ে নামলো পথে
মৃতের স্তুপে ফোটালো ফুল
নতুন প্রাণে গাঁথলো নতুন দীপাবলি।
আগুন জ্বলে। জ্বলতে থাকে পাশব আঁধার
গ্রাম নগরে রাত পেরিয়ে, রাত পেরিয়ে
রাত পেরিয়ে
সূর্য নামে।
তখন দেখি
আলোর মুকুট মাথায় পরে
ভুবন জুড়ে বাইরে এলো বন্দিনী মা বাংলা আমার
স্বদেশ আমার।

একবার বলেছি তোমাকে


একবার বলেছি, তোমাকে আমি ভালোবাসি।
একবার বলেছি, তোমাকে আমি, তোমাকেই ভালোবাসি।
বল
এখন সে কথা আমি ফেরাব কেমনে !
আমি একবার বলেছি তোমাকে …
এখন তোমাকে আমি ঘৃণা করি।
এখন তোমার
দৃষ্টির কবলে এলে ক্ষতস্থান জ্বলে জ্বলে ওঠে।
তোমার সান্নিধ্যে এলে তুমি উষ্ণ নাভিমূল থেকে
বাতাসে ছড়াও তীব্র সাপিনীর তরল নিঃস্বাস। আমি
যতবার ছুটতে চাই, তোমার দৃষ্টির বাইরেযেতে চাই, তুমি
দু চোখে কী ইন্দ্রজাল মেলে রাখ ! আমি ছুটতেও পারি না
আমি ফেরাতে পারি না কথা
আমি একবার বলেছি, তোমাকে …
সম্রাজ্ঞীর বেশে আছ। নতজানু আমি
দাসানুদাসের ভঙ্গি করপুটে, দেখি
তোমার মুখের রেখা অবিচল, স্থির জঙ্ঘা তোলে না টঙ্কার,
তুমি পবিত্রতা পবিত্রতা বলে
অস্পষ্ট চিত্কার কর, তুমি
কেবলি মালিন্য দেখ, অশ্লীলতা, ক্রমান্বয়ে ঘৃণা
ক্রোধ বাড়ে, উত্তেজনা বাড়ে
নামে উষ্ণ জলস্রোত। তুমি
এইভাবে প্রবল ঘৃণায়
আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে অহঙ্কার রাখতে চাওঅটুট। তবুও
পৃথিবীতে আছে কিছু মানুষের অবস্থান, তারা
অপমানে ধন্য হয়
উপেক্ষায় ঋজু;
তারা স্বভাব-কাঙাল ! যদি
একবার বলে তবে ফেরাতে পারে না। আমি
ফেরাতে পারি না। আমি
একবার বলেছি, তোমাকে আমি ভালোবাসি।
ভালোবাসা ভালোবাসা ভালোবাসা
ভালোবাসা ! সে কেমন, কোন দীপ্র স্বর্গীয় প্রতাপ
যার মৃত্যু নেই
জন্মান্তর নেই?

এই খানে নিরঞ্জনা


এইখানে নিরঞ্জনা নদী ছিলো
এই ঘাটে হাজার গৌতম
স্নান করে শুদ্ধ হয়েছেন।
নদী আছে ঘাট আছে
সেই শুদ্ধ জলের অভাব
অশুদ্ধ মানুষ খুব বেড়ে গেছে
সারিবদ্ধ স্নানার্থী মানুষ
মরানদী মরাস্রোত ছাড়িয়ে এখন _
বলে দাও
যেতে হবে অন্য কোনো নিরঞ্জনা নদীর সন্ধানে।

ঘুমের আগে


জানো মা, পাখিরা বড় বোকা, ওরা কিছুই জানেনা।
যত বলি, কাছে এসো, শোনো শোনো, কিছুতেই মানেনা।
মিছেমিছি কেন ওরা ভয় পায়, ভয়ের কি আছে?
বোঝেনা বোকারা, আমি ভালোবাসি তাই ডাকিকাছে।
দেখোনা, যখন কাল আমাদের আমবাগানের
পুবধারে ওরা সব বসিয়েছে আসর গানের-
আমি গিয়ে চুপ চুপে কিছু দূরে বসেছি যখন,
গান ভুলে বোকাগুলো একসাথে পালালো তখন।
ওরা কি জানেনা, আমি গান বড় ভালোবাসি, তাই
যখনি ওদের দেখি চুপে চুপে কাছে চলে যাই !
আচ্ছা মা, বলো দেখি কি করে কাটাব এই ভয়,
কি পেলে তখন ওরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়?
সাদা কড়ি ওদের কি ভাল লাগে ? আমার যেমন
ছোট লাল ঘুড়ি আছে, মাজা সূতো, ওদের তেমন
আছে না কি ? কিছু নেই ? বেশ কথা, না-ই যদি থাকে
বোকারা নিজেরা এসে বলে যেতে পারে ত আমাকে,
আমি ত দিতেই চাই, বোকারা যে কখনো আসে না।
জানি, ওরা পাখি কি-না, মানুষকে ভালোই বাসে না।
বলোনা মা, কি করলে পাখিরাও খুব ভালোবাসে,
কি করলে পাখিরাও ভালোবেসে খুব কাছে আসে।

আমার সন্তান


তাকে কেন দুদিনেই এমন অচেনা মনে হয় !
সন্ধ্যায় পড়ার ঘরে একা বসতে ভয় পেত। নিজেই নিজের
ছায়া দেখে কেঁপে উঠত। কনিষ্ঠকে সঙ্গী পেলে তবেই নির্ভয়ে
বসত সে পড়ার ঘরে।
আমার সন্তান
যে আমার হাতের মুঠোয়
হাত রেখে তবে
নিশ্চিন্তে এ-পাড়া
ও-পাড়া ঘুরেছে, গেছে মেলায়
এবং নানা প্রশ্নে
ব্যতিব্যস্ত করেছে আমাকে
আজ
তাকে কেন দুদিনেই এমন অচেনা মনে হয় !
কোথায় বেরিয়ে যায় একা একা ব্যস্ত পায়ে
একা একা
ক্লান্ত হয়ে ফেরে, তার
কোথায় কী কাজ, তার কেন ক্লান্তি?
যখন বাড়িতে
কেন সে দুধের সর না পেলেও এখন একবার
ক্ষুব্ধ দৃষ্টি মেলে দিয়ে তাকায় না মার চোখে চোখে?
যা পায় তা খায় কেন মুখ বুজে
কেন সে হঠাৎ
এমন উত্কর্ণ হয়ে বাইরে চোখ ফেরায়। খোকন
কিছু যেন শুনতে চায়। ঘরে নয় বাইরে কিছু শুনবে বলে
কান পাতে। কখনো না খেয়ে
হঠাৎ বেরিয়ে যায়
কোথায়, কোথায়?
কী ভাবনায় আমার খোকন
দুদিনেই এমন গম্ভীর হয়ে গেল
এমন বিষন্ন কেন
দীর্ণবুক দুঃখী মানুষের মতো হাঁটে কেন
এমন বয়স্ক কেন মনে হয় আমার খোকাকে।
কেন সে আমাকে
কিছুই বলে না আর
আমাকে আমার
পূর্বপুরুষের ছেঁড়া মাদুরে বসিয়ে রেখে অসহায়
হেঁটে যায় একাকী এমন রাজদর্পে
এবং তখন তার রাজবেশে আহা
সারা পথ এমন উজ্জ্বল হয়ে
জ্বলে ওঠে কেন।
আর তার কিশোর দেহের কী আশ্চর্য মহিমা।দু চোখে
প্রজ্ঞার আগুন যেন
কণ্ঠস্বর যেন
স্বর্গীয় সংকেতে ঋদ্ধ শব্দাবলি ছড়ায় দুপাশে।
দেখে দেখে মনে হয় কোনো নব পয়গম্বর যেন।
আমার সন্তান যায়
হেঁটে যায়
সামনে যায়
দেহ তার দীর্ঘতর হয়। আরো দীর্ঘ
সন্তানের দেহ
পিতার গর্বিত বুক উঁচু কাঁধ প্রশস্ত ললাট
ছাড়িয়ে সে আরো দীর্ঘ দীর্ঘতর হয়ে
আমার হাতের
নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে ছুটে যায়।
আসন্ন সন্ধ্যায়
অন্ধকারে ভয় পেয়ে বুকফাটা চিত্কারেপখন
জানতে চাই, এই অন্ধকারে কোথায় সে যেতে চায়, বলে
সামনে যাব।
সামনে কী ভয়াল অন্ধকার। বলে
অন্ধকার পেরোলেই আলো। বলি তাকে
ওপথে অনেক
হিংস্র জন্তুর তীক্ষ্ণ নখর তোমাকে চায়
উত্তরে খোকন
নিচু হাত ঊর্ধ্বে তুলে ঘোরায় তলোয়ার।
ওপথে নিশ্চিত মৃত্যু বলে আমি যখন আবার
অসহায় শিশুর মতোই কাঁদতে থাকি
তখন বয়স্ক কোনো পিতার কণ্ঠস্বরে খোকা বলে
‘মৃত্যুই জীবন’| এবং সে আরো বলে
তুমি আর হাতের আড়ালে রেখো না আমার হাত
ভয়ের কাফনে জড়িয়ে রেখো না আর
অন্ধকার ছড়িয়ে রেখো না
আমার দু চোখে পিতা
তোমার চারপাশে বড় অন্ধকার তাই
সামনে যাব
আরো সামনে
সূর্যোদয়ে যাব।
ইতিহাস আয়োজিত সাজানো মেলায়
আলোয় দাঁড়াবো বলে
যখন খোকন যায় আরো দূরে
যতদূরে আমার দুর্বল দৃষ্টি চলে না, তখন
কেঁদে বলি, তুই চলে গেলে
অন্ধকার অপমান নিঃসঙ্গতা এইসব রেখে
তুই চলে গেলে খোকা
আমার কী থাকে বল
যখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি
হঠাৎ তখন
সন্তানের সেই দৃষ্টি ফেরায় আমার চোখে, বলে
‘পিতার গৌরব !’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত