| 19 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প গল্প সাহিত্য

জন্মদিনের মেয়ে ।। হারুকি মুরাকামি

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

অনুবাদক: ইশরাত তানিয়া

[হারুকি মুরাকামি উত্তর আধুনিক সাহিত্যের একজন অন্যতম প্রভাবশালী লেখক। জন্মেছেন ১৯৪৯ সালের ১২ জানুয়ারি জাপানের কিয়োতোয়। মুরাকামির গদ্যের ভাষা সহজ ও সাবলীল। তিনি ব্যতিক্রমী প্লট নির্বাচন করেন এবং তাঁর কাহিনী অতি ধীরে ধীরে দীর্ঘ বেনীর মতো খুলে যায় । জন্মদিনের মেয়ে গল্পটি তাঁর ব্লাইণ্ড উইলো, স্লীপিং ওম্যান গল্পগ্রন্থ থেকে নেয়া। তিনি জন্মদিনের মেয়ে গল্পটি লিখেছিলেন একজন সম্পাদকের অনুরোধে। তখন তিনি বিভিন্ন লেখক রচিত জন্মদিন বিষয়ক সাহিত্য-সংকলন নিয়ে কাজ করছিলেন। জাপানি ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জেই রুবিন।]


বরাবরের মতই বিশতম জন্মদিনে সে টেবিলগুলোয় খাবার পরিবেশন করছিল। সে সবসময় শুক্রবারে কাজ করত। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু ঠিক থাকলে মেয়েটি এই বিশেষ শুক্রবার রাতে ছুটি নিত। স্বাভাবিকভাবেই আরেকজন খণ্ডকালীন মেয়ে তার সাথে কাজের সময় পরিবর্তন করতে রাজি হয়েছিল। ক্রেতাদের টেবিলে কুমড়োর নিয়োকি এবং সামুদ্রিক খাবার ফ্রিটো মিসটো পরিবেশন করে আর রেস্তোরাঁর রাগী প্রধান পাচকের চেঁচামেচি শুনে কারো বিশতম জন্মদিন কাটানোর কোনো অর্থই ছিল না। কিন্তু সেই আরেকজন মেয়ের হঠাৎ একশ’ চার ডিগ্রী জ্বর এবং পেট খারাপ হওয়ায় অল্প সময়ের নোটিশে সে কাজ থেকে ফিরে গিয়েছিল।      
অসুস্থ মেয়েটি দুঃখ প্রকাশ করাতে সে মেয়েটিকে বলেছিল, ‘এটা কোনো ব্যাপারই না’, সে মেয়েটিকে স্বস্তি দিতে চেয়েছিল, ‘আমার বিশতম জন্মদিন হলেও আজকে আমি বিশেষ কিছু করছি না।’
এবং আসলেই সে খুব হতাশ হয়নি কারণ কিছু দিন আগেই ছেলেবন্ধুর সাথে তার ভীষণ ঝগড়া হয়েছিল। এই বন্ধুর সাথেই সে রাতে সময় কাটানোর কথা ছিল। স্কুল থেকেই তারা পরিচিত ছিল। খুব সামান্য বিষয় থেকে তাদের মতের অমিল শুরু হয়েছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে সেটা এতো দীর্ঘ এবং তিক্ত চেঁচামেচিতে পরিণত হয়েছিল যে মেয়েটি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন হতে চলেছে। তার নিজের ভেতরটা পাথরের মতো শক্ত এবং মৃত মনে হচ্ছিল।  ক্রোধের সেই বিস্ফোরণের পর থেকে ছেলেটি তার সাথে যোগাযোগ করেনি এবং সেও ছেলেটির সাথে কথা বলতে চাইছিল না।        
সে কাজ করত একটি জনপ্রিয় ইতালিয়ান রেস্তোরাঁতে। জায়গাটি ছিল টোকিয়োর পাহাড় ঘেরা রোপ্পোঙ্গি  এলাকায়। ষাটের দশকের শেষদিকে রেস্তোরাঁটি ব্যবসা শুরু করেছিল। রান্নার বিশেষ প্রণালীর জন্য এর সুনাম ছিল। কিছু নিয়মিত ক্রেতা ছিল যারা এর খাবার খেয়ে কখনোই হতাশ হয়নি। সেখানে খাওয়ার জায়গাটির পরিবেশ ছিল কোলাহলহীন, নিরুদ্বেগ এবং আরামদায়ক। তরুণদের ভিড় এখানে দেখা যেত না। একটু বয়স্ক মানুষই এই রেস্তোরাঁতে আসতেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ মঞ্চ শিল্পী এবং লেখক ছিলেন। 
দু’জন পূর্ণকালীন খাবার পরিবেশক সপ্তাহের ছয় দিন কাজ করত। সে আর অন্য আরেকজন খণ্ডকালীন পরিবেশক মেয়ে পর্যায়ক্রমে তিনদিন করে কাজ করত। ওরা দু’জনই ছাত্র ছিল। এছাড়াও দাপ্তরিক কাজের জন্য একজন ম্যানেজার ছিল, শুকনোমতো মধ্যবয়স্ক মহিলা। রেস্তোরাঁটির শুরু থেকেই সে মহিলা চাকরি করে আসছিল এবং আক্ষরিক অর্থেই সে একই জায়গায় বসে থাকত। তাকে দেখে ‘লিটল ডোরিট’ এর মেঘাচ্ছন্ন বুড়ো চরিত্রের কথা মনে পড়ে যেত। সে ঠিক দুটো কাজ করত- ক্রেতাদের কাছ থেকে টাকা রাখা এবং টেলিফোন ধরা। মহিলা শুধু প্রয়োজনে কথা বলত আর একই কালো পোশাক পরে থাকত। তার মধ্যে এতটাই শীতলতা আর কাঠিন্য ছিল যে মনে হতো রাত্রিকালীন সময়ে তাকে কোন নৌকা করে সাগরে ভাসিয়ে দিলে সে নৌকা ডুবে যাবে।     
আরেকজন ম্যানেজারের বয়স ছিল প্রায় চল্লিশের কোঠায়। লম্বা এবং চওড়া কাঁধ বলে দেয় যৌবনে সে খেলোয়াড় ছিল। যদিও তখন তার চিবুকে আর পেটে মেদ বেশ মেদ জমছিল। তার ছোট আর খাড়া চুল পাতলা হয়ে এসেছিল। এক ধরনের বয়সী অকৃতদারের গন্ধ তাকে ঘিরে থাকত- ড্রয়ারের ভেতর বহুদিন ধরে রেখে দেয়া নিউজপ্রিন্টের ওপর সর্দির ওষুধের ফোঁটা পড়লে যেমন গন্ধ হয় তেমনি এক গন্ধ। মেয়েটি খেয়াল করেছিল তার এক অবিবাহিত চাচার গায়েও সে একই রকম গন্ধ পেয়েছিল।    
ম্যানেজার সবসময় কালো স্যুট, সাদা শার্ট এবং বো টাই পরত। ক্লিপ লাগানো নয়, আসল বো টাই। আয়নাতে না দেখে সে টাই বাঁধতে পারত। এ ব্যাপারে সে খুব গর্বিত ছিল। রেস্তোরাঁয় দিনের পর দিন সে তার কর্তব্য নিপুনভাবে পালন করে যেত। তার কাজ ছিল ক্রেতাদের আগমন এবং প্রস্থান পর্যবেক্ষণ করা, সংরক্ষিত তালিকা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল থাকা, নিয়মিত ক্রেতাদের নাম জানা এবং খাবার পরিবেশকদের কাজ দেখাশোনা করা। তার আরেকটি বিশেষ কাজ ছিল এবং সেটি ছিল রেস্তোরাঁর মালিকের কক্ষে সান্ধ্যভোজ সরবরাহ করা।   
*
‘রেস্তোরাঁর ভবনটির ৬ তলায় মালিকের নিজস্ব বাসস্থান ছিল’, মেয়েটি বলেছিল, ‘একটা এপার্টমেন্ট বা অফিস জাতীয় কিছু।’ 
‘সে আর আমি, যেভাবেই হোক, আমাদের বিশতম জন্মদিন নিয়ে কথা বলছিলাম- সে দিনটি কী ধরনের দিন ছিল আমাদের সে ব্যাপারে। বেশিরভাগ মানুষই তাদের বিশতম বয়সে পা দেবার দিনটি মনে রাখে। মেয়েটির বিশতম জন্মদিনটি ছিল আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে।’   
‘যদিও মালিক কখনই রেস্তোরাঁতে আসত না তবুও তাকে একজনই দেখেছে- সে হলো ম্যানেজার। মালিকের রাতের খাবার সরবরাহ করা একমাত্র তারই কাজ ছিল। আর কোনো কর্মচারী জানত না মালিক দেখতে কেমন ছিল।’ 
‘তাহলে, মালিকের নিজের রেস্তোরাঁ থেকেই নিজের বাসায় খাবার যেত।’ 
‘ঠিক’- সে বলেছিল, ‘ম্যানেজার প্রতি রাতে আটটার সময় মালিকের কক্ষে খাবার নিয়ে যেত। এটা ছিল রেস্তোরাঁর সবচেয়ে ব্যস্ত সময়। এই সময়ে ম্যানেজারের অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটা আমাদের জন্য খুব অসুবিধার ছিল কিন্তু এছাড়া আর উপায় ছিল না। রুম সার্ভিসের জন্য ব্যবহৃত কার্টে করে মালিকের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া হতো। ম্যানেজার যখন লিফটে খাবারবাহী কার্ট ঠেলে দিতেন তখন তার মুখে শ্রদ্ধার দৃষ্টি ফুটে থাকত এবং বিশ মিনিট পর সে খালি হাতে ফেরত আসত। এক ঘন্টা পর ম্যানেজার আবার উপরে যেত এবং কার্টে করে খালি গ্লাস-প্লেট নামিয়ে আনত। প্রতিদিন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘড়ির কাঁটা ধরে সে কাজটি করত। শুরুতে আমার চোখে এটা বিসদৃশ ঠেকেছিল, জানেন? যেন একটি ধর্মীয় রীতি পালন করা হচ্ছিল। তারপর ব্যাপারটা আমার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেল এবং আমি এটা নিয়ে আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি।’  
রেস্তোরাঁর মালিকের খাবারে সবসময় মুরগি থাকত। রান্নার প্রণালী এবং সবজিতে পরিবর্তন থাকলেও মুরগির মাংসই ছিল তার প্রধান খাবার। তরুণ পাচক একবার সপ্তাহের প্রতিদিন একই রকমভাবে রোস্ট করা মুরগি পাঠিয়ে দেখতে চেয়েছিল কী হয়, কিন্তু সে কোনো অভিযোগ পায়নি। আরেকজন পাচক বিভিন্নভাবে মুরগি রান্নার আয়োজন করেছিল। নতুন পাচকরা মুরগি রান্নার সব ধরনের প্রক্রিয়া ব্যবহার করে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইত। তারা বিভিন্ন উপাদেয় সস ব্যবহার করত এবং বিভিন্ন সরবরাহকারিদের কাছ থেকে মুরগি নিত কিন্তু এসবের কোনো কিছুই মালিককে প্রভাবিত করত না। ব্যাপারটা ছিল শূন্য একটি গুহায় পাথরের টুকরো ছুঁড়ে দেয়ার মতো। শেষ পর্যন্ত তারা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই প্রতিদিন মুরগি রান্না করত।      
১৭ নভেম্বর, মেয়েটি তার জন্মদিনে অন্যান্য দিনের মতোই কাজ শুরু করেছিল। বিকেল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল এবং সন্ধ্যার দিকে সেটা প্রবল বৃষ্টিপাতে পরিণত হয়েছিল। পাঁচটার সময় ম্যানেজার সেদিনের বিশেষ বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার জন্য পরিবেশনকারীদের জড়ো করেছিলেন। পরিবেশনকারীদের নির্দেশনাগুলো প্রায় মুখস্থ করে ফেলতে হতো। যেমন ভিল মিলানীজ, পাস্তার উপরিভাগে সার্ডিন আর পাতা কপির স্তর, বাদামের মূস্। লিখে রাখার জন্য আলাদা কোনো কাগজ ব্যবহার করা যেত না।  মাঝে মাঝে ম্যানেজার ক্রেতার চরিত্রে অভিনয় করতেন এবং প্রশ্ন করে তাদের পরীক্ষা করে দেখতেন। এবার আসা যাক কর্মচারীদের খাবার প্রসঙ্গে। এই রেস্তোরাঁর খাবার পরিবেশনকারীদের পেটে অস্বস্তিকর আওয়াজ হতে পারত না কারণ তাদের ক্রেতার কাছে গিয়ে খাবারের অর্ডার নিতে হতো!     
৬টার সময় রেস্তোরাঁর দরজা খুলেছিল কিন্তু ভারি বৃষ্টির জন্য সেদিন তেমন অতিথি আসছিল না। এমনকি ক্রেতারা কিছু সংরক্ষিত আসনও বাতিল করে দিয়েছিল। বিশেষ করে মহিলারা বৃষ্টিতে তাদের পোশাক নষ্ট করতে চাইছিল না। ম্যানেজার মুখ বন্ধ করে হাঁটছিলেন। পরিবেশনকারীরা লবন আর গুঁড়ো মরিচের কৌটো পরিস্কার করছিল আর পাচকের সাথে রান্না নিয়ে কথা বলছিল। শুধুমাত্র এক দম্পতিকে মেয়েটি খাবার ঘরে আপ্যায়ন করছিল। ছাদে লাগানো স্পিকার থেকে তারের বাদ্যযন্ত্রে বাজানো সুর তাদের ভালো লাগছিল । রাস্তা থেকে ভেসে আসছিল হেমন্তের বৃষ্টি ভেজা গাঢ় গন্ধ।       
প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে ম্যানেজারের অসুস্থবোধ করা শুরু হয়েছিল। সে একটি চেয়ারে পেট চেপে গুলিবিদ্ধের মতো বসে পড়েছিল। তার কপালে ছিল পিচ্ছিল ঘাম। বিড়বিড় করে ম্যানেজার বলেছিল, ‘আমার বোধ হয় হাসপাতালে যাওয়া উচিৎ।’ অসুস্থ হওয়া তার জন্য ছিল একটি বিরল ঘটনা। গত দশ বছরে একদিনের জন্যও তার রেস্তোরাঁতে আসা বাদ যায়নি। তার কখনো অসুখ হয় না- এটা তার আরেকটি গর্বের বিষয় ছিল কিন্তু ব্যাথায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখভঙ্গি দেখে পরিষ্কার বোঝা হচ্ছিল যে তার অবস্থা আসলেই শোচনীয়।      
মেয়েটি রেস্তোরাঁ থেকে ছাতা মাথায় বের হয়ে ম্যানেজারের জন্য ট্যাক্সি ডেকেছিল। আরেকজন পরিবেশক  কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ম্যানেজারকে ধরে ট্যাক্সিতে উঠিয়েছিল। ভাড়া গাড়িতে ওঠার আগে ভাঙা গলায় ম্যানেজার মেয়েটিকে বলেছিল, ‘আমি চাই তুমি আজকে রাতের খাবার নিয়ে উপরে যাও- কক্ষ নম্বর ৬০৪। ঠিক আটটায়। তোমাকে যা করতে হবে তা হলো তুমি দরজার বেল বাজাবে আর বলবে, ‘আপনার রাতের খাবার এখানে’- তারপর খাবার রেখে চলে আসবে।’   
‘এটা ৬০৪ নাম্বার কক্ষ, তাই তো?’ 
‘রাত আটটার সময়’, ম্যানেজার আবারো বলেছিল, ‘ঠিক ঐ সময়ে।’ সে আবারো ব্যাথায় মুখ বিকৃত করেছিল। ম্যানেজার ট্যাক্সিতে উঠতেই ট্যক্সি তাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল।  
ম্যানেজার চলে যাবার পরও বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। অনেকক্ষণ পর পর দু’একজন করে ক্রেতা আসছিল। তাই ম্যানেজার এবং একজন পরিবেশনকারী না থাকলেও তেমন অসুবিধা হচ্ছিল না।  
মালিকের খাবার তৈরি হয়ে গেলে ঠিক আটটায় সে রুম-সার্ভিস ট্রলি ঠেলে ছয় তলার উদ্দেশ্যে লিফটে উঠেছিল। মালিকের খাবারে ছিল- আধ বোতল রেড ওয়াইন- বোতলের ছিপি হালকা করে লাগানো, গরম কফির পাত্র, মাঝখানে সেদ্ধ সবজি দেয়া মুরগির মাংস, রোল এবং মাখন। রান্না করা মাংসের সুস্বাদু গন্ধে ছোট লিফট ভরে গিয়েছিল। এর সাথে মিশে গিয়েছিল বৃষ্টির গন্ধ। ভেতর পানির ফোঁটা দেখে বোঝা যাচ্ছিল কিছুক্ষণ আগে কেউ ছাতা নিয়ে লিফটে উঠেছে।    
সে ট্রলি নিয়ে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। ৬০৪ নম্বর কক্ষের সামনে এসে মনে মনে নাম্বার মিলিয়ে গলা পরিস্কার করে দরজার বেল-এ চাপ দিয়েছিল।   
কোনো উত্তর আসছিল না। সে ঠিক বিশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ছিল। যখন সে দ্বিতীয়বারের মতো বেল এ চাপ দিতে যাবে তখনি ঘরের দরজা ভিতরের দিকে খুলে গিয়েছিল এবং দরজায় একজন ক্ষীণকায় বৃদ্ধকে দেখা গেল। বৃদ্ধ লোকটি মেয়েটির চেয়ে চার-পাঁচ ইঞ্চি খাটো ছিলেন। তাঁর পরনে ছিল গাঢ় রঙের স্যুট এবং টাই। সাদা শার্টের ওপর শুকনো পাতা রঙের বাদামি-হলুদ টাই সুন্দর ফুটে উঠেছিল। তাঁর নিখুঁতভাবে ইস্ত্রি করা পোশাক এবং পরিপাটি সাদা চুল দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন রাতে বাইরে কোনো সমাবেশে যাবেন। কপালে বয়সের গভীর বলিরেখা তাঁর ভুরুকে ভাঁজপূর্ণ করেছিল। সেই বলিরেখা দেখে মেয়েটির বিমান থেকে তোলা আলোকচিত্রের গিরিখাত মনে হচ্ছিল।  
‘আপনার রাতের খাবার, স্যার’, সে শুষ্ক গলায় বলেছিল। কিছুপরে তাঁর গলা স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। দুশ্চিন্তা করলে তার গলা শুকিয়ে আসত।  
‘রাতের খাবার?’
‘জ্বি, স্যার। ম্যানেজার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তাই আমাকে আজকে তার বদলে আসতে হল। আপনার খাবার, স্যার।’
‘বুঝেছি’, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলেছিলেন বৃদ্ধ, তাঁর হাত তখনো দরজার কড়ার ওপর স্থির হয়েছিল, ‘অসুস্থ, হ্যাঁ? তুমি বললে না।’
‘ম্যানেজারের পেটে প্রচণ্ড ব্যাথা হচ্ছিল। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে ভাবছে এটা এপেন্ডিসাইটিস হতে পারে।’ 
‘ওহ, এটা ভালো কিছু না’, কপালের বলিরেখার ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘এটা একদমই ভালো না।’
মেয়েটি আবার গলা পরিস্কার করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমি কি আপনার খাবার ভেতরে আনব, স্যার?’
‘আ- হ্যাঁ, অবশ্যি’- বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই, যদি তুমি চাও। আমার কোনো অসুবিধে নেই।’
‘আমি যদি চাই?’ মেয়েটি ভাবছিল- কি আজব অবস্থা। আমার কী চাওয়া উচিৎ? 
বৃদ্ধ লোকটি দরজার বাকিটুকু খুলে দিলে আর সে ট্রলির চাকা ভেতরের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ঘরটি ধূসর কার্পেটে ঢাকা। জুতো খুলে রাখবার আলাদা কোনো জায়গা নেই। প্রথম ঘরটি ছিল বেশ বড় একটি পড়ার ঘর- তাই ঘরটিকে বাসস্থানের চেয়ে বেশি কর্মস্থল মনে হচ্ছিল। জানালা যেন পাশের টোকিয়ো টাওয়ার পর্যবেক্ষণ করছিল। আলোতে টোকিয়ো টাওয়ারের  স্টিলের কাঠামো বোঝা যাচ্ছিল। জানালার পাশে ছিল একটি বড় পড়ার টেবিল। টেবিলের পাশে সোফা এবং দু’জনে বসার মতো একটি আসন ছিল। বৃদ্ধ লোকটি তাকে সোফার সামনে প্লাস্টিক আবরণ দেয়া কফি টেবিলের দিকে ইশারা করেছিলেন। সে টেবিলের ওপর  সাদা ন্যাপকিন, রূপার প্লেট-চামচ, কফির পাত্র এবং কাপ, ওয়াইন এবং ওয়াইনের গ্লাস, রুটি- মাখন, মুরগীর মাংস এবং সবজির থালা সাজিয়ে দিয়েছিল।     
‘আপনি অনুগ্রহ করে থালা বাটি হলঘরে রেখে দিলে আমি এক ঘণ্টা পর এসে নিয়ে যাব।’
মেয়েটির কথায় তাঁর খাবারের চিন্তা ছিন্ন হলো। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই, তুমি চাইলে এক ঘণ্টার মধ্যেই আমি খাবার শেষ করে সব কিছু ট্রলিতে করে হলঘরে রেখে দেব।’ 
‘হ্যাঁ, ঠিক এটাই আমি চাই’, মনে মনে বলেছিল সে। মুখে বলেছিল, ‘আমি আপনার জন্য কি আর কিছু করতে পারি, স্যার?’ 
‘না, আমি মনে করি না’, এক মুহূর্ত ভেবে তিনি উত্তর দিলেন। তাঁর পায়ের পালিশ করা জুতো জোড়া থেকে জেল্লা বের হচ্ছিল। সেগুলো ছিল ছোট এবং মার্জিত। বেশভূষায় তিনি খুব ফ্যাশান দুরস্ত, এমনটাই ভাবছিল মেয়েটি। বয়সের তুলনায় তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গিও বেশ ঋজু। 
‘ঠিক আছে, স্যার, তাহলে আমি কাজে ফিরে যাচ্ছি।’
‘না। একটু দাঁড়াও।’
‘স্যার?’
‘তুমি কি মনে করো যে আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিতে পারবে?’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।’
তিনি এত বিনীতভাবে অনুরোধ করেছিলেন যে মেয়েটি লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। ‘আমি… ঠিক আছে’, সে বলেছিল, ‘আমি বলতে চাইছি যদি শুধু পাঁচ মিনিটের ব্যাপার হয়ে থাকে।’ শত হলেও তিনি চাকরিদাতা। তিনি তাকে ঘণ্টা হিসেবে পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন। এখানে সময় দেয়ার বা নেয়ার প্রশ্ন ছিল না। বৃদ্ধ লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি মেয়েটির জন্য খারাপ হয় এমন কিছু করবেন না।
‘যাই হোক, তোমার বয়স কত?’ হাত দুটো ভাঁজ করে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি সরাসরি মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। 
‘আমার বয়স এখন বিশ বছর’, সে বলেছিল।
‘এখন বিশ বছর’, তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন, চোখ এমনভাবে সরু করলেন যেন ফাটলের ভেতর দিয়ে তিনি কোন কিছু দৃষ্টিগোচর করতে চাইছিলেন, ‘এখন বিশ, এখন মানে কখন?’
‘আমার ঠিক বিশ বছর বয়স হলো’, সে বলেছিল। তারপর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে আবার বলেছিল, ‘আজকে আমার জন্মদিন, স্যার।’
‘বুঝলাম’, তিনি চিবুক ঘষতে ঘষতে এমনভাবে বলেছিলেন যেন এই ব্যাখ্যাটি তাঁর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ‘আজকে, তাই না? আজকে তোমার বিশতম জন্মদিন।’
সে সম্মতি জানাতে মাথা নেড়েছিল। 
‘আজ থেকে ঠিক বিশ বছর আগে এই পৃথিবীতে তোমার যাত্রা শুরু হয়েছিল।’
‘জ্বি, স্যার’- সে বলেছিল, ‘তা-ই হয়েছিল।’
‘বুঝলাম, বুঝলাম’- তিনি বলেছিলেন, ‘এটা চমৎকার ব্যাপার। ভালো, তাহলে, শুভ জন্মদিন।’
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ’- সে বলেছিল এবং তাঁর মনে হয়েছিল সারা দিনে এই প্রথম তাকে কেউ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল। অবশ্যই তার বাবা মা ওইতা থেকে তাকে জন্মদিনের অভিবাদন জানিয়েছে, কাজ শেষ করে বাড়ি গেলেই এ্যন্সারিং মেশিনে সে অভিবাদন বার্তা পেয়ে যাবে। 
‘এটা উদযাপন করার মতোই একটা ব্যাপার’ তিনি বলেছিলেন, ‘একটা ছোট টোস্ট করলে কেমন হয়? আমরা রেড ওয়াইন পান করতে পারি।’   
বৃদ্ধ লোকটি চট করে বোতলের ছিপি খুলে তাঁর গ্লাসে মেয়েটির জন্য সামান্য ওয়াইন নিয়েছিলেন আর নিজের জন্য কাচের ক্যাবিনেট থেকে সাধারণ একটা গ্লাস বের করে তাতে ওয়াইন ঢেলেছিলেন।
‘শুভ জন্মদিন’- তিনি বললেন, ‘তোমার জীবন সমৃদ্ধ ও সার্থক হয়ে উঠুক এবং কোনো কিছু যেন সেখানে খারাপ প্রভাব না ফেলে।’  
তারা পরস্পরের পানপাত্রে মৃদু টোকা দিয়েছিল।
কোনো কিছু যেন সেখানে খারাপ প্রভাব না ফেলে, বৃদ্ধের এই কথাটি মনে মনে পুনরাবৃত্তি করে মেয়েটি নিজেকে শুনিয়েছিল। জন্মদিনের টোস্ট করতে গিয়ে বৃদ্ধ এই অপ্রচলিত কথাটি কেন বেছে নিয়েছিলেন?
‘বিশতম জন্মবার্ষিকী জীবনে শুধু একবারই আসে, প্রিয় তরুণী। এটি একটি অপূরণীয় দিন।’
সতর্কভাবে ওয়াইনে চুমুক দিয়ে সে বলেছিল, ‘জ্বি, স্যার, আমি জানি।’
‘এবং এখানে, তোমার বিশেষ দিনে, এক সদয় পরির মতোই আমার রাতের খাবার নিয়ে আসার ঝামেলায় তোমাকে পড়তে হয়েছে।’
‘শুধু আমার কর্তব্য করেছি, স্যার।’
‘তা সত্ত্বেও’, বৃদ্ধ মাথা দ্রুত নেড়েছিলেন কয়েকবার, ‘তা সত্ত্বেও, সুন্দর তরুণী।’ 
বৃদ্ধ ডেস্কের পাশে চামড়ার চেয়ারটিতে বসেছিলেন এবং ইশারায় মেয়েটিকে সোফায় বসতে বলেছিলেন। হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে সে সাবধানে সোফার কোণে বসেছিল। স্কার্ট টেনে হাঁটু দুটো এক সমানে রেখে মেয়েটি আবারো গলা পরিস্কার করেছিল। জানালার শার্শির কাচে বৃষ্টির পানির রেখা দেখতে পাচ্ছিল সে। তখন ঘরটি ছিল আশ্চর্যরকম নীরব।      
‘আজকে তোমার জন্মদিন এবং আজকেই তোমাকে আমার জন্য রাতের উপাদেয় উষ্ণ খাবার আনতে হলো’- বৃদ্ধ লোকটি এমনভাবে কথাটি বলেছিলেন যেন তিনি পুরো পরিস্থিতির ব্যাপারে আরো একবার নিশ্চিত হলেন। ডেস্কের ওপর সামান্য শব্দ করে তিনি গ্লাস রেখেছিলেন। ‘দুটি ব্যাপার যেন বিশেষ এক কেন্দ্রমুখী হচ্ছে, তুমিও কি তাই মনে করো?’    
যদিও মেয়েটি তা মনে করে না তবুও সে কোনো মতে হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গি করে মাথা নেড়েছিল।
‘সেজন্যই’- বৃদ্ধ শুকনো-পাতা-রঙা নেক টাই স্পর্শ করে বলেছিলেন, ‘তোমাকে জন্মদিনের উপহার দেয়া আমার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বলে আমি মনে করি।’     
ব্যস্ত হয়ে সে মাথা নেড়েছিল, ‘না, স্যার, অনুগ্রহ করে এমন কিছু ভাববেন না। আমি যা করেছি তা হলো আপনার জন্য আমাকে যেভাবে খাবার আনতে বলা হয়েছিল আমি শুধু সেটুকুই করেছি।’ 
বৃদ্ধ হাত দুটো এমনভাবে উঠিয়েছিলেন যে হাতের তালু মেয়েটির দিকে ফেরানো ছিল, ‘না, মেয়ে, তুমি বরং এটা নিয়ে ভাববে না। আমার মনে যে ‘উপহার’টি আছে সেটি কোনো নির্দিষ্ট কিছু নয়, এটাতে কোনো মূল্য লেখা নেই। এটা শুধু- তিনি ডেস্কের ওপর হাত রেখে দীর্ঘ ধীর একটি শ্বাস নিয়ে বলেছিলেন- ‘আমি তোমার মতো এক সুন্দর পরির জন্য যা করতে চাই সেটা হলো তোমার একটি ইচ্ছে পূরণ করা, তোমার ইচ্ছে কে সত্য করা, যে কোনো কিছু। এমন কিছু যা তুমি চাও- ধরে নিচ্ছি তোমার এমন একটি ইচ্ছে আছে।’
‘একটি ইচ্ছে?’ তার গলা শুকিয়ে আসছিল। 
‘এমনকিছু, যেটা তুমি চাও যে তা বাস্তবে হোক, মেয়ে, তেমন ইচ্ছে যদি তোমার থাকে- একটি ইচ্ছে- আমি সেটা সত্য করে দেব। এটাই সেই জন্মদিনের উপহার যা আমি তোমাকে দিতে পারি। কিন্তু তোমাকে এটার ব্যাপারে খুব সতর্ক হয়ে ভাবতে হবে কারণ আমি তোমার একটি ইচ্ছেই পূরণ করতে পারি।’
তিনি একটি আঙুল উঠালেন- ‘শুধুমাত্র একটি। এরপর তুমি আর মন বদলাতে পারবে না এবং ইচ্ছেটি ফিরিয়ে নিতে পারবে না।’  
সে কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। একটা ইচ্ছে? বাতাসের আঘাতে এলোমেলোভাবে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো জানালার শার্শিতে টোকা দিচ্ছিল। যতক্ষণ সে চুপ ছিল, বৃদ্ধ লোকটি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিছু বলছিলেন না। মেয়েটির কানে সময় তার অনিয়মিত হৃদ-স্পন্দন চিহ্নিত করে দিয়েছিল।  
‘আমার একটি ইচ্ছে আছে, সেটি কি পূরণ হবে?’
উত্তর দেবার পরিবর্তে তিনি শুধু হেসেছিলেন। তাঁর হাত দুটো তখনো ডেস্কের ওপর পাশাপাশি রাখা। তাঁর হাসিটি ছিল স্বভাবিক এবং অমায়িক। 
‘তোমার কি কিছু চাওয়ার আছে, মেয়ে, নাকি নেই?’ শান্তভাবে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন।   
*
‘সত্যি এমন হয়েছিল’- আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে সে বলেছিল, ‘আমি এটা বানিয়ে বলছি না।’ 
‘অবশ্যই নয়’- আমি বলেছিলাম। হঠাৎ করে আষাঢ়ে গল্প বলার মতো মানুষ সে ছিল না। ‘যাই হোক… আপনি কি কোনো ইচ্ছের কথা বলেছিলেন?’
মেয়েটি খানিকটা সময় আমার দিকে তাকিয়েছিল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। ‘আমি তাঁর কথাটা একেবারেই সত্যি বলে মনে করিনি’- সে বলেছিল, ‘আমি বলতে চাচ্ছি, বিশ বছর বয়সে আসলে কেউ আর রূপকথার জগতে বাস করে না। তিনি যদি এটা ঠাট্টাও করে থাকেন, সেই মুহূর্তে এমন একটা ঠাট্টা করার জন্য আমাকে তাঁর প্রশংসা করতেই হবে। তিনি একজন পরিপাটি বৃদ্ধ লোক যার চোখে বলিরেখা পড়ে গেছে তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তাঁর সাথে আমি একটু খেলব। সেটা আমার বিশতম জন্মদিন বলে কথা! আমি হিসেব করেছিলাম, সেই দিন আমার জন্য সাধারণ দিন ছিল না। সেক্ষেত্রে বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাসের কোনো ব্যাপার ছিল না।’   
আমি কিছু না বলে সম্মতিসূচক মাথা নেড়েছিলাম।  
‘আমি নিশ্চিত, আপনি বুঝতে পারছেন তখন আমার অনুভূতি কেমন ছিল। আমার বিশতম জন্মদিন কোনো বিশেষ কিছু ছাড়াই শেষ হয়ে যাচ্ছিল, কেউ আমাকে জন্মদিনের অভিবাদন পর্যন্ত জানায়নি, এবং আমি যা করছিলাম তা হলো মানুষের টেবিলে টেবিলে এনশৌভি সস দিয়ে টরটিলিনি নিয়ে যাওয়া।’  
আমি আবারো মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম। ‘চিন্তা করবেন না’- আমি বলেছিলাম, ‘আমি বুঝতে পারছি।’
‘সুতরাং আমি তাঁকে আমার একটি ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলাম।’  
*
বৃদ্ধ লোকটি এক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিল, কিছু বলছিল না। তাঁর হাত দুটো তখনো ডেস্কের ওপর রাখা। টেবিলের ওপর ভারি কিছু ফোল্ডার ছিল হতে পারে সেগুলো হিসাবের বই। আরো ছিল লেখার কাগজ, একটা ক্যালেন্ডার এবং সবুজ ঢাকনা দেয়া একটি ল্যাম্প। এসব কিছুর সাথে তাঁর ছোট হাত দুটিকেও ডেস্কের পর রাখা গৃহসজ্জার মতো দেখাচ্ছিল। তখনো বৃষ্টি জানালায় আঘাত করছিল। বৃষ্টির বিক্ষিপ্ত ফোঁটাগুলো চুইয়ে টোকিয়ো টাওয়ারের আলো আসছিল। 
বৃদ্ধ লোকটির কপালে বলিরেখায় গভীর ভাঁজ পড়েছিল, তুমি কি চাও?’
‘জ্বি’ মেয়েটি বলেছিল, ‘এটাই আমার ইচ্ছে।’ 
‘তোমার বয়সী মেয়ের পক্ষে এই রকম একটি ইচ্ছে কিছুটা অদ্ভুত’- তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অন্য কিছু আশা করেছিলাম।’ 
‘এটা যদি ভালো না হয়, আমি অন্যকিছু চাইতে পারি’- সে গলা পরিস্কার করে বলেছিল, ‘আমি কিছু মনে করব না, আমি অন্য যে কোন কিছুও চাইতে পারি।’  
‘না, না’, দু-হাত পতাকার মতো উড়িয়ে বৃদ্ধ লোকটি বলেছিলেন, ‘এই চাওয়ায় কোন অসুবিধা নেই, একে বারেই নেই। আমি শুধু একটু অবাক হয়েছি, মেয়ে। তোমার আর কিছুই চাইবার নেই? যেমন, তুমি আরো সুন্দরী, বুদ্ধিমান অথবা ধনী হতে চাইতে পারতে- এমন কিছু না চাওয়াও ঠিক আছে- মানে, সাধারণ মেয়েরা যা চাইতে পারত?’ 
মেয়েটি সঠিক শব্দগুলোর জন্য সময় নিয়েছিল। তিনি কিছু না বলে অপেক্ষা করছিলেন এবং তাঁর হাত দুটো এক সাথে আবারো ডেস্কের ওপর রাখলেন। 
‘অবশ্যই আমি সুন্দরী,  বুদ্ধিমান অথবা ধনী হতে চাই। কিন্তু এগুলো পেলে আমার কী হবে তা আমি ঠিক এখনই ভাবতে পারছি না। এগুলো আমার নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বেশিও হয়ে যেতে পারে। এখনো জীবন সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই। আমি জানিনা জীবন কিভাবে কেটে যায়।’ 
‘বুঝলাম’- বৃদ্ধ লোকটি হাতের আঙুলগুলো একসাথে জড়ো করছিলেন আবার বিচ্ছিন্ন করছিলেন, ‘বুঝেছি।’  
‘তাহলে আমার ইচ্ছেটা কি ঠিক আছে?’
‘অবশ্যই’, তিনি বলেছিলেন, ‘এটা আমার জন্য কোনো সমস্যাই নয়।’
বৃদ্ধ লোকটি হঠাৎ শূন্যে তাকিয়ে রইলেন, তাঁর কপালের ভাঁজ গাঢ় হয়ে উঠেছিল; ভাঁজগুলোকে মস্তিষ্কের রেখা মনে হচ্ছিল কারণ মস্তিস্ক তাঁর চিন্তাকে ঘনীভূত করছিল। মনে হচ্ছিল তিনি যেন কোনো কিছু দেখছেন- হতে পারে তিনি অদৃশ্য কোন নরম বস্তুর কণা দেখছিলেন- যা বাতাসে ভেসে নেমে আসছে। তিনি তাঁর বাহু দু-দিকে প্রসারিত করেছিলেন এবং চেয়ার থেকে সামান্য উঠে দুই হাতের তালুতে চাপড় দিয়েছিলেন। তারপর আবার চেয়ারে বসে খুব ধীরে আঙুলের সামনের অংশ তাঁর ভ্রুর ওপরের বলিরেখায় বুলিয়ে ছিলেন। মনে হচ্ছিল তিনি ভাঁজগুলোকে নরম করতে চাইছেন। তারপর তিনি শান্ত হাসিতে মেয়েটির দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন।         
‘এটা পূর্ণাঙ্গ হলো’- তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার ইচ্ছে মঞ্জুর করা হলো।’
‘এরই মধ্যে?’ 
‘হ্যাঁ, এটা কোনো সমস্যাই ছিল না। তোমার ইচ্ছে পূরণ করা হলো, মিষ্টি মেয়ে। শুভ জন্মদিন। এখন তুমি কাজে ফিরে যেতে পারো। চিন্তা করো না। আমি হলঘরে ট্রলি রেখে দেব।’।
সে লিফটে করে রেস্তোরাঁয় নেমে এলো। এখন তার হাত শূন্য, নিজেকে তার বিরক্তিকর রকম হালকা মনে হচ্ছিল যেন সে কোনো রহস্যময় নরম পালকের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। 
‘তুমি কি ঠিক আছো? তোমাকে দেখে কেমন আচ্ছন্ন মনে হচ্ছে’- অধিকতর কম বয়সী একজন ছেলে পরিবেশক তাকে বলেছিল।
মেয়েটি দ্ব্যর্থক হাসি হেসে ছেলেটির মাথা নেড়ে দিয়েছিল, ‘ওহ, তাই নাকি? না তো, আমি ঠিক আছি।’
‘তুমি আমাকে মালিক সম্পর্কে কিছু বলো’- ছেলেটি বলেছিল, ‘সে দেখতে কেমন?’
‘আমি জানি না, আমি এত খেয়াল করে তাকে দেখিনি’- সে দ্রুত কথা শেষ করেছিল।
এক ঘণ্টা পরে মেয়েটি ওপরে গিয়ে ট্রলি নিয়ে এলো। এটা বাসন-পেয়ালাসহ করিডোরে ছিল। মুরগীর মাংস আর সবজির প্লেট খালি হয়েছে কি না দেখার জন্য সে ঢাকনা খুলেছিল। ওয়াইনের বোতল এবং কফির পাত্র শূন্য। অভিব্যাক্তিহীন হয়ে ৬০৪ নম্বর কক্ষের বন্ধ দরজা দাঁড়িয়ে আছে। সে দরজাটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল, তার মনে হচ্ছিল এটা যে কোনো সময় খুলে যাবে- কিন্ত দরজাটি খুলেনি। সে লিফটে করে ট্রলি নামিয়ে এনে থালা-বাটি ধোয়ার মেশিনের দিকে ট্রলির চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে ছিল।  প্রধান রাঁধুনি ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে প্লেটের দিকে তাকিয়েছিল- প্লেটটি বরাবরের মতোই ফাঁকা ছিল।  
*
‘আমি আর কখনো কোনদিন মালিককে দেখিনি’- মেয়েটি বলেছিল, ‘একবারের জন্যও না। ম্যানেজারের স্বাভাবিক পেটে ব্যাথা হয়েছিল এবং পরদিন সে কাজে ফিরে নিজেই মালিকের খাবার নিয়ে গিয়েছিল। নববর্ষের পরই আমি কাজটা ছেড়ে দেই এবং আমি আর কখনো সেখানে যাইনি। আমি জানি না। আমার মনে হয়েছিল সেখানে না যাওয়াই ভালো- অনেকটা পূর্বাভাষ বলা যায়।’    
সে গরম প্লেট রাখার একটি কাগজের কোস্টার নিয়ে খেলছিল আর নিজের মনে কিছু ভাবছিল। ‘মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমার বিশতম জন্মদিনে যা কিছু ঘটেছিল তা সবই বিভ্রম। ব্যাপারটা এমন যে, কিছু হয়েছে সেটা আমাকে বোঝানোর জন্যিই এমন কিছু হয়েছিল যা আদৌ হয়নি। কিন্ত আমি নিশ্চিত জানি ব্যাপারটি ঘটেছিল। এখনো আমি ৬০৪ নম্বর কামরার প্রতিটি আসবাবপত্র এবং ছোট খাটো সবকিছু খুব স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি। সেখানে যা হয়েছিল, তা সত্যি আমার সাথে হয়েছিল, এবং আমার জন্য  অর্থবহও ছিল।’   
আমরা দুজন চুপ করে বসে পান করছিলাম আর যে যার ভাবনা ভাবছিলাম। 
‘আমি যদি আপনার কাছে একটি কথা জানতে চাই তাহলে কি আপনি কিছু মনে করবেন?’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আরো সঠিকভাবে বললে, দু’টি কথা।’ 
‘বলুন’- সে বলেছিল, ‘আমি ধারণা করতে পারছি, আমি সেদিন তাঁর কাছে কী চেয়েছিলাম আপনি সে ব্যাপারে জানতে চাইছেন। এটা প্রথম কথা যা আপনি জানতে চান।’ 
‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনি এ ব্যাপারে কিছু বলতে চান না।’ 
‘তাই মনে হচ্ছে?’
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম।
সে হাত থেকে কোস্টার নামিয়ে রেখেছিল এবং চোখ সরু করে ছিল যেন সে দূরের কিছু দেখছে। ‘জানেন, আপনি যে ইচ্ছে মনে পোষণ করেন সেটা কাউকে বলা ঠিক না।’
‘আমি আপনার কাছ থেকে এ ব্যাপারে কিছু টেনে বের করতে চাইছি না’-আমি বলেছিলাম, ‘আমি শুধু জানতে চাই আপনার ইচ্ছে পূরন হয়েছিল কি না? আর আপনার ইচ্ছেটা যাই হয়ে থাকুক সেটার জন্য পরে আপনি কি কোনো অনুতাপ করেছিলেন? আপনার কি কখনো দুঃখবোধ হয়েছিল যে কেন আপনি অন্যকিছু চাইলেন না?’  
‘প্রথম প্রশ্নের উত্তর একই সাথে হ্যাঁ এবং না। সম্ভবত, জীবন যাপনের জন্য আমার এখনো অনেক কিছুই বাকি পড়ে আছে। শেষ পর্যন্ত এগুলো কিভাবে কাজ করে আমি এখনো দেখিনি।’
‘তাহলে এটা এমন একটা ইচ্ছে ছিল যা পূরণ হতে সময় লাগে?’
‘তা আপনি বলতে পারেন। এখানে সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে।’
‘কোনো কিছু রান্না করতে যেমন সময় লাগে?’
মেয়েটি হ্যাঁসূচক মাথা নেড়েছিল।  
আমি কিছুক্ষণের জন্য সেই ইচ্ছেটির ব্যাপারে ভেবেছিলাম, কিন্তু আমি যা ভাবতে পেরেছিলাম তা হল একটি বিরাটাকৃতির পাই খুব কম তাপে চুলায় রান্না হচ্ছে।     
আর আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর?’
‘কী যেন ছিল প্রশ্নটি?’
‘আপনি যা চেয়েছিলেন তার জন্য কি কখনো অনুতাপ করেছিলেন?’
নৈশব্দের একটি মুহূর্ত কেটে গেল। সে খুব গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার ঠোঁটের কোণে শুষ্ক হাসির ছায়া দুলে গিয়েছিল, এ সবকিছুই নিরবে তার একটা হাল ছেড়ে দেয়া ভাব প্রকাশ করছিল।
‘আমি এখন বিবাহিত’, সে বলেছিল, ‘আমার চেয়ে বয়সে তিন বছরের বড় একজন সিপিএ এর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, আমার দুটো সন্তান আছে, একজন ছেলে আরেকজন মেয়ে। আমাদের একটি আইরিশ সেটার কুকুর আছে। আমি অডি চালাই, সাপ্তাহে দু-বার আমার বান্ধবীর সাথে টেনিস খেলি। এমন জীবনই আমি এখন যাপন করছি।’
‘শুনে ভালোই মনে হচ্ছে’-আমি বলেছিলাম।
‘যদি অডির বাম্পারে চাপ লেগে দুটো আঘাত থাকে তবুও?’
‘আরে, বাম্পার তৈরিই হয়েছে আঘাত সইবার জন্য।’
‘আপনার এই কথাটি কিন্তু বাম্পার স্টিকারে ব্যবহার করা যেতে পারে’ -সে বলেছিল, ‘আঘাতের জন্যই বাম্পার।’
সে যখন এটা বলছিল আমি তার মুখবিবর দেখছিলাম।
‘আমি আপনাকে যা বলার চেষ্টা করছি তা হলো-‘ -সে তার সুন্দর আকৃতির কানের লতি চুলকিয়ে খুব নরম স্বরে বলেছিল, ‘মানুষ যা কিছুই চেয়ে থাকুক না কেন, যত দূরই যাক না কেন, মানুষ আসলে যেমন, তেমনই, তার বাইরে কিছু নয়। আমার আর কিছু বলার নেই।’
‘এ কথাটিও আরেকটি ভালো বাম্পার স্টিকার হতে পারে’- আমি বলেছিলাম, ‘মানুষ যা কিছুই চেয়ে থাকুক না কেন, যত দূরই যাক না কেন, মানুষ আসলে যেমন, তেমনই, তার বাইরে কিছু নয়।’ 
সে উচ্চস্বরে হেসে উঠেছিল- সত্যিকার আনন্দের হাসি এবং তার মুখের ছায়া সরে গিয়েছিল।  
মেয়েটি বারের ওপর তার কনুই রেখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। ‘আমাকে বলুন তো’- সে বলেছিল, ‘আপনি যদি আমার জায়গায় থাকতেন তাহলে কী চাইতেন?’ 
‘মানে আপনি বলতে চাইছেন, আমার বিশতম জন্মদিনের রাতে?’
‘আ-হ্যাঁ।’
আমি এ ব্যাপারে কিছু সময় ধরে ভাবলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি কিছুও চাইবার মতো পেলাম না। 
‘আমি চাওয়ার মতো কিছু পাচ্ছি না’- আমি স্বীকার করেছিলাম, ‘আমি আমার বিশতম জন্মদিন থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি।’
‘আপনি কি সত্যি কিছু ভেবে পাচ্ছেন না?’
আমি মাথা সম্মতি জানিয়ে মাথা নেড়েছিলাম।
‘একটি কিছুও না?’
‘একটি কিছুও না।’
সে আবারো গভীরভাবে আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল- সরাসরি- এবং বলেছিল, ‘কারণ আপনি এরই মধ্যে আপনার ইচ্ছেটি চেয়ে ফেলেছেন।’
*
‘কিন্তু তোমাকে এটার ব্যাপারে খুব সতর্ক হয়ে ভাবতে হবে, আমার সুন্দর পরি, কারণ আমি তোমার শুধু একটি ইচ্ছেই পূরণ করতে পারি।’ অন্ধকারে কোথাও শুকনো-পাতা-রঙা টাই পরিহিত একজন বৃদ্ধ লোক একটি আঙুল ওঠান। ‘শুধুমাত্র একটি। এরপর তুমি আর মন বদলাতে পারবে না এবং ইচ্ছেটি ফিরিয়ে নিতে পারবে না।’  

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত